Shwagota Sayeed

Inspirational

4  

Shwagota Sayeed

Inspirational

"বংশের বাতি"

"বংশের বাতি"

17 mins
386


(দ্বিতীয় অংশ)

মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে এসবই ভাবছিলো আরশি। ভাবতে ভাবতেই আবার হারিয়ে গেলো অতীতে। বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার পরপরই আরশির উপর শাশুড়ির হুকুম জারি হয় যে ও যেহেতু বয়সে সেই হিসেবে কচি নয়, বাচ্চা নিয়ে নিতে হবে যতো দ্রুত সম্ভব। তা না হলে পরে সমস্যা হতে পারে। উনার বংশধর চাই। মাহতাব উনার একমাত্র ছেলে। ছেলের মা হিসেবে উনার যে একটা অহংকার কাজ করে সেটা দেখাতে উনি বিশেষ কার্পণ্য করতেন না। আর একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে বংশের বাতি দেখানোর দায়িত্ব বর্তালো আরশির উপর।

সেই কথা রাখতে গিয়েই হোক আর নিজের আগ্রহেই হোক, বিয়ের বছর ঘুরতেই মা হলো আরশি। কোলে এলো প্রথম সন্তান, মেয়ে সোহা। শ্বশুর নাতনীর মুখ দেখে চোখ বুজলেন। মেয়ের বাবা যথেষ্ট খুশি। পরিবারের নতুন ছোট্ট সদস্যকে নিয়ে সকলে মোটামুটি কাড়াকাড়ি করে খেলা চললো। ছেলে না হওয়াতে কিঞ্চিৎ অসন্তুষ্ট হলেও নাতনীর মুখ দেখে প্রথমবার দাদী হওয়ার আনন্দ লুকাতে পারলেন না আরশির শাশুড়িও।

তিন বছর পর এলো নুহা। এবার শাশুড়ির ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। সাথে মুখও ছুটলো। আরশি যে বিশেষ অবাক হলো তা নয়, ততোদিনে সে চিনে গেছে শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোকে। তবে এটা না ভেবে পারলো না যে আধুনিক শহরে থেকে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত মানুষগুলো চিন্তাভাবনা কতোখানি পেছানো। দিনের একটা বড় সময় কর্মস্থলে কাটাতে হতো, আর বাসায় ফিরলে দুই দুইটা কলিজার টুকরা, এই নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছিলো আরশির। শাশুড়ি কিছু বললে বেশির ভাগ সময়েই এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতো। যে বোঝার নয়, তাকে কিছু বোঝাতে যাওয়াটা বেকার। বোঝার হলে নিজেই বুঝতো। ওর নিজের মা’ই তার প্রমাণ। নিজের ব্যস্ত শিডিউলের মধ্যে এই মানসিক অশান্তি নেয়ার মতো অবকাশ ওর ছিলো না। কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে উঠলেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা ছাড়া আসলে ওর কোনও উপায়ই ছিলো না। সাহায্যকারী রেখেছিলো দুই জন। বাড়িতে এমনিতেও শাশুড়ি থাকেন, তাই বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা অতো বেশি ছিলো না। হাজার হোক, যতো যাই বলুন, নিজের নাতনী তো! কোনও ক্ষতি হতে নিশ্চয়ই দেবেন না, এই ভরসাটুকু ছিলো।

মাহতাব বরাবর এই সমস্ত পারিবারিক অশান্তি থেকে দূরে। মায়ের কথার বাইরে এক চুল সে যাবে না বা মায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করবে না সেটা আরশি বুঝে গিয়েছিলো ওর সাথে নতুন জীবন শুরু করার একদম প্রথম দিকেই। বিয়ের আগে সেভাবে ভালোবাসাটা না জন্মালেও বিয়ের পর মাহতাবকে ভালোবেসেছিলো নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে। কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। শুধু শুধু প্রত্যাশা বাড়িয়ে আর কষ্ট ডেকে আনে নি নিজের উপর। মাহতাবের দৌড় বোঝার পর থেকেই নিজের প্রয়োজন ও নিজেই সামলে নিয়েছে। খোলাখুলি বললে, ওকে সন্তান দেয়া ছাড়া ওর জীবনে মাহতাবের আর বিশেষ কোনও অবদান নেই। ও নিজেই এখন যখন অতিষ্ট বোধ করে তখন ভাবতে বসে, কি ভেবে ওর মতো মেয়ে আসলে মাহতাবকে বিয়ে করতে মত দিয়েছিলো। তখন তো আর প্রেম ছিলো না!

মূল সমস্যা শুরু হলো যখন ওর শাশুড়ি আরও একবার বাচ্চা নেয়ার জন্য চাপাচাপি শুরু করলেন। এমনিতেই নুহার সময়েই ওর প্রেগন্যান্সিতে যথেষ্ট জটিলতা ছিলো। এখন যখন সোহা প্রায় ৮ বছরে পড়েছে, নুহাও স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে, ওর নিজের চাকরিতে প্রোমোশনের সাথে সাথে দায়িত্ব বেড়েছে প্রচুর, বছরে দুই-চার বার বিদেশে ট্যুর থাকে, তখন ওর শাশুড়ির এই অন্যায় আবদার ওর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিলো। ও নিজে এখন মধ্য তিরিশে। প্রথমবারের ইস্যু হলে একটা কথা ছিলো, কিন্তু দুইবারের পরে এখন আবার প্রেগন্যান্সি ওর জন্য প্রাণঘাতি হতে পারে! এই সময় ওর শাশুড়ির নিত্য নৈমিত্তিক অশান্তি ওর জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠলো। কড়াভাবে এবার ও বলে দিলো, উনি যা চাইছেন সেটা সম্ভব নয়, অযথা ওকে এই নিয়ে বিরক্ত করা যেন উনি এবার বন্ধ করেন।

কিন্তু সমস্যা কমার বদলে বাড়লো, কারণ বেডরুমে একান্তে মাহতাব একটা ছেলের জন্য আবদার ধরলো। মা তো ঠিকই বলেন! বংশধর তো লাগবে, তাই না? ছেলে না হলে বংশ তো এখানেই শেষ! তখন? বংশের বাতি দেবে কে? মেয়েদের দিয়ে তো সেটা হবে না! শেষ বয়সে দেখবে কে? ফেটে পড়লো আরশি রাগে। কিন্তু সর্বনাশটা এড়াতে পারলো না। একরোখা, জেদী, বেপরোয়া মেয়েটার ইমেজ ভেঙে নিজেকে সংসারী ভালো বউয়ের ইমেজে সাজাতে চেয়েছিলো আরশি। আর সেটাই হলো কাল। প্রতিবাদ করলেও মেপে, সংসার রেখে করেছিলো। আর তারপরেই আরও একবার সন্তানসম্ভবা হলো ও। ঘটনাটা মাহতাবের ইচ্ছায় ঘটলো নাকি এ্যাক্সিডেন্ট, তা বলা তো মুশকিল, কিন্তু ঘটলো ঠিকই। সন্তানসম্ভবা হওয়ার বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার পরে আরশির তীব্র দৃষ্টির সামনে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো মাহতাব।

কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের হাসাহাসি, টিকা-টিপ্পনী কানে তোলার মতো দুর্বল আরশি নয়। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরক্তি দেখে বিরক্ত হয়েছে, কখনও কখনও মুখের উপর জবাবও দিয়ে এসেছে। প্রচন্ড শারীরিক কষ্ট সহ্য করে নিজের কাজ করে গেছে। এই রিস্কি প্রেগ্নন্যান্সি নিয়ে দুই মেয়ে সামলেছে। দুই জনেরই বয়স এখন অজস্র প্রশ্ন করার। পেটের ভেতর বেবীকে নিয়ে তাদের সেই সমস্ত কৌতূহল মিটিয়েছে। ওর জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়াতে পেয়েছে একজনকেই, ওর বড় বোন। নিজের মা’কে তো প্রেগন্যান্সির খবরটাও নিজে থেকে দেয় নি ও। ‘ঠিকই তো! উনাদের তো ইচ্ছা থাকতেই পারে একটা ছেলের! পর পর দুই বারই তোর মেয়ে হলো, আরেকবার চেষ্টা তো তোর আরও আগেই করা উচিৎ ছিলো! মা যখন বলে তখন ভালোর জন্যই বলে, বুঝলি? এই সমস্ত কারণেই আরও আগে অল্প বয়সে বিয়ের কথা বলছিলাম তোদের… আমার কথা তো শুনিস নাই… তোর বোন তো তাও বেঁচে গেছে, একটা মেয়ে হয়ে একটা ছেলেও হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ… এখন কি করবি! একটু তো সহ্য করতেই হয়! ছেলের মা হওয়া কি সহজ কথা? আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ কর যেন এবার ছেলেই হয়…’। এই লম্বা তিক্ত বক্তব্য নিজে থেকে খবর দিয়ে আগ বাড়িয়ে শুনতে যাওয়ার কোনও আগ্রহই হয় নি আরশির।

আরও একবার ফুঁসে উঠলো আরশি যখন বাচ্চার জেন্ডার জানতে বললো ওর শাশুড়ি। আরশি জানতো এর পরে কি আসবে, তাই সে কথা ওঠা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করে নি। এবারও মেয়ে হলে যে এ্যাবরশনের কথা আসবে, সেটা বুঝে আগেই যা বলার বলে দিয়েছে, ‘তোমাদের মতো বাচ্চা নিয়ে ব্যবসা করতে বসি নাই আমি… যে বাজারে পছন্দ হলে নিলাম… পছন্দ না হলে ফেরত দিয়ে দিলাম… বাচ্চা আমার… বাকি দুইটার মতো পালতেও হবে আমারেই… শুধু শুধু তোমরা মাথা ঘামায়ো না… আর এমনও তো না যে বাচ্চা পালার জন্য আমি তোমাদের কাছে হাত পেতে বসে আছি! ৩ টা কেন, আরও এক ডজন বাচ্চা পালার সামর্থ্য আমার আছে… সুতরাং, তোমাদের ভাতে টান পড়বে না আমার বাচ্চারে খাওয়াতে গিয়ে!...’ প্রেগন্যান্সির খবরের পর থেকেই আরশির যে মেজাজ দেখেছে মাহতাব, তাতে আর কথা বাড়াতে সাহস পায় নি। সংসারে অশান্তি এড়াতে তেমনভাবে জোর না খাটালেও, বা গলা না চড়ালেও, আরশির অতীত এবং এখনও ওর কর্মক্ষেত্রে ওর তেজী অবস্থান আর অন্যায়ের সাথে আপোষহীন আচরণ সম্পর্কে ধারণা আছে মাহতাবের। ওর মায়ের সাথে আরশি গলা তুলে কথা বলে না বা বেয়াদবি করে না মানে ও যে ঘাড় নিচু করে সব মেনে নেয়ার মতো মেয়ে নয়, তা মাহতাব জানে। তাই আরশির এই কথার পরে আর ঘাঁটায় নি ওকে। ঘাঁটায় নি আর ওর শাশুড়িও। ছেলের কাছ থেকে ওর বক্তব্য যে জেনেছেন, সেটা বুঝেছিলো আরশি। তবে উঠতে বসতে নিজের বিরক্তি লুকানোর কোনও চেষ্টাও তিনি করেন নি।

***

মূলত সিদ্ধান্তটা বাচ্চাটা পেটে আসার পরেই নিয়ে ফেলেছিলো আরশি। একে তো মেয়ে সন্তানের প্রতি এই পরিবারের এরকম বিরূপ মনোভাব, তায় মাহতাবের এই ধরণের ম্যানিপুলেশন, তার উপর ও খেয়াল করেছিলো, নুহার জন্মের পর নুহা তো বটেই, সোহার আদরযত্নেও ঘাটতি পড়ছে দিনে দিনে। বিশেষত যখন থেকে ও তৃতীয়বার বাচ্চা নিতে অস্বীকার করলো, তখন থেকে ওর উপর রাগটা যেন গিয়ে পড়লো ওর মেয়েদের উপর। যে বাবা বা দাদীর আদর-ভালবাসা শর্তনির্ভর হয় তার মেয়েদের প্রতি, তাদের সংস্পর্শে ওর মেয়েদের শৈশব-কৈশোর কেমন হবে তা বুঝে গিয়েছিলো আরশি। ওর নিজের শৈশব-কৈশোরের যে ট্রমা, যে মানসিক কষ্ট ও নিজে পার করে এসেছে, সেই একই ট্রমার মধ্য দিয়ে ওর মেয়েরা যাক, এটা কখনোই ও চাইবে না। সেটা ও হতে দেবেও না। ও নিজে সারাক্ষণ বাসায় থাকে না। ওর অনুপস্থিতিতে ওর মেয়েদের সাথে কি ব্যবহার করা হয় বা হতে পারে সে সম্পর্কে ওর একটা ধারণা হয়ে গেছে। এই পরিবেশ, এই ধরণের কথাবার্তা আর এরকম ব্যবহার পেয়ে বড় হলে এই নিষ্পাপ মনগুলো নষ্ট হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

ওর শাশুড়ি বাড়িতে কেউ আসলেই মেয়েদের সামনেই আক্ষেপ শুরু করেন তাঁর ছেলের ঘরে একটা ছেলে হলো না বলে। এমনকি মেয়েরা তাঁর কাছে গেলেও কখনও কখনও লোকের সামনেই ওদের দূরছাই করতে তাঁর আটকায় না। কিছু কিছু আরশি নিজের চোখে দেখেছে, আর কিছু কিছু জেনেছে ঘরের সাহায্যকারীদের কাছ থেকে। দাদীর মুখ থেকে ওদের বাবার কোনও ছেলে নেই বলে আফসোস শুনে এসে সোহা-নুহা এসে ওদের মা’কে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেলে হলে কি হয় মা?’, ‘আমরা কেন ছেলে হলাম না, মা?’, ‘আমরা কি ভালো না, মা?’, ‘বাবা তো ছেলে… তাহলে কি বাবাই শুধু ভালো? কিন্তু তুমিও তো কত্তো ভালো, মা! তাহলে তুমি কি ছেলে?’, ‘বংশের বাতি কি মা?’ শিশুমন যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে ছেলে হওয়ার মাহাত্ম্য আর গুরুত্ব। আর কলিজা কষ্টে ফেটে যায় আরশির। সোহা এখন বুঝতে শিখছে, দাদীর বা পাড়াপড়শি, আত্মীয়দের এধরণের কথায় ওর চোখে এখন কষ্ট ফুটে ওঠে, দেখেছে আরশি।

ওর বড় হওয়ার সময় ওর বাবা ছিলেন ঢাল হয়ে। তারপরেও মায়ের কটূ কথা, অবহেলা, ভাইয়ের সাথে ভেদাভেদ তীব্রভাবে এঁটে বসতো ওর মনের উপর, মাথার উপর। এখন পর্যন্ত কষ্ট পায় সেসব কথা মনে পড়লে। সেই কষ্টগুলোকে উৎরে যেতেই ও যেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতো পড়ালেখাকে। তার ফলও সে পেয়েছে। শিক্ষাজীবন এবং ক্যারিয়ার, দু’টোতেই ও আজ সফল। কিন্তু জেনেশুনে ওর মেয়েদের ও সেই একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারবে না। ও যেভাবে ডিল করেছে, বা করতে পেরেছে, ওর মেয়েরাও যে সেভাবেই সেটা পারবে, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই! নিজের ভেতরেই নিজে নিজেকে ছোট মনে করে, দোষী মনে করে দিনের পর দিন পার করা যে কি কঠিন, সেটা ওর থেকে ভালো কে জানে? মা হয়ে মেয়েদের সেই জীবন সে দেবে না কিছুতেই, বিশেষত ওর হাতে যখন সুযোগ এবং সামর্থ্য দু’টোই আছে।

রাহা পেটে থাকতেই তাই আরশি ওর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলো। বাসা ভাড়ার চেষ্টায় না গিয়ে নিজের সামর্থ্যের মধ্যে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলো। বাবার সম্পত্তি, জমিজমা বাবা মারা যাওয়ার আগে যখন অসুস্থ ছিলেন, তখনই ভাগাভাগির সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। তাই ওর অংশ বুঝে পেতে ওর কোনও সমস্যা হয় নি। ওর মায়ের তীব্র আপত্তির মুখেও ওর মায়ের অংশ বাদে বাকি ৩ ভাইবোনের জন্য সম্পত্তি সমান ৩ ভাগ করে গিয়েছিলেন ওর বাবা উইল করে। সেখান থেকে কিছু বিক্রি করে, আর চাকরির শুরুর দিকে করা একটা ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিওর হওয়াতে সেটা ভেঙে ফ্ল্যাট বুকিং দেয়ার মতো টাকার জোগাড় ওর হয়ে গিয়েছিলো। এরপরে চলবে কিস্তি। ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে সম্পূর্ণ সাহায্য করেছে ওর বড় বোন আর দুলাভাই। ওরা দু’জন আসবে আজকে ও যখন রওনা দেবে, তখন। ওর বোন তো বটেই, বোনের স্বামীও নেহায়েৎ নির্বিরোধী একজন মানুষ। ইচ্ছে করেই আজকের এই ফ্যামিলি ড্রামায় ওরা আসে নি, আর আরশিও আসতে বলে নি। একবারে যখন বেরুবে তখন বাসার নিচে ওদের সাথে মিট করবে, বলে দিয়েছে।

নতুন ফ্ল্যাট গোছানো, ফার্নিচার, সব কিছুরই মোটামুটি একটা ব্যবস্থা ও করে ফেলেছিলো রাহার জন্মের আগেই। রাহার জন্মের পর একটু সুস্থ হয়েই ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ার। আর সব প্রায় তৈরি হয়ে গেলে তারপর জানিয়েছে মাহতাবকে।

মাহতাবকে জানানোর পরে ওর চোখেমুখে যে কষ্টটা ফুটে উঠতে দেখেছে, সেটা মিথ্যা নয় ও জানে। কিন্তু একই সাথে যে স্বস্তিটা দেখেছে, সেটাও অস্বীকার করার মতো নয়। মনে মনে হেসেছে ও। মাহতাব মিন মিন করে দু’একবার বলার চেষ্টা করেছে যেন আরশি না যায়, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার পরে আরশি আর কোনও দীর্ঘ আলোচনাতে যাওয়ার আগ্রহই বোধ করে নি। ওর হিসাবটাও খুব সহজ, স্বামী হিসেবে মাহতাব যদি তার স্ত্রীকে আটকাতেই চাইতো, তার বাচ্চার মা’কে ধরে রাখার সেই রকম তাগিদ যদি তার ভেতর থেকে থাকতো, তাহলে সেটা তার আচরণেই বোঝা যেতো। মেয়েদের মাহতাব মিস করবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু একটা ছেলে সন্তানের ইচ্ছাটা অগ্রাহ্য করার মতো শক্ত বা উদার সে না। তার উপর মায়ের কথাই তার কাছে শেষ কথা, রেহনুমা যদি বলতেন যে, ‘ছেলে লাগবে না, মেয়ে-বউ নিয়ে তুই এখানেই সংসার কর’, তাহলে হয়তো মাহতাবের জন্য সুবিধা হতো। কিন্তু রেহনুমা শুরু থেকেই আরশিকে পছন্দ করেন না, আরশি যদি নিজে থেকে সরে যায়, তাহলে রেহনুমাও খুশি হবেন, আর মাহতাবও ঘরের এই সার্বক্ষণিক টেনশনের হাত থেকে বাঁচবে।

***

গোছগাছ শেষ করে একটু বসলো আরশি। মাহতাব মুখ কালো করে একবার শোবার ঘর আরেকবার বাইরের ঘরে যাচ্ছে আর আসছে। ওর দিকে এক বিন্দু পাত্তা দিতে ইচ্ছাও করছে না আরশির, দিচ্ছেও না। মাহতাব কি চায়, এমনকি সেটা জানতেও ইচ্ছে করছে না। মেয়ে দু’টোও বুঝে গেছে কিভাবে যেন যে আজকে ঘরের আবহাওয়া ঠিক নেই। মা যেভাবে তৈরি করে দিলো কোনও রকম দুষ্টুমি না করে চুপচাপ তৈরি হয়ে নিলো ওরা। ওরা জানে মা ওদের নিয়ে কোথাও যাচ্ছে, কিন্তু কেন, কোথায় বা কতদিনের জন্য সেসব কিছু এখনও জানে না। প্রশ্নগুলো মনে আসার জন্য নুহা এখনও ছোট, কিন্তু সোহার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে কথাগুলো। তবে মা ওদের ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়েছে, আর শিখিয়েছে মা’র উপর আস্থা রাখতে। ছোট্ট দু’টো মাথাই জানে যে মা ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দেবে, সব সময়ই দেয়। আসলেও আরশি যথাসাধ্য চেষ্টা করে বাচ্চাদের বোঝার মতো উপযোগী ভাষায় ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। ওদের কৌতূহলের উত্তরে কখনোই ওদেরকে ধমকে বা ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর পথে যায় না ও, মিথ্যা বা বানোয়াট কোনও ব্যাখ্যা তো কখনোই দেয় না। তবে ওদের বলা আছে যে মা ব্যস্ত থাকলে তখন উত্তর দিতে না পারলেও সময় করে অবশ্যই বুঝিয়ে বলবে, ওরা যেন ততোক্ষণ অপেক্ষা করে। ওদের এটা এখন অভ্যাসই হয়ে গেছে। আজকেও তাই মায়ের হাতের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে ওরা।

সোহা তো বটেই, ছোট্ট নুহাও খেয়াল করেছে যে ওদের ছোট্ট বুনুটা মায়ের পেট থেকে বের হয়ে বাড়িতে আসার পর থেকেই ওদের দাদী ওদের আর ওদের মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করছেন। এমনকি ওদের বাবাও আর এখন ওদের সাথে খেলে না, গল্প করে না, কাছে গেলেই কেমন ধমক দিয়ে কথা বলে, একটুও আদর করে না, চকলেট দেয় না, ঘুরতে নিয়ে যায় না। শুধু ওদের মা’ই ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করে আর শিউলি আন্টি, ওদের আয়া যে, সে খুব আদর করে। ওদের মা যখন বুনু এক্টু বড় হওয়ার পর থেকে আবার অফিসে যাওয়া শুরু করলো, তখন দাদীর বকা থেকে শিউলি আন্টিই ওদের আগলে রাখে। আরেকজন যিনি আছেন, আছমা নানু, সেও যেন ইদানীং কেমন ওদের দূর দূর করে, আগে এরকম ছিলো না, কিন্তু এখন সেও ওদের আগের চাইতে কম ভালবাসে।

কয়েকদিন আগে তাই যখন ওদের মা বললো ওদের যে এখন থেকে ওরা আরেকটা বাসায় গিয়ে থাকবে, তখন সোহা খুব অবাক হয় নি, বরং কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। নুহার অনেক প্রশ্ন, কিন্তু নুহাকে একেবারে বড় একটা বোনের মতোই সামলে নিয়েছে সোহা।

সব গোছগাছ শেষ করতে করতে বহু সময় লেগে গেছে। বুকিং করা পিক আপ আসার কথা ছিলো দুপুরে, লাঞ্চ টাইমের পর পর। কিন্তু দুই বার ফোন করে তাদের সময় পেছাতে বলতে হয়েছে। অর্ধেক দিনের বদলে পুরো দিনের ভাড়া দিতেও রাজী না হয়ে উপায় ছিলো না আরশির। কিন্তু এতো দিনের জমানো জিনিস, আর সব চাইতে বড় কথা, ছোট ছোট তিনটে বাচ্চার কাপড়চোপড়, খেলনা আরও নিত্য প্রয়োজনীয় হাজার হাজার জিনিস সব গুছিয়ে নেয়া কি সোজা কথা? সেই ফাঁকে ছোট্ট রাহাকে খাওয়ানো সময়ে সময়ে, বাকি দুই জনের খাবার তো তাও তৈরি করে দিয়েছে শিউলি, কিন্তু মেয়েরা বায়না ধরেছে মা খাওয়াবে তাদের। একে তো সব দিন মা’কে কাছে পায় না, তার উপর আজকে বাসার পরিস্থিতি ওদের মনের উপর যথেষ্ট চাপ ফেলছে। মায়ের সাথে লেপ্টে থাকতে চাইছে ওরা নিজেদের অজান্তেই। তাতে যে মায়ের কাজ পেছাচ্ছে, সেটা বোঝার বয়স ওদের না। আর আরশিও ওদের আজকে অন্তত বকা দিতে পারছে না ঘ্যান ঘ্যান করার জন্য, ওদের জন্য আজকের দিনটা যেমন কঠিন, সামনের দিন, সপ্তাহ, মাস, এমনকি বহু বছর পর্যন্ত দিনগুলো একই রকমের কঠিন হতে চলেছে। এর জন্য দায়ী তো ওরা নয়, কিন্তু ভুগতে হবে ওদেরকেই। কিভাবে এখন ওদের বকা দেয় আরশি? নিজের বিরক্তি, ক্লান্তি সব গিলে ফেলে তাই ওদের আবদার মেনে নিয়েছে।

কাজ মোটামুটি সব গুছিয়ে নিয়ে বসলো আরশি। বড়ো করে শ্বাস নিলো একবার। তারপর নরমভাবে ডাকলো সোহা আর নুহাকে নিজের কাছে। দু’জন এসে মায়ের সামনে দাঁড়ালো। চুপ করে অপেক্ষা করছে মা কি বলে তা শোনার। এই কথাগুলো বলাটাই সব চাইতে কঠিন, আর সেই কঠিন কাজটাই করতে হবে এখন আরশিকে। ও জানে বাসার আরও কয়েক জোড়া কান উৎকর্ণ হয়ে আছে ও কি বলে তা শোনার জন্য। বিরক্তি লাগলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে শুরু করলো ও, “শোনো বাবা, এখন থেকে তোমরা, রাহা মণি আর মা, আমরা এই কয়জন আলাদা একটা বাসায় থাকবো, বুঝেছো? শিউলি আন্টিও আমাদের সাথেই থাকবে, কিন্তু বাবা আর দাদীআপু এই বাসাতেই থাকবে, কেমন?”

নুহা ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললো, “মাম্মাম! আমরা আর কোনও দিইইন আসবো না?”

আরশি ধৈর্য্য নিয়েই বসেছে, উত্তর দিলো, “আসবে বাবা! এই বাসায় তোমরা বেড়ু করতে আসবে… দাদীআপুকে দেখতে আসবে… বাবার সাথে দেখা করতে আসবে… কিন্তু আমরা থাকবো এখন থেকে আলাদা বাসায়, কেমন? আমাদের নিজেদের একটা বাসায়…”

সোহা পূর্ণ মনোযোগ নিয়ে মা’র কথা শুনছে, নুহার প্রশ্ন, “কেন মাম্মাম? দাদীআপু আমাদের আদর করে না তাই?”

দীর্ঘশ্বাস পড়লো আরশির। যতোই গুছিয়ে নিয়ে বসুক উত্তর, কথাগুলো বলাটা খুব কঠিন। ধীরস্বরে বলা শুরু করলো, “শোনো মাম্মাম… তোমাদের দাদীআপু আর বাবা মেয়ে বাবু পছন্দ করে না… উনারা ছেলে বাবু চেয়েছিলেন, এই যখন তোমরা দুইজন, তারপরে রাহা মণি আমার পেটের ভিতর ছিলে, তখনও চেয়েছিলেন যেন তোমরা ছেলে বাবু হও… কিন্তু তোমরা তো মেয়ে! তাই উনারা খুশি হন নি… এখন তোমাদের তো আমি বলেছি যে বাবু দেন আল্লাহ্‌, তাই না? আর আল্লাহ্‌ই নিজের ইচ্ছায় তোমাদের দু’জনকে আর রাহা বাবুকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন… কিন্তু তোমাদের দাদীআপু তোমাদেরও পছন্দ করেন না, আর আমি তোমাদের আল্লাহ-এর কাছ থেকে এনেছি বলে আমাকেও পছন্দ করেন না… মা তোমাদের শিখিয়েছি না? কক্ষনোও অন্যের কাছে কিছু চাইবে না? মা ছাড়া? তাহলে এখন বলো তো! দাদীআপু আর বাবা যদি তোমাদের ভালো না বাসে, মা’কে ভালো না বাসে, তাহলে কি আমরা জোর করে ওদের থেকে চাইবো?”

দুই মেয়ে একসাথে মাথা নাড়লো এদিক ওদিক, চাইবে না জোর করে। কিন্তু সোহা এবার প্রশ্ন করলো, “মাম্মাম! তুমি না বললে আল্লাহ্‌ বাবু দেন! তাহলে দাদীআপু কেন আমাদের বকেন? আমরা তো কোনও দুষ্টু করি নি! আমাদের তো আল্লাহ্‌ দিয়েছেন তোমাদের কাছে, তাই না?”

শিশুর সরল মাথা যা বুঝে নেয় অতি সহজে, বয়স্ক এবং কুটিলতায় ভর্তি মাথা সেই সরল যুক্তির ব্যাখ্যা বুঝতে চায় না কোনও মতেই। সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে আরশি বললো, “এই তো তুমি বুঝেছো মা! তোমাদের কোনও দোষ নেই এখানে… এই জন্যই আমরা অন্য বাসায় চলে যাচ্ছি বাবা! যাতে তোমাদের আর তোমাদের মাম্মামকে দাদী আর বকতে না পারেন। আমি তোমাদের বলেছি না? দুষ্টু করলে অবশ্যই বকা দেবো, কিন্তু তোমরা তো কোনও দুষ্টু করো নি! তাহলে তো তোমাদের বকা খাওয়াটা উচিৎ না, তাই না?”

একটু থেমে আবার বললো আরশি, “এখন তোমাদের মাম্মামের তিইন টা বেবী আছে তাই না? মাম্মামের তো আর বেবী হবে না! আর তোমার বাবা আর দাদীআপুর ছেলে বাবু লাগবে, বুঝেছো? তাই তোমার বাবা আরেকটা মাম্মাম নিয়ে আসবে… তাই আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি… যাতে তোমাদের বাবা নতুন মাম্মামের সাথে থাকতে পারে…”।

কথাগুলো বলতে গিয়ে আরশির মনে হয় হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানির চোটে দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। সহজ করে এই নির্মম সত্যগুলো নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানদের বুঝিয়ে বলাটা কতোটা কঠিন, সেটা যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে নি, তার পক্ষে বোঝা সম্ভব না। এই সময় মাহতাবের কণ্ঠ শোনা গেলো, “আরশি, বাচ্চাদের এগুলো কি বলছো তুমি? আমি কি কখনও বলেছি আমি আরেকটা বিয়ে করবো? এই বাসা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও তোমারই… আমি তোমাকে কখনোই বলি নি যে আলাদা হয়ে যাও, বরং এখনও বলছি, আরেকবার ভেবে দেখো… মেয়েদের ভবিষ্যতের কথাটা একবার ভাবো!...”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আরশি, ভঙ্গীতে কোনও আড়ষ্ঠতা নেই। সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া মায়ের শরীরে জমা সামান্য মেদটুকু ছাড়া ঋজু দেহ, সুঠাম অবয়ব, উন্নত চিবুক। ও পেয়েছে ওর বাবার শরীরের ধাত। সহজে মেদ লাগে না গায়ে। এই কারণে দুইটা মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও মুটিয়ে বেঢপ হয়ে যায় নি ও। খাবারের ব্যাপারে ও বরাবরই সচেতন, আর সেই সাথে শরীরচর্চা। সোহা-নুহার জন্মের পর এই দুই মিলিয়ে নিজেকে আবার ঠিকঠাক করে নিতে খুব বেশি সময় লাগে নি ওর। কিন্তু রাহা সিজারিয়ান হওয়াতে ওকে এখনও সতর্ক থাকতে হচ্ছে অনেক বেশি। তারপরেও, জেনেটিক কারণেই হয়তো অতো বেশি মোটা সে হয় নি।

ধীর গলায় উত্তর দিলো আরশি, “সেটাই তো ভাবছি, মাহতাব! মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি! রোজ রোজ মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য আমার মেয়েরা কথা শুনতে শুনতে বড় হবে, সেটা আমি অন্তত মা হয়ে কিছুতেই সহ্য করবো না… ওরা মন ছোট করে বড় হবে, নিজেকে তুচ্ছ ভাববে, অনাকাঙ্খিত ভাববে, আর সম্পূর্ণ অযথা নিজের আশেপাশের লোকের অপমানকর কথা শুনবে, সেটা বাবা হয়ে তোমার হজম হলেও, আমার হবে না… আর রইলো তোমার কথা, তুমি নিজের মুখে কখনও বলো নি তো কিছুই… কোনদিনই… কিন্তু মা যখন বলে গেছেন… এইমাত্রও যখন বললেন, তার কোনও প্রতিবাদও তো করো নি! আমার কথা তো বাদ… নিজের মেয়েদের হয়েও কি কোনদিন মুখ খুলেছো তুমি? একবারের জন্যও?... আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার ছিলো বলছো… তা সিদ্ধান্তটা আমি যখন তোমাকে জানিয়েছি, তখনও কি কিছু বলেছিলে? কি বুঝবো আমি তোমার এই চুপ করে থাকা থেকে? … মা যখন বলছেন তোমার আবার বিয়ে দেবেন, তখনও তুমি চুপ… আমার মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন, যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে যাচ্ছেন, তখনও তুমি চুপ… আমি যখন বলছি আমি বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাবো, তখনও তুমি চুপ… আমি তাহলে কি বুঝবো এর থেকে?”

শান্ত গলায় কথাগুলো বললেও ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগ-ক্ষোভ চেপে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে আরশি। বড়ো পোস্টে চাকরি করে সে, দেশী-বিদেশী, ধনী-গরীব, সরকারি আমলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সব ধরণের মানুষের সাথে ওঠাবসা তার, আবেগ, উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানতে হয় সেখানে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আর ছেড়ে নিজেকে আবার শান্ত করে আনলো আরশি, মাহতাব এখনও চুপ, অবশ্য আরশির এই কথার উত্তরে কিছু বলার মতো নেইও তার। আরশি আবার বললো, “বিয়ের আগে থেকেই তুমি জানো মাহতাব পড়ে পড়ে বিনা কারণে কারও করা অপমান হজম করার মতো মানুষ আমি না, এবং আমার মেয়েদেরও আমি সেটা হতে দেবো না… আর তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি আমার বাচ্চাদের কাছে মিথ্যা বলি না… সত্যটাই সবসময় বলি, এবং সত্যটা জানার অধিকারও ওদের আছে… কোনও ফ্যান্টাসীর জগতে…”।

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাশের ডাইনিং রুম থেকে তীক্ষ্ম কণ্ঠের ব্যাঙ্গ শোনা গেলো, “ইইইইইইহ!... আসছেন আমার সত্যবাদী মানুষ রে!... বাপ-দাদীর নামে বিষ ভরতেসে মেয়েগুলার কানে উনি আবার মানসম্মানের আলাপ তোলেন!... সম্মান রাখার জায়গা পাইতেসেন না উনি!... স্বামী ছেড়ে দেয়া মেয়েমানুষের আবার সম্মান কি রে? আজকের পর এই বাড়ির বাইরে পা রাখলে কালকে তোরে কে সম্মান দেয় দেখবো নে আমি!... নিজে তো রাস্তায় দাঁড়াইতেসেই… মেয়েগুলারেও রাস্তায় নামাইতেসে কত্তোবড় শয়তান মেয়েমানুষ!... বাপের পরিচয় না থাকলে মেয়েদের দাম থাকবে? স্কুল-কলেজে দিতেও বাপের নাম লাগে, মনে রাখিস!... আসছে সম্মান দেখাইতে!... “।

এতোক্ষণে মনে হয় মাহতাবের মনে হলো যে ওর মা যেটা করছেন সেটা ঠিক না। ওর মেয়েদের জন্মপরিচয় নিয়ে এতো নোংরা কথা যে ওর মা বলবেন, এটা বোধহয় সেও ভাবে নি। ওরা দু’জন আলাদা হয়ে গেলেও তাতে ওর মেয়েরা তো আর পিতৃপরিচয়হীন হয়ে যাচ্ছে না! গলার স্বর সামান্য উঁচু হলো ওর, “আহ! আম্মা!... কি সব বলতেসো উলটাপালটা! মাথামুথা খারাপ হয়ে গেসে নাকি তোমার!”

আরশিও ভাবে নি সরাসরি গালি দিয়ে বসবেন মহিলা। এতো দূর পর্যন্ত আগে কখনও যান নি তিনি। মাহতাবের কথার উত্তরে গলার স্বর আরও কয়েক গ্রাম উপরে তুলে শাপ-শাপান্ত শুরু করেছেন ততোক্ষণে তিনি। পাড়াপড়শি কারও জানতে বাকি নেই যে কি ঘটছে এই বাড়িতে। আরশির দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো মাহতাব। শীতল রাগ যেন শরীর ফুঁড়ে বেরোচ্ছে ওর। ওর পাশ থেকেই অনুভব করা যাচ্ছে সেটা। মেয়েদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো আরশি। তারপর দৃঢ়, শান্ত পায়ে এগুলো ওর শাশুড়ির আওয়াজ লক্ষ্য করে। ওকে থামাতে গিয়েও সেই সাহস জোটাতে পারলো না মাহতাব। রওনা হলো ও নিজেও আরশির পিছু পিছু। ওর পেছনে চললো শিউলিও, একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে প্রচন্ড উত্তেজনা কাজ করছে ওর এখন ওই ঘরে কি নাটকের অবতারনা হয় তা দেখার জন্য।

***

(চলবে)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational