STORYMIRROR

Shwagota Sayeed

Drama Inspirational

3  

Shwagota Sayeed

Drama Inspirational

"বংশের বাতি"

"বংশের বাতি"

17 mins
242

(প্রথম অংশ)

১০ বছরের সংসার ফেলে আজ আরশি নিজের আলাদা পথ খুঁজে নিচ্ছে। বা বলা যায় নিজের পথ খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ১০ বছরের সংসার, আর তিন তিনটি সন্তান। এর মধ্যে সংসারটা ফেলে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু সন্তান নয়। ওদের সাথে করেই নিয়ে যাচ্ছে আরশি। বড়জনের বয়স ৯ এর কাছাকাছি, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি যথাক্রমে ৬ বছর এবং ৫ মাস।

সকাল থেকে নিজের লাগেজ গোছানো আর বাচ্চাদের তৈরি করার প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেই ক্রমাগত কানে আঘাত হানছে ওর শ্বাশুড়ির কটু বাক্য বর্ষণ। ও অপেক্ষা করছে। হাতের কাজ শেষ হোক। আজকে ও মনে মনে প্রস্তুত। জবাব ও দেবে। ১০ বছর ধরে শুনে আসছে অযৌক্তিক সমস্ত দোষারোপ। ১০ বছর ধরে সহ্য করে আসছে অহেতুক সব অপমান। আর জীবনভর বয়ে আসছে এই অন্যায়ের ভার, যার দায় কোনক্রমেই ওর নয়। আর না।

***

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আরশি ছিলো বন্ধুদের মধ্যে সব চাইতে উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, এবং সেই সাথে প্রতিবাদী আর স্বাধীনচেতা। ওর সরাসরি কথা বলা এবং দ্বিধাহীনভাবে অন্যায়কে অন্যায় আর সত্যকে সত্য বলে ফেলার অভ্যাসটাকে ভয় পেতো অনেকেই। হয়তো এটাও একটা কারণ যেজন্য ওর ছাত্রজীবনে সেভাবে কখনও প্রেম আসে নি। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করলো, তারপর যোগ দিলো নামী এক এনজিও তে। সেখান থেকে শুরু করে প্রায় ১৩ বছরের বেশি সময়ে আজ সেই একই প্রতিষ্ঠানে ও বেশ ভালো পদেই আসীন। পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমতী হওয়ার সুবাদে, কর্মক্ষেত্রের সাফল্যগুলো ধরা দিয়েছে ওর কাছে একে একে।

সাহসী এই মেয়ে যে বিয়ের পর এভাবে এতোদিন শ্বশুরবাড়ির দুর্ব্যবহার আর অন্যায় সহ্য করে আসছে, এটা ওর পরিচতদের কাছে একটা বিস্ময়। অবশ্য যারা জানে, তাদের জন্য। যারা বরাবরই ওকে অপছন্দ করে এসেছে, তাদের কাছে অবশ্য বিষয়টা ব্যাঙ্গ এবং তাচ্ছিল্যের, ‘ছাত্রজীবনের ফুটানি এখন কই গেলো? বিয়ের পর সব ঠান্ডা হয়ে গেছে না? কেমন লাগে, দ্যাখ!’ এমন না যে আরশি জনে জনে ওর সমস্যার কথা বলে বেড়ায়, কিন্তু এটা ঠিক বিয়ের পর অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে ও, উচ্ছ্বলতাটা যেন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যেটা সবারই চোখে পড়ে।

***

“সোহা! মামণি! নুহা বেবীর ব্যাগটা গোছাতে একটু হেল্প করে দাও তো মা! আর তোমার বইগুলো কি সব গোছানো হয়ে গেছে? ক্লাসের বইখাতা… গল্পের বই সব নিয়েছো?”

“হ্যাঁ, মাম্মাম!... সব নিয়েছি… কিন্তু নুহা কথা শুনছেই না মাম্মাম! আমি ওর ব্যাগে বই ঢুকালেই আবার বের করে ফেলছে!”, কচি কণ্ঠে অনুযোগ জানালো ৯ বছরের সোহা।

মেয়েদের গোছাতে দেয়া তো ওদের কিছু একটা দায়িত্ব দিয়ে ব্যস্ত রাখার একটা বাহানা মাত্র। সব গুছিয়ে নিয়েছে আরশি নিজেই। মেয়েদের বইয়ের জন্য ওদের দু’টো স্কুল ব্যাগ দিয়ে সেটাতে কিছু বই ঢুকাতে দিয়েছে শুধু। সোহা তো তাও কিছুটা বড়, নিজের বইখাতা এমনিতেও সে খুব সুন্দর করেই গুছিয়ে রাখে, এখনও সব ঠিকমতো গুছিয়ে নিয়েছে, মা’কে এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্যও করেছে। নুহা এখনও অবুঝ, বড় বোনের কাজে সাহায্য করার চাইতে এলোমেলো করছে আরও বেশি। তাই এই অভিযোগ। নির্মল হাসি ফুটে উঠলো আরশির মুখে। এই তো ওর বেঁচে থাকার রসদ! এই কচি কচি হাতের অগোছালো কাজ, কচি মুখের বিরাট গাম্ভীর্য, কচি কণ্ঠে কচি যুক্তি দিয়ে বড়দের মতো কথার নকল, এই যে ওকে ঘিরে জড়িয়ে থাকা, আর কি লাগে জীবনে?

***

চাকরিতে যোগ দেয়ার পর বিয়ে করেছিলো আরশি। ওর মা ওর বিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেই অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। বা বলা ভালো ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর থেকেই। আরশিরা এক ভাই দুই বোন। ভাই সবার ছোট। ভাইয়ের প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্বটা ছিলো চোখে পড়ার মতো। মেয়ে দু’টিকে পড়ানোর বদলে ঘরের কাজ শেখানোর আগ্রহই বেশি ছিলো উনার। আর কোনমতে বিয়ে দিয়ে পার করে দায় সারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি আরশির বাবার কারণে। তিনি ছিলেন আরশির মায়ের সম্পূর্ণ বিপরীত।

আরশির মায়ের পরামর্শমতো কোনরকমে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার চিন্তা ওদের বাবা মাথাতেও আনেন নি। ঢাকার একটা প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন তিনি। আর নিউ মার্কেটে তাঁর একটা কসমেটিকস এর দোকান ছিলো যেটা তিনি পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন। নিজে না বসলেও পারিবারিক এই ছোট ব্যবসাটা উনি হাতছাড়া করেন নি। লোক দিয়ে চালিয়ে গেছেন। উনার আগ্রহ আর উৎসাহেই আরশির বড়বোন ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে, আর আরশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স।

ওর বড়বোনের অবশ্য বিয়েটা মেডিকেলে পড়াকালীন সময়েই হয়ে যায়, কিন্তু তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সাপোর্টিভ হওয়ায় পড়াতে কোনও বাধা আসে নি। সফল গাইনোকলজিস্ট সে এখন। সে নিজেই শুধু নিজেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয়, আরশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে থাকার সময়েই ওদের বাবা যখন মারা যান, তখন নিজের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আরশির পড়া শেষ হওয়া এবং চাকরি পাওয়া পর্যন্ত সব রকমের সাহায্য করে গেছে। বাবা বেঁচে থাকতে ওদের পরিবারে বিলাসিতা সেভাবে না থাকলেও স্বচ্ছলতার অভাব ছিলো না। শিক্ষকতা, দোকান আর বাবার টিউশনির টাকায় ভালোই চলতো ওদের। তাঁর মৃত্যুর পরে কিছুটা আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে ওরা। ওরা দুই বোন দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরে এখন আরশির মায়ের সংসারের অধিকাংশ খরচ চলে ওদের দুই বোনের টাকাতেই।

দ্রুত হাতে ছোট্ট রাহার ছোট্ট ছোট্ট মোজা, জামা গোছাতে গোছাতে ভাবছে আরশি, এখন পর্যন্ত আরশির মায়ের কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি? একদমই না! নিজেদের বাড়িতে বসে আরশি বা ওর বোন কোনদিন মুরগির রান বা মাছের মাথা, পেটি খাবার পাতে পেয়েছে কিনা ওরা মনে করতে পারে না। বাবা বেঁচে থাকাকালে তাও যাও বা ওদের পছন্দমতো খাবার-রান্না বাসায় হতো, উনি মারা যাওয়ার পরে একেবারেই না। এমনকি দুই মেয়ের এমন চকচকে ক্যারিয়ার দেখেও উনার মুখে অহরহ ওরা এখনও আফসোস শোনে, কত করে উনি বলেছিলেন আরও অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার কথা আর কত শত শত ভালো ভালো টাকাওয়ালা প্রস্তাব উনি তখন মেয়েদের জন্য পেয়েছিলেন। পায়ের উপর পা তুলে বসে খেতে পারতো নাকি ওরা সেসব জায়গায় বিয়ে হলে। উনার কথা না শুনে মেয়েরা কিনা বাইরে খেটে খাওয়ার জীবন বেছে নিলো। অথচ, আরশি সংসার জীবনে সুখী সেভাবে না হতে পারলেও ওর বড়বোনের সংসার যথেষ্ট সুখের হয়েছে। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-জা নিয়ে ভরা সংসার তার। ওদের মায়ের এই লাগামছাড়া কথাবার্তার কারণে, বড়বোনের স্বামী পারতপক্ষে ওদের বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় না। যেচে পড়ে কথা শুনতে কে যাবে? কার ঠেকা পড়েছে?

***

এমন সময় শিউলি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকলো। এসে বললো, “ভাবী, আমি আপনাদের সাথেই যাবো। আমারে নিয়ে যান সাথে। আমার গোছানো শেষ।“

আরশি খুব বেশি অবাক হলো না। শিউলি বা আছমা, বাসার সাহায্যকারী দুইজনের কাউকেই নিজের সাথে যাওয়ার জন্য বলে নি আরশি। আছমা একটু বয়স্ক, প্রায় ওর শাশুড়ির কাছাকাছিই বয়স। ৫ টা ছেলে তাঁর, আর একটা মেয়ে ছিলো, মারা গেছে ছোটবেলাতেই। ছেলেদের কারও সংসারেই মায়ের জায়গা না হওয়াতে এখন এই বাসায়। আছমা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে আরশির সাথে যাওয়ার বিশেষ ইচ্ছা নেই ওর। কিন্তু শিউলি এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। আজ প্রায় ৫ বছর ওর বাচ্চাদের দেখভাল করছে মেয়েটা। বছর ২৫ বয়স। ওর বাচ্চাদের সাথে তো বটেই, আরশির প্রতিও শিউলির যে একটা টান তৈরি হয়েছে সেটা আরশি বোঝে। তারপরেও এই বাসার সমস্যা হবে ভেবে শিউলিকে রেখে যাবে ভেবেছিলো। শিউলি আর আছমা, দুইজনের বেতনই ও দেয়। তবুও। এখন মেয়েটা নিজে থেকে এসে ওর সামনে দাঁড়ালে ও একটু আশ্বস্তই হলো। নতুন জায়গায়, ছোট বাচ্চা নিয়ে কোনও হেল্পিং হ্যান্ড ছাড়া সব কিভাবে সামলাবে সেটা ভাবতে গিয়ে মাথা নষ্ট হচ্ছিলো ওর। একবার ভাবলো মানা করে, পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালো, সব সময় ভালো মানুষি দেখাতে যাওয়ার মানে হয় না। ওর নিজের প্রয়োজন নিজে না দেখলে অন্য কেউ দেখতে আসবে না। তাই বললো, “যাবে? গেলে যেতে পারো, কিন্তু প্রথম প্রথম কিন্তু একটু কষ্ট হবে, খাটনি আছে…”।

শিউলি ওর কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলো, “সে খাটনি কইরা আমার অভ্যাস আছে… আমার না হইলে আপনার হইবো… আমি সোহামনি নুহামনিরে ছাড়া থাকতে পারুম না…”।

শিউলির বিয়ে হয়েছিলো বালিকা বয়সে। বিয়ের কয়েক বছর পর্যন্ত বাচ্চা না হওয়ায় স্বামী তাড়িয়ে দিয়ে আবার বিয়ে করেছে। আরশির এনজিও তে দুস্থ নারী ও শিশু নিয়ে কাজ হয়, সেই কাজের সূত্রেই শিউলির খোঁজ পাওয়া। পরে বেশ কয়েকবার আবার বিয়ে করার জন্য আরশি ওকে বলেছে, নিজে ছেলে দেখে বিয়ে দেবে তাও বলেছে, শিউলি রাজী হয় না। ওর প্রথম স্বামীর ঘরে সংসারের অভিজ্ঞতা ওর এতোই খারাপ যে আবার বিয়েতে প্রবল বিতৃষ্ণা ওর। আর তাছাড়া এতোদিন ধরে মেয়ে দু’টোকে নিয়ে থাকতে থাকতে আসলেও ও এদের ছেড়ে থাকার কথা এখন আর ভাবতে পারে না। ওদের নিয়েই ওর জগৎ। শিউলির কথায় তাই বেশ স্বস্তি পেলো আরশি এখন।

শিউলি বললো, “আমারে দেন ভাবী… আপনে একটু বইসা দম নিয়া নেন… অনেকক্ষণ ধইরা কাজ করতেসেন… আপনের শরীর ভালো না… আমি করতেসি…”, এইটুকু বলে একটু ইতস্তত করে শেষে আবার বললো, “আপনের মা, মামা আর ভাই আইসে… ওই ঘরে… খালাম্মার লগে কথা কয়…”।

শিউলির কথার বিরোধিতা করলো না আরশি। সোহা আর নুহা নরমাল ডেলিভারিতে হলেও রাহা, ওর ছোটো মেয়েটা সিজার করে হয়েছে। প্রেগন্যান্সির শেষ কয়েকটা মাস খুব ক্রিটিক্যাল ছিলো ওর জন্য। সিজারের ধকল সামলে এখনও ওর শরীর পুরোপুরি সারে নি। একটু বিশ্রামের জন্য টানছিলো শরীরটা। মা এসেছে শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো ওর। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে দেখা করতে টানলো না মন থেকে। শিউলির হাতে বাকি কাপড় চোপড়ের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বিছানার এক পাশে বসলো ও। আবার ডুবে গেলো ভাবনায়। ওর সারাজীবনের ছবিগুলো আজ যেন পিছু ছাড়ছেই না ওর।

***

আরশি এবং ওর বোন নিশি, দু’জনেই জানে যে একে তো ওদের মা মেয়ে সন্তান দেখতে পারেন না, তার উপর ওদের দু’জনের কেউই তেমন চেহারা পায় নি যেটাকে ওদের মা অন্তত সুশ্রী বা সুন্দরের কাতারে ফেলবেন। তিনি নিজে গড়পড়তা দৃষ্টিকোণ থেকে সুন্দরী ছিলেন, এখনও আছেন, এবং ভাগ্য উনার ছেলেকে উনার সৌন্দর্য্যের ভাগীদার করেছে, উনার মেয়েদের নয়। ওদের দুই বোনের নিজেদের চেহারা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা কোনকালেই খুব জোরালো হয়ে উঠতে পারে নি, সেটাও ওদের বাবার জন্য। চেহারার বদলে নিজেদের কাজ এবং গুণের বিকাশে নজর দিয়ে এসেছে ওরা বরাবর। ওদের বাবা ওদের মায়ের কথায় পাত্তা না দিয়ে দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, আরশির সফলতা উনি দেখে যেতে পারেন নি, কিন্তু সেই সফলতার ভিতটা উনার হাতেই তৈরি করা।

ওদের মায়ের বিতৃষ্ণার সর্বশেষ কারণ হলো, ওদের ভাইটা আর শিক্ষিত হয় নি। শুধু শিক্ষিত হয় নি তা না, না হয়েছে সে কর্মঠ, না আছে তার কোনও দায়িত্বজ্ঞান। এবং এটা সম্পূর্ণভাবেই ওদের মায়ের কর্মফল, এটাও ওরা জানে, উনি নিজেও জানেন। নিজে তো কোনদিন ছেলেকে শাসন করেনই নাই, স্বামীকেও করতে দেন নি। মেয়েদের কথা তো বাদই। অতি আদরে, লাগামছাড়া প্রশ্রয়ে ওদের ভাইয়ের পড়াশোনা থেমে গেছে ইন্টারের পরেই। এখন সে বাবার দোকানেই বসে, তবে সেই ব্যবসাতেও উন্নতির বদলে লোকসানই বাড়ছে কেবল দিন দিন। ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন প্রথমবার ভালো ঘরের ভালো মেয়ে দেখে, এই আশায় যে ছেলের মতি ফিরবে, ঘটেছে তার উল্টোটা। ছেলের বউ তাঁর ছেলের প্রতি অতি আহ্লাদ, আর নিজের স্বামীর অকর্মণ্যতা কিছুদিন দেখে সোজা বেরিয়ে গিয়ে ডিভোর্স নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপরে নিজের গ্রাম খুঁজে দরিদ্র, ভদ্র পরিবারের এক মেয়েকে ছেলের বউ করে তুলে এনেছেন, যার খুঁটির জোর তেমন নয়।

সুপ্রতিষ্ঠিত মেয়েদের বিপরীতে আদরের ছেলের দুর্বল আর্থিক এবং সামাজিক অবস্থান ওদের মায়ের ভুলটা তাঁর চোখের সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরে, আর সেটাই উনার সহ্য হয় না। ছেলে এবং মেয়ে নিয়ে নিজের ধ্যানধারণা যে ভুল, তা মানতে তিনি নারাজ। চোখের সামনে দেখা প্রমাণও গ্রহণ করতে আপত্তি তাঁর। মেয়েদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা কোনকালেই সেজন্য খুব দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে নি।

ওর ভাইটা অল্প বয়সে মায়ের এই প্রশ্রয়ের কারণে অতিরিক্ত নাক উঁচু স্বভাবের হয়ে উঠেছিলো। বোনেদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দু’বার ভাবতো না। কিন্তু যতো দিন গেছে, ততো বুঝেছে যে এই প্রশ্রয়গুলো ওর জীবনে ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসে নি। বরং কিছুটা শাসন এবং সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে ওর জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। বোনেদের সাথে এখন ওর সম্পর্ক ভালো। মাঝেমধ্যেই বড় দুই বোনের কাছে আফসোস করে ওর অল্প বয়সের ভুলগুলো নিয়ে। তবে ওর স্বভাব যেভাবে গড়ে উঠেছে, যেরকম অলস প্রকৃতি আর গা-ছাড়া স্বভাবের হয়ে সে বড় হয়েছে, তাতে নিজেকে খুব একটা বদলাতেও সে পারে না এখন আর। আফসোস করে ঠিকই, কিন্তু নিজের জীবনের মোড় ঘোরানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।

***

বিয়ের আগে নিজের বাড়িতে দেখা ছেলে-মেয়ের এই ভেদাভেদ আরও বেশি করে আরশির চোখে ধরা পড়লো ওর শ্বশুরবাড়িতে এসে। পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করেই ওর বিয়ে হয় মাহতাবের সাথে। এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিয়ে হয়ে এসে পড়লো আরেক মধ্যবিত্ত পরিবারে। খুব বেশি তফাৎ যে ছিলো তা না। বরং এই দিক দিয়ে একটু বেশি মিলই পেয়েছিলো।

ওর যখন বিয়ে হয় তখন ওর শ্বশুর বেঁচে। তিনিই পছন্দ করেছিলেন ওকে। কোনও একটা কাজে ওর এনজিও তে গিয়েছিলেন একদিন, আর গিয়েই দেখেছিলেন আরশির রুদ্রমূর্তি। যৌতুকের দাবীতে এক গৃহবধূর গায়ে আগুন দিয়ে তার স্বামী আর স্বামীর পরিবার সেটাকে দুর্ঘটনা বলে চালাতে চাইছিলো। মেয়েটার মা-বাবা পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত কোথাও থেকে সেভাবে কোনরকমের সাহায্য না পেয়ে এসে এই এনজিও-এর দ্বারস্থ হয়েছিলো। পুলিশ-প্রশাসনের সাথে কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলো আরশি, এনজিও-এর প্রতিনিধি হিসেবে। পুলিশ, প্রশাসন, সাংবাদিক, মেয়েটার পরিবার, আইনজীবী এদের সবার সাথে একটা মিটিং-এর আয়োজন ছিলো আরশিদের অফিসে। আর যেকোনোভাবেই হোক, এদের সবার সাথে আরশির কথাবার্তা, এমন স্পর্শকাতর একটা ঘটনাকে সহমর্মিতা এবং দৃঢ়তার সাথে ওর ডিল করাটা উনি সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আরশির স্পষ্ট বক্তব্য, অন্যায়ের সাথে আপোষহীন কঠোর মনোভাব, নিজের অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করার মতো বিচারবুদ্ধি, এবং সর্বোপরি ওর ব্যক্তিত্ব উনাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিলো। তারপরেই আরশির সম্পর্কে খোঁজখবর করে উনি দ্রুত আরশিদের বাসায় ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।

ওকে পছন্দ করেছিলো মাহতাবও। প্রথম দেখাতেই সে নাকি প্রেমে পড়েছিলো আরশির। যদিও পরবর্তীতে ওর সেই কথা আরশির কাছে একটা তামাশা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি। আরশির শাশুড়ির আপত্তি ছিলো ওর বয়স, ওর গায়ের রঙ, চেহারা, সব কিছু নিয়েই। একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে হয়তো হুরপরী আশা করছিলেন তিনি। নেহায়েৎ মেয়ে চাকরি করে এবং বেতনটা বিশেষ আকর্ষনীয় বলেই আর ছেলের আর ছেলের বাবার আগ্রহ দেখে উনি পরে আর বিয়েতে না করেন নি।

***

“তেজ দেখাইতেসেন উনি! ৩টা মেয়ে জন্ম দিয়ে আবার তেজ দেখাইতেসেন! বাড়ি ছেড়ে যাবেন! কোন চুলায় যাবে? মাহতাব! তোর বউরে গিয়া জিজ্ঞেস কর… কোন চুলায় জায়গা হবে ৩টা মেয়ে নিয়ে? একটা ছেলে জন্ম দিতে পারলো না এতো দিনে তার আবার এতো তেজ!” ডাইনিং রুম থেকে ওর শাশুড়ি, মিসেস রেহনুমা আফরোজ তালুকদারের চিৎকার ভেসে এলো। সাথে ভেসে এলো ওর মায়ের মিন মিন করে বলা অস্পষ্ট কিছু শব্দ।

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আরশির। ঠোঁটের উপর ঠোঁট চেপে বসলো। উত্তরটা জিভের আগায় এসে থেমে আছে। ভেবে রেখেছিলো যে সব কাজ শেষ করে একদম বের হওয়ার আগে বসবে স্বামী-শাশুড়ির সাথে। কিন্তু ক্রমাগত উল্টোপাল্টা কথার আঘাত সহ্য করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েদের দিকে চোখ গেলো ওর। দুইজনেই হাতের কাজ থামিয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওরা জানে এই বাসায় ওরা দোষী, কিন্তু কেন যে দোষী, সেটা জানে না, বুঝে উঠতে পারে না। মায়ায় আর্দ্র হয়ে উঠলো ওর মনটা। ওদের ভীত দৃষ্টি একদম কলিজায় গিয়ে কামড় বসালো ওর। এতোটুকু বয়সে, জীবনের সবচাইতে নিরাপদ যে জায়গা, সেই পরিবারের মধ্যেই ওর মেয়েরা এখন আর স্বস্তিবোধ করে না, সার্বক্ষণিক কেমন সিঁটিয়ে থাকে ভয়ে যে এই বুঝি ওদের কেউ কিছু বললো। মা’কে সারাক্ষণ কথা শোনাতে থাকে দাদী, সেটা যে ওদের জন্যই, সেটা কিভাবে যেন বুঝতে পেরে গেছে ওরা। ছোটো মানুষ, ছোটাছুটি-দুষ্টুমি করার সময় এতো কিছু তো মাথায় থাকে না! থাকার কথাও না ওদের, কিন্তু একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই দাদী বকা দেয়, এমনকি বাবাও!

নানী এসেছে শুনেও ওদের ভেতর নানীর কাছে যাওয়ার বিশেষ আগ্রহ দেখা গেলো না। নানুমণি ওদের আদর করেন ঠিকই, কিন্তু ওই যে! ওরা মেয়ে বলে সর্বক্ষণ বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোস! আর ওদের দাদুর বাসায় এলে, দাদীআপুর সামনে সেই আফসোস যেন আরও বেড়ে যায় উনার! আরও ছোটবেলায় খুব নানী-ঘেঁষা ছিলো সোহা। কিন্তু একটু বড়ো হওয়ার পর থেকে ইদানীং একটু গুটিয়ে গেছে। আর নুহা এমনিতেই খুব বেশি উনার কাছে যেতে চায় না। সে উসখুস করছে মামার কাছে যাবে কিনা সেই জন্য, মামু তার ভীষণ প্রিয়। তবে আজকে বাসায় যে কিছু একটা হচ্ছে সেটা তার ছোট্ট মাথাতে কাজ করছে, তাই অস্বস্তি ডিঙিয়ে সে আর বাইরের ঘরের দিকে গেলো না।

দরজার বাইরে থেকে ভেসে আসা দাদীর কথায় আবার চমকে উঠতে দেখলো আরশি ওদের, “কতোখানি সাহস এই মেয়ের! এ্যাঁ! বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে! একটা বংশধর দেয়ার যোগ্যতা নাই সেই মেয়ে মানুষ আবার বড় গলায় কথা বলে! একটা ছেলে জন্ম দিতো! তাও নাইলে বুঝতাম… তিন তিনবার সেই মেয়ে! সেই মেয়ে নিয়ে আবার তার আদিখ্যেতার শেষ নাই!... এখন আবার মেয়ে নিয়ে তিনি বের হয়ে যাচ্ছেন! … দুই পয়সার চাকরি করে মাথায় উঠসে আমার!... বাপ ছাড়া মেয়ে মানুষ করবি কেমনে? মেয়ের বিয়ের সময় বাপের পরিচয় লাগবে না? দেখবো নে কি করিস… এইরকম সংসার ফেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া মায়ের মেয়েদের কি গতি হয় দেখবো আমি!... ফাইজলামি শুরু করসে!...”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আরশি। মেয়ে দু’টো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ওর পিঠ সোজা, ছড়ানো কাঁধ শক্ত হয়ে আছে রাগে। মনে মনে ভাবছে, এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্তটা আরও আগেই নেয়া উচিৎ ছিলো ওর। এই সমস্ত কথা কোনটাই ওর মেয়েদের কানে ঢোকা উচিৎ ছিলো না। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে যতোটুকু প্রশ্ন ছিলো এক লহমায় যেন উবে গেলো মন থেকে। এই জঘন্য মনমানসিকতার সাক্ষী হবে ওর মেয়েরা, এই ভাষা আর এই ধ্যানধারণার কথা শুনতে শুনতে বড় হবে, এটা কখনোই হতে দেয়া যায় না। জীবনে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটাই হারিয়ে ফেলবে মেয়েরা এর ভেতর। মনোবল, আত্মবিশ্বাস বলে কিছুই গড়ে উঠবে না। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগবে। ওর নিজের যাই হয়ে যাক, মেয়েদের একটা সুস্থ পরিবেশ দিতে ও বদ্ধপরিকর।

রেহনুমা বলে যাচ্ছেন, “মাহতাব! সারাজীবন তো বউরে শাসন করতে পারলি না… এখনও খালি তাকায় তাকায় দেখেই যাচ্ছিস… কি দেখে যে তখন তোর আর তোর বাপের মাথা ঘুরসিলো তা আজও আমার বুঝে আসলো না… কতো না করসিলাম তখন! শুনলি না… এখন দেখলি তো?” আরশি চোখে না দেখেও বুঝতে পারলো পরের কথাগুলো ওর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, “বংশরক্ষা কি তোর মুখ দেখলে হবে? হ্যাঁ?... তোর মুখের দিকে তাকায় তাকায় বংশের গতি হবে? এখন আবার মেয়েগুলার উপর থেকে বাপের ছায়া সরায় নিচ্ছে বদ মেয়েমানুষ! ওর কখনও ভালো হবে না… আমি তোর আবার বিয়ে দেবো মাহতাব… তোর ছেলেও হবে দেখবি… আর সংসারও হবে ঠিকমতো…”।

উনার কথা শুনতে শুনতে শীতল হাসি ফুটে উঠলো আরশির ঠোঁটে, এতো শাপশাপান্ত করে চলেছেন মহিলা, ও ওর বাচ্চাদের উপর থেকে বাবার ছায়া সরিয়ে নিচ্ছে বলে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন ওর স্বভাবচরিত্র নিয়ে, অথচ মেয়েদের রেখে দেয়ার কথা কিছু বলছেন না! জাতে মাতাল তালে ঠিক! মেয়েদের দায়িত্ব নেয়ার বেলায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ উনার বা উনার ছেলের আসে না। ওকে কথা শোনানোর বেলায় ষোল আনা। প্রতিটা মুহূর্তেই ও যেন আরও বেশি করে নিশ্চিত হচ্ছিলো ওর সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আর যৌক্তিকতা নিয়ে।

হাসিটা ঠোঁটে ধরে রেখেই আবার কাজে লাগলো আরশি। যেকোনো আবেগ, সেটা প্রেম হোক, বা বিরহ, আনন্দ হোক বা দুঃখ, আমোদ হোক বা ক্রোধ, অতিরিক্ত হয়ে গেলে বোধহয় মানুষের এক ধরণের নির্লিপ্ততা চলে আসে। এক ধরণের ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করতে শুরু করে ব্রেনে, আবেগটাকে আর বাড়তে না দিয়ে একটা শীতল, হিসাবী, থম ধরে থাকার মতো একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়, প্রকৃতির যে অবস্থা হয় নিম্নচাপের সময়, কালবৈশাখীর ঠিক আগে দিয়ে। আরশির ঠোঁটে হাসি দেখে বেকুব হয়ে শিউলি তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে। এখন একবার কেমন ভয়ে শিউরে উঠলো ও। কিন্তু কিছু বললো না।

তখনও কানে আসছে রেহনুমার কথা, “আর বেয়ান! এ কিরকম মেয়ে মানুষ করসেন আপনি? স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি কাউরে মানে না!... মনে চাইলো আর চললো সংসার ফেলে? দেখতেসেন তো! নিজের চোখেই তো দেখতেসেন কেমন তার আচরণটা!... মেয়েগুলি তো এই পরিবারের, নাকি?!... কি এক চাকরি করে! তাই নিয়ে এতো দেমাগ! সাপের পাঁচ পা দেখসে!... আপনাদেরও তো কোনও খবর দেয় নাই বললেন!... আপনাদের কাছে যাচ্ছে শুনলেও নাইলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হইতে পারি যে আমার নাতনীরা নিরাপদেই আছে!... আর আপনিই বা কেমন? মেয়েদের এটুকু শেখান নাই যে ছেলেতে আর মেয়েতে পার্থক্য আছে?... নাহলে আমি চাইসিই একটা নাতি!... একটা নাতির আশা করা কি আমার এতো বড় কোনও অপরাধ নাকি? আমার তো এই এক ছেলে ছাড়া আর কোনও সন্তান নাই যে আমি আরেক ছেলের ঘরে বংশের বাতির আশা করবো!... আপনিও তো ছেলের মা... আপনি বোঝেন না নাতি কেন লাগে? সত্যি কথা না বলে পারতিসি না বেয়ান... আপনার এই দুই মেয়ের ভাব দেখলে মনে হয় দুনিয়াতে আর কেউ ডাক্তার হয় নাই... আর কেউ চাকরি বাকরি করে খায় না!...কেমন শিক্ষা দিসেন আপনিই ভাবেন...”।

রওশন আরা, অর্থাৎ আরশির মায়ের উদ্দেশ্যে লম্বা বয়ান দিয়ে থামলেন রেহনুমা। কথা বললো এবার পরশ, আরশির ছোট ভাই, “আন্টি, ছোট আপু কিন্তু প্রায় মাস দুয়েক আগেই আপনাদের সব কিছু জানাইসে!... তাইলে আজকে এতো কথা কেন উঠতেসে? পারিবারিকভাবে আলোচনা করতে চাইলে আরও আগেই আমাদের সাথে বসতে পারতেন আপনি! আজকের জন্য অপেক্ষা করসেন কেন? আর ব্যাখ্যা দেয় নাই কেন বলতেসেন আন্টি? আপনি জানেন না? ও নিজের ফ্ল্যাট নিসে... সেখানেই উঠতেসে... আপনিও জানেন, আমরাও জানি আপনি নাতি নাতি করে মাথা নষ্ট করে ফেলতেসেন... আর আপু ৩টা বেবীর পরে আর বেবী নিবে না... একটু আগে আপনিই তো বললেন দুলাভাইয়ের আবার বিয়ে দিবেন আপনি... তো আজকের এই যুগে বসে আমার বোন কি সতীনের ঘর করবে বলে আশা করেন আপনি? আর ছোট আপু বরাবরই নিজের মতে চলে... কিন্তু আপনি বড় আপুর কথা যে বললেন, সেটা মানতে পারলাম না... বড় আপুর মতো মাটির মানুষ দুইটা হয় না! আর আপনি কিনা বলতেসেন সে ডাক্তার বলে অহংকার করে!...”

ঝড়ের গতিতে নিজের প্রয়োজনীয় কসমেটিকস একটা ছোট ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে সবটাই শুনলো আরশি। ঠোঁটের কোণে তখনও সেই হাসি। একটু ভালো লাগাও কাজ করছে যে অন্তত ওর ভাইটা তো ওর হয়ে কিছু বলেছে! যদিও ও কারও ওর পক্ষ নেয়া বা না নেয়ার অপেক্ষায় বসে নেই, তারপরেও একটু আপন একটা ভাব অনুভব করতে পারাটাই বা কম কি! পরশ মায়ের আদরে বাঁদর যেমন হয়েছে, তেমনি ঠোঁটকাটাও বটে। সেই কারণেই দুমদাম এই কথাগুলো বলে ফেলতে পারলো। কথাটা ভেবে হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো আরশির।

কিন্তু ওর ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ টিকলো না ওর মায়ের কথায়। চিকন গলায় টেনে টেনে সুর করে তিনি বলছেন, “তুই থাম বাবা!... বড়দের মুখে মুখে কথা বলিস না তো!... বেয়ান, আমি আপনার কষ্টটা বুঝি! আমার ছেলের বউ যদি আমার মুখে মুখে এরকম চোপা করতো, আমার যে কেমনটা লাগতো সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না!... কিন্তু কি করবো বলেন! মেয়ে দু’টোকে এরকমভাবে তৈরি করে গেছেন ওদের বাবা... আমি কম বোঝাতে চেষ্টা করি নাই, বিশ্বাস করেন! কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! শুনলে কি আর আজকে আমাকে এতোগুলো কথা শোনাতে পারতেন আপনি বেয়ান! পারতেন না!... সেই সুযোগই পেতেন না কোনদিন.”, গলা ভেঙে এসেছে তাঁর, চোখ মুছলেন আঁচলে।

মুখটা তেতো লাগছে আরশির। দোলনা থেকে মৃদু চ্যাঁ চোঁ, কুঁ কুঁ আওয়াজ আসছে। ঘুম ভেঙেছে উনার। রাহাকে বুকে তুলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো আরশি। উনার খাওয়ার সময় হয়েছে। ক্ষুধা পেলে এই মেয়েটা কাঁদেও না, চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথাতেও তোলে না। ঐ অতোটুকু আওয়াজে বুঝে নিতে হয় যে তার খিদে পেয়েছে। নুহা এক দৌড়ে এসে বিছানার পাশে দাঁড়ালো। বিছানার কিনারে দুই হাত রেখে হাতের উপর ভর দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিতে লাগলো সে। স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়ানোটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। বুনুর খাওয়া দেখাটা তার ভীষণ প্রিয় একটা কাজ। পাতলা পাতলা লাল লাল দু’টো ঠোঁট গোল গোল করে সে যখন চামচে করে কিছু মুখে নেয়, অথবা ফীডারের নিপিলটা মুখে নিয়ে চুষতে চুষতে বড় বড় চোখ দু’টো দিয়ে আশে পাশে তাকাতে থাকে, সেটা তার ভীষণ পছন্দের দৃশ্য। কত্তো সুন্দর যে লাগে তখন বাবুটাকে! ব্রেস্টফীড করাতে গেলেও যতোই আড়াল নিয়ে বসুক আরশি, ও উঁকি দিতেই থাকে। সোহা অবশ্য এখন একটু একটু লজ্জা পায়। ৯ বছর বয়সে হয়তো লজ্জা পাওয়ার কথা ওর না, কিন্তু আছমা আর দাদী আপুর সঙ্গ-আলাপ ইত্যাদি থেকে হয়তো সে কিছু কিছু বুঝতে শিখেছে লজ্জা পাওয়ার বিষয়গুলো সম্পর্কে। আর তাছাড়া গুড-টাচ, ব্যাড-টাচ সম্পর্কে ওর মা তো ওদের শিখিয়েছেই।

বাইরের ঘরে এখনও তুমুল আলোচনা চলছে। শুধু যে আরশির মা-ভাই উপস্থিত তা না। উপরের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নাহার বেগম আর উনার বড় ছেলের বউ শারমিনও উপস্থিত সেখানে। আরও আছেন নার্গিস আক্তার। পাশের ফ্ল্যাটের নিঃসন্তান ভদ্রমহিলা। উনি এসেছেন উনার বাসার হেল্পিং হ্যান্ড, রুবিনাকে নিয়ে, সেও এক মধ্যবয়সী মহিলা। নাহার বেগম আর নার্গিস আক্তার, দু’জনের বয়সই রেহনুমার কাছাকাছি। খাতিরও আছে উনার সাথে। সকালের হাঁটাহাঁটির পার্টনারও বটে। আলাপের বিষয়গুলোও কাছাকাছি হওয়াতে সুবিধা হয়েছে উনাদের, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ-মোকদ্দমা, এবং সিরিয়াল, ইত্যাদি। এনারা আজকে হঠাৎ এসে এই পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছেন তা যে নয়, সেটা আরশি খুব ভালমতোই জানে। ওর শাশুড়ি ওর এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পর থেকেই যে পাড়া বেড়ানোর সময় পুরো বিল্ডিং, তথা পুরো পাড়াতেই এই কাহিনী রটিয়ে এসেছেন, সেটা ওর অজানা নয়। আজকের দিনেই তাই বেছে বেছে এই কয়েকজন এসে উপস্থিত হয়েছেন, ঘরোয়া সিরিয়ালের আকর্ষণ ছাড়তে না পেরে। সবার ভাঙা ভাঙা টুকটাক মন্তব্য ভেসে আসছে আরশির কানে।

(চলবে)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama