STORYMIRROR

Shwagota Sayeed

Inspirational

4  

Shwagota Sayeed

Inspirational

"বংশের বাতি"

"বংশের বাতি"

14 mins
390

(তৃতীয় অংশ)

ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসে আছেন ভদ্রমহিলা। টেবিলের উল্টো পাশে চেয়ারে বসে আছেন নাহার বেগম। নাহার বেগমের পাশের চেয়ারে বসা শারমিন। টেবিলের কোণাকুণি একটা চেয়ারে বসা রওশন আরা, তাঁর চেয়ারের পেছনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো পরশ। রওশন আরার পাশেই আরেকটা চেয়ারে বসা উনার ভাই সারোয়ার ইসলাম। এতোক্ষণ বসবার ঘরে বসা ছিলেন বোধহয়, আরশির এই ঘরে আসার আওয়াজ পেয়ে উঠে এসেছেন নার্গিস আক্তার। রান্নাঘরের দরজাটা লাগোয়া, দরজার দুই পাশে চোখে মুখে উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আছমা আর রুবিনা। রগড় দেখতে কার না ভালো লাগে! বিশেষত সেই রগড় যখন হয় অন্য কারও, আর নিজে থাকা যায় দর্শকের ভূমিকায়। মজাই মজা!

ফোঁস ফোঁস করছিলেন রেহনুমা, কিন্তু আরশিকে হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে কেমন একটু মিইয়ে গেলেন। এই মেয়েটা মুখের উপর কিছু বলে না কোনদিনই, কিন্তু এমন একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে সে চলে যে ওর পেছনে যা খুশি তাই বলা গেলেও, ওর সামনে এসে উনার উৎসাহে ভাটা পড়ে। কিছুতেই আর জোর পান না যেন, মেয়েটা এই ১০ বছরে কোনদিন উনার সাথে একটাও জোরগলায় কথা বলেছে উনি বলতে পারবেন না, কিন্তু কোনদিনই একে নিজের ইচ্ছায় নাচাতেও পারেন নি তিনি। শুকনো ঢোক গিললেন তিনি চোখের সামনে আরশিকে দেখে। একটু আগে মুখ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া গালিটার জন্য নিজেকে নিজে দুষছেন এখন। মানুষের সামনে আরশিকে ছোটো করার ইচ্ছাতে আর নিজের ক্ষমতার জোর দেখাতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে এখন উনার। স্বামীর সাথে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যে ছেলের বউ, তাকে বাইরের লোকের সামনে হেনস্থা করাটা ছিলো উনার উদ্দেশ্য, আর নিজেকে ভিক্টিম প্রমাণ করা। কিন্তু এখন ঘটনা উল্টে না যায়!

ভয় ফুটে উঠেছে রওশন আরার চেহারাতেও। এই মেয়েটাকে উনি একটু সমঝেই চলেন। বড়টাকে ইচ্ছেমতো কথা শোনানো যায়, কিন্তু এটাকে সেই ছোটবেলা থেকেই কিছু বলতে গেলেই ছ্যাঁত করে উঠতো। কয়েক দফা নিজের পেটের মেয়ের হাতে তুলোধুনো হয়ে উনার শিক্ষা হয়ে গেছে। সারোয়ার সাহেব আরশি ঘরে ঢোকার পরে একবার চোখ তুলে ওর দিকে চেয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিলেন।

কয়েক সেকেন্ড রেহনুমা আফরোজের দিকে ঠান্ডা চোখে চেয়ে রইলো আরশি। তারপর শব্দ করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উনার সামনে বসে পড়লো, একদম মুখোমুখি। ঘরে উপস্থিত বাকিদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলো ও। পরিষ্কার, শান্ত কণ্ঠে, সাবলীল ভঙ্গীমায় বললো, “বলেন মা… কি কি বলার আছে আপনার… আপনার সামনেই আছি আমি… বলেন, শুনছি…”।

আবার ঢোক গিললেন রেহনুমা। ভালোই বিপদে পড়েছেন। উনারই এক রকম অলিখিত দাওয়াতে এখন যারা এখানে উপস্থিত, তাদের সামনে রীতিমতো মানসম্মানের প্রশ্ন এখন উনার। মুখোমুখি এভাবে কিছু বলার সাহস উনার হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না, কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। আরশি চেয়ে আছে উনার চোখে চোখ রেখে, এক দৃষ্টিতে।

গলার জোর বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে অবশেষে উনি মুখ খুললেন, “বলবো আবার কি? যে মেয়েমানুষ একটা ছেলে জন্ম দিতে পারে না তার তো মাথা নামায় চলার কথা!... কিন্তু তুমি? তুমি তো উলটা তেজ দেখায় বাসা থেকেই বের হয়ে যাচ্ছো! স্বামীর ঘর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে যাওয়া মেয়েমানুষরে কি বলে জানো তুমি?... তোমার এই শিক্ষায় আমার নাতনীগুলাও নষ্ট হবে...”, কথাগুলো বলতে বলতে উনার ভেতর আবার উনার নড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে, দেখলো আরশি, মনে মনে হাসলো ও, কিন্তু উনাকে বাধা দিলো না বলতে, “কেমন মা তুমি? এ্যাঁ? কি শিখবে তোমার মেয়েরা তোমারে দেখে? কেমন মেয়েমানুষ? সমাজের নিয়মকানুন মনে হয় কিছু জানো না! এতো সাহস তোমার হয় কিভাবে যে তুমি মেয়ে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছো? হ্যাঁ!... আজকে ১০ বছরে আমার ছেলেরে একটা বংশের প্রদীপ দিতে পারলা না তুমি! কোথায় চেষ্টা করবা যাতে হয়! মানুষ একটা ছেলের জন্য কতো কিছু করে!... নামাজ, রোজা, মানত, দান-সদকা নিয়ে আল্লাহ-এর দরবারে পড়ে থাকবা যাতে একটা ছেলে পেটে আসে... তা না সারাক্ষণ পড়ে আছো চাকরি নিয়ে... তোমার তো লজ্জা হওয়া উচিৎ! আমি হইলে তো চোখ তুলে কথাই বলতাম না লজ্জায়!...”

উনি হয়তো আরও কথা চালিয়ে যেতেন, কিন্তু থামতে বাধ্য হলেন অকস্মাৎ আরশি কথা বলে ওঠায়। গম্ভীর, কর্তৃত্বপূর্ণ স্বর আরশির। ঠোঁটের কোণে ধরে রেখেছে এক টুকরো হাসি, হতে পারে তা আমোদের, হতে পারে তা অবজ্ঞার। আরশি বললো, “আপনার তো লজ্জিত হওয়াই উচিৎ!”

আরশি বলে চুপ করলো বটে কথাটা, কিন্তু উনি পুরো ধরতে পারলেন না যে আরশি কি বলেছে, তাই প্রশ্ন বেরুলো, “অ্যাঁ? কি বললা?”

আরশি আরও পরিষ্কারভাবে আবার বললো, “বলছি যে আপনারই তো লজ্জিত হওয়া উচিৎ!”

কথাটা আত্মস্থ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় দিলো আরশি উনাকে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, উনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন, বুঝেও বুঝতে পারছেন না আরশির কথার অর্থ। আরশি ব্যাখ্যা করলো এবার, “যে নিজে মেয়ে হয়ে মেয়ে জন্ম হওয়াটাকে খাটো চোখে দেখে, মূল্য দেয় না, তার তো নিজের কাছেই নিজের কোনও দাম নেই!... লজ্জিত তো তার হওয়াই উচিৎ!”

ক্ষেপে উঠলেন রেহনুমা, “বৌমা!...”, কিন্তু এর বেশি উনাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না আরশি। উনি অনেক সুযোগ পেয়েছেন, ১০ বছর ধরে সুযোগ পেয়েছেন বহু কিছু বলার এবং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহারও করেছেন। আজকে ওর বলার দিন।

আরশি বললো, “আজকের যুগে বসে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা নিয়ে বসে আছেন ছেলে আর মেয়ে হওয়া নিয়ে... লজ্জা আপনার অবশ্যই পাওয়া উচিৎ!... আপনি তো এই যুগে, এই সময়ে চলার মতোই উপযুক্ত না!...”

এবার আরশিকে ছেড়ে ছেলের দিকে ফিরলেন রেহনুমা। মাহতাবের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে, বারবার জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাচ্ছে সে। ছেলের চেহারা দেখেই ওদিক থেকে এই আক্রমণের জবাব আসার আশা বাদ দিলেন তিনি। আবার ফিরলেন আরশির দিকে।

আরশি উনার প্রতিটা নড়াচড়া খেয়াল করছে। ওর দিকে আবার ফিরতেই রেহনুমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আর কি যেন বলছিলেন? বংশ প্রদীপ?... তা আপনি কোন বংশের?”

খ্যাঁক করে উঠলেন রেহনুমা, “মানে?”

খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নটা আবার করলো আরশি, “আপনার বংশ কোনটা?”

রাগ চেপে খানিকটা অহংকার নিয়ে উত্তর দিলেন রেহনুমা, “আমি সিকদার বংশের মেয়ে! কেন তুমি কি জানো না নাকি? এই প্রশ্ন করার মানে কি?”,সন্দেহের চোখে তাকালেন আরশির দিকে, ওর প্রশ্নের আর কথাবার্তার গতিবিধি কোন দিকে যাচ্ছে ধরতে পারছেন না তিনি।

আরশি বললো এবার, “তাই নাকি! কিন্তু আপনি তো মেয়ে... আপনি তো আর কারও বংশ প্রদীপ না, তাই না?... হ্যাঁ, আপনি সিকদার বংশের কারও ঔরসে জন্মেছেন সেটা হতে পারে, কিন্তু বংশের পরিচয় দিচ্ছেন কেন? আপনি সিকদার বংশে জন্ম নিয়েছেন, বিয়ে হয়ে তালুকদার বংশের বউ হয়েছেন... কিন্তু এর কোনটাই তো আপনার নিজের হওয়ার কথা না! আপনাকে দিয়ে তো আর সিকদার বংশের ধারা বজায় রাখা যায় নি, তাই না? আপনি তো আর তাদের উত্তরাধিকার না! কাজেই আপনি স্রেফ জন্মসূত্রে আপনার বাবা-মায়ের পরিচয়টুকু পেতে পারেন... বংশ পরিচয় না... আর তালুকদার বংশে তো এমনিতেই আপনি স্রেফ বউ... মানে পরের মেয়ে... আমিও যেমন পরের মেয়ে... আপনিও তেমনই পরের মেয়ে... রাইট?”

উনার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আরশি আবার বললো, “আর এগুলো কিন্তু আমি বলছি না!... এটা আপনারই থিওরি... মেয়ে দিয়ে বংশ রক্ষাও হয় না... তাই মেয়েদের কোনও বংশও হওয়ার কথা না... তাই না?”

***

হাঁ শুধু রেহনুমার মুখ হয় নি, উপস্থিত সবার মুখই খুলে দেড় ইঞ্চি ফাঁক হয়ে রয়েছে। বাপের জন্মে এরকম যুক্তি এদের কেউ কোনদিন শোনে নি। শুধু দুই চোখ ভর্তি মায়া নিয়ে আরশির দিকে চেয়ে আছেন সারোয়ার সাহেব। কতো যন্ত্রণায় যে এই কথা বের হয় একটা মেয়ের মুখ দিয়ে, তা উনি বুঝতে পারছেন ভালো করেই। ওর বেড়ে ওঠার সাক্ষী উনি নিজেই।

আরশির বাবা আর উনি একই কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সহকর্মী থেকে একসময় বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে উঠলে সারোয়ার সাহেব নিজের বোনকে আরশির বাবার সাথে বিয়ে দেন। বন্ধুত্বটাকে বদলে নেন আত্মীয়তায়। কিন্তু পরবর্তীতে উনি নিজে বহুবার আফসোস করেছেন নিজের বন্ধুর জীবনটা নষ্ট করার জন্য। নিজের বোনকে চিনতেন আগে থেকেই, রূপের অহংকারে অহংকারী, বেশ খানিকটা ম্যানিপুলেটিভ, আত্মকেন্দ্রিক, এবং টাকা-পয়সার ব্যাপারে ভীষণ সচেতন একজন মানুষ তিনি। কিন্তু আরশির বাবার উদার এবং প্রগতিশীল মন-মানসিকতার বিপরীতে তাঁর বোনের প্রাচীনপন্থী চিন্তাভাবনা, ছেলেতে-মেয়েতে বিভেদ, এই বিষয়গুলো যে এতোটা প্রকট হয়ে উঠবে, সেটা তিনি আগে বোঝেন নি। রওশন আরা, আরশির বাবার মতো একটা মানুষের মর্যাদাই বুঝতে পারেন নি সারাজীবনে। বোনকে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, মৃদু শাসনও করেছেন, কিন্তু ফলাফল যেই কে সেই। নেহায়েৎ আরশির বাবার এক ধরণের শান্ত দৃঢ়তা ছিলো, কারও সাথে বিবাদে না গিয়েও নিজের অবস্থানে অটল থাকার একটা অসাধারণ গুণ ছিলো। সেই দৃঢ়তার কারণেই তাঁর মেয়েদু’টো আজকে এই অবস্থানে। আরশির মধ্যে যেন সারোয়ার সাহেব ওর বাবার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। বোনের সাথে তর্ক করার রুচি চলে গেছে তাঁর নিজের অনেক দিন আগেই। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে মনে বড়ো শান্তি পান তিনি।

ঘরভর্তি বেআক্কেল হয়ে থাকা মানুষগুলোর বিপরীতে আরশি কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বিকার! এখনও চেয়ে আছে রেহনুমার মুখের দিকেই। বাকিদের ফিরেও দেখছে না। শুধু চোখের কোণা দিয়ে খেয়াল রেখেছে যে ওর মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে শিউলির দুই পাশে। সোহা খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছে, বোঝার চেষ্টা করছে, নুহার মুখে ওর ডান হাতের বুড়ো আঙুল গোঁজা। ওদের চোখই বলে দিচ্ছে যে ওরা বোঝার চেষ্টা করছে যে রোজ রোজ যে দাদীআপু ওদের মাম্মামকে বকা দেয়, আজকে মাম্মাম দাদীআপুকে বকা দিচ্ছে কিনা।

আরশি মুখ খুললো আবার, “আমি নাহলে এসব মানি টানি না… আমার কাছে সন্তান মানে সন্তানই… তার আবার ছেলে-মেয়ে কি! সন্তান মানেই আমার অংশ… আমার উত্তরাধিকার বলেন, লেগ্যাসি বলেন… আপনার ভাষায় বংশের প্রদীপ বলেন… আমি মরে যাওয়ার পরে আমার চিহ্ন বয়ে নিয়ে চলার, আমার স্মৃতি মনে করার একজন মানুষ বলেন, তার সবই… কিন্তু আপনার মত অনুযায়ী… মেয়েদের তো সেই অর্থে কোনও বংশই নাই, তাই না?”

নাহার বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন, “দ্যাখো মা! এইভাবে শাশুড়ির সাথে কথা বলাটা কিন্তু ঠিক না... হাজার হইলেও মুরুব্বী মানুষ... মায়ের জায়গায়... এইটা কিন্তু তোমার বেয়াদবি হইতেসে...”।

উনার কথা শেষ হতেই তড়িৎ জবাব এলো আরশির কাছ থেকে, “আর এইভাবে উঠতে বসতে আমাকে আমার মেয়েদের সামনে যা খুশি তাই বলাটা উচিৎ কাজ? বয়সে ছোট বলে আমার মানসম্মান থাকতে নেই?... আর আমি অন্যায় কি বললাম! আমার মেয়েদের উনি উনার বংশের উত্তরাধিকার বলে মনে করেন না... কারণ ওরা মেয়ে... তাহলে উনিও কোনও বংশের উত্তরাধিকার হতে পারেন না মেয়ে হিসেবে!... সিম্পল!”

মাহতাবের বোধহয় এই পর্যায়ে মনে হলো ওর পৌরুষ দেখানোর সময় এসেছে। আরশির নাম ধরে একটা হুঙ্কার দিয়ে হাত উঠিয়ে তেড়ে এলো ও। কিন্তু হাত নামানোর আগেই থমকে গেলো। গর্জে উঠেছে আরশি, “ভুলেও ওই কাজ করো না মাহতাব!...”, শীতল দৃষ্টিতে যেন পুড়ে গেলো মাহতাবের পুরো অস্তিত্ব। আরশি আবার মুখ খুললো, “আমি কোনও অসহায় বা ভীতু মেয়েমানুষ না যে আমার গায়ে হাত তোলার মতো দুঃসাহস তুমি দেখাবে... আমাকে আঘাত করলে তা আমি ফিরিয়ে দেবো মনে রেখো... আমার মেয়েদের বাবা বলে কোনও ছাড় আমি তোমাকে দেবো না... মেয়েদের প্রতি কোনও দায়িত্বই তো কখনও পালন করলে না! অন্তত মেয়েদের চোখে নিজেকে আর ছোট করো না!... আর এটাও মনে রেখো যে নারী নির্যাতন নিয়েই আমার কাজ এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতা... নারী নির্যাতন আইনের সমস্ত অলিগলি আমার জানা আছে! ১০ বছরে তোমার পুরুষের তেজ তো দেখলাম না কোনদিন... একটা কোনও বিষয়ে নিজের কোনও অবস্থান বলে কিছু দেখি নি... ন্যায়-অন্যায় চোখে দেখে না যে, সে আজকে আসছে আমার গায়ে হাত তুলতে!... খবরদার যদি আর এক পাও আগাও তুমি আমার দিকে!”

আরশির কণ্ঠস্বর ঝনঝন করে বেজে উঠলো যেন ঘরের ভেতর। সুড়সুড় করে হাত নামিয়ে নিলো মাহতাব। আরশি যে তাকে জেলের ঘানি টানানোর ক্ষমতা রাখে, সেটা সে খুব ভালোই জানে। এও জানে যে আরশি সেটা করবেও। এতোগুলো বছরে আরশির প্রতি এমন কোনও দায়িত্বশীল আচরণ সে করে নি যে আজকে প্রত্যাশা করবে আরশি তার প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা দেখাবে, আবেগের বা সম্পর্কের।

কিন্তু মাহতাবের মা, রেহনুমা এতো কিছু হিসাব কোনদিনই করেন নাই, আজও করলেন না। ভেবে বা হিসেব করে কথা বলা এবং ব্যবহার করা তাঁর ধাতে নেই। তার উপর ছেলের বউ হিসেবে এই মেয়ে কোনকালেই তাঁর খুব পছন্দের তো ছিলোই না! এমনকি ছেলের বউয়ের পিছনে সর্বক্ষণ লেগে থাকলেও ওর কাজের ধরণ, পরিচিতির পরিধি বা অবস্থানের ক্ষমতা সম্পর্কেও কোনদিন উনি কৌতূহলবশতও বেশি কিছু জানতে চেষ্টা করেন নি। মাহতাবকে আরশির এই সাবধান করে দেয়া তাই উনার কাছে স্রেফ ওর মিথ্যা চোটপাট আর ফাঁকা বুলি বলেই মনে হলো। সুতরাং আজকে সুযোগ পেয়ে এই মেয়েকে উপযুক্ত অপমান করতে, কথা শোনাতে উনি ছাড়বেন কেন? বলে বসলেন, “দ্যাখেন! দ্যাখেন নাহার আপা! দ্যাখেন নার্গিস ভাবী! ভাইসাহেব আপনারাও দ্যাখেন! কেমন মেয়ে নিয়ে আমার ছেলের সংসার!... আদব-সহবতের কোনও শিক্ষা আছে এর? দেখতেসেন? নিজের স্বামীর সাথে এইভাবে কথা বলে কেউ! ... এই জিনিস বছরের পর বছর সহ্য করতেসি আমি!... আপনারা কেউ করতেন? এই রকম বেয়াদবি সহ্য করতেন আপনারা! আর আমার দোষটা কি? একটা নাতি চাইসি!... আমার কি এই শখটুকুও থাকতে নাই!” ম্যাক্সির উপরে জড়ানো ওড়নার এক প্রান্ত চোখে গুঁজে দিয়ে ফোঁপাতে লাগলেন উনি।

কিন্তু আরশি তো আজকে পণ করেই বসেছে যে কোনও কথাই সে ছাড়বে না। সোজা প্রশ্ন করলো, “৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এইরকম সোজাসুজি মিথ্যা বলবেন না আম্মা... এই ১০ বছরে, আজকের আগে একবারও আমি আপনার বা আপনার ছেলের কোনও অন্যায়েরই কোনও জবাব দেই নাই... নিজের বুকে হাত দিয়ে বলেন তো কয়বার আপনার সাথে বেয়াদবি করেছি আমি?”

মাহতাবকে হাত তুলে তেড়ে আসতে দেখে পরশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। আরশির কথা শুনে আর মাহতাবও থেমে যাওয়াতে এবার আবার শরীরে একটু ঢিল দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মনে মনে একটু হাসল, তৃপ্তির হাসি। সত্যিই তার এই বোনটার নিজেকে রক্ষা করতে কাউকে লাগে না। সে নিজেই যথেষ্ট।

সারোয়ার সাহেব মুখ খুললেন, “আরশি মা!... তুই তো তোর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস... এখন তাহলে আর কথা বাড়াচ্ছিস কেন? শুধু শুধু নিজের আর বদনাম করিস না রে মা...”

এবার ক্যানক্যানে গলায় কথা বললেন নার্গিস আক্তার, “সে তুমি যাই বলো না কেন বৌমা! এইরকম করে স্বামীর সাথে কথা বলাটা কোনও ভালো ঘরের মেয়ের কাজ না! এই আমার বাচ্চা হয় না বলে আমি আমার স্বামীরে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি পর্যন্ত দিসি!... কথায় বলে মেয়েরা সব জিনিসের ভাগ দিতে পারে কিন্তু স্বামীর ভাগ দিতে পারে না কাউরে! আমি তাও করসি! শুধু তাঁর সুখের জন্য...স্বামীর পরিচয়ই একটা মেয়ের আসল পরিচয়!... স্বামীর সুখেই স্ত্রীর সুখ! আর তুমি কিনা তোমার স্বামীরে থ্রেট দিতেসো!... এইটা কোনও কথা! সে তো তোমার গায়ে হাত তোলেও নাই! তুলতে গেসিলো...”

আরশি একদম গুণে জবাব দিয়ে দিলো তাঁর বক্তব্যের, “এটা কি বললেন আন্টি? আমি মরলে কি অন্য কারও নামে জানাজা পড়বেন আপনারা? নাকি আরেকজনকে কবরে নামাবেন? নাকি আঙ্কেল খাওয়াদাওয়া করলে আপনার আর খাওয়া লাগে না? আঙ্কেলের পেট ভরলেই আপনার পেট ভরে যায়?... আপনার মেরুদন্ড নাই থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে কারোরই থাকবে না, এটা আশা করা কি ঠিক, আন্টি?” মহিলা নিজের মহত্বের বয়ান একটু দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেই জায়গায় যে কেউ এইভাবে মুখে ঝামা ঘষে দেবে, সেটা বোধহয় আশা করেন নি। অপমানে কালো হয়ে গেলো উনার মুখ।

নাহার বেগম আর একবার শেষ চেষ্টা করলেন, “কিন্তু মা! তোমার স্বামী-শাশুড়ির চাওয়াটা তো আর ভুল না! তুমি না মানলেই তো আর হলো না! কিন্তু সমাজ বলে তো একটা কথা আছে তাই না? একটা ছেলে হইলে সেটাকে এখনও সমাজ একটা শক্তি হিসেবেই দেখে পরিবারের জন্য... তোমার বয়স কম, এখন তোমার কাছে জরুরী না মনে হতেই পারে... কিন্তু তোমার এই মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তখন তুমি কি করবা? কে দেখবে তোমারে? সমাজের সব কথাই তো আর উড়ায় দেয়ার মতো না... আর তুমি একলা চাইলেই সমাজ বদলায়েও যাবে না... ছেলে আর মেয়ে কখনও সমান হয় না রে মা! সমাজ কখনোই সেটা মানবে না...”।

ডান হাত দিয়ে কপালটা একবার ঘষলো আরশি। বলতে শুরু করলো, “আন্টি! আমি যে এনজিও-তে কাজ করি, সেটা এই বাংলাদেশে কাজ করছে আজকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে। তো এদের একদম শুরুর দিকের একটা প্রোজেক্ট ছিলো... অনেক সচেতনতামূলক প্রোজেক্টই তো থাকে!... সেইরকমই একটা... পায়খানায় যাওয়ার পরে পশ্চাতদ্দেশ ধুয়ে এসে হাত ধোওয়া... ছাই হোক আর সাবান হোক... সেটা দিয়ে হাত পরিষ্কার করা... আপনারাও নিশ্চয়ই ওই মীনা কার্টুন বা ওই রকম কিছুতে দেখেছেন! বিটিভিতে দেখাতো... ছোট নাটিকায়... তো আমি যেটা বলতে চাচ্ছি... আমাদের পুরাতন বয়স্ক কলিগদের মুখে শুনেছি... প্রত্যন্ত অঞ্চল, অজপাড়া গাঁ এলাকায় ঐ সময়েও কিন্তু কিছু মানুষ ছিলো যারা বলতো, বাপ-দাদা চৌদ্দ গুষ্টি কি সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে থাকে নাই? তারা কি মরে গেছে? তারা কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা আমাদের শিখায় নাই যে আপনাদের থেকে আবার শিখতে হবে? ... অথচ আমরা এখন সাবান তো সাবান... হ্যান্ড ওয়াশ আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের যুগে বাস করছি... মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে... অবশ্য সেই সাথে চটপটি-ফুচকাও খাচ্ছি!... তো সে যাক... ওই রকমই কিছু মানুষ কিন্তু এখনও আছে যারা করোনা মহামারীর সময়েও বুক ফুলিয়ে বলেছে, আমার গ্রামে, আমার পাশের গ্রামে, আমার নানার গ্রামে কেউ মাস্ক পরে নাই... আমি কি মাস্ক পরে মরবো নাকি?... তো তাদের কথাতে কিন্তু মাস্কের প্রয়োজনীয়তাও কমে নাই বা মহামারীও তার মানুষ মারার কাজ থামায় রাখে নাই... এই রকমই... যে সমাজের কথা আপনি বলছেন, সেটা অনেক কিছুই মানে আবার অনেক কিছুই মানেও না... তার মধ্যে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা বিচার করার বুদ্ধি যদি আমরা সবাই শিকেয় তুলে রেখেই দিতাম, তাহলে আমরা এখনও ডাইনোসরের যুগে বসবাস করতাম... মেয়েরা সমস্ত ক্ষেত্রে সাফল্যে ছেলেদের ছুঁয়ে যাচ্ছে শুধু না, ছাড়িয়েও যাচ্ছে... আর আমরা দুলে দুলে বসে পড়া মুখস্ত করার মতো এক ধ্যানে বলেই যাচ্ছি...সমাজ মানবে না... এঁ এঁ এঁ... আমাদের পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন সমাজ কিছুতেই মানবে না, যুক্তি-প্রমাণ যাক চুলোয়... এঁ এঁ এঁ...”।

এই অকাট্য বিকট সত্যের মুখোমুখি হয়ে এবার ঘরে উপস্থিত লোকজন সকলে তওবা কেটে জিভে ছিটকিনি দিলেন। আর কোনও সমঝদারি দেখাতে যাওয়ার সাহস করলেন না কেউ।

চোখের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে একবার নাকটা টেনে নিয়ে রেহনুমা বললেন, “বাদ দেন ভাবী!... কারে কি বলেন!... আমার বংশ নিয়েও খোঁটা দিলো! বোঝেন না!... নিজের তো দেয়ার মতো বংশ পরিচয় নাই কোনও!... ছোটো বংশের মেয়ের কাছ থেকে এর চাইতে আর বেশি কি আদব-কায়দা আশা করেন, বলেন? আপনারা বরং বাসায় যান... আমার কষ্ট তো নিজের চোখেই দেখলেন... এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে শেষে আপনাদেরও অপমান করবে এই অসভ্য মেয়েলোক...”।

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে রেহনুমার দিকে তাকালেন সারোয়ার সাহেব। কিন্তু চটজলদি কথার পিঠে কথার জবাব দেয়ার অভ্যেস উনার নেই। তাই চুপই থাকলেন। কিন্তু উনার মুখের কথা মাটিতে পড়তে পারলো না আরশি বলে উঠলো, “সে কি কথা!... এই বাসার বউ-শাশুড়ির দাস্তান দেখতে আসছেন উনারা!... বউ কতোখানি খারাপ সেটা পুরো না দেখেই, না জেনেই চলে যাবেন? কক্ষনো না!... বসবেন উনারা... কেউ কোথাও যাবেন না!...”, বলে সবার উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে আনলো আরশি।

এতোক্ষণ পর্যন্ত ওর জবাবের ধার দেখে এই কথাটার প্রতিবাদ করার চিন্তাও আর কেউ মাথাতেও আনলো না। জায়গা থেকেও আর কেউ নড়লো না। নাহার বেগম আর নার্গিস আক্তার ধরাশায়ী হয়েছেন, শারমিন তা দেখে আর নিজের মুখই খুললো না। এমনিতে আরশিকে সে মোটেই দেখতে পারে না। মাস্টার্স পাশ করেও সে কিছু করলো না, ওদিকে আরশি এতো অল্প বয়সেই এতো বড় চাকরি করে, মোটা বেতন পায়, এইগুলো সবই তার গা জ্বলার কারণ ছিলো। ঈর্ষা থেকেই সে আরশিকে বেশ অহংকারী বলে মনে করে। নিজের শাশুরির সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও আজকে আরশি কিভাবে অপদস্থ হয় তা নিজের চোখে দেখতে শাশুড়ির সাথে সেও এসে উপস্থিত হয়েছে এই বাসায়। ইচ্ছে ছিলো সুযোগ বুঝে সেও দুই কথা শোনাবে, কিন্তু ঘরের যা আবহাওয়া, তাতে সেই কথা মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলল সে। মুরুব্বীদেরই মানছে না! ও কিছু বললে আরশি আজকে কাপড়চোপড় নিয়ে ফিরতে দেবে না নিজের ঘরে। অতএব...

আরশি মনোযোগ ঘোরালো ওর শাশুড়ির দিকে আবার, “কি যেন বলছিলেন আম্মা? ওহ... আপনার বংশ গৌরবের কথা!... তা বলেন তো... আমরাও একটু শুনি আজ পর্যন্ত আপনার বাবার বংশ বা আপনার স্বামীর বংশ দেশ ও জাতির কল্যাণে কি কি অবদান রেখেছেন? বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতি-প্রযুক্তি-বিজ্ঞান... কোন সেক্টরে উনাদের কেমন কন্ট্রিবিউশন? আমাদেরও বলেন! আমরাও একটু শুনি!... আমার মেয়েরা বড় হলে ওদেরকেও তো আমার জানাতে হবে, তাই না! কয়জন আইন্সটাইন, কয়জন রবীন্দ্রনাথ, নজ্রুল, জীবনানন্দ... কয়জন মাদাম কুরি... কয়জন সূর্যসেন... কয়জন ডক্টর ইউনুস... কয়জন রুনা লায়লা জন্ম নিয়েছেন আপনার বংশে? আপনার এই বংশ গৌরবের পেছনেও অবশ্যই কোনও না কোনও কারণ আছে, নাকি? খাওয়া, ঘুম আর বংশবৃদ্ধি ছাড়া উনাদের আর কি কন্ট্রিবিউশন... আমাদেরও একটু বলুন!...”

***

(এর পরে শেষ অংশ)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational