ছায়ানট
ছায়ানট
গোপালপুরে বাস থেকে নেমে একটা গোরুর গাড়ি ভাড়া করে তা'তে চেপে বসল ।
হুরররর হাট হাট হাট । বলদ দুটো মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিল তারা অলরেডি চলতে শুরু করেছে।
বৈশালী এবং রমাদি ছইয়ের ভেতর গল্পগুজব করছে।
- জানো ছোড়দি !
রমাদি বলে - তোমার দাদা ( ভবতারণ ) আজকাল আমাকে কোথাও যেন এড়িয়ে চলে ।
বৈশালী বলে - সে কি কথা বৌ ! এ তো ভালো লক্ষণ নয়।
মাধবকে দেখেছিলাম সেও কেমন যেন মনমরা হয়ে বাড়ির বাইরে পড়ে থাকত । কথা বললে হুঁ বা না ছাড়া আর কিছুই বলত না । তারপরই তো অমন সোমত্ত জোয়ান ছেলে মরে গেল ।
- শুভ শুভ বল ছোড়দি । এমন কথা মুখে এনো না । মাধবদার সাথে যা ঘটেছে তার একটা উদ্দেশ্য ছিল ।
- জানি তো ! ওই বেটি শ্বশুর ছোঁড়াটাই তো ওকে সরিয়ে দিয়েছে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করতে !
রমাদির পেটে কথা থাকে না । যতক্ষণ না তা বেরিয়ে আসে ; পেটটা গুড়গুড় করে । ফস করে বলেই ফেলল - সেটা জানতেই তো আসা !
বৈশালী চোখ কপালে তুলে বলে - সে কি ? এখন আমরা কি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি না কি ?
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে রমাদি বলে - দূর বোকা মেয়ে । আমরা তো গোপালপুরে এসেছি গো ! তোমার শ্বশুর বাড়ি এদিকে তো নয়!
- নয় ঠিকই। তবে ওনার তো গোপালপুরে দোকান আছে। চা- চপের দোকান ।
হা হা করে হাসে রমাদি । ওই দোকানের চপ তেলেভাজা বিখ্যাত । মুড়ি খেতে চপ বেগুনি পেঁয়াজি নিতে লাইন পড়ে যায় ।
- তার মানে তুমি কি সেখান দিয়ে যেতে চাইছ ?
রমাদি বলে - তা'তে কি হয়েছে ? তোমাকে যে সাজপোশাক পরিয়েছি ; কারও ক্ষমতা নেই তোমাকে চিনে ফেলবে !
বৈশালী বলে - আর মুখটা? মুখে তো কিছু দাও নি গো ! হতভাগা মুখ দেখলেই চিনে ফেলবে। কত সাধ্য করে ওর হাত থেকে ছাড়া পেয়েছি ! জানো, ঠাকুর ঘরে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছিল !
- কেমন করে জানব ছোড়দি ? আমি তখন কি ওখানে ছিলাম ? নাকি তার কোন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে ?
- ও , তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না ?
রমাদি স্বভাবের বশে চুপ করে যায় । বৈশালীর মুখ গোমড়া করে থাকে । তবু রমাদি কোন কথা বলে না ।
বাধ্য হয়ে বৈশালী বলে - তোমার যা ইচ্ছে হয় কর । তবে একটা কথা বলে রাখি ও যদি চিনতে পারে তোমার সাধ্য হবে না ওর হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে ?
গোরুর গাড়ি তেলেভাজার দোকানের সামনে আসতেই রমাদি গাড়োয়ানকে বলে - রোকো রোকো। আমি দোকানে নামব ।
বৈশালীকে বলে দেয় চুপ করে বসে থাকতে । তারপর আস্তে আস্তে দোকানে এসে হাজির হয় ।
- ও ঠাকুর ! কোথায় গেলে ? আমার যে দশটা চপ আর দশটাকার পকোড়া চাই গো !
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন এক পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই প্রৌঢ় । বিগলিত হাসি হেসে বলেন - এই যে মা ! সব গরম আছে। দেব ? না কি নতুন করে ভেজে দেব ?
- ও মা এ যে দাসখুড়ো গো ! কতদিন দেখা হয় না ! কেমন আছ খুড়ো ?
- অঅ রমামা যে ! ভালো আছিস? আমি ভালো নেই মা।
চোখ থেকে কপট কান্নার জল মুছতে মুছতে লোকটি বলেন - ছেলেটা অকালে চলে গেল । ছেলের বৌকে কত সাধাসাধি করলাম ; বাপের বাড়ি যেওনি , আমার তো আর কেউ রইলে না গো ।
- কেন খুড়োয়? বৌ চলে গেল কেন ?
- এদিকে আয় মা । এখানে বস! বলছি দুঃখের কথা।
রমাদি সাহসী মেয়ে । তায় বৈশালী আছে গাড়িতে। গাড়োয়ান অবশ্য চা চপ খেতে ব্যস্ত । আর বলদ দুটো সকালে যা গিলেছে সেগুলো টেনে বের করে জাবর কাটছে।
রমাদি বসল । - বল খুড়ো।
রমাদির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন ওই প্রৌঢ় । কানটা সরিয়ে নিতেই বুড়ো যেন আরও কাছাকাছি হল , যেন এবার চুমু খেয়ে ফেলবেন।
রমাদি বলল - দাঁড়াও খুড়ো, তুমি বস, আমি না হয় দাঁড়িয়ে শুনি ।
- আমি বৌকে বলেছিলুম বাড়ি থেড়ে না যেতে। এমনকি ওকে বলেছিলুম ছেলে গেছে তো কি হয়েছে; আমি তো রইছি। আমি তোমাকে বে' করে নেব ।
রমাদি বলল - আর তুমি তাকে টেনে নিয়ে গেলে ঠাকুর ঘরে সিঁথিতে সিঁদুর দিতে ?
চমকে উঠলেন প্রৌঢ় ।
- তুই জানলি কি করে ?
- তোমার বৌমাটি যে আমার ননদ গো ।
- এ্যা ? তোর আবার বে' কবে হল ? আর হল তো হল ওই মোড়লের ছেলের সাথে !
- আজ্ঞে হ্যাঁ, মোড়ল মশাই আমার শ্বশুর ; ঠিক যেমন তুমি তোমার বৌমাটির শ্বশুর । বলি ভীমরতিতে ধরেছে তোমাকে । তুমি না ওর শ্বশুর ? কোন আক্কেলে মেয়েতুল্য বউকে সিঁদুর পরাতে গেছলে ?
প্রৌঢ় বলল - দেখ মা । ছেলেটা তো গেল । ওইটুকু মেয়ের সারা জীবনটাই তো পড়ে আছে । আজীবন বিধবা হয়ে থিকার চেয়ে ভাবলাম আমিই যদি ওকে বে' করে নিই ; তবে ঘরের বৌ ঘরেই থাকবে আর ওকেও বৈধব্য জ্বালা সইতে হবে না । তাই.........
রমাদি হেসে বলল - তাই জবরদস্তি করে ঠাকুরঘরে নিয়ে গেছলে ? বুড়ো ভাম । তোমার যদি এতই সদিচ্ছা ছিল তবে ওর বিয়ে কোন অন্য পাত্রে দিতেই পারতে । তুমি এখ বিকৃত মনের লোক ।
- রমা !
ঘম্ভীর গলায় বললেন প্রৌঢ়।
- আমাকে চিনিস না ? জানিস আমি কেৎ?
- ঈশ্বরাও নও, দিল্লীশ্বরও নও । তুমি একটা পশু । তা' তোমার ছেলের মানে মাধব জামাইয়ের কি হয়েছিল ?
- হঠাৎ মারা গেল ।
- হঠাৎ ? তেমনি হঠাৎ তুমি মরলে না কেন ?
- রমা ! বড় বাড়াবাড়ি করছিস তুই। নিজেকে মোড়লের ছেলের বৌ বলে আমাকে অপমান করছিস।
- মাধবকে কে এবং কেন মারল আমি জানি। তাই তো বৈশালীকে নিয়ে থানায় এসেছি তদন্ত করাতে ।
চুপসে গেল প্রৌঢ় ।- ছেলে মরল আমার; থানাপুলিশ করবি তোরা ? কি প্রমাণ আছে তোদের কাছে ?
- সে টা পুলিশ বুঝবে । নাও চপের দামটা নাও তো খুড়ো। আমাদের এখন অনেক কাজ ।
প্রৌঢ় প্রভুদাস হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ।রমার পিছু পিছু চললেন বৌমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছু বন্দোবস্ত করা যায় কি না ভেবে ।
বৈশালীর দিকে চেয়ে বললেন - এই কি আমার ছেলের বৌ? না না, হতেই পারে না । সেই মুখ, সেই চোখ আমি খুব ভালো করে চিনি । এ বৈশালী হতেই পারে না । আর হলেও সে তার শ্বশুরের সর্বনাশ করতে যাবে না । আমি তো তার উপর কোন অত্যাচার করিনি !
ঘোমটা খুলে বৈশালী বলল - অনাচার তো করেছ আমার প্রাক্তন শ্বশুরমশাই !
বৈশালীর গলাটা ঠিক চিনতে পেরেছেন প্রভুদাস।
- আমাকে ক্ষমা করে দাও বৌমা। আমাকে রেহাই দাও রমামা। ভুল করেছি। তার শাস্তি তো পেয়েই গেছি। আর নতুন করে কোন শাস্তি দিও না মা ।
রমাদি বলল - তোমার সম্পত্তি স্থাবর, অস্থাবর - সব বৈশালীর নামে করে দিলে আমরা পুলিশে যাব না । কথা দিলাম।
প্রভুদাস কাঁদতে কাঁদতে বললেন - সব লিখে দেব মা, সব লিখে দেব । আমিও কথা দিলাম।
( ক্রমশঃ)
