Sonali Basu

Drama Romance

2.5  

Sonali Basu

Drama Romance

চাঁদের অপেক্ষায়

চাঁদের অপেক্ষায়

5 mins
4.6K


ঋষভের মেসেজটা এসেছে একটু আগে। তারপর থেকেই জানলার পাশে বসে আছি আমি। কুড়িতলার ফ্ল্যাট থেকে গোটা শহরটাকে চাঁদের আলোয় এক মোহময় নগরী বলে মনে হচ্ছে। আজ পূর্ণিমা! পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ গুরু পূর্ণিমা। কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে। এক মোহময়ী স্নিগ্ধ আলো চারদিক আলোকিত করে তুলেছে। কিন্তু এই চাঁদ সেই রাতের মতো মোটেও না। এটা অবশ্য আমার চোখের দৃষ্টি দিয়ে দেখা আলোর কথা বলছি না এটা আমার মনের কথা। আমার মনের এই কথাটা যদি কাউকে বলি তাহলে সে হয়তো আমাকে পাগল ঠাউরাতেও পারে। এই সব বিশেষ রাতে চাঁদের আলো যে কি অপূর্ব শোভা ধারণ করে তা সবাই জানে। তাহলে এই কথা বলার মানে কি?

কিন্তু আমার মন মানে না আর সেই কারণেই আমি প্রতি রাতে আমার ঘরের জানলায় বসে থাকি চাঁদের অপেক্ষায়। প্রকৃতিপ্রেমিক? তা নয়। তবে থাকি অপেক্ষায়! আর পূর্ণ থালার মতো চাঁদের। সবাই জানে প্রতি মাসেই একবার করে অমাবস্যা হয় আর একবার করে পূর্ণিমা। তাহলে মাসের একরাত যদি চাঁদকে নাও দেখা যায় বাকি রাতগুলোতে তো সে হাজির থাকে তা যে সময়ই হোক আর যে চেহারাই হোক না কেন। তাহলে আর হাপিত্যেশ করে বসে থাকার কি মানে সন্ধ্যা হোক বা মধ্যরাত দেখতে তো পাওয়া যাবেই। কিন্তু আমি থাকি পূর্ণ চাঁদের অপেক্ষায় আর তা পুর্নিমার রাতেও অনেক সময় দেখা যায় না। তাহলে? পাগলের প্রলাপ নয় কি?

প্রলাপ থেকে মনকে টেনে নিয়ে আবার মন দিলাম ঋষভের মেসেজে। লিখেছে – সরি। আর একবার কি চেষ্টা করতে পারি না দুজনে মিলে? আমি জানিনা তুমি আমার অপেক্ষায় আছো কিনা আজও তবে দুরাশা যে এখনো আছো। নিজে যা করেছি তাতে তোমার কাছে এখনো কি করে আশা করছি তা নিজেই জানি না। ভেবে উত্তর দিয়ো।

কি উত্তর দেবো আমি? হ্যাঁ নাকি কোন উত্তর দেবো না। কিন্তু নিজের মনকে প্রশ্ন করলে তো দেখতে পাচ্ছি আজও মন ওকে চায়।

ভাবনায় ছেদ টেনে হাতের মোবাইলটার মেসেজ টোন টিং আওয়াজ করে কারো মেসেজ আসার কথা জানান দিলো। মোবাইলটা চোখের কাছে আনতে চোখে পড়লো জয়ন্তীর মেসেজ -কি রে পিয়ালি জেগে আছিস?

উত্তর দিলাম – হ্যাঁ

- আমিও আছি আমার জানলায়

- জানিস আজ ঋষভ মেসেজ পাঠিয়েছে

- কি লিখেছে?

- বলছে আবার নতুন করে শুরু করতে চায়

- তোর কি ইচ্ছে?

- বুঝতে পারছি না। আমার মন এখন দোলাচলে

- আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবো তোর মনের কথাটা খুলে বলে দে

- দেখি

এই আমার এক বান্ধবী যে প্রতি রাতে জাগে আমার সাথে যদিও ভিন্ন ভিন্ন জানলায় আমরা বসে থাকি। কার অপেক্ষায় আমরা?

তখন আমার ক্লাস টেন। স্কুল কোচিং সেন্টারে পড়তে যাওয়া এর বাইরে আর কোথাও পা বাড়ানোর কথাও ভাবতে পারিনা। দু একটা কোচিংএ জয়ন্তী আর আমি একসাথে গেলেও অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ি আমার ছোড়দার কাছে। ছোড়দা পিয়াল তখন সবে অঙ্কে মাস্টার্স করছে। কিন্তু পরীক্ষার আগেআগেই দাদা এক নামী স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলো।

দাদা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে আমি পড়লাম বিপদে। পরীক্ষার বৈতরণী কি ভাবে পার হবো তখন আমার সেটাই চিন্তা। এমন দিনে আমার অভিন্ন হৃদয় বান্ধবী জয়ন্তী বলল “তুই আমার বাড়িতে আয়, আমি যার কাছে পড়ি তাকে অনুরোধ করে দেখবো তোকেও পড়িয়ে দেন কি না। এক বিকেলে স্কুল ফেরত গেলাম ওদের বাড়ি। আমরা পৌঁছানোর আধঘণ্টা পর ওর স্যার এলেন। পরিচয় হল ঋষভের সাথে জয়ন্তীর বাড়িতে। জয়ন্তীর কাছে আমার সমস্যা শুনে বললেন “দেখি তোমার খাতা” স্কুলের খাতা এগিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। খানিকক্ষণ গম্ভীরভাবে উল্টেপাল্টে দেখার পর বললেন “ঠিক আছে তুমিও পড়তে আসবে আর ওর কাছে জেনে নিয়ো কবে কবে ক্লাস। আর একটা কথা আমি কিন্তু ক্লাসে দেরী করে আসা পছন্দ করি না”

শুরু হল পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া। পরীক্ষা এলো পেরিয়ে গেলো এবং তিন মাস পর ফলাফল যখন বেরোল জানলাম আমরা দুই বান্ধবী দারুণ করেছি। পরীক্ষার ফলাফল বেরোনোর পর ঋষভ এলেন জয়ন্তীদের বাড়িতে আমাদের ফলাফল জানতে। সব দেখে উনি খুশি হয়ে বললেন “যাক তোমরা আমার মান রেখেছো। আমি খুব খুশি”

আমি আর জয়ন্তী দুজনেই বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলাম। ঋষভ আবার পড়াতে এলো তবে এবার আমার বাড়িতে। বাবাই ঠিক করে দিলেন। পড়া বেশ এগিয়ে চলল তার সাথে ধীরে ধীরে কবে যে আমার মন ওর পায়ে সমর্পণ করলাম সেটা বুঝতেই পারলাম না। বড়দা প্রিয়ব্রতর স্ত্রী তানিয়াই প্রথম ধরতে পেরেছিল আমার মনের কথা। বলেছিল “তুমি কি ওকে তোমার মনের কথা জানিয়েছো?” লজ্জায় রাঙা হয়ে না বলেছিলাম। সে বলেছিল “এমন ভুল কর না তাড়াতাড়িই জানিয়ে দিয়ো”

সেই রাতের কথাই এবার বলি যার স্মৃতি আজও মনে ঝিনুকের মধ্যে মুক্তোর মতো রয়েছে। সেদিন ঋষভ এসেছে পড়াতে, হঠাৎ লাইট দপ করে নিভে গেলো, লোডসেডিং। আর কপাল গুণে সেদিন আমাদের ইনভার্টার খারাপ। বৌদি মোম ধরিয়ে দিয়ে গেলো আর যাওয়ার সময় কানে ফিসফিস করে গেলো আজই সুবর্ণ সুযোগ। ওদিকে মোমের আলোয় পড়া সম্ভব নয় বলে ঋষভ বলল “তাহলে আজ আমি আসি” আমি বললাম “মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। তাহলে চলুন আমরা বরং ছাদে যাই”

হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে ও বলল “চলো। আজ পূর্ণিমা। তুমি তো এ্যাসট্রোনমি নিয়ে পরবে ভেবেছ। চাঁদের কলঙ্কগুলি কেমন হয় তা দেখবে”

উঠে এলাম ছাদে। নীরস ভৌতবিজ্ঞানের পড়া শুনতে শুনতে খেয়াল করলাম কখন ও চুপ করে গেছে। বেশ মন দিয়ে চাঁদ দেখছি তখন হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তে ওর দিকে ঘুরে দেখি ও গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পুর্নিমার আলোয় ওর চোখে পড়লাম এক অপূর্ব প্রেমাখ্যান যা এর আগে কোনদিন দেখিনি। ফিসফিস করে বলে উঠলো “আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পিয়া” এই কথাটা কানে যেন মৌমাছির গুঞ্জন ভরে দিলো, জড়িয়ে ধরলাম ওকে। ওর ঠোঁট নেমে এলো আমার ঠোঁটের ওপর। খানিকক্ষণ পড় যখন ছেড়ে দিলো তখন আমার সাড়া শরীর জুড়ে এক অপূর্ব ভালোবাসার ভালোলাগা।

এরপর থেকে বেশ এগোতে থাকলো আমাদের ভালোবাসার তরণী। আমার সবথেকে প্রিয় বান্ধবীও জানলো আমাদের ভালোবাসার কথা। এর মধ্যে আমরা স্কুল জীবন শেষ করে কলেজে প্রবেশ করলাম। ঋষভ চাকরি পেয়ে চলে গেলো দিল্লী। আমি স্থানীয় কলেজে ভর্তি এলাম তবে জয়ন্তী চলে গেলো দিল্লী কলেজে পড়তে। দুজনের সাথেই আমআর যোগাযোগ রয়ে গেলো ফোনের মাধ্যমে।

কিন্তু কথায় আছে চোখের বাইরে গেলেই মনের বাইরেও চলে যায় মানুষ। একেবারে ঠিক। দূরত্বের কারণে কি না জানি না জয়ন্তী আর ঋষভ খুব কাছাকাছি চলে এলো আর আমি দূরে সরে গেলাম। যখন জানলাম সেই রাতে আমার চোখে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এসছিলো। যে নিজে ভালোবাসার অঙ্গীকার করেছিলো সে এভাবে ভুলে যেতে পারে ভাবিনি। জয়ন্তীকে একটাই কথা বলেছিলাম “পারলি তোর বান্ধবীকে এরকম দাগা দিতে? তুই তো আগেই চিনতিস ঋষভকে, ভালোই যদি বেসেছিলি তো ওকে আগে জানালিনা কেন? তাহলে আমি এগোতাম না” অবশ্য ভালোবাসা এরকমই কখন এক জায়গা থেকে সরে আরেক জায়গায় বাসা বাঁধবে জানা থাকে না। কিন্তু এ আঘাত আমাকে একেবারে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো। নিজেকে গুটিয়ে আমি ঘরের কোনায় আশ্রয় নিলাম। পড়াশোনা আর হবে কিনা সেটাই সন্দেহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

অনেক চেষ্টায় যে আমি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি এটাই অনেক বড় কথা। ভালো চাকরিও বাগিয়েছি। চাকরি জীবনের সহকর্মী একজন দুজন এগিয়ে আসার চেষ্টা করেছে কিন্তু আমি আজও এগিয়ে যেতে পারছিনা। প্রথম ভালোবাসা আজও মনের মধ্যে ব্যথা দেয়।

কিন্তু আমার কথা জয়ন্তীর মনে বা ঋষভের মনে কি দাগ কেটেছিল আমি জানি না। শুনেছি দুজন যত তাড়াতাড়ি কাছে এসেছিল তেমনই তাড়াতাড়িই সরে গেছে। আজ ঋষভের মেসেজ এসেছে কিন্তু আমার মনে সেই পূর্ণিমার রাত আজও ঝলমল করছে। আসবে কি সেই রাত আবার আমার জীবনে? সেই উত্তরের অপেক্ষায় আমি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama