Rinki Banik Mondal

Romance Tragedy

2.5  

Rinki Banik Mondal

Romance Tragedy

বসন্ত এসে গেছে

বসন্ত এসে গেছে

6 mins
664


---------"এই ওড়নাটা তুমি কেন বের করেছ? এটা আমার খুব শখের ওড়না। যাও রেখে এসো বলছি। এক্ষুনি রেখে এসো।"


---------"কিন্তু মাম্মাম, এরকম একটা ওড়নাই তো আমার চাই দোলের দিন নাচের অনুষ্ঠানে। তোমার আলমারিতে দেখতে পেলাম,,,তাই,,,"


---------"আর একটাও কথা নয়। যাও গিয়ে রেখে এসো। আর কোনোদিনও আমার জিনিসে হাত দেবে না।"


সুতপার গম্ভীর গলার স্বরে মিমির দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ওকে কি আর জানতো, আলমারি থেকে সাতরঙা এই ওড়নাটা নিয়ে এলে ওর মা খুব বকাবকি করবে! সাত বছরের ছোট্ট মিমির আজ খুব কষ্ট হয়েছে মায়ের কথা শুনে। সুতপা কোনোদিনও এর আগে এরকমভাবে কথা বলেনি ওর সাথে। কিন্তু আজ যে সুতপার কি হল, তা যে মিমির ছোট্ট মনটা বুঝতে পারছে না। মায়ের কাছে বকা শুনেই মিমি দৌড়ে ঘরে চলে গেল ওড়নাটা রাখার জন্য। তবে মিমি চলে যাওয়ার পর সুতপাও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ও মিমিকে বকতে চাইনি, কিন্তু ওর যে আজ কেন মাথাটা গরম হয়ে গেল ও জানেনা।


সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই রান্না করা, বাসনমাজা, অভিকের জন্য টিফিন করা, অভিকের অফিসের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, বাজার-হাট, অসুস্হ শাশুড়িমার দেখাশোনা, মিমিকে সময়মত স্কুলের জন্য তৈরি করা, যদিও আজ মিমির স্কুল ছিল না, তবুও রোজই এরকম হাজার কাজের রকমারিতে নিজেরই খেয়াল রাখার সময় পায় না সুতপা। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব ওকেই করতে হয়। কাজের লোক অবশ্য একজন আছে, তবে তাকে দিয়ে বলে কাজ করানোর থেকে নিজেরই আগে কাজ হয়ে যায় সুতপার। দুপুরবেলা মিমিকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সুতপাও সবে চোখের পাতা দুটো এক করছে, ব্যস্, অমনি কলিংবেলের আওয়াজ! এই ঘরদুপুরবেলা বাড়িতে কে আসল এই ভাবনা নিয়েই ঘুম ফেলে সুতপা ছুটল সদরদরজার দিকে।


----------"কি গো ঘুমাচ্ছিলে নাকি?"


----------"না না। এসো ঘরে এসো।"


----------"না গো এখন ঘরে যাব না। শোনো যার জন্য আসা, এই সোমবার, আমরা একটা গাড়ি ঠিক করেছি। শান্তিনিকেতন যাব বসন্ত উৎসবে। মানে আমরা মহিলারাই এর উদ্যোক্তা। তা যদি তোমার সময় হয় তুমিও যেও আমাদের সাথে মেয়েকে নিয়ে। তবে আমরা মহিলারই শুধু যাব। পুরুষ 'নট অ্যালাউড'। আজকে সন্ধ্যেবেলা একটা মিটিং বসবে, তাতাইদের ছাদে। ওখানে চলে এসো কেমন,এখন আসি।"


পাড়ার তনিমাদির কথাগুলো শোনার পরই এক আশ্চর্যরকমের অনুভূতি যেন সুতপাকে ছুঁয়ে গেল। সদর দরজাটা কোনোরকমে বন্ধ করেই সুতপা ছুটে এসে নিজের ঘরের আলমারিটা থেকে সেই সাতরঙা ওড়নাটা বের করলো। ওড়নাটাকে বুকে আগলে ধরে আজ ও হাউমাউ করে কাঁদছে। মনে পড়ছে ওর আজ থেকে দশ বছর আগের কথা।


বাবা মার একমাত্র মেয়ে ছিল সুতপা। কিন্তু একমাত্র মেয়ে হলে কি হবে, সুতপার কোনো কথাকে ওর বাড়িতে গুরুত্ব দেওয়া হত না। কলেজের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ না হতেই চলল সুতপার জন্য সম্বন্ধ দেখা ওর মতের বিরুদ্বেই। কিন্তু ততদিনে সুতপার মনে থাকা ভালোবাসার রঙিন ফুলগুলো যে মালা গাঁথতে শুরু করেছে। 


একবার কলেজ থেকেই কয়েকজন বান্ধবী মিলে সুতপারা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবে গিয়েছিল। সেখানেই সুতপার সাথে পরিচয় হয় আবীর সান্যালের। প্রথম দেখাতেই সুতপার গালে আবীরের ছোঁয়া লেগেছিল। দোকান থেকে একটা রঙিন ওড়নাও কিনে দিয়েছিল সুতপাকে।ছেলেটি খুব ভালো গান করে। সেইবার আবীরের গানের সুরে সুর মিলিয়েছিল সুতপাও। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের শুরু, তারপরে প্রেম। আবীর কলকাতারই ছেলে। তাই সুতপার সাথে যোগাযোগের কোনো অসুবিধে ওর হয়নি। সুতপা আর আবীর ওদের সম্পর্কের কথা নিজেদের বাড়িতে জানায়। আবীরের বাড়িতে সুতপাকে মেনে নিতে চাইলেও সুতপার বাড়িতে আবীরকে মেনে নেয়নি। বরঞ্চ সুতপার মা বাবা আবীরকে বাড়িতে ডেকে যা নয় তাই বলে অপমান করে। আবীর তখন সবে কলেজ পাশ করেছে। বিয়ের জন্য চাকরী খুঁজতে ব্যস্ত। কিন্তু সুতপার মা বাবা কিছুতেই একটা গানওয়ালা বেকার ছেলের কাছে সুতপাকে তুলে দিতে রাজি নয়। মা বাবার সম্মান রাখতে সুতপা বাড়ি থেকে পালানোর কথা ভাবেনি। আবীরও চায়নি যে ওদের বিয়েটা পালিয়ে হোক। ভাগ্যের ওপর ওদের সম্পর্কটা ছেড়ে দিয়েছিল। আর সেই ভাগ্যের পরিহাসে সুতপার বিয়ে হয়ে যায় ধনী পরিবারের ছেলে অভিকের সাথে। 


অভিকের বড় মার্বেল পাথরের ব্যবসা। ব্যবসার থেকে বড় ওর কাছে আর কিছু নেই। স্ত্রীর প্রতি ওর দায়িত্ব কর্তব্য আছে ঠিকই তবে সেটা টাকায় ভরানো। সুতপাকে দামী শাড়ি, দামী গয়না কিনে, একটু আদর দিয়ে ভরাতে পারলেই অভিক ভাবে ওর কর্তব্য পালনে কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু সুতপা যে এরকম অগোছালো সুখ কোনোদিনও চায়নি। তাও নিজেকে ও মানিয়েছে। বিয়ের দুবছরের মাথায় সুতপা একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। নাম রাখে মিমি।


আজ দশবছর পর অতীত যে কেন ওকে কাছে টানছে তা সুতপা জানে না। বিয়ের দশবছরের মধ্যে অভিক সুতপা আর মিমিকে দেশে বিদেশের অনেক নামিদামী জায়গাতেই ঘোরাতে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো জায়গাতে ঘুরেই সুতপার মনের শান্তি হয়নি। কিন্তু আজ শান্তিনিকেতন নামটা শোনার পর মনের শান্তিটা যেন হাতছানি দিয়ে গেল। এবার সুতপা ঠিকই করে ফেলে বসন্ত উৎসবে মিমিকে নিয়ে শান্তিনিকেতন যাবে পাড়ার অন্য সকল মহিলাদের সাথে।


আজকের হোলির উৎসবটা যেন সুতপার কাছে একটু অন্যরকম, ঠিক দশবছর আগে একটা দিন যেরকম কেটেছিল। কিন্তু সেই সময় যে মনের মানুষটা কাছে ছিল, আজ সে কাছে নেই। হয়তো যেখানে আছে ভালো আছে, সেও হয়তো অন্য কাউকে নিয়ে সুখে সংসার করছে। এইসব ভাবনাগুলিই বারবার মনটাকে উথাল পাতাল করে দিচ্ছে সুতপার। যদিও এগুলো ঘটে চলেছে মনের খুবই গভীরে। এর খোঁজ কেউ কোনোদিনও পাবেনা। এই ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করা মানে তো নিজেরই ক্ষতি। সমাজ আঙুল তুলবে। অভিক গুণাক্ষরেও যদি টের পায় হয়তো সংসারটাই ভেঙ্গে দেবে, আর মিমি, সেই ছোট্ট মেয়েটার কি দোষ! ওর মা যদি চরিত্রহীনা হয় তাহলে যে ওকেও এই সমাজ একঘরে করে দেবে। এ তো কখনই হতে দিতে পারে না সুতপা। তাই গোপন কথাগুলো মনের ভেতর তালা বন্ধই থাক।

মিমিকে আজ অনেকবার আসতে বলেছিল সুতপা, কিন্তু সে আজ তার নাচের স্কুল নিয়ে ব্যস্ত‌। অগত্যা সুতপাকে একাই আসতে হয়েছে পাড়ার অন্যান্যদের সাথে।


সকলে যখন বসন্ত উৎসবে হোলি খেলতে ব্যস্ত তখন সুতপা বসে রয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছের নীচে। ওর পরনে আজ সাদা জামদানী, আর কাঁধে সেই আবীরের দেওয়া রঙিন ওড়নাটা। ও এখানে বসেই বড় শান্তি পাচ্ছে। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে শুধুই আবীরের বর্ষণ। আবীর?? এ কি কান্ড! আজ দশবছর পর এ কাকে দেখছে সুতপা! আবীরের বর্ষণে যে সেই জলয্যান্ত আবীর সান্যাল। আবারও ওদের দেখা হল শান্তিনিকেতনের এই বসন্ত উৎসবেই। আবীরের সাথে কথা বলা ঠিক হবে কিনা এই ভাবনাতে যখন সুতপা ডুবে রয়েছে, তখন আবীরই কথা শুরুর প্রথম সিঁড়িতে পা দেয়।


---------কেমন আছ সুতপা?


---------"আমি ভালো। তুমি কেমন আছ?"


---------"খুব ভালো। তা তোমার বর আর মেয়ে সাথে আসেনি?"


---------"না, কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমার মেয়ে,,,,"


---------"আরে জানি, জানি। এইটা না জানার কি আছে?"


---------"তুমি তারমানে,,,,,,না মানে তুমি এখনো বিয়ে করোনি?"


---------"করেছি তো। কবেই বিয়ে হয়ে গেছে আমার।"


----------"ওহ্। তা তোমার বৌ, ,"


---------"এইখানেই আছে।"


---------"তা তুমি এখানে,,,"


---------"প্রত্যেকবারই আসি। আমার সেই চিরসঙ্গী গানের জন্যই আসা। এবারেও তাই।"


--------- "ও,,,"


---------"চলি তাহলে,,,,ভালো থেকো।"


না, এর থেকে আর বেশি কথা আবীর সুতপাকে বলতে পারেনি। তবে সুতপা আজ আবারও আবীরকে দেখতে পেরেছে। এইটুকুনিইতে ও খুশী। তবে আবীর সান্যাল কিন্তু আজ সুতপাকে সবটা সত্যি বলে যায়নি। সুতপাকে হারানোর পর আবীর আর বিয়ে করেনি। বিয়ে তো ওর সেদিনই প্রথম হয়েছিল, যেদিন ও প্রথম দেখাতেই সুতপাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। ওর গালে আবীর মাখিয়েছিল। সুতপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ও গান বাজনাকে আরো বেশী করে আপন করে নিয়েছে। এটাই ওর সঙ্গী। প্রত্যেকবছর এই বসন্ত উৎসবে ও শান্তিনিকেতনে আসে, নিজের হারানো ভালোবাসাকে আবার নতুন করে খুঁজে পেতে। এই দশ বছরে সেই ভালোবাসার দেখা ও পায়নি। কিন্তু আজ পেয়েছে। আবীর আজ সুতপাকে দেখেই ভালোবাসার জয়গান বেঁধেছে। দশ বছর আগের দেওয়া রঙিন ওড়না আজও সুতপা আগলে রেখেছে দেখেই ও খুশি।


সুতপা জানে না, আবীরের মনে ওর জন্য ভালোবাসা এখনো রয়েছে। তবে সব ভালোবাসা কি আর পরিণতি পায়! সুতপা জানে আবীর সুখী আছে নিজের পরিবার নিয়ে। সেই ভেবে সুতপাও খুশী। আবীরের মত ছেলেরা যে সব সময় সুতপাদের খুশীতেই রাখতে চায়। গাছের গোড়ায় পড়ে থাকা একমুঠো আবীর নিয়ে সুতপা আজ নিজেই নিজের গালে মাখলো, গান ধরলো-


আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা

কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে


মধুর অমৃত বাণী, বেলা গেল সহজেই

মরমে উঠিল বাজি; বসন্ত এসে গেছে


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance