বৃত্তের বাইরে পর্ব ছাব্বিশ
বৃত্তের বাইরে পর্ব ছাব্বিশ
পর্ব ছাব্বিশ
দ্বিপ্রাহরিক ভোজন শেষে সমাপ্তি যখন নিজের রুমে বসে বাগানের দিকে আনমনে চেয়েছিল ; তার মোবাইলে অবিরাম ম্যাসেজ আসছিল ।
রাজদীপের সঙ্গে কথা হয়েছিল যে এভাবে বেশীদিন আর চালানো সম্ভবপর নয় ; সুতরাং রাজদীপকে এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি করবে ।
সম্পাতি তার আপন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল । সে যে কোন দিন যে কোন মুহুর্তে ওর বাড়ি গিয়ে উঠবে । তাই নিয়ে আনমনা ছিল ।
যে বাগানের দিকে ফিরেও চাইত না সম্পাতি, আজ সেই জনশুন্য বাগানই তার কাছে পরম মিত্র বলে মনে হল । জানালার নিকটস্থ আমগাছের ডালগুলো কেটে দেওয়ার জন্য ফুলের বাগানটা স্পষ্ট দেখা যায় ।
মোবাইলে যে এত ম্যাসেজ আসছে - বিভোর হয়ে থাকায় সম্পাতি তার টুংটাং শব্দগুলো খেয়াল করেনি । ম্যাসেজগুলো যে রাজদীপ পাঠিয়েছে তা' দেখেছিল ঘটনা ঘটে যাবার পর ।
রাজদীপ দুপুর বেলায় চলে এসেছিল ব্যানার্জী ভিলায় । ফোন না করে ভিলার অদূরে দাঁড়িয়ে ম্যাসেজ করছিল ।
সম্পাতির থেকে তার কোন জবাব না পেয়ে দশ ফুটের পাঁচিল টপকে বাগানে নেমে গেল । ভেবেছিল সম্পাতি জানালায় থাকলে অবশ্যই দেখতে পাবে ।
সম্পাতি জানালার পাশে ছিল ; কিন্তু এত আনমনা এবং রাজদীপের স্বপ্নে বিভোর ছিল যে বাগানের ফুল গাছ ছাড়া অন্য কিছু তার নজরে আসেনি ।
বামুন বউ খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিতে যাবে হঠাৎ শুনতে পেল বাগানের দিক থেকে যেন দুপদাপ আওয়াজ আসছে । শম্ভু বাড়ি গেছে । এই সময়ে সে রোজ বাড়ি যায় । খাওয়া দাওয়া করে বাড়ির সকলে উপর তলায় চলে গেছেন ।নীচে বামুন বউ একলা রয়েছে । তার ভয় করতে লাগল ।
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল শহর । দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য । তা ছাড়া বাগানের দিকেই তো কারখানার বর্জ্য ফেলে ডাই করা আছে । ওখানেও নানান কীর্তিকলাপ চলে । মাঝে মাঝেই গুলিগোলার শব্দ পাওয়া যায় ।
বামুন বউ দেখল এ শব্দ যেন অন্য রকম । পাঁচিল থেকে ঝাঁপ দেওয়ার মত মনে হল । তার অর্থ নির্ঘাৎ কেউ বাগানে ঢুকেছে । বেশ কিছু সেগুন এবং দু'চারটে চন্দন গাছও আছে ।
বামুন বউয়ের ধারণা হল হয়ত চন্দন কাঠ চুরি করতে কেউ নেমেছে ।একলা মেয়েছেলে জানালা খুলতে সাহস করল না । আবার উপরেও যেতে পারছে না - সেখানে তো না ডাকলে যাওয়া যায় না !
তথাপি যাবার মনস্থ করে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই সম্পাতির মুখোমুখি পড়ল ।
- এই যে মামণি ! খুব আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগল বামুন বউ ।
- শুনছ ! বাগানে চোর এসেছে গো ! মনে হয় চন্দন চুরি করতে এসেছে !
সম্পাতি বলল - ধ্যেৎ ! এই ভরদুপুরে চোর আসে নাকি ? তুমি ভুল শুনেছ । যাও দেখি বিশ্রাম নাওগে ! আমি দেখছি কেমন চোর ।
বামুন বউ খপ করে ওর হাত ধরে বলল - খবরদার যেওনি গো ! ওরা খুব খারাপ লোক । চল উপরে চল, বৌদিমণিকে বলে আসি ।
সম্পাতি বড় বিপদে পড়ল । কি করে বলে যে ও চোর নয়, তার অতি প্রিয়জন । বলল - যা বলছি শোন । মাকে খবর দেবার প্রয়োজন নেই । এই মাত্র ঘুমিয়েছে । তুমি যাও । আমি দেখছি ।
বামুন বউ বলল - তোমাকে আমি একা যেতে দেবনি । চল আমিও সঙ্গে যাই ।
সম্পাতি কিছুতেই রাজী হয় না ; বামুন বউও জেদ ধরে ।
- একলা তোমাকে ছেড়ে দিয়ে যদি কোন বিপদ হয় ; কি জবাব দেব দাদা বৌদিমণিকে ! না না, তোমার একা যাওয়া চলবেনি । আমিও যাব ।
সম্পাতি ভীষণ ঝকমারিতে পড়ে গেল । রাজদীপ তাকে নিতে এসেছে । কেন যে ওর ম্যাসেছগুলো দেখিনি !
মুখ গোমড়া করে ভারী গলায় বলল - বামুন মাসী ! তোমাকে বলছি না - বিশ্রাম নাওগে ! আমি দেখছি ।
সম্পাতিকে ভালো করেই চেনে বামুন বউ । নিজের জেদে অনড় । এমনকি মা বাবাকেও ছেড়ে কথা বলে না । ভয়ে বিস্ময়ে পিছিয়ে গেল বামুন বউ । বলল - সাবধানে কিন্তু !
সম্পাতি তা গ্রাহ্য না করে সদর খুলে বেরিয়ে গেল । বাগানের গেটের চাবিকাঠি নিয়ে গেট খুলতে যাবে রাজদীপ বলল - শম্ভু আসছে, , বি কুইক ।
সম্পাতি বলল - শম্ভুদা এখন তার বাড়িতে। তথাপি
শম্ভুর নাম শুনে সম্পাতির হাত থেকে চাবিটা পড়ে গেল । আবার তা' তুলে গেট খুলে দেখে রাজদীপ নেই । এদিক সেদিক চেয়েও রাজদীপকে দেখতে না পেয়ে হাল্কা সুরে ওকে ডাকল ।
শম্ভু বলল - দিদিমণি গো , পালিয়েছে ।
সম্পাতি এবার সত্যিই চমকে উঠল ।
শম্ভু বলল - কি ব্যাপার দিদিমণি ! তোমার উদ্দেশ্য তো ভালো মনে হচ্ছে না ! দাঁড়াও ম্যা'মকে ডেকে আনি । স্যারকেও বলি ।
সম্পাতি তখন ঠকঠক করে কাঁপছে । এখন যদি এই অবস্থায় বাবা মা দেখতে পায় তবে কপালে অশেষ দুঃখ ভোগ আছে ।
বলল - তুমি কি করে জানলে রাজদীপ পালিয়েছে।
শম্ভু বলল - এ তো জলের মত সোজা । আমাকে দেখতে পেয়েছিল যে ! আমিও তো দেখে ফেলেছি । ভেবেছিলাম বাগানের ভেতরে হাতে নাতে ধরব - তা' আর হল না ।
তবে পালিয়ে যেতে পারবে না । ও নিশ্চয় টেন্টে লুকিয়েছে । চল দেখে আসি ।
টেন্টের ভেতরে ঢুকে সলজ্জ রাজদীপকে দেখে সম্পাতি হেসে ফেলল ।
- এত ভীতু তুমি ? জানতাম না । আরে ও আমাদের শম্ভুদা । ভীষণ ভালো মানুষ । বেরিয়ে এস। শম্ভুদাই আমাদের হেল্প করবে ।
তারপর শম্ভুর দিকে চেয়ে বলল - তাই না শম্ভুদা ?
সম্পাতি রাজদীপকে বলল - পকেটে কত আছে ?
রাজদীপ বলল - দু' লাখ ।
সম্পাতির কানের কাছে মুখ রেখে বলল - ব্যাগে গয়নাগাটি আর নগদ মিলে প্রায় পঞ্চাশের মত আছে ।
সম্পাতি বলল - পকেটের বাণ্ডিলটা দাও ।
রাজদীপ সম্পাতির কথামত দু'হাজার টাকার বাণ্ডিল ওর হাতে তুলে দিল । সম্পাতি শম্ভুর হাতে বাণ্ডিলটা গুঁজে দিয়ে বলল - পুরো দু'লাখ দিলাম । খুশী তো ?
শম্ভুর মত চরিত্রবান মানুষও হাতের মুঠোয় দু লক্ষ টাকা পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ল । মনে মনে হিসেব মিলিয়ে নিল - মাইনা এবং পুরস্কার মিলে দু'লক্ষ পেতে অন্তত দু'বার জন্ম নিতে হবে ।
সম্পাতিকে বলল - মাত্র দু'লাখ ? ওকে বল ব্যাগটাও দিয়ে দিক ; তবে ছেড়ে দেব ।
রাজদীপ ভয়ে কাঁটা হয়েছিল। বিভূতিভূষণকে খুব ভাল মত চেনে । মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বিভূতিভূষণকে দুর্গাপুরের ভিখারীরাও জানে । একবার ধরা পড়ে গেলে তার প্রেম তো ছার ; জীবন সংশয়ও হতে পারে ।
ভীত চক্ষে সম্পাতির দিকে চেয়ে রইল । বামুন বউ সেই সব দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দিল ।
- ও বৌদিমণি গো , ও দাদাবাবু গো ! জলদি নেমে এস , তোমাদের মেয়ে .....
সম্পাতি দৌড়ে এসে বামুন বউয়ের মুখ চেপে ধরল । রাজদীপকে বলল - পালিয়ে যাও । নইলে সব শেষ হয়ে যাবে । রাজদীপ আর দেরী করেনি । মোটরবাইক ছুটিয়ে দিল উর্দ্ধশ্বাসে । শম্ভু এবার ক্যাবলার মত ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে রইল ।
বিভূতিভূষণ ও শুভমিতা দেবী চটজলদি উপর থেকে নেমে এলেন ।
' কি হয়েছে কি হয়েছে ' বলে শুভমিতা দেবী বামুন বউকে বললেন - এমন করে চেঁচিয়ে উঠলে কেন বামুনদি ?
বামুন বউ কিছু বলার আগেই শম্ভু দু'লক্ষের বাণ্ডিলখানা শুভমিতা দেবীর হাতে দিয়ে বলল - বড় বাঁচা বেঁচে গেলেন ম্যা'ম । দিদিমণি ওই ছেলেটার সঙ্গে পালাবার মতলবে ছিল । ভাগ্যিস আমি আজ একটু জলদি বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম ...
বামুন বউ বলে উঠল - হতচ্ছাড়া ! তুই তো ঘুষখোর! অতগুলো টাকা পেয়েও কোন লজায় ব্যাগ নিতে চেয়েছিলি ?
বিভূতিষণের মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠল । শুভমিতা দেবী ব্যাপার স্যাপার বুঝতে না পেরে বামুন বউকে বললেন - কি ঘটেছিল বল তো বামুন বউ ?
শম্ভু কিছু বলতে যাচ্ছিল । বাধা দিয়ে তিনি বললেন - তোর কথা পরে শুনব । আগে বামুনদি কি বলছে শুনি !
রাগে বিভূতিভূষণের দুই চোখ জ্বলে উঠল । হাতের মোবাইল নিয়ে কাউকে ফোনে বললেন - রাজদীপ লাহা! চিনিস তো ? সিটি সেন্টারে ' মাঙ্গলিকী' বিয়ের প্রতিষ্ঠানের মালিক ?
কেউ যেন বলল - হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো মত চিনি । রাজশেখর লাহার ছেলে!
- হ্যাঁ। ওকে আমার চাই । আজই এক্ষুণই ।
সম্পাতি কেঁদে ভাসাল । তার কৃত কর্মের ফল যে এ ভাবে হাতে নাতে পাবে ভাবেনি । বেচারা রাজদীপ ! কি যে হবে তার!
নিজের পরিণামের কথা একবারও ভাবল না সম্পাতি । বিভূতিভূষণ নিজের হাতে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলেন ।
( চলবে )

