ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-4- যেন নতুন হাতেখড়ি
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-4- যেন নতুন হাতেখড়ি
ছোড়দিকে ভরতি করিয়ে দেওয়া হল আদর্শ বিদ্যালয়ে। এবার আমার পালা। আমার ভরতি নিয়ে যেন অভিভাবক মহলে একটা সাজো সাজো ভাব। যেন আবার আমায় নতুন করে হাতেখড়ি নিতে হবে। নতুন করে বিদ্যারম্ভ শুরু হবে আমার। আমায় ভরতি হতে হবে কোনও একটা নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সবার অভিমত বিশেষ করে আমার বড়দিদির বরের ইচ্ছে আমি ভরতি হই নগাঁও বাঙালি বয়েজ স্কুলে।
বাঙালি বয়েজ স্কুলেই শিক্ষকতা করেন আমাদের বড়দিদির বর। তিনি ছাত্রমহলের অতি প্রিয় ও পরিচিত একজন অঙ্কের শিক্ষক। আমাদের পিতাশ্রী বহু বছর আগেই বড়দিদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এদেশে। বড়দিদি এতকাল মাতামহ নবীন চন্দ্র রায়ের আশ্রয়ে থেকেই বড় হয়েছে এবং সে স্কুল পেরোনোর পরে পরেই বয়েজ স্কুলের ওই অঙ্ক শিক্ষকের সঙ্গে আজ বেশ কয়েক বছর হল তার বিয়েও সম্পন্ন হয়ে গেছে।
আমরা পূর্বপাকিস্তান থেকে পাকাপাকি ভাবে এদেশে চলে আসার কয়েকদিন পরেই গিয়েছিলাম বড়দিদিদের বাড়ি বেড়াতে। বড়দিদিরা তখন বেঙ্গলি পট্টির ইটাচালি রোডে দুই কামরার টিনশেডের দোচালা একটি ভাড়াবাড়িতে বসবাস করে। বড়দিদিরা ছাড়াও আরও দু'তিনটে পরিবার ভাড়া থাকে ওই আবাসনের ভেতরের দিকের ঘরগুলোতে। অনেকগুলো টিন শেডের ঘর নিয়ে একটা বিশাল আবাসন। আবাসনের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে মস্ত একটা উঠোন বা আঙিনা, আর সেই উঠোনের চারপাশ ঘিরেই টিন শেডের দোচালা ভাড়ার ঘরগুলো। সবারই রান্নাঘর আর শৌচালয় শয়নঘর থেকে অনেকটা দূরে।
বড়দিদির ছেলে হয়েছে। পর পর তিন তিনটি মেয়ের পরে এই প্রথম ছেলে। ছেলে হওয়ায় বড়দিদিরা বড়ই আনন্দিত ও আহ্লাদিত। একমাস মাত্র বয়স হয়েছে সেই ছেলের। আমার তিন তিনজন ভাগিনির মধ্যে বড়জন একেবারে আমার পিঠোপিঠি। যেন আমার বোনের মতো। আমি তাদের সবার ছোটমামা প্রথম দেখাতেই হয়ে গেলাম খুব প্রিয়। মধুর সম্পর্ক একটা তৈরি হয়ে গেল আমাদের মধ্যে।
পূর্বপাকিস্তানে ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়েছি বাংলা মাধ্যমে। অতএব অসমে নতুন করে অসমিয়া মাধ্যমে শুরু করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। ভরতি হতে হবে আমায় বাংলামাধ্যম স্কুলেই। এই শহরে তিনটি বাংলামাধ্যমের স্কুল। তার মধ্যে একটি ছেলেদের এবং আরও একটি মেয়েদের জন্যে। এই দুটো ছাড়া আরও একটা কো-অ্যাড স্কুলও আছে, ছেলে-মেয়ে উভয়েই সেখানে পড়তে পারে। ইতিমধ্যে সেই স্কুলেই ভরতি করানো হয়ে গেছে ছোড়দিকে।
বড়দিদির বর ধরেই নিয়েছেন তার সবচেয়ে ছোট শ্যালক শ্রীমান খোকন, অর্থাৎ আমি খুবই মেধাবী একজন ছাত্র। আমাকে নিয়ে তার গর্বের যেন শেষ নেই। আমায় যে করেই হোক, যে বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করছেন সেখানেই ভরতি করাবেন বদ্ধপরিকর। এবং ওনার স্থির বিশ্বাস বয়েজ স্কুলে আমার ভরতি অনায়াসেই হয়ে যাবে। বড়দিদির বরের মতো বড়দারও তাই ধারণা, বাঙালি বয়েজ স্কুলে অতি সহজেই আমার ভরতি পর্ব সমাধা হয়ে যাবে।
তবে আমার জীবনে কোনওদিনই যে কোনওকিছু সহজে হয়ে ওঠে না। বিস্তর টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল আমার ভরতি নিয়ে। প্রথমে সাদা কাগজে পিতৃদেবের হাতে লেখা দরখাস্ত নিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। ইংরেজিতে লেখা সেই দরখাস্তে গ্রামাটিক্যাল একটা ভুল ধরেছিলেন হ্যাডস্যার। তারপর এল আমার বয়সের প্রশ্ন। পূর্বপাকিস্তানের স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী আমার বয়স নাকি অনেকটাই কম। এদেশের বোর্ডের নিয়ম আনুযায়ী সেই বয়স নাকি গ্রহণযোগ্য নয়। সে না হয় বয়স বাড়িয়ে ম্যানেজ করে নেওয়া গেল। তাহলে আর সমস্যা থাকল কোথায়? আসলে সমস্যা হল আমি ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে এলেও উত্তীর্ণ হওয়ার গ্রহণ যোগ্য কোনও প্রামাণ্য রিপোর্টই নাকি নেই আমার অভিভাবকদের হাতে! ভরতি আমার আটকে গেল। এসব নিয়েই বড়দিদির বরের সঙ্গে সামান্য কিছু কথা কাটাকাটিও নাকি হয়েছিল স্কুলের কর্তৃপক্ষের। শুধু মাত্র হাতে লেখা একটা শংসাপত্রের ওপর ভিত্তি করে আমায় নবম শ্রেণিতে ভরতি নিতে কর্তৃপক্ষের ঘোরতর আপত্তি।
তবুও যার শেষ ভালো তার সব ভালো। আমার ইনটারভিউ নিয়ে হ্যাড স্যার খুবই সন্তুষ্ট। অনেক টানাপোড়েন অন্তে অবশেষে ভরতিটা আমার হয়েই গেল। আমি ভরতি হলাম ক্লাস নাইনে।
ভরতির পরে পরেই সব স্যাররাই মেনে নিলেন আমি নাকি সত্যিই একজন ভালো ছাত্র। এমনকি অল্প কয়েকদিনেই বেশ কয়েকজন স্যারের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলাম আমি। রায়বাবু স্যার তো স্নেহভরে আমায় "ময়মনসিংহ" বলে সম্বোধন করতেন। ক্লাসে এসেই এদিকওদিক তাকিয়ে তিনি আমার খোঁজ করে ডেকে উঠতেন, ময়মনসিংহ..ময়মনসিংহ কোথায়? আজ আসেনি ময়মনসিংহ?
আমি হাত তুলে সাড়া দিয়ে বলতাম, স্যার এই যে আমি ময়মনসিংহ!
ক্রমশ... পরবর্তী পর্ব- প্রবাসী হওয়ার পরে

