ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-3- সময়ের প্রতীক্ষায়
ব্রহ্মপুত্র যায় বয়ে-3- সময়ের প্রতীক্ষায়
কয়েক মাসের মধ্যেই এসেও গেল প্রতীক্ষিত সেই সময়। গ্রীষ্মকালও তখন প্রায় শেষের দিকে। তবুও সরষে, ধান, কলাই এসব কৃষিপণ্যের দাম সেরকম কিছুই উঠল না। বাজারে যা দর, বেচতে গেলে কেনা দাম তো দূর, অর্ধেক দামও উঠে আসবে কিনা সন্দেহ। অগত্যা আর কী উপায়? সময়ের এই বিশ্বাসঘাতকতায় কুলকিনারা হারিয়ে দিশেহারা অসহায় অবস্থা যেন আমাদের সকলের।
খবর পেয়ে আমাদের চিরকালের হিতৈষী, সম্পর্কে মায়ের এক মামাতো ভাই, আমাদের মামা এসে হাজির। তিনি আমাদের সকল ভাইবোনদের কাছে প্রিয় রাঙামামা। তিনি পরামর্শ দিলেন বড়দাকে, এক কাজ কর, এগুলো এ বছর না বেচে আগামী মরশুমের জন্যে মজুত রেখে দে। আমার বিশ্বাস আগামী বছর এর ভালো দাম পাবিই পাবি। আসলে কিনতে গিয়েই তোরা ঠগে গেছিস! ব্যবসার লাভ তো কেনার সময়ে, যত কম দামে কিনতে পারবি, তবেই না বেচে লাভ! রূপহি, জুরিয়ার দিকে বহু মুসলমান মহাজন আছে, আমার চেনাজানা। আগে যদি তোরা কথাটা আমায় জানিয়ে রাখতি, আমি তাদের বলে দিতাম, অনেক কম দামে কিনতে পারতি। যাকগে যা হবার হয়ে গেছে, ভালো দাম পেতে গেলে আগামী মরশুমের জন্যে তোদের অপেক্ষা করতেই হবে। লাভের মুখ দেখতে হলে এছাড়া আর কোনও পথ নেই।
মামার কথা মতো অপেক্ষা করতেও দ্বিমত নেই আমাদের কারও। তবে সমস্যা এই, বোরাগুলোকে মজুত করে রাখা হয়েছে পাকা মেঝের ওপরে চটের বস্তা পেতে। একদিকে নিচ থেকে মেঝের ঠান্ডা, তদুপরি সামনেই একটা ভরা বর্ষা, আগামী মরশুম পর্যন্ত বস্তা ভরতি শষ্যগুলো কি আর ভালো থাকবে? হাঁ সেটাও তো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে!
আবারও আরও একটা পরামর্শ দিলেন মামা, তাহলে এক কাজ কর, চারপায়া খুঁটির ওপরে কাঠের ব্যাটান দিয়ে সাত বাই সাত ফুট সাইজের আট ইঞ্চি খানেক উচ্চতার তক্তাপোশ, মানে চকি বানিয়ে নে বেশ কয়েকটা। তারপর দুচারজন দেশোয়ালি ভাই ডেকে তাদের দিয়ে বস্তাগুলোকে সরিয়ে সেখানে চকিগুলোকে বসিয়ে তার ওপর স্তূপ করে রাখলে আমার মনে হয় নষ্ট হওয়ার আর কোনও ভয় থাকবে না। তোদের ঘরগুলো বড়ই আছে, এঁটেও যাবে সব কয়টা চকি।
পরামর্শটা মন্দ নয়। অতএব মেনে নেওয়া হল মামার এই পরামর্শও। বানানো হল আট ইঞ্চির মতো উচ্চতার, সাত বাই সাত ফুট সাইজের নিচু চকি বা তক্তাপোশ বেশ কয়েকটা। যদিও অসম দেশে কাঠ অনেক সস্তা তবুও খরচ একেবারে কম হয়নি। পিতৃদেবের সঞ্চিত টাকার বেশ খানিকটা অংশ আবারও বেরিয়ে গেল।
ডাকা হল ছয় টগবগে জওয়ান দেশোয়ালি ভাইকে। পুরো একটা দিন তারা রাতঅব্দি খেটেখুটে বস্তাগুলোকে সরিয়ে তক্তপোশগুলোকে যথাস্থানে বসিয়ে তার ওপরে সমস্ত বোরাগুলোকে তুলে গুছিয়ে স্তূপ করে তারপরে গেল ফিরে। তাদের ওই অপরিসীম খাটাখাটনির দাম দিতে গিয়েও ব্যয় হয়ে গেল বেশ ভালো পরিমাণ কিছু টাকা।
ব্যয় হোক টাকা, তবুও একটা বছর তো শান্তি আর নিশ্চিন্তি! আগামী মরশুমে খরিফ শষ্যের দাম যখন দ্বিগুণ হয়ে যাবে, এই যত খরচ হচ্ছে এক্ষণে, সব একবারে সুদে-আসলে উঠে চলে আসবে। আর সেই অনাগত সুখ স্বপ্নে আবারও হাসি ফিরে এল আমাদের সবার বিষণ্ণ মুখে।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অসম দেশ বর্ষাও চলে এল এরইমধ্যে। চলছিল টানা একনাগাড়ে। আর অসম দেশের বর্ষা একবার শুরু হলে মাসাধিকাল পর্যন্ত বিরামহীন চলে। ব্রহ্মপুত্রের পারাপার প্লাবিত হয়ে যায় উত্তাল বানের জলে। শহর, বাড়ি, উঠোন, পথঘাট সমস্ত কর্দমাক্ত ভিজা স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে। প্রতিকূল আবহাওয়া জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে।
আর ওই সময়েই হঠাৎ একদিন সরষে আর কলাই বস্তার বাইরে কালো কালো গুঁড়িগুঁড়ি পোকার মতো কিছু নজরে পড়ল আমার মায়ের। নজরে পড়তেই আঁতকে উঠে চিক্কুর দিয়ে উঠলেন তিনি, হায় হায়! সর্বনাশ হইয়া গেছে!
হাঁক দিয়ে ডাকলেন তিনি বড়দাকে, বাচ্চু বাচ্চু, তাড়াতাড়ি আয়, দেইখ্যা যা!
দৌড়ে এল বড়দা। পোকাগুলোকে দেখিয়ে মা বললেন, ওই দ্যাখ!
বড়দাও দেখে চমকে উঠল, কী ব্যাপার, কালো গুঁড়িগুঁড়ি পোকাগুলো এল কোত্থেকে? বস্তায় পোকা ধরে ফেলেনি তো তাহলে?
চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলেন পিতৃদেবও। বস্তার ওপরে পোকার আনাগোনা দেখে তিনিও স্তম্ভিত হতবাক। আর দেরি না করে তখন তখনি পিতৃদেব ও বড়দা মিলে ওপর থেকে টেনে নামালেন একটা বস্তা। তারপর বস্তার মুখ খুলে তো ওনাদের চক্ষু চড়কগাছ!
সর্বনাশের যেন চূড়ান্ত। আবারও ডেকে পাঠানো হল রাঙামামাকে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন মামা। পোকার কাহিনি শুনে মামাও ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এবার মামার নিদান, আর তো কোনও উপায় দেখছি না! এর মধ্যে যখনি রোদ উঠবে বস্তাগুলোকে বাইরে নিয়ে গিয়ে খুলে সরষে কলাই এগুলোকে বার করে শুকোতে দিতে হবে।
মামার কথা শুনে আবারও আরেক প্রস্থ বিমূঢ় হয়ে গেলেন পিতৃদেব, মা, বড়দা ওনারা।
বড়দার দিকে তাকিয়ে মামা আবারও বলে উঠলেন, দোষ তো তোদেরই। কেনার সময় দেখে কিনবি না? সরষে, কলাই এগুলো হচ্ছে কাঁচা কৃষিপণ্য। খুব দেখে যাচাই করে তবে কিনতে হয়। এগুলো ভালো করে রোদে শুকোনো শুষ্ক কিনা যাচাই করে দেখবি না? তোদেরকে দেখেছে নতুন খদ্দের, যে যার ইচ্ছে মতো গছিয়ে দিয়েছে।
মামার বয়ান শুনে সকলের মাথায় যেন বজ্রপাত। কয়দিনের মধ্যে রোদ না উঠলে সব বরবাদ হয়ে যাবে। ভাগ্য যদি খুব সহায় হয়, রোধ হয়তো উঠল। কিন্তু এত এত বস্তা নামিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে তার থেকে শষ্যগুলোকে বার করে কে শুকোতে দেবে? বাবা-মা, বড়দা, ছোড়দা, ছোড়দি আমরা সবাই মিলেও আমাদের কি সাধ্য, দেশোয়ালি ভাইদের মতো অমানুষিক পরিশ্রমের এইসব কাজ সুসম্পন্ন করতে পারি?
কলাই আর সরষেয় আর কোনও সন্দেহই নেই যে পোকা ধরে ফেলেছে। কীটের মতো কিলবিল কড়ছে কালো কালো পোকা। ধানের বস্তাগুলোরই বা কী অবস্থা কে জানে? ধান বোঝাই বোরা তো সরষে কলাইয়ের থেকেও সংখ্যায় অনেক বেশি! টেনে নামানো হল একটা ধানের বস্তাও। না, ধানের মধ্যে সেরকম কিছু চোখে পড়ল না, তবে কেমন যেন ছাতাপড়া ছাতাপড়া স্যাতঁসেঁতে গন্ধ ধরে গেছে। সময়ে রোদে না শুকোতে দিলে এগুলোও বরবাদ হয়ে যাবে।
আবারও কথা বলা হল চার দেশোয়ালি ভাইয়ের সঙ্গে। রোদ উঠলেই তারা চলে আসবে। যে কয়দিন লাগে লাগবে, তক্তাপোশের ওপরে স্তূপিকৃত বস্তার থেকে একটা একটা করে নামিয়ে তারা বাইরে নিয়ে যাবে। তারপর বস্তার মুখের সেলাই খুলে শষ্য বের করে তারা সেগুলোকে রোদে শুকোবে আবার তুলবে।
ভালো কথা। কিন্তু রোদেরও তো আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না! সপ্তাহ পনেরো দিন পার হয়ে যাচ্ছে সূর্য আর উদয়ই হচ্ছেন না! যাক ভাগ্য সহায়, মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলেন তিনি একদিন অবশেষে। আর তিনি উদয় হতেই দেশোয়ালি ভাইয়েরা এসে হাজির হয়ে গেল।
কিনে আনা হল বাঁশের চেঁচাড়ি দিয়ে তৈরি বড়ো বড়ো কয়েকটা চাটাই। চার দেশোয়ালি দিনমজদুর ভাই দিনে চারপাঁচটা করে বস্তা স্তূপের থেকে নামিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বস্তা খুলে চাটাইয়ের ওপর শষ্যগুলোকে ঢালে। মিনিট দশের মধ্যেই রোদের আঁচ গায়ে লাগতেই হাজারে হাজারে ক্ষুদ্র থেকে অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পোকার সৈন্যসামন্ত শষ্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। এভাবে সারা দিনে উলোট পালট করে দেশোয়ালি ভাইয়েরা যতটুকু সম্ভব শুকিয়ে নেয়। তারপর দিনের শেষে আবার বেলচা দিয়ে তুলে সেগুলোকে তারা বস্তায় ভরে। অতি ক্ষুদ্র কালো কালো সেই সৈন্যসামন্তের দল তবুও কিছু বস্তার ভেতরে থেকে যাওয়ায় পরের দিনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয়। এইভাবেই দুইতিনদিন শুকানোর পর শষ্যগুলোকে বস্তায় ভরে লম্বা সুইয়ের পেছনে সুতলি পরিয়ে মুখ সেলাই করে আবারও তারা ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে চকির ওপর তুলে গুছিয়ে রাখে। চার দেশোয়ালি ভাইয়ে পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে গিয়ে দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে তাদের সঙ্গে হাত লাগাতে হল আমাদেরকেও। পিতৃদেব, মা, বড়দা, ছোড়দা, ছোড়দি কেউ আর আমরা বাকি রইলাম না ওই কাজে হাত লাগাতে। তাতেও মজুত স্তূপিকৃত বস্তার অর্ধেক সংখ্যাও শুকানো গেল না। আবারও হুড়মুড় করে ঢেলে নেমে গেল বর্ষা।
কলাইগুলো পোকায় খেয়ে প্রায় নব্বই ভাগই চোকলা বানিয়ে ফেলেছে। সরষেও অনেকটা তাই। এরমধ্যে ধানের বস্তাগুলার মধ্যেও লেগে গেল পোকা। পোকা তো নয় যেন সাদা সাদা কীট। আমাদের জন্যে এই সর্বনাশার যেন আর কোনও সীমান্ত রেখা নেই।
আবারও চাওয়া হল মামার সুপরামর্শ। মামা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে বড়দাকে বললেন, বাচ্চু এগুলোর যা দাম পাওয়া যায় বেচে দে! আর অপেক্ষা করিস না, এছাড়া আর তো কোনও গত্যন্তর দেখছি না।
'যা দাম' দেওয়ার মতোও তো খরিদদার পেতে হবে! সেই খরিদদারও পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে পাড়ার এক মুসলমান ধনী ব্যবসায়ী রাজি হলেন সব কিনে নিতে। বেচে দেওয়া হল সব তার কাছে। তার লোকজন এসে বাড়িঘর খালি করে নিয়ে চলে গেল সব। যে দামে কেনা হয়েছিল বোধহয় তার একভাগ দামেও বেচা গেল না।
তবুও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচা। এক মহা যন্ত্রণা যেন বিদেয় হল বাড়ি থেকে। তবে লোকসানের যা বহর, কোমর ভেঙে গেল গোটা পরিবারের। তবে সময় সব ক্ষতই তো দূর করে দেয়। সেই সময়ের দিকেই তাকিয়ে রইলাম আমরা সবাই। আমার বাবা-মা, দাদা, দিদিরা।
ক্রমশ.. পরবর্তী পর্ব - যেন নতুন হাতেখড়ি

