Sayandipa সায়নদীপা

Drama

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama

বংশের প্রদীপ

বংশের প্রদীপ

11 mins
2.0K


                 এক


বাইরে আজ এক ফোঁটাও বাতাস নেই, গায়ের জামা ভিজে একসা। এই সন্ধ্যের সময় বাড়িতে টিকতে মন চায়না কিন্তু আজ কোনোকারণে বাইরে যেতেও ঠিক সায় দিচ্ছেনা অভির মন। পাড়া পড়শিদের বাড়ির থেকে মাঝেমাঝেই ভেসে আসছে শাঁখের পুঁ পুঁ শব্দ। অসহ্য লাগছে অভির। 

“ভাই… ও ভাই এক গেলাস জল দে নারে।” 

বিভাদেবীর ডাক কানে গেলনা অভির, অবশ্য গেলেও বুড়ির ডাকে সাড়া দেওয়ার বান্দা সে নয়। পাশের বাড়ির টিভি থেকে আচমকা একটা অচেনা গান বেজে উঠল। অমনি রান্নাঘর থেকে মালাদেবী ছুটে এলেন খুন্তি হাতে, "বাবুরে 'এই বাংলা' চ্যানেলটা একটু ধরা না, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আজ থেকে ওখানে একটা নতুন সিরিয়াল শুরু হচ্ছে। তোর পাল কাকিমা দেখছে নিশ্চয়, আওয়াজ শুনতে পেলাম।"

 "পারব না, দেখছো না খেলা দেখছি।" ঝাঁঝিয়ে উঠল অভি।

"ও বৌমা এক গেলাস জল দাওনা গো।"

 "লক্ষী বাবু আমার, তোর জন্য পাঁপড় ভাজছি, মুড়ি খাবি যে।"

"তা সেটাই ভাজো না গিয়ে, সিরিয়াল দেখতে হবেনা এখন। একটা দিনই তো বাড়ি আছি, তোমার জ্বালায় একটু শান্তিতে টিভিও দেখতে পারবনা! সবসময় সিরিয়াল আর সিরিয়াল!"

 "ভাই এক গেলাস জল দে রে ভাই।"

"আরে রাগ করিসনা বাবু, আচ্ছা খেলা দেখ তুই।"

 "বৌমা… " এবার কথাটা শেষ করার আগেই কাশির দমক উঠল বিভাদেবীর, দমকটা সামলে নিয়ে কোনোক্রমে বললেন, "জল…"

রান্নাঘর থেকে একগ্লাস জল এনে মালাদেবী ঠক করে রাখলেন বিভাদেবীর সামনে। গ্লাসটা তুলতে যেতেই আরেকবার কাশির দমক উঠল, সেই সঙ্গে অনেকখানি জল গ্লাস থেকে চলকে পড়ল নীচে। 

 "দেখলি বাবু দেখলি, এবার কে ওই জলটা মুছবে বল! এই জন্য আমি জল দিতে চাইনা খাওয়ার সময়, কিন্তু শুনলে তো!" চিৎকার করে কথাগুলো বললেন বিভাদেবী, আর মনে মনে ভাবলেন পারলে বুড়িটার গলা টিপে মেরে ফেললে তার শান্তি হত। আর সহ্য করা যাচ্ছেনা বুড়িটাকে। বিরক্ত মুখে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গেলেন মালাদেবী, আর তখনই রিমোটটা হাতের তালুতে ঠুঁকে মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করল অভি। মালাদেবী ঘুরে দেখলেন টিভিতে ছবি নেই, কিসব যেন লেখা গোটা পর্দা জুড়ে। 

"কি হল রে বাবু?"

"কি করে জানবো!"

"বলছি একবার 'এই বাংলা'য় ধরিয়ে দেখনা সেখানে ছবি আছে নাকি।"

বিনা বাক্যব্যয়ে রিমোটটা তুলে ৯০৫ নম্বর টিপল অভি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টিভির পর্দায় ভেসে উঠল একটা অট্টালিকাসম বাড়ি। বাড়ির ভেতর ব্যস্ত ভাবে ছোটাছুটি করছে জল পাঁচেক মহিলা, তাদের পরনে বেনারসি জারদৌসি সঙ্গে ভারী ভারী গহনা। পুরুষমানুষগুলোর পোশাকও বিচিত্র, ধুতি থেকে শুরু করে কোট প্যান্ট সবই আছে। একটা সাদা রঙের সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক পরে পুজোর থালা হাতে পর্দার সামনে উপস্থিত হলেন এক বৃদ্ধা। তিনি গম্ভীর গলায় বাকি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, "আমার দিদিভাই কি উঠেছে?" 

একজন ঘোমটা দিয়ে বেনারসি পরা মহিলা জবাব দিলেন, "না মা এখনও ওঠেনি। মেয়েটা একেবারে বিগড়ে…"

বৃদ্ধা বাম হাত তুলে ওই মহিলাকে চুপ করতে নির্দেশ করলেন, তারপর বললেন, "আজ আমার দিদিভাইয়ের আঠারো বছরের জন্মদিন। আজ খবরদার কেউ ওকে বকবেনা।"

টিভির দিকে তাকিয়ে খুকখুক করে আবার কেশে উঠলেন বিভাদেবী।

বেনারসি পরা মহিলা মাথা নিচু করলেন। বৃদ্ধা এবার পুজোর থালা হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন একটি ঘরে। ঘরটা আগেকার দিনের রাজকুমারীদের ঘরের মত সাজানো। বৃদ্ধা এসে একটা টুলে পুজোর থালাটা রেখে খাটে বসলেন। খাটে গোলাপী রঙের লেপ মুড়ি দিয়ে কেউ ঘুমোচ্ছিল, বৃদ্ধা লেপের ওপর হাত রেখে নরম স্বরে ডাকলেন, "দিদিভাই… ও দিদিভাই…"

দিদিভাই লেপটা মুখ থেকে সরালো, কিন্তু এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখটা পরিষ্কার দেখা গেল না। সে আদুরে গলায় ঠামী বলে বৃদ্ধার কোলে মাথা রাখল। বৃদ্ধা ওর এলোমেলো চুলগুলো সরাতে সরাতে বললেন, "শুভ জন্মদিন দিদিভাই, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো নয়তো সারপ্রাইজটা কিন্তু মিস হয়ে যাবে।"

  "সারপ্রাইজ…!" লাফ দিয়ে উঠল দিদিভাই। এতক্ষণে বৃদ্ধার দিদিভাই তথা সিরিয়ালের নায়িকার মুখটা দেখা গেল পরিষ্কার ভাবে। অভি সবে একটা গরম পাঁপড়ে কামড় বসিয়েছিল, নায়িকার মুখ দেখে একটা টুকরো তার গলায় আটকে বিষম খেলো সে। মালাদেবী আঁচলের খুঁটটা দিয়ে গলার ঘাম মুছছিলেন, থমকে গেলেন তিনিও। কয়েক সেকেন্ড পরে দুজনেই একসাথে চিৎকার করে উঠলেন, "মুনিয়া…!"

 "কোথায় গো বৌমা কোথায়?" বিভাদেবীর চোখে ছানি পড়েছে, স্পষ্ট দেখেননা কিছুই, তাই মুনিয়াকে কোথায় খুঁজে পেল মালা দেবী আর অভি টের পেলেন না তিনি। বৌমা আর নাতির কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি, "মুনিয়া কোথায় গো?" 

বিভাদেবী চুপ করার পরেই গোটা ঘরে নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটার পর আচমকা মালা দেবী ব্যাঙ্গ করে উঠলেন, "মেয়ে নাকি তার পড়াশুনায় ভীষন ভালো, বাব্বা কি গর্ব তোর জ্যেঠিমার। তা ভালোর এই নমুনা! এই লাইনে কিভাবে আসে সব জানা আছে আমার।"

 মায়ের কথায় অদ্ভুত স্বরে হাসলো অভি। মালাদেবী আবার বলে উঠলেন, "অবশ্য এই মেয়ের চরিত্র যে কি হতে চলেছে তা তখনই টের পেয়েছিলাম আমি। ওই ছোটো বয়েসে..."

মায়ের কথায় সায় দেওয়ার জন্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অভি, কিন্তু তখনই বাইরের গেটে আওয়াজ হল। 

"বোধহয় তোর বাবা এলো।" কথাগুলো বলতে বলতে বাইরের দিকে এগিয়ে গেলেন মালাদেবী। অভি ঘরের ভেতর থেকে শুনতে পেলো আগন্তুক মালাদেবীকে জিজ্ঞেস করলেন, "অভিরূপ চৌধুরী বাড়ি আছেন?"


                    দুই


দুপুরে ভাত খাওয়ার পর্ব মিটতেই পেপারটা নিয়ে বসলেন জাগৃতি দেবী। এটা তাঁর আইবুড়ো বেলার অভ্যেস, দুপুরে না ঘুমিয়ে গোটা পেপারটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া। এখন অবশ্য সেই আগের মত পেপার পড়ায় বৈচিত্র্য খুঁজে পাননা তিনি; সেই তো একই খুন জখম রাহাজানি, রাজনীতির খবর। তবুও পেপারটা পড়তে তাঁর ভালোই লাগে। আজ ভেতরের পাতার একটা ছোট্ট খবরে আচমকা চোখ আটকে গেল তাঁর--- "শহরে ধর্ষণ, অভিযুক্ত চার।" খবরটা পড়েই সারা শরীরে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল জাগৃতি দেবীর।


                  ★★★★★


বাবা মা'র আদরের ছোটো মেয়ে জাগৃতির বিয়ে হয়েছিল এক গৃহস্থ পরিবারে। এতো বড় পরিবারে বিয়ে দিতে মায়ের ঠিক সায় ছিলো না। কিন্তু বাবা বলেছিলেন ছেলেটা খুব ভালো, দেখবে আমাদের জগুকে খুব ভালো রাখবে। জাগৃতিদেবীরা ছিলেন ছয় ভাইবোন, বাবা ছিলেন সামান্য স্কুল মাস্টার। কিন্তু খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে অন্য কোনো ব্যাপারে কোনোদিনও কিছু অভাব বোধ করেননি। বিয়ের পর প্রথম অভাব কাকে বলে বুঝলেন তিনি। বাবার জানতে এক স্বচ্ছল বর্ধিষ্ণু পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মানসিক দিক থেকেও যে বর্ধিষ্ণু পরিবার খোঁজার প্রয়োজন ছিল কোনদিনও টের পাননি তিনি। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা একদিকে জাগৃতিদেবীকে তাঁর বাবার আয় নিয়ে খোঁটা দিতেন আবার অন্যদিকে এই মানুষগুলোর খাওয়ার শেষে জাগৃতি দেবী যখন খেতে বসতেন তখন হাঁড়ির ভাতও হত বাড়ন্ত, আবার সেটুকুকেই তৃপ্তি করে খাওয়ার মত যথেষ্ট তরকারিও থাকতো না। বাবার বাড়িতে রোজ রাতে দুধ দিয়ে ভাত খেতেন জাগৃতি দেবী, কিন্তু বিয়ের পর শ্বাশুড়ি মা বললেন, "দুধ বাড়ির বউদের জন্য নয়।"

সেই যে দুধ খাওয়ার অভ্যাস ছাড়া হল এখন আর পেটে দুধ সহ্যই হতে চায়না।


  এসব কিছু মুখ বুজে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেন জাগৃতি দেবী। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারতেন না, সেটা হল যে মানুষটার হাত ধরে এই বাড়িতে আসা সেই মানুষটারই অমন পরের মত ব্যবহার। আসলে মানুষটা যে ঠিক অমন ব্যবহার করতে চাইতেন তা নয় কিন্তু তাঁকে বাধ্য করা হত। জাগৃতি দেবী স্পষ্ট অনুভব করতে পারতেন তাঁর শ্বাশুড়ি মা সব সময় ছেলে পর হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় ভুগতেন। আর সেই জন্যই তো রথীন বাবু শনিবার অফিস থেকে ফিরলেই শ্বাশুড়ি মা তাঁদের রুমে এসে ছেলের সাথে হাজার গল্প জুড়তেন, রবিবার দুপুরের চিত্রটাও ছিল একই। আবার রাতেও বেশিরভাগ দিন জাগৃতি দেবীকে দিয়ে এতো কাজ করাতেন শ্বাশুড়ি মা যে যখন জাগৃতি দেবী শেষমেশ রুমে আসতে পেতেন ততক্ষণে রথিনবাবু হয়তো গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছেন। সেই সময় একেকদিন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করত জাগৃতি দেবীর। যত অভিমান গিয়ে জমত মানুষটার প্রতি। কিন্তু অভিযোগ জানানোর মত কেউ ছিলো না, এসব কথা কাকেই বা বলা যায়! একবার বাপের বাড়ি এসে মাকে বলে ফেলেছিলেন খানিক, মা বিশ্বাসই করতে চাননি যে কোনো শ্বাশুড়ি ছেলে বৌমার শোওয়ার ঘরে ঢুকে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা নিছক গল্প করে তাদের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে। শ্বাশুড়ি মাকে দেখে জাগৃতির অদ্ভুত লাগত; একটা ছেলের জীবনে মা আর স্ত্রীর ভূমিকা বা গুরুত্ব দুটোই তো সম্পূর্ণ আলাদা তাহলে ওনার এতো ভয় কিসের!


  সেইসময় অল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ নিষিদ্ধ হয়নি। রথিন বাবু বাড়ি ফিরে উচ্ছসিত কণ্ঠে মায়ের হাতটা ধরে বলেছিলেন, "মা একটা দারুণ খবর আছে। তোমার নাতনি হবে গো!"

জাগৃতি দেবীর এখনও মনে আছে শ্বাশুড়ির প্রতিক্রিয়াটা, "তাহলে দারুণ খবরটা কি?" কাটা কাটা গলায় কথাগুলো বলছিলেন মহিলা। হতভম্বের মত মায়ের হাতটা ছেড়ে দিয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলেন রথিন বাবু। আর জাগৃতি দেবী অনুভব করেছিলেন তাঁর মেয়ে হওয়ার খবর শুনে বিশ্রাম দেওয়ার বদলে সংসারের কাজগুলো আরও বেশি করে যেন তাঁর পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 


  মুনিয়া হওয়ার দিন অনেক চেষ্টা করেও রথিন বাবু কিছুতেই ছুটি পাননি অফিস থেকে। তাই বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন স্ত্রী মেয়ের খেয়াল রাখতে। ভেতর থেকে নাতনির কান্নার আওয়াজ টুকু শুনেই বাড়ি ফিরে চলে এসেছিলেন সাগরময় বাবু--- শিশুকন্যার প্রথম কান্না আনন্দ নয়, দুঃখ নিয়ে আসে; বংশের প্রদীপ নিভে যাওয়ার শঙ্কা নিয়ে আসে। তাই সেই শঙ্কার মুখদর্শন করতে ইচ্ছে হয়নি সাগরময় বাবুর। জাগৃতি দেবীর ছিল O- রক্ত, মেয়ের পজিটিভ রক্ত হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে একটা ইনজেকশন দিতে হত। ডাক্তাররা সেই ইনজেকশন দেওয়ার জন্য তখন হন্যে হয়ে খুঁজেও জাগৃতিদেবীর বাড়ির লোককে খুঁজে পাননি। 


  মেয়েটা শুয়ে শুয়ে কাঁদত, কেউ কোলে নিতো না তাকে। মেয়েটার খিদে পেলে দুধ গরমটাও রান্নার মাঝে জাগৃতি দেবীকেই করতে হত। উনুন থেকে রান্নার কড়া নামিয়ে দুধ বসালে আবার শুনতে হত গঞ্জনা। রথিন বাবু তাই মেয়ের খাবার তৈরি করার জন্য একটা স্টোভ কিনে আনেন। হুলুস্থুলুস পড়ে যায় গোটা ঘরে, গৃহস্থ পরিবারে থেকে আলাদা জিনিস! স্টোভটা শেষমেশ বাজেয়াপ্ত করে তবেই শান্তির নিশ্বাস ফেলেন বিভা দেবী। 


  সংসারের এই রাজনীতিতে আবার পরিবর্তন আসে একদফা, যা হয়তো জাগৃতি দেবীকে সম্পূর্ণরূপে কোণঠাসা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে এবার আর তিনি একা নন, তাঁর স্বামী সন্তানও শিকার হয়েছিল এই রাজনীতির। জাগৃতি দেবীর ছোটো জা মালা দেবী জন্ম দিলেন এক পুত্র সন্তানের। দুজনের প্রতি ব্যবহারের পার্থক্যটা এখন থেকে স্পষ্ট অনুভব করতে পারতেন জাগৃতি দেবী। অবশ্য এমনটা যে হবে তা তো আগেই জানতেন তিনি। মালাদেবীর ছেলে হবে জানতে পারা মাত্রই আনন্দের আতিশয্যে সাগরময় বাবু তাঁর সম্পত্তির কিছু অংশ গোপনে লিখে দিয়ে ছিলেন ছোটো ছেলের নামে। পরে সে কথা জানতে পেরে রথিন বাবু দুঃখ করে বলেছিলেন, "বাবা তো আমায় চেনে, আমি কি বাধা দিতে যেতাম! তাও কেন আমায় গোপন করে করল সবকিছু?"

এরপরেও নানা অছিলায় ছোটো ছেলের নামে সম্পত্তি হস্তান্তরিত হতে থাকে একটু একটু করে। আসলে ছেলেকে তো নয়, তিনি তাঁর সর্বস্ব দিচ্ছিলেন তাঁর বংশের প্রদীপকে। 


  ইতিমধ্যেই গৃহস্থ পরিবার ভেঙে গিয়েছে। সাগরময় বাবু আর বিভাদেবী নিজের ছেলেদের নিয়ে আলাদা হয়েছেন। অবশ্য এই নতুন সংসারের মধ্যেই জাগৃতি দেবীরা যেন একঘরে। তবুও রথিন বাবু মাকে ছেড়ে অন্যত্র সংসার পাতার বিষয়ে ভাবতে পারেননা। মা তাঁকে যতই অনাদর করুক, তবুও মা তো। মাকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসেন। কিন্তু আচমকা একদিন সেই মা'ই তাঁকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করলেন। মুনিয়া তখন সাত বছরের। একদিন রান্নাঘরে রান্না করছিলেন জাগৃতি দেবী। আচমকা ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরল মুনিয়া। 

"কি করছিস কি ছাড় আমাকে…" বলতে বলতে জাগৃতি দেবী খেয়াল করলেন মেয়েটা তাঁর কেমন যেন ফোঁপাচ্ছে।

"কিরে কি হয়েছে!" উত্তর না দিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল মুনিয়া। মেয়ের দিকে ভালো করে তাকাতেই জাগৃতি দেবী দেখলেন মেয়েটার গলার কাছে একটা টাটকা লাল দাগ, কেউ যেন মনে হচ্ছে আঁচড়ে দিয়েছে। মুনিয়ার সামনে হতভম্বের মত বসে পড়ে তিনি বুক আর হাতেও আবিষ্কার করলেন একই রকম দাগ। মেয়েটা বিড়বিড় করে বলল, "বিভাস আঙ্কল…" কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই ঢলে পড়ল মায়ের কোলে। শিউরে উঠলেন জাগৃতি দেবী। 


  বিভাস ছিল মালা দেবীর কোনো তুতো ভাই। দুদিন আগেই ওদের বাড়িতে এসেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় তুলকালাম হল বাড়িতে। রথিন বাবুর মত শান্ত লোকটা নিজের জুতো খুলে ছুঁড়ে মারলেন বিভাসের দিকে। চিৎকার করে উঠলেন মালা দেবী, "আপনারা দু'জন আমাদের হিংসা করেন জানতাম। কিন্তু এতো হিংসা! আমার ভাইটাকে কোন সাহসে মারলেন আপনি। আপনার হিংসা তো আমার ওপর, আমার ভাইকে জড়াচ্ছেন কেন। আপনাদের মেয়ে এইটুকু বয়সেই কি পরিমাণ পেকেছে সবাই জানে। ইস্কুলে ছেলে বন্ধু জুটিয়ে ঢলাঢলি করে তাদের সঙ্গে, সেগুলো তো আপনাদের নজর পড়ে না। মা আপনি ওই বিচ্ছু মেয়ের কথা বিশ্বাস করবেন না, আজ সারাদিন তো আমার অভি ছিল বিভুর সঙ্গে। আপনি আপনার নাতির কথা তো বিশ্বাস করবেন!"

ব্যাস আর কোনো প্রমাণের দরকার ছিলো না বিভাদেবীর, ঈশ্বরের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেন যাকে সেই নাতি যখন মায়ের শেখানো বুলিগুলো আওড়ে গেল, তখন আর কি প্রমাণ চাই! এমনিতেই তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বড় ছেলে বৌমা মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে ভর্তি করেছিল, সেখানে ছেলে মেয়ে সব একসঙ্গে পড়ে। তা সেই মেয়ের এমন অধঃপতন হবেনা তো কার হবে!


                  ★★★★★


চশমাটা খুলে চোখটা মুছলেন জাগৃতি দেবী। অভি কোনো দোষ করলে বরাবর সেই দোষ মুনিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পিছপা হতেননা বিভা দেবী; মুনিয়াকে রথিন বাবু মারলেও সেটা চোখে দেখতে পেতেন না তাঁরা, এদিকে অভিকে কেউ একটু বকে দিলেও রেরে করে তেড়ে যেতেন দাদু ঠাকুমা দুজনেই। কি আশ্চর্য না, দুজনেই তদেরই দুই ছেলের সন্তান, তাঁদের অংশ, অথচ দুজনের প্রতি দাদু-ঠাকুমার ব্যবহারের কেমন আকাশ পাতাল ফারাক! আবার দিদির প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করার বদলে যার মা তাকে অন্যায়কারীর পক্ষে কথা বলতে বলে, সেই ছেলেটা…

হ্যাঁ আজ ওই খবরটার চারজন অভিযুক্তের মধ্যে একটা নাম অভিরূপ চৌধুরী। জায়গাটাও ওদের বাড়ির কাছাকাছিই।


  সংসারের রাজনীতির শিকার হতে হতে সেদিন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল জাগৃতি দেবীর। বাড়ি থেকে প্রকারান্তরে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন শ্বাশুড়ি মা। বড় ছেলেকে বলেছিলেন, "তোকে আর কোনো প্রয়োজন নেই আমার, আমার নাতিই আমার সবকিছু পাবে, আমার নাতিই আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।"

একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন জাগৃতি দেবী; নাহ আফসোস তাঁর কোনোদিনও ছিলো না, আজও নেই। মেয়ের গর্বে গরবিনী তিনি। গর্ভ ধারণ করার থেকে বরাবর প্রার্থনা করে গিয়েছেন ছেলে মেয়ে যাই হোক, সে যেন সুসন্তান হয়। ভগবান তাঁর কথা শুনেছেন। 


                     তিন


হরেক রকম মানুষের ভীড়ে গমগম করছে কোর্ট চত্বর। কালো কালো কোট পরা গুটিকতক মানুষকে ছাপিয়ে আরও রকমারি পোশাকে শয়ে শয়ে মানুষ ছুটে চলেছে এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত। পুলিশের জিপটা থেকে একেক করে নামল অভিসহ আরও তিনজন। প্রত্যেকের হাতে হাত কড়া। নিজের মুখটা যথাসম্ভব ঝুঁকিয়ে এগোবার চেষ্টা করল অভি। মালাদেবী ছুটে এলেন, "তুই চিন্তা করিসনা বাবু, তোর জন্য ভালো উকিল দেবো আমি। তোর কিচ্ছু হবেনা।"

মায়ের কথায় শুধু মাথা নাড়ল অভি। আর তখনই পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, "বাঁচার যেটুকু আশা ছিল সব শেষ, এবার আর রেহাই নেই। শুনলাম পি.চৌধুরী মেয়েটার জন্য লড়বে।"

 "তাতে কি হয়েছে?" জানতে চাইলেন মালা দেবী।

"ততে কি হয়েছে মানে! পি. চৌধুরীর কাছে এসব কেস জলভাত। এইটুকু বয়েসে কত নারী নির্যাতনের কেস লড়ে জিতেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো ফিজও নেননা উনি।"


  আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অভির কানে বারবার বেজে চলেছে সেই মেয়েটার আর্তনাদ। মলয়ের প্রস্তাবে সায় দেয়নি বলে মলয়ের বহুদিনের রাগ ছিল মেয়েটার ওপর, আর তাই তো সেদিন ওরা… উফফ! এখানে আসার পর থেকে লজ্জায় একবারও মুখ তোলেনি অভি। বিচারকের নির্দেশে বাদী পক্ষের উকিল পারমিতা চৌধুরী এগিয়ে আসতেই দর্শকাসনে মৃদু গুঞ্জন উঠল। অভি এবার মুখ তুলে তাকিয়েই চমকে উঠল… দিদিভাই! দর্শকাসনে চাপা গুঞ্জন… আরে ইনিই তো নতুন সিরিয়ালটায়… ! 

"অর্ডার… অর্ডার…" বিচারকের নির্দেশে শান্ত হল সকলে। সবার অলক্ষ্যে মুনিয়া একবার তাকাল ভাইয়ের দিকে, সঙ্গে সঙ্গে মুখটা নামিয়ে নিল অভি। দিদির মুখটা থেকে যেন প্রদীপের চেয়েও উজ্জ্বল এক দ্যুতি ছড়াচ্ছে, সে দুত্যির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না অভি, চোখ দুটো যেন ঝলসে গেল তার।


শেষ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama