STORYMIRROR

Ranu Sil

Inspirational Others

3  

Ranu Sil

Inspirational Others

বনসাই

বনসাই

6 mins
218


কালক্রমেন জগতঃ পরিবর্তমানা

চক্রারপঙক্তিরিব গচ্ছতি ভাগ্যপঙক্তি...


শুধু ভাগ্যই নয়, সবকিছুই অর্ পঙক্তির মতো পরিবর্তিত হয়। তৃপ্তি-অতৃপ্তি , যন্ত্রণা-আরাম., প্রেম-বিরহ... অনেকটা ঋতুর মতো ! অর্থাৎ এই পরিবর্তন অনেকটাই প্রাকৃতিক। যেমন ভাবে প্রেমের মাদকতাও সত্যি, তেমনই যন্ত্রণাটাও সত্যি , যাকে আদর করে বিরহ বলে ডাকি


#########


একজিবিশনে গিয়ে চোখ পড়লো বনসাইটার দিকে । ছোট্টো ছোট্টো পাতা ছড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, ছোটো শরীরটা নিয়ে, কে বলবে ওর মধ্যে বিরাট হয়ে ওঠার শক্তি আছে ! ও পারে পথিককে ছায়া দিয়ে শান্তি দিতে....ও পারে পাখিদের আশ্রয় হয়ে উঠতে, ও পারে ঝুড়ি নামিয়ে সমৃদ্ধ হতে....কি অসীম প্রাণশক্তি লুকিয়ে রয়েছে ওর ভেতর...


গাছটার কি সুন্দর গঠন, যেন আদর্শ বটগাছের মডেল। ডালগুলোও যত্ন করে তৈরি হয়েছে.... বললাম ,

------- একটা ছবি তুলতে পারি ?

দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তুললাম ছবি। দেখে মনে হলো এক্ষুনি ওর তলায় বসে পড়ি। যেন এখনই ওর ওপর একটা সাদা ক্লান্ত বক উড়ে এসে বসবে.... ঠিক করলাম নিয়ে যাবো। মুক্তি দেব । মুক্তিটা ওর প্রাপ্য। 


পকেট হাতড়ে দেখি, খুব বেশি টাকা নেই... কি হবে ? বললাম, 

------- মেলা কতোদিন চলবে ? আজ যদি এডভান্স করি ? 

------ না স্যার, ওটা তো.....

একজন চশমাপরা বড়ো চুলের মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, বললেন,

------ আপনি নেবেন এটা ?

------ হ্যাঁ, নিতাম, মানে আজ তো আমি বেশি কিছু... 

তোতলাতে তোতলাতে বলি আমি । একটু রহস্যময় হেসে উনি বললেন,

----- কি করবেন নিয়ে ?

বললাম ,

------ রেখে দেব... মানে সবাই যা করে....

একটু এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললেন, 

------ কেন মিথ্যে কথা বলছেন ! আপনি একে বনসাই থাকতে দেবেন না । 

ভীষণ রকম চমকে উঠলাম। তাকালাম তাঁর দিকে, বললেন, 

------- একটু খালি হোক, ঘুরে আসুন।


গেলামনা । দূর থেকে লক্ষ্য করতে থাকি মানুষটিকে। চেহারায় তেমন বিশেষত্ব নেই, তবে আচরণে বেশ বৈশিষ্ট্য আছে। কপালে মাঝে একটি শিরা ফুলে রয়েছে... চোখ দুটি খুব চঞ্চল, মানসিক অস্থিরতার লক্ষণ.... তবে উনি বুঝলেন কি করে ? থট রিডিং ? 


একটু ফাঁকা হতে উনি ডাকলেন আমায়। সামনের চেয়ারটায় বসতে বললেন। নিজেও বসলেন ,

------- আপনার গাছটা সত্যিই পছন্দ হয়েছে ?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাই। উনি একটু থেমে বললেন, 

------ নিয়ে যান...


গাছটা টব সমেত পরম স্নেহে , একটা ঝুড়ির মধ্যে রাখলেন। একটু স্প্রে করলেন কিছু....পাতাগুলো চকচক্ করে উঠলো। উনি নরম একটা রুমালে পাতার ফোঁটা ফোঁটা জল মুছিয়ে দিলেন, যেন সযত্নে চোখের জল মোছালেন। একটা ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিলেন আমায় আর গাছকে, যেন মেয়েকে ঘটা করে শ্বশুরালয় পাঠাচ্ছেন..... 


------ হ্যাঁ, মানে দামটা ?

------ ওটা আমি দিলাম.... শুধু একটা অনুরোধ আপনার ঠিকানাটা দেবেন, মাঝে মাঝে একটু দেখে আসবো ! আপত্তি নেই নিশ্চয়ই ?

চোখটা যেন চিকচিকিয়ে উঠলো..... 


বললাম, 

--- না না.. আসবেন.. কিন্তু দাম না নিলে..

-- ও আমার সন্তান..পরে কথা হবে... 

যাবই তো... শুধু ওকে মুক্ত করে দিন.. বাঁচতে দিন


গাছটা নিয়ে এলাম। ভালো করে ধন্যবাদটুকুও জানাতে দিলেন না। রেখেছি আমার মাথার কাছের জানলায়...সাত দিন হলো... কেমন মায়া পড়ে যাচ্ছে... আমার ফ্ল্যাট., তাই জায়গা নেই ..... এটা রেখে আসবো দিদির বাড়ি, বনহুগলীতে। ওখানে নিশ্চিন্তে বড়ো হতে পারবে।


ওই ভদ্রলোককে ফোন করে ডাকলাম । বললাম , - - - - একবার আসুন দেখে যান আপনার গাছ কোথায় থাকবে.... 


সকাল সকাল গাছ আর ওঁকে নিয়ে পৌঁছলাম দিদির বাড়ি। দিদি খুব গাছ ভালো বাসে ।খাওয়াতেও । মজায় কাটলো সারাটাদিন ।ভদ্রলোকও খুব মিলেমিশে গেলেন , যেন কতোদিনের আত্মীয়তা। দিদির মেয়ে সুমনা , অত্যন্ত বুদ্ধিমতি কিন্তু বড়ো গম্ভীর। 


আমি যেতে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো সুমনা। বললাম , 

----- কি এনেছি দেখ !

ও এলোনা কাছে। দেখলোও না। তাকিয়ে রইলো । উনি উঠে গিয়ে বললেন ,

-------- হ্যালো ! আমি শতদল.....একটা গাছকে নিয়ে এলাম.... থাকতে দেবে তোমার কাছে ওকে ? 

ও ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিছু না বলে চলে গেলো। উনি চুপ করে ওর চলে যাওয়া দেখলেন। বললাম ,

------ ও একটু ডিসটার্বড। নিজেকে সামলাতে পারছেনা কিছুতেই......ওর আর বাঁচার ইচ্ছে নেই....বারবার চেষ্টা করছে, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার !


গাছটা দিদির বাগানের এক কোনে লাগিয়ে দিলাম। ফেরার সময় শতদলকে দেখলাম খুব গম্ভীর। জিগেস করলাম,

-------কি হলো বলুন তো ! গাছের জন্য মন খারাপ ?

------- জানেন ! কেউ পুরোপুরি অন্যকারোর জন্য বাঁচেনা , আসলে নিজের বাঁচার জন্য অন্যকাউকে প্রয়োজন হয় ! 

ডান হাতটা লম্বা করে ছড়িয়ে বললেন, 

-------স-অ-অ-অ-বটাই নিজের জন্য....এমন কি গাছও তাই করে.......

অবাক হলাম খুব। হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললাম

------- কি ?

খুব আত্মগত ভাবেই বললেন,

-------- আশ্চর্য খুবই আশ্চর্য ! এতোদিন যারাই ওকে কিনে নিয়ে গেছেন , সবাই দুদিন পরেই 

ফেরত দিয়ে গেছেন , গাছের পাতা নাকি ঝুলে যাচ্ছে, আজ সাতদিন হলো আপনার কাছে রয়েছে, অথচ......বরং বেশ উৎফুল্ল মনে হলো......আমার মেয়ে টুপুর, ওকে খুব যত্ন করতো....ও মারা যাওয়ার পর..... আমি এখান থেকে চলে যাব বলে....গাছটা... তাই তো আপনাকে দিলাম। দেখে মনে হলো আপনিই সেই মানুষ...... 

------ ওঃ সত্যি দুঃখিত ! কি করে হলো এমন ! 

------ স্যুইসাইড.... কিন্তু আমার মন বলছে আপনাদের সুমনা আর গাছ দুজনেই বাঁচবে..... 


             ~~~~~~~~~~~২~~~~~~~~~


সামনেই, মাধ্যমিক পরীক্ষা। কিচ্ছু পড়া হয়নি সুমনার। ও পড়তেই পারছেনা। কেবলই কে যেন ভেতর থেকে বলে, 

---- নাঃ, এ জীবন তোমার নয়,এই শরীরটা তোমার নয়। তুমি মুক্ত আত্মা। এ দেহ নষ্ট না হলে, তোমার মুক্তি নেই……

সুমনা ছটফট করে, কি করবে সে !! কী করে মনটাকে এ দেহের মধ্যে ফেরাবে ! 

ক্লান্ত পাদুটো টানতে টানতে বাগানে এলো সুমনা।

কোথাও কি এমন কেউ নেই ?? বেঁচে থাকতে গেলে একটা উদ্দেশ্য লাগে । কেউ কি বলে দিতে পারে ! তার উদ্দেশ্যটা কী ? 


 ভালো রেজাল্ট করে বাবা-মাকে সম্মানিত করা ! শুধুই তাদের জন্য জীবনটা বয়ে চলা ? জীবনের ধার মেটানো ? ও জানে, ওর নিজের মতো বাঁচা হবেনা কোনোদিন। ওকে ইচ্ছেমতো বেঁকিয়ে চুরিয়ে একটা নিটোল ভালো মেয়ে করে তোলা হবে। নাঃ ও তা হতে দেবেনা। ও শেষ করে দেবে নিজেকে, এটাই হবে প্রতিবাদ…..


পায়ে পায়ে বাগানের কোণায় চলে এলো সুমনা। এই কোণটা থেকে আকাশে তাকালে, মঙ্গল গ্রহটা লাল তারার মতো দেখা যায়। কিন্তু….…

আবছা আলোয় সুমনার চোখে পড়ল, কোণায় একটা ছোট্টো গাছ। কী গাছ ? কোত্থেকে এলো ? কৈ, আগে তো দেখেনি ? 


নিচু হয়ে, পাতা ছুঁয়ে দেখল সুমনা।

------ একটা ছোট্টো বট, বনসাই !!

মনে পড়ল, কেউ এসেছিলেন, মামার সাথে। বলেছিলেন, কোনোও গাছের কথা। এটাই তবে !!

কী মিষ্টি, কিন্তু দুঃখী। পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিল পাতায় ডালে। দুফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল, পাতায়...

------ আজ থেকে তুই আমার বন্ধু ! আর তোকে কেউ কষ্ট দেবেনা রে বটুক। তুই বাঁচবি। নিজের মতো করে বাঁচবি…..


এদিক ওদিক তাকিয়ে, মাটি খোঁড়ার খুরপিটা পেয়েই গেল। ওটা তুলে নিয়ে, মাঠির টবে আঘাত করতে থাকে, ঠাঁই..ঠাঁই..ঠাঁই..…আস্তে আস্তে চিড় ধরে, সুমনা প্রবল উৎসাহে, আরোও জোরে আঘাত করে, আরোও জোরে……


(সমাপ্ত)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational