Rohit Das

Horror Classics Thriller

4.9  

Rohit Das

Horror Classics Thriller

বন্ধুত্ব

বন্ধুত্ব

6 mins
241


ক্রিং ক্রিং ক্রিং...

চায়ে চুমুক দিতে না দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভারটা তুলতেই ওপার থেকে একটা মোটা কর্কশ গলায় আওয়াজ এল " মিস্টার সুজন চক্রবর্তী বলছেন??" কথাটা কানে যেতেই বেশ কিছু পুরনো স্মৃতি তাজা হয়ে গেল। বুকের মধ্যে একটা শিহরণ যেন সমস্ত কিছুকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল,এ অবস্থায় আমার মুখ ফুটে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারিত হল সুরঞ্জন ....।

ওপার থেকে কর্কশ গলায় উত্তর দিল "আরে তুই দেখছি আজও আমায় ভুলতে পারিস নি ??আমায় মনে আছে তাহলে তোর!"

আমি একটু অবাক ও আনন্দের সুর মিলিয়ে বললাম, তুই এতদিন বাদে কোথায় আছিস? কেমন আছিস? আর আমার নম্বর...

আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সুরঞ্জন বলে উঠলো,"আরে দাঁড়া দাঁড়া এত প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেওয়া যায় নাকি বলছি দাঁড়া।"

"গ্রাম ছেড়ে আসার পর শহরে কাকার বাড়িতে উঠেছিলাম। সেখান থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আমি বিদেশে নামি কোম্পানিতে চাকরি পায় তারপর আর কি ওই চলে যাচ্ছে।" আমি একটু অভিমানের সুরে বললাম মনে পড়েনা না আমায় তোর? তাইতো এই ১৫ টা বছর একবারও চিঠি দিস নি। সেইতো গোসাই বাড়ির আম বাগানের আম চুরির মিথ্যে অপবাদে বাবার আত্মহত্যা করার পর জমিজমা ঘরবাড়ি বিক্রি করে উধাও হলি তারপর থেকে তো তোর টিকি দেখতে পাইনি।

" আরে না না গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় অনেক কষ্ট হয়েছিল।তোদের ছেড়ে যেতে সত্যি রে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার কিন্তু..।"

আমি ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম থাক ওসব পুরনো দিনের কথা।তোর খবর বল। হঠাৎ আমায় মনে পড়লে কিভাবে???

"তোকে বললাম ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর একটা কোম্পানির চাকরি জয়েন করি। তারপর আর কি আমার কাজ ভাল হচ্ছে দেখে তারা আমায় আরও উচ্চ পদে নিয়োগ করেন।সেখান থেকেই আমাদের গ্রামের একটা কাজের জন‍্য এলাম।আর গ্রামে ফিরতেই সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ল।বিশেষ করে তোর সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো। তা বাকিদের খবর কি ওমর রাজু রঘুদা...।" ওরা সবাই ভালো আছে কেউ চাষবাস করে আবার কেউ চাকরি।

" ও হ্যাঁ তোকে তো বলাই হল না গ্রামে কাজের জন্য যাচ্ছি। ভাবছি তোর বাড়িতে উঠবো তোর অসুবিধা হবে নাতো??"

অসুবিধা!!কিসের অসুবিধা? আমার পুরনো বন্ধু আমার বাড়িতে আসবে অসুবিধার কি আছে??আমার মা স্ত্রী দুজনেই তোকে দেখতে চাই। অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয়নি চলে আয় তাড়াতাড়ি। রিসিভারটা রাখতেই মনের মধ্যে একটা পুঞ্জিভূত আনন্দ যেন একসাথে খুলে গেল। মা মালিনী দুজনেই সংবাদ শুনে খুব খুশি। সত্যিই অনেকদিন বাদ এই দুই হরিহর আত্মা এক হবে।

আনন্দের মুহূর্ত গুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো। রিসিভারটা তুলতে ওপার থেকে বস এর গলা," সুজন কাল থেকে এক সপ্তাহের জন্য একটা অফিশিয়াল ট্রিপ আছে তোমাকে অ্যাটেন্ড করতে হবে ওকে।"

আর ওকে সমস্ত খুশির জোয়ারে আমার অফিসের বস যেন সময় এগিয়ে দিয়ে ভাটা এনে দিল।মন কিছুতেই যেতে চাইছিলো না কিন্তু কি করা যায় চাকরির সময় বলি দেয়া হয়েছিল সমস্ত এটেন্ন্ড করা একান্তই জরুরী এবং বাধ্যতামূলক নইলে মাইনে কাটা যাবে। তাই মন কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গোছগাছ শুরু করলাম। ৩০ বছরের বন্ধু পরশু বাড়িতে আসবে আর এসে দেখবে আমি নেই নিজেকে বড় স্বার্থপর বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু কি আর করব হাত আমার একদমই যে বাধা।

তাই পূর্বক্ষণে মা এবং মালিনীকে সব ভালো করে বুঝিয়ে আমি তৈরী হলাম যাবার জন্য। সারাদিনটা একটা আত্ম লড়ায়ের মধ্যে দিয়ে গেল। রাত পেরোলেই সকালে বাস ধরতে হবে ট্যুরের জন্য।

ঘুম আসছেনা তাই গল্পের বইটা নিয়ে বারান্দায় সবেমাত্র গা হেলিয়েছি ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠলো।

এত রাতে কে এল??কেউ বিপদে আপদে পরলো নাকি ?? তাড়াতাড়ি দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দরজাটা খুলতেই দেখি সুরঞ্জন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

দীর্ঘ ১৫ টা বছর তাকে না দেখলেও আমার চোখ তাকে চিনতে ভুল করেন। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে গোলগাল চেহারার বেঁটেখাটো সুরঞ্জন। ইতিমধ্যে তার একটা ছোট্ট নাদুস ভুরি হয়েছে । কোট-প্যান্ট এ তাকে একেবারে সাহেবি লাগছে। আমি এক নিমেষে চোখের জল মুছে তাকে গলায় জড়িয়ে নিয়ে তার নাম দিতে লাগলাম সুরঞ্জন... সুরঞ্জন...।

সে একটু হেসে বলে উঠল," তুই দেখছি এখনও বদলা লি না, ঠিক আগের মতই আছিস খাওয়া দাওয়া করছিস না নাকি।" আমি ঠাট্টা সঙ্গেই বললাম, হ্যাঁ বিদেশিনীদের আদরে তুইও তো একটা ভুড়ি বানিয়ে নিয়েছিস।

আমি সুরঞ্জন কে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে মালিনী আর মাকে ডাকতে যাব এমন সময় সুরঞ্জন বাধা দিয়ে বলল," আরে থাক না ওরা ঘুমাও কাল সকালেই ওদের সারপ্রাইজ দেবো।

তুই বলতে কি এখন ওদের বিরক্ত করতে হবে না।" সুরঞ্জন এর সামনের চেয়ারটায় আমি বসলাম বললাম বল কি খাবি বল। সুরঞ্জন বলল নারে ফ্লাইটে খেয়ে এসেছি তোকে আর কষ্ট করতে হবে না।

প্রায় সারারাত ধরে আমাদের গল্প জন্য নানান ধরনের। আমি বললাম হ্যাঁরে তুই এখনো ব্যাচেলারই রয়ে গেলি। "কি করব বল??" আমি একটু জোর দিয়ে বললাম কাউকে ভালবাসিস?? সুরঞ্জন একটা মুচকি হেসে বলল," নারে বিদেশে থাকার সময় এক মহিলার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়। তবে সেটা শুধু বন্ধুত্বই মাত্র।" তুই বিয়ে করলি কবে??

এইতো এক বছর হল, সকাল দেখিস তাকে।

আমায় একটু উদাসীন দেখায় সে বলল," কিরে কিছু সমস্যা হয়েছে নাকি আমায় নিয়ে??"

আমি বিরক্তির সুরে বললাম নারে ব্যাপারটা আসলে অন্য। আসলে তুই ফোন করার পর আমার বস আমাকে ফোন করে সাত দিনের জন্য একটা ট্যুরে যেতে বলেন। সুরঞ্জন রেগে বলল," আমি একমাস তোর সাথে কাটাবো বলে এলাম আর তুই টুরে যাবি । না না যাওয়াটা ক্যান্সেল কর তোকে ছাড়া আমি এখানে থাকবো করে বলত?" সুরঞ্জন এর জোর পীড়াপীড়িতে আমি যাওয়াটা ক্যান্সেল করলাম। ভাবলাম কাল বাস ধরবি না বলে দেবো বাস মিস করেছি। হ্যাঁ তা তুই তো পরশু আসতিস এত তাড়াতাড়ি চলে এলি??

সুরঞ্জন জবাবে বলল,"বন্ধুকে দেখতে পাবো বলে আমি তৎক্ষণাৎ ফ্লাইট ধরি তারপর একটা প্রাইভেট গাড়িতে তোর বাড়ি পৌঁছে তাই এত রাত হল।"

বেশি ফ্রেশ হয়ে নে। সকাল হয়েই এল। আমি মার মালিনীকে ডাকি চা করার জন্য ।

সুরঞ্জন কে তোয়ালে দিয়ে আমি মা আর মালিনীকে ডাকতে চলে যায়। সবাইকে হইচই দিয়ে জাগিয়ে তোলার পর সবাই যখন সুরঞ্জন কে দেখার জন্য পাগল তখন সারা বাড়ি ঘুরে কোথাও সুরঞ্জন এর দেখা মিলেনা। ভাবলাম হয়তো বা একবার ঘুরতে গেছে। তাই জলখাবার তৈরি করতে বলে আমি স্নানের জন্য চলে গেলাম। সকাল আটটা বাজে, সুরঞ্জন এখনো বাড়ি ফেরেনি। কোথায় গেল ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং..‌।

একজন ভদ্রমহিলা বললেন,"মিস্টার সুজন চক্রবর্তী বলছেন।" আমি হ্যা বলাতেই যেন একটা বিনা মেঘে বজ্রপাত আমার মাথায় করলো। ওপারে এয়ারপোর্ট রিসেপশনিস্ট শ্রীমতি সুস্মিতা ব্যানার্জি যা বললেন তা হয় আমার কান শুনতে ভুল করেছে বা আমার মনে একটা ভুল ধারণার জন্ম হচ্ছে। তিনি বললেন, "কাল দুবাই থেকে দুপুর তিনটের যে ফ্লাইট দমদম আসছিল সেটা ক্রাশ করেছে আপনার বন্ধু সেই প্লেনটিতে ছিলেন খবর পাওয়া গেছে সবাই মৃত দয়াকরে দেহটি শনাক্ত করে নিয়ে যান।"

কথাটা শুনে আমার কানের পর্দা ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। অতীত আর বর্তমানের যুদ্ধে আমি পরাস্ত হয়েছি কিন্তু সারারাত যে আমার সাথে ছিল সে কে। পরমুহূর্তে আবার ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভারটা কানে তুলতে এই বসের গলা পেলাম। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন," সুজন হ্যালো সুজন। শুনলাম তুমি যাওনি তা একদিকে ভালোই করেছো।আমাদের বাসটা পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যাবার সময় পাহাড় থেকে পাথর হলে পড়ে চাপা পড়েছে সবাই মারা গেছে শুধু তুমি চাওনি বলেই বেঁচে গেছো।"

একসঙ্গে দুটো ঘটনা যেন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে এর উত্তর আমি পাচ্ছিলাম না। অনেক কষ্টে বুঝলাম সব কিছু। আসল ব্যাপারটা হলো কাল ফ্লাইট ক্রাশ করায় সুরঞ্জন এর মৃত্যু ঘটে।জানিনা এটা কোন শক্তি সে নিজে মৃত্যুবরণ করলেও আমায় দূরে যেতে না দিয়ে আমার জীবন বাঁচে প্রকৃত বন্ধুর মত আমায় কৃতজ্ঞ করে চলে গেল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror