:: আয়না ::
:: আয়না ::


বৃষ্টি পড়ছিল চরম।তারপর তখন আবার রাত।বান্ধবী রীতুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে আটকে পরি আমরা।ঘন জঙ্গল আর ঘন কালো রাত্রের মাঝে চারদিক যেন ডুবে গেছে।বৃষ্টিও পড়েছিল প্রবলবেগে।এমতাবস্থায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা কোথায় থাকবো ভেবে না পেয়ে এগিয়ে চলেছি বাড়ি দিকে। রীতুর কথা শুনে এক রাত থেকে গেলে হত কিন্তু পারলাম না,কারণটা অবশ্য আজকাল যেন ওর মেয়েদের প্রতি আসক্তি টা একটু বেশি বেড়েছে।ও যেভাবে তাকাচ্ছিল আমার তো তাতে সন্দেহ হয় । দেখতে যতটা সোজা সাপ্টা আদেও সে কি? না!! মন মেনে নিতে পারে না চট করে ।টিভি,প্রতিবেশীর কাছে তো শুনি কিভাবে বরেরা একের বেশি বউ নিয়ে... না এসব ভাবলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়।
এই ধারণা আমার জন্মেছে গত ছ'মাস আগে। সব ঠিক ছিল কিন্তু জামাই লিপস্টিক এর দাগ বেশ কয়েকদিন ধরে দেখার পর আর কাজের মেয়ের সাথে কথায় আমাকে এসব..।এসব কথা ভাবতে কখন যে হারিয়ে গেছি জানিনা হুশ ফিরতেই দেখি আমরা একটা পুরনো বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি গাড়ি থেকে নামতে রাজিবও নামলো।বাড়িটার দিকে তাকালেই যেন মনে হবে কোন এক ভয়ঙ্কর কান্ডকারখানায় জ্বলে পুড়ে গেছে। রাজিব বাড়িটার দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই আমি বলে উঠলাম "কার বাড়ি জানিনা, কেউ থাকে কিনা জানিনা,কি আছে এখন ভেতরে তাও জানি না ঢুকলেই হলো নাকি?" রাজিব দরজাটা ঠেলেতে লাগলো। হালকা চাপ দিতেই খুলে গেল। রাজিব ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আমিও ভেতরে ঢুকলাম।
মোবাইলের টর্চ জ্বেলে এদিকে ওদিকে দেখার চেষ্টা করলাম কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না আমার কাঁধের ব্যাগে একটা বড়ো টর্চ ছিল সেটা বের করে জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে থাকলাম। সামনের জায়গাটা বিশাল।মেঝেতে এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ধুলো পড়ে আছে। সামনের দিকে চলে গেছে দোতলার সিঁড়ি।বারান্দায় একটা আয়না আর পাশেই একটা টেবিল।এতক্ষণে ভয় কাটিয়ে বললাম বাহ!! চমৎকার বেশ ভালোই হলো ভেতরে এলাম।এখানে বসেই রাতটা পার হয়ে যাবে, কাল সকালে বাড়ির জন্য রওনা দেওয়া যাবে। রাজিব গাড়িটা বাড়ীর ভেতরে নিয়ে চলে এল।আর একটা পুরনো কাপড় দিয়ে বেশ কিছুটা জায়গা ঝেড়ে ঝুড়ে বসার মত উপযোগী করে তুলল। গাড়ির সিটের নিজ থেকে দেড় হাত লম্বা একটা ট্রিপল বের করে সেটা মেঝেতে পেতে নিজে বসে আমায় বলল "কি বসবে না।" আমিও গিয়ে বসে পড়লাম রাজিব রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে লাগলো। জামা কাপড় একেবারে প্রায় ভিজে গেছে। কি আর করব এখানে শুকনো জামাকাপড় পাওয়া যাবে না সেগুলো পড়েই বসে থাকলাম। রাজিব জামাটা খুলে খালি গেঞ্জি পড়ে বসে আছে। ইতিমধ্যে ঝড়ের আর জলের বেগ আরও বেড়েছে। দরজা দিয়ে জলের ছিটে ক্রমশ ভেতরে আসছে। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া শরীরের প্রত্যেকটা হারকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজিব আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ও ভীষন ঘুমকাতুরে। দশ মিনিটের মধ্যেই দেখি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার ঘুম এলো না। দু চোখ যেন অজানা ভয়ে বন্ধ হতে চায়ছিল না।যত সময় কাটতে লাগলো ঝি ঝি পোকার ডাক আর ঠান্ডা কনকনে হাওয়ায় পরিবেশটা ভীষণ ভয়ংকর হতে লাগল। গাড়ির হেডলাইটের আলোই একমাত্র সম্বল তাও কিছুটা জায়গায় আলো করে রেখেছে, বাকি চারপাশ ভীষণ অন্ধকার। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় দরজাটা বিকট আওয়াজ করে একবার খুলে গিয়ে আবার কিছুটা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি বসে থাকতে পারছিলাম না। কোল থেকে রাজিবের মাথাটা নামিয়ে উঠে পরলাম মোবাইলের লাইট আর টর্চ লাইট নিয়ে এদিক-ওদিকটা একটু ঘুরে দেখবো ভাবলাম।
বারান্দায় আসবাবপত্র কিছুই নেই শুধু আয়না আর টেবিলটা আমি আস্তে আস্তে সেই দিকেই এগিয়ে গেলাম। আয়নাটা বেশ পুরনো, ধুলো জমেছে অনেক। তবে দেখে বোঝা যায় এটা বেশ সুন্দর দেখতে। টেবিলটা মোটা মেহগনি কাঠের। আয়নাটা খুব লম্বা নয়, আমার হাটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে হাত দিয়ে আয়নাটার ধুলোগুলো একটু পরিষ্কার করলাম। এবার আয়নাটার দিকে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।আয়নাটা আমায় দেখাচ্ছেনা ,দেখাচ্ছে অন্য কিছু। আমি যা দেখলাম তার বর্ণনা নিজের মুখে কতটা ঠিক করে দিতে পারব জানিনা। হতবুদ্ধি সম্পূর্ণ আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা শুধুই দেখেই গেলাম। দেখলাম একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ি যেখানে থাকেন এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও তার ছেলে। বেশ ভালই চলছিল তাদের সংসার। কিন্ত তাদের সাংসারিক জীবনে যেন শনির দৃষ্টি হঠাৎই পড়ে গেল। ঘটনাটা
যেন একটু তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছিলো কোন মোর ঘোরানোর চেষ্টায়।একদিন হঠাৎ ছেলেকে স্কুলে থেকে আনার সময় স্ত্রীটি দেখল তার স্বামী একটা বছর তিরিশের নারীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
সে ভাবল তার স্বামী দিনমজুরের কাজ করে এখানে কি করছে? এভাবেই সপ্তাহ দুয়েক ধরে মাঝেমধ্যেই সে দেখতে পেত তার স্বামীকে সেই জায়গায় সেই মহিলাটির সাথে। কিন্তু ঘরে ফিরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেও সে কোন উত্তর দিতো না। এমনই একদিন সে হাতেনাতে ধরবে বলে স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন দেখতে পেল না সে খুব হতাশ হয়েছিল। বাড়ির দিকে আসতেই সে দেখতে পেল সেই মহিলাটি তার বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। সে দেখল তার স্বামীর জামার নিচের দিকের কয়েকটা বোতাম খোলা। এভাবেও বেশ কিছুদিন পর আবারও একই ঘটনা। ইতিমধ্যে একটা অশান্তি ঘটেছিল তাদের মধ্যে। স্বামীটাকে জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কোন কিছুই বলতে রাজি ছিল না সে। এভাবে দ্বিতীয় দিন দেখার পর সে আর সহ্য করতে পারছিল না স্বামীকে। তার পাশে শুতেও যেন তারা ঘিন্না করছিল ।সামনে দাঁড়াতে তার ঘেন্না করছিল। সে ঠিক করল তাকে এভাবে ঠকানোর বদলা সে নেবে। তাকে এভাবে অপমান করার বদলা সে ঠিক নেবে। তাই ঠিক করল সে তার স্বামীকে খুন করবে। সেদিন স্কুলে ফেরার পথে তাদের দেখে সে সত্যিই খুব রেগে গেছিল। হয়তো স্বামী তাকে দেখেছে। কিন্তু কোনো কথা বলেনি। সারা দুপুরটা যেন ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থার মতো কেটে গেল। স্বামী ভাবল যেন কোন কিছুই হয়নি। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে ছেলেকে অন্য ঘরে শুইয়ে রেখে এসে স্বামীর গলায় সে নরম ছুরির ফলা টেনে দিল। রক্তবন্যা বয়ে গেল সারা বিছানা জুড়ে। মেয়েটির বুকের জ্বালা এতটাই ছিল যে সে চিৎকার করে বলতে লাগল "আর যাবি সেই মেয়ের কাছে?? যা চলে যা।" পরদিন পুলিশ এসে যখন মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য রওনা হচ্ছে,তখন সেই মেয়েটা স্ত্রীটি সামনে এসে দাড়াল।সে বললো আপনার স্বামী বড়ই ভালো মানুষ ছিলেন।আপনি এভাবে তাকে কেন মারলেন?স্ত্রীটি ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো চরিত্রহীন তুই আমার জীবনটা নষ্ট করেছিস।তোর রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমার স্বামী আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলো তাই আমি তাকেই মেরে ফেলেছি। মেয়েটি অবাক হয়ে বললো "কি বলছেন??আমার সাথে আপনার স্বামীর কোন সম্পর্কই ছিলনা। আপনি ভুল ভাবছেন আপনি যেটা ভাবছেন সেটা নয়।
আসলে আমার স্বামীর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছিল। আপনার স্বামীও নিজের চাকরিটা হারিয়েছিলেন। কিভাবে সংসার চালাবে ভেবে না পেয়ে আমার খবর পেয়ে আমার সাথে দেখা করেন। আমারও কিডনির প্রয়োজন ছিল আপনার স্বামী তার একটা কিডনি আমার স্বামীকে দেওয়ার জন্য রাজি হয়। আমি তাকে নগদ এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিলাম। এমন একটা সময় আপনার স্বামী আমার এত উপকার করেছিলেন।প্রথম দিন আপনার বাড়ি আসার কারণ এটাই ছিল। আপনার স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম তিনি আগের দিনই হাসপাতালে কিডনি ডোনেট করেছিলেন। গত 26 তারিখে আমার অপারেশন হয়। তার আগের দিনও আপনার স্বামীর সাথে আমি দেখা করি।সত্যি কথা বলতে উনার মত স্বামী আপনার ভাগ্যে ছিল না।তাই হয়তো আপনি আজ হারিয়ে বসলেন। কথাগুলো শোনা মাত্রই স্ত্রীটি পুলিশের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে একছুটে ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নিল। পুলিশও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে।তারাও এই বিষয়টা শুনে অবাক। হতভম্ব পুলিশের সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো সেই স্ত্রীটির দেহ।আগুনের জ্বালায় ঘরে চারদিকে ছুটতে লাগল, ধরিয়ে দিলোআগুন সারা ঘরে। সেই মহিলাটি ইতিমধ্যে চলে গেছে।
পুরোটা দেখা মাত্রই আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম। আমার বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছিল।রাত এখনো অনেক বাকি। বৃষ্টিটাও একটু ধরেছে। আমি এক ধাক্কায় রাজীবকে তুলে বলতে লাগলাম "রাজিব..রাজিব বৃষ্টি থেমেছে চলো আমরা এখনই এখান থেকে চলে যায়..রাজিব চলো...আমার এইখানটা ভালো লাগছেনা।চলো রাজিব।" রাজিব আমার কথা শোনা মাত্রই সে ট্রিপল গুটিয়ে গাড়ি বের করে আমায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
এরপর ছয় মাস কেটে গেছে।সেই ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। রাজীবের মেয়ের দোষ নেই সে নিজেই আমাকে একথা বলেছে। স্বীকার করেছে যে আমায় জ্বালানোর জন্য সেই কাজগুলো করেছে।আমার সুখী পরিবার আবার সুখে ভরে গেছে কিন্তু সেই দিন শেখা জিনিস চিরতরে মনে থেকে গেছে।