বিসর্জন
বিসর্জন
সূর্য সবে সবে ঘুম থেকে উঠে আড়িমুড়ি ছেরে পূর্ব আকাশে নিজের হাস্যজ্বল চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে। ঘাসের ওপর জমে ওঠা শিশির বিন্দুর ওপর সূর্যের ছটা পড়ায়, হিরের মত জ্বলজ্বল করে উঠছে। শরতের আকাশ,তাই আকাশও নিজেকে সাদা মেঘ দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে নতুন নতুন রূপে। প্রকৃতিও নিজেকে এক অপরূপ সাজে সাজিয়ে তুলেছে,পৃথিবীতে মায়ের আসার আগমনের খুশিতে। আজ মহালয়া হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর মায়ের আগমন।
সকাল সকাল উঠে একটু মর্নিং ওয়াক করে এসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চোদ্দ তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে রেডিওতে মহালয়া শুনতে শুনতে প্রকৃতির এই সুন্দর পরিবেশ দুচোখ ভরে দেখছিল রূপ। রূপের ভালো নাম রূপাঞ্জন বাগচী। আসলে রূপ নামেই সবাই ওকে ডাকে। বছর চারেক আগে এই পূজোর সময় গুলো রূপের কাছে কত আনন্দের ছিল। কিন্তু এখন রূপ আর সেই আনন্দ খুঁজে পায়না। তাইতো নিজের বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির পূজোতে না গিয়ে দূর শহরে একটা চোদ্দ তলার বিল্ডিং এর একটা থ্রি বেডরুমের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একা একা বসে আছে। মহালয়া শুনতে শুনতে হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে উঠল রূপের মন। তাই আর মহালয়া শুনতে ভালো লাগছেনা রূপের। রেডিওটা বন্ধ করে আবার নিজের বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিল।
বিশেষ করে এই পূজোর দিন গুলোতে রূপের বেশি কষ্ট হয়। কারন এই রকম পূজোর এক সুন্দর সময়ে তুলিকে নিজের করে পেয়েছিল রূপ। তুলির ভালোবাসার ছোঁয়ায় নিজেকে নতুন করে রাঙিয়ে তুলেছিল। দুজনে একসাথে অনেকটা পথ চলার স্বপ্ন দেখেছিল। তুলি নিজের হাতে প্রত্যেকটা জিনিস পছন্দ করে কিনেছিল নিজেদের সুখের খেলাঘর সাজাতে। নিজের মনের মত করে এই ফ্ল্যাট টাকে সাজিয়ে ছিল। হানিমুনে গিয়ে প্যারিস থেকে আনা ফোল্ডিং জোড়া আয়নাটা খুব প্রিয় ছিল তুলির, আজও সেটা বেডরুমের শোভা বাড়াচ্ছে, রোজ সকালে রূপ একবার করে আয়নাটার সামনে দাঁড়ায়, আর তুলির হাস্যজ্বল প্রতিবিম্বকে কল্পনা করে। তুলির হাতের ছোঁয়া এই ফ্ল্যাটের প্রত্যেক কোনায় কোনায় উপলব্ধি করতে পারে রূপ। তাইতো নিজের সব থেকে প্রিয় মানুষের অনূভুতি কে ফেলে চলে যেতে পারেনি রূপ।
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন চুপচাপ শুয়ে থাকল রূপ। আজ রবিবার তাই অফিস যাওয়ার কোন তাড়া নেই। কিছুক্ষন একটু শুয়ে আবার এককাপ কড়া করে চা বানিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল। ততক্ষনে সূর্য তার পুরো তেজ বিস্তার করতে লেগেছে চারিদিকে। চা খেতে খেতে রূপের হঠাৎ খেয়াল হলো অনেকদিন হলো ওয়াড্রবটা গোছানো হয়নি, একে বারে অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। চট করে তাহলে আজ ওয়াড্রবটা গুছিয়ে নেওয়া যাক। যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
বেড়রুমে এসে বিছানাটা ঠিক করে এফ.এম চালিয়ে গান শুনতে শুনতে কাজে হাত দিল রূপ। ওয়াড্রবটা খোলার সাথে সাথে বেশ কিছু জামা হুড়মুড়িয়ে পড়ল। রূপ আস্তে আস্তে সবকিছু তুলে রেখে ভালো করে গোছাতে শুরু করল। গোছাতে গোছাতে হঠাৎ করে রূপের চোখে পড়ল সেই সাদা পাঞ্জাবিটা যেটাতে প্রথম তুলির ঠোঁটের লিপস্টিককের দাগ লেগে ছিল। পাঞ্জাবিটা সাথে সাথে রূপ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। পাঞ্জাবিটা খুলে লিপস্টিকের জায়গায় হাত বুলিয়ে তুলির ঠোঁটের ছোঁয়াটা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগল রূপ।
****************************************
সেইদিন ছিল সপ্তমী। বাড়িতে পূজো আর রূপ বাড়ির বড়ো ছেলে তাই ওর ঘাড়ে দায়িত্ব অনেক বেশি। অনেক কাজ নিজেকে পুরোপুরি একা সামলাতে হচ্ছে তাই সকাল থেকে ভালো করে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় টুকুও পাইনি রূপ। কাজ কিছুটা গুছিয়ে রেখে স্নান করে নতুন পাঞ্জাবি পড়ে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করে আসছিল। হঠাৎ করে কার সাথে যেন ধাক্কা লাগে। প্রথমে রূপ কিছুই বুঝতে পারেনা তারপর দেখে ঘন কালো চুলে ঢাকা একটা মেয়ের মুখ একদম তার বুকের কাছে। আর তার সর্ব শরীর জুড়ে কি সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের জন্য রূপ অন্য একটা জগতে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বাস্তবের মাটিতে ফেরে একটা সুমধুর গলার আওয়াজ শুনে।
------------চেয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলছে, আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি। আসলে আমি একটু তাড়াতাড়ি করে পূজোর ওখানে যাচ্ছিলাম তাই আপনার সাথে ধাক্কা লেগে গেল। ইসস্ আপনার সাদা পাঞ্জাবিটায় আমার জন্য দাগ লেগে গেল।
এতক্ষনে রূপ ভালো করে চেয়ে দেখল ওর পাঞ্জাবিটাতে ঠোঁটের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
-------------মেয়েটি তাড়াতাড়ি করে রুমাল দিয়ে দাগটা মুছতে গেলে রূপ মেয়েটির হাত ধরে বললে, থাক মুছলে উঠবেনা আমি চেঞ্জ করে আসছি আপনি বরং পূজোর ওখানে যান। আর হ্যাঁ.... আপনাকে তো ঠিক চিনলামনা?
-----------মেয়েটি বলল আমি তুলি। রুদ্রনীল আঙ্কেল আমার বাবার বন্ধু। আমরা কিছুক্ষন আগেই এসেছি। আর আপনার নাম কি ?
------------রূপ হাসতে হাসতে বলল আমার নাম রূপাঞ্জন। আপনার রুদ্রনীল আঙ্কেলের বড়ো ছেলে। সবাই এই অধমকে রূপ বলে ডাকে।
-------------দুজন মিলে একসাথে হো..... হো.... করে হেসে উঠল। তুলি হাত বাড়িয়ে বলল তাহলে এখন থেকে আমরা ফ্রেন্ড রূপ।
এই কথাগুলো মনে পড়ায় রূপ আবার হো.... হো....... করে হেসে উঠল। ফাঁকা ঘরে ওর হাসিটা যেন আরও জোড়ে মনে হল। তখন রেডিওতে গান হচ্ছে.....
"প্রেমে পড়া বারণ......
কারনে অকারন... আঙ্গুলে আঙ্গুল
রাখলেও., হাত ধরা বারন।
প্রেমে পড়া বারন......
শূন্যে ভাসি..... রাত্রি এখনও গুনি....
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার.... শব্দ এখনও শুনি......তাই মুখ লুকিয়ে.......
ঠোঁট ফুলিয়ে বসন্তের
এই স্মৃতিচারণ...,. "।
রূপ এবার নিজের ওয়াড্রবটা বন্ধ করে তুলির ওয়াড্রবটা খুলে তুলির জামা, কাপড় গুলোর ওপর হাত বোলাতে লাগল। হঠাৎ করে লাল শাড়িটা বুকের কাছে নিয়ে রূপ চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কেন চলে গেলে তুলি? এইভাবে আমাকে একা ফেলে। শাড়িটা বুকের মধ্যে নিয়ে আবার অতীতের স্মৃতিতে পা..... দিল রূপ।
সেইদিন ছিল ওদের ফুলসজ্জার রাত। রূপ নিজে পচ্ছন্দ করে টুকটুকে লাল জামদানি শাড়িটা নিয়ে এসেছিল তুলির জন্য। শাড়িটা পড়ে তুলিকে অপরূপ সুন্দর লাগছিল দেখতে। মনে হচ্ছিল শাড়িটা যেন শুধুমাত্র তুলির জন্যই তৈরী হয়েছে। সেইদিন ওরা দুজন একে অপরের ভালোবাসার ছোঁয়ায় নিজেদের নতুন করে রাঙিয়ে নিয়ে ছিল। রূপের চোখদিয়ে শ্রাবনের বারিধারার মতো অনবরত জল পড়ে চলেছে। আর রেডিওতে তখন গান বাজছে.......
"আজ ঠোঁটের কোলাজ.....,
থামালো কাজ.....,মন তোমাকে.....
ছুঁয়ে দিলাম....নাম....,বুকের বোতাম, হারানো খাম....,আজ কেন
যে খুঁজে পেলাম......।"
রূপ বেশ কিছুক্ষণ মেঝেতে বসে কেঁদে চলল। চোখের জল আজ জেন বাঁধ মানছেনা। সে শুধু অবিরাম ধারায় বয়ে চলেছে। বেশ কিছুক্ষন কেঁদে মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্টটাকে কিছুটা হলেও হাল্কা করে রূপ উঠে দাঁড়িয়ে সমস্ত জামা, কাপড় ঠিকমত গুছিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। তখন সূর্য একদম মাথার উপরে উঠে তার প্রচন্ড জলন্ত দৃষ্টি চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। বাইরের পরিবেশ এখন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সকালের সেই শান্ত স্নিগ্ধতা এখন আর নেই। রূপের চোখদুটোও কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে উঠেছে। রূপ ব্যালকনিতে বসে বসে আবার অতীতের পথে পা বাড়াল।
সেই বছর দূর্গা পূজোতে বাড়ি যাবে বলে তুলি খুব আনন্দে ছিল। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যেবেলায় ওরা বাড়ির পথে রওনা দিল। সেইবার পূজোটা খুব আনন্দ আর হই হুল্লোড় করে বাড়ির সবার সাথে কেটে ছিল। কিন্তু রূপ বুঝতে পারেনি এই আনন্দ ওর জীবনের শেষ আনন্দ হয়ে যাবে। দশমীর দিন লাল পাড় সাদা জামদানি সারা মুখ ভর্তি সিঁদুর মেখে তুলিকে পুরো মা দূর্গার মতো দেখতে লাগছিল। রূপ তুলির দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছিল না। সবসময় তুলির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আর মুগ্ধ হয়ে তুলিকে দেখছিল।
------------তুলি রূপের পেটে এক গুতো দিয়ে বলেছিল কি হলো রূপ???? ঐ ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছ বলতো?
----------রূপ বলে ছিল, আমি আমার জ্যান্ত দূর্গাকে দেখছি। কিন্তু তখনও রূপ বুঝতে পারেনি তার জ্যান্ত দূর্গা মাটির দূর্গার সাথে বিসর্জন হয়ে যাবে।
দুপুর হতে না হতেই সবাই মিলে "বল দূর্গা মাইকিজয়..." করতে করতে ভাসানের জন্য বেড়িয়ে পড়ল। নৌকায় মধ্যে ঠাকুর উঠিয়ে সবাই মিলে আনন্দ করে গঙ্গা বক্ষে ঘুরতে লাগল। আরও অনেক ঠাকুর, আর নৌকায় ভর্তি গঙ্গা বক্ষের চারিদিকে। প্রত্যেক বছর এই ভাবেই রূপদের বাড়ির এবং গ্রামের সমস্ত ঠাকুর বিসর্জন হয়। কিন্তু ঠাকুর বিসর্জনের সময় হলো আসল বিপত্তি। ঠাকুরের সাথে সাথে তুলিও নৌকার টাল সামলাতে না পেরে মাঝ গঙ্গার জলে পড়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও কেউ তুলিকে খুঁজে পায়না, তুলি জলের তলায় তলিয়ে যায়। এমনকি দুদিন ধরে খোঁজা খুঁজির পরও তুলির দেহটাকে পায়নি।রূপের চোখের সামনেই তার জ্যান্ত দূর্গার বিসর্জন হয়ে যায়।
রূপ আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। ঘরে এসে বুকের মধ্যে তুলির একটি ছবি জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রূপ এখনও বিশ্বাস করে তার তুলি ঠিক তার কাছে ফিরে আসবে। তুলি কখনও রূপকে এইভাবে একা ফেলে চলে যেতে পারে না। আর এদিকে সূর্যও তার বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়িয়েছে। আকাশের চারিদিকে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। রেডিও থেকে হাল্কা সুরে গান ভেসে আসছে......
"হে প্রিয়তমা......আমি তো তোমায়...
বিদায় কখনও..... দেবনা,
হৃদয়ে আমার কি যে..... ব্যাথা......
তুমি তো সে কথা.... জানোনা.....।
তুমি চলে যাবে.... মালা খুলে রেখে...
স্বপ্নেও আমি ভাবিনি
এই মনেতে আগুন জ্বালিয়ে
কেন যে নিভিয়ে দিলেনা।
হে. প্রিয়তমা।"

