Gopa Ghosh

Romance Classics

5.0  

Gopa Ghosh

Romance Classics

বিশ্বাস

বিশ্বাস

5 mins
738



সলিল ঘরে ঢুকেই বেশ টের পেলো কিছুক্ষণ আগেই একটা খন্ড যুদ্ধ হয়ে গেছে মা মেয়েতে। এটা তার পরিবারে একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার যদিও, তাও ছোট মেয়ে নীলুকে না জিজ্ঞেস করে পারলো না "কি রে, আজ আবার কি নিয়ে লাগলো মা মেয়েতে?" নীলু খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে পড়া মুখস্থ করছিল। বাবার প্রশ্নে পড়া থামিয়ে বলে উঠলো "বিয়ে নিয়ে, আর জিজ্ঞেস কোরো না, অনেক পড়া বাকি"। কথাটা বলেই আবার পড়তে শুরু করলো। সলিল আর কিছু না বলে পাশের ঘরে গিয়ে বউকে জিজ্ঞেস করলো "কি গো, মুখটা এমন লাগছে কেনো, শরীর খারাপ নাকি?" আসলে সরাসরি ঝগড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে অনেক বেশি মুখ ঝামটা খেতে হবে,অবশ্য পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে বউয়ের মুখ ঝামটা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, তবু শুরু টা এভাবেই করে প্রতিবার। বউ শুক্লার যেনো আগুনে ঘি পড়লো সলিল এর প্রশ্নে "হ্যাঁ, আমার আর বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই, বড় মেয়েকে তো লাই দিয়ে মাথায় তুলে বসে আছো, এখন বলছে তমাল না ফিরলে সে নাকি আর কাউকেই বিয়ে করতে পারবে না, ধন্যি মেয়ে বটে তোমার" সলিল আর বেশি কথা বাড়ালো না কারণ সে যা বোঝার তা ভালো ভাবেই বুঝে গেছে। 

সলিলের বড় মেয়ে পারুল পড়াশুনা শেষ করে একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করে। মেজো মেয়ে শিমুল ছোটো থেকেই মামার বাড়িতে মানুষ হলেও সম্প্রতি তাদের কাছেই আছে। আসলে পারুল আর শিমুল পিঠোপিঠি বলে শুক্লা সামলাতে পারতো না। তাই দেখে শুক্লার মা নাতনিকে এতদিন নিজের কাছেই রেখে মানুষ করেছে। কয়েক মাস আগে শুক্লার মা মারা যেতে সলিল মেয়েকে মামার বাড়ি থেকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। সলিল খুব অভাবের মধ্যেই মেয়েদের মানুষ করলেও তাদের পড়াশোনায় কোনো খামতি হতে দেননি। বাড়ী ভাড়া ছাড়া নিজের রোজগার বলতে ছোটো খাটো কম্পাউদারি। এক সময় এক ডাক্তারের চেম্বারে কাজ করায় কিছু কিছু শিখেছিল, সেটা এখন কাজে লাগায়। তবে তাতে টেনেটুনে সংসারটা যাহোক করে চলে যায়

 পারুল স্কুলে চাকরি পাওয়ার পর একটু স্বস্তি। তবে মেয়ের বিয়ে নিয়ে সলিল আর ওর বউয়ের খুব চিন্তা। চিন্তার একটা বড় কারণ ওদের পাড়ার তমাল। ছেলেটা যদি থাকতো তাহলে তো চিন্তা ছিল না কিন্তু বলা যেতে পারে সে নিরুদ্দেশ। তমাল মিলিটারি তে জয়েন করে বার দুয়েক বাড়ী এসেছিল, আর তখনই সলিল জানতে পারে পারুল আর তমাল নাকি অনেকদিন ধরেই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। পারুলের মায়ের কোনো আপত্তি ছিল না। বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায় দুই পরিবারের উপস্থিতে। বিয়ের দিনও স্থির হয়।কিন্তু তমাল কে জানানো সত্বেও সে ছুটি পাবে না বলে ওইদিন বিয়ে নাকচ করে দেয়। এই নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে মন কষাকষি শুরু। কিন্তু পারুলের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তাই তো একদিন মায়ের এক প্রশ্নে উত্তর দিয়েছিলো "তুমি কি করে ভাবলে, তমাল বিয়ে না করার জন্য ছুটি না পাওয়ার বাহানা করছে" শুক্লা বেশ ঝাঁজের সাথে উত্তর দিয়েছিলো "দেশে কি আর চাকরি নেই? পড়াশোনায় তো খুব ভালো, একটা অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নিতে পারলো না?" পারুল ঈষৎ হেসে বলে উঠলো "তোমার মতো যদি সবার মা হতো তাহলে দেশকে রক্ষা করাই মুশকিল হয়ে পড়তো, মা তমালের জন্য আমার গর্ব হয়, তোমরা আমার বিয়ের জন্য এত চিন্তা কোরো না, ওর এখন অনেক কাজ" কথা শেষ হওয়ার আগেই শুক্লা বলে উঠলো "চিন্তা তো থাকবেই, শিমুলটার ব্যবস্থাও তো করতে হবে না কি? এখন নীলু ছোটো হলেও তার চিন্তাও আছে, তুই শুধু তোর চিন্তাই করিস, বোনদের কথাও ভাবতে হবে বুঝলি?" 

আরো একবার তমাল বিয়ের জন্য ছুটি পেলো না। তখন কাশ্মীর নিয়ে দেশে উথাল পাথাল চলছে, ছুটি মঞ্জুর হলো না। পারুল শুনে যেনো কিছুই হয় নি এমন করে ফোনে তমালকে এই বলে আশ্বস্ত করলো যে সে সারাটা জীবন তার অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিতে পারে হাসি মুখে, তাই তমাল যেনো তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেই ফেরে। মেয়ের মুখে এই কথা শুনে শুক্লার রাগে গা জ্বলে উঠলো। মেয়েকে হাজার কথা শুনিয়ে প্রাণ একটু ঠান্ডা করলো। পারুলকে বারবার বোঝালেও সে এক কথায় বলতে থাকে "তমালকে আমার চেয়ে বেশি এখন দেশের প্রয়োজন, ওকে ওর কাজ করতে দাও, আর শিমুলের বিয়ে দিয়ে দাও, ও কেনো আমার জন্য সাফার করবে?" 

পারুলের কথাই ফলে গেলো। শুক্লা ভালো পাত্র হাতছাড়া করলো না। শিমুলের বিয়ে হয়ে গেলো। তমালের ফোন বেশ কিছুদিন ধরেই সুইচড আফ বলছে। এই নিয়ে তার বাড়িতে সবাই খুব চিন্তায় আছে। পারুলও কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের মত আর কথা বলে না। শুক্লা অবশ্য বিয়ের কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। সলিল অসুস্থ হওয়ার পর পারুলই বাইরের সব কাজ করে। আসলে শুক্লা ভেবেই নিয়েছিল তমাল আর কোনোদিন ফিরবে না। শুধু শুক্লা কেনো তমালের পরিবারও প্রায় তার আসার আশা ছেড়েই দিয়েছিলো। সেই সময় শত্রু দেশের হাতে বেশ কিছু সৈন্য বন্দী হওয়ার খবরে সবার এই ধারণা বদ্ধ হয়। কিন্তু পারুল একথা বিশ্বাস করতো না। কেউ আরো এককাঠি এগিয়ে বলতো "ও দেশের জন্য শহীদ হয়েছে, তুই এবার বিয়ে করে সংসার কর, তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তো বুড়ি হয়ে যাবি"। পারুল এ কথার উত্তরে বেশ মেজাজ দেখিয়ে বলতো "তোর তাতে কি, আমি বুড়ি হয়ে গেলেও ও আমাকে বিয়ে করবে, এটা জেনে রাখিস"। 

সত্যি পারুলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলো। দুই বোনের বিয়েও হয়ে গেলো। পারুলের বিশ্বাস এক ফোঁটাও টাল খেলো না। যেনো আরো বেশি দৃড় হয়ে উঠল। তমাল ফেরার আশায় পাতলা হয়ে যাওয়া চুলে বেনি করে, ফ্যাকাসে মুখে পাউডার বুলিয়ে কপালে ছোট্ট একটা টিপ পরে সেজে জানালার গরাদ ধরে দু চোখের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো পথের দিকে। মন বলতো যদি সে বেঁচে থাকে তাহলে একবার আসবেই। পারুলকে দেখে এখন সবাই হেসে বলে "এই হলো কপাল, সময়ে বিয়ে করলো না এখন সং সেজে নতুন প্রেমিক ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, দেখে গা পিত্তি জ্বলে যায়"। পারুল এসব কথা যেনো শুনেও শোনে না। তার মন তমালকে বিশ্বাস করতে চায়, তাতে যে কোনো মূল্য দিতে হয় দেবে, কিছুতেই পিছপা হবে না। মৃত্যুর আগে যদি দেখা না হয়, তো পরের জন্মে সে নিশ্চয়ই তমালকে পাবে। 

তার নির্ভেজাল বিশ্বাস সত্যি হলো, তমাল ফিরে এলো একদিন, তবে শত্রু দেশ তাকে রেহাই দিলেও শরীরকে রেহাই দেয় নি। তাদের অমানুষিক অত্যাচারে সে পঙ্গু হয়ে ফিরেছে। পারুল যে তার জন্য এতদিন অপেক্ষা করে আছে এটা তার বিশ্বাস করতে অনেক সময় লেগেছিল। দুজনের চোখের জল আর কোনো বাধা মানে নি। পারুলের দৃড় বিশ্বাস আর অটুট ভালোবাসায় ও মনের মানুষকে নিজের করে পেয়েছিল। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance