বিজয়া
বিজয়া
ছোটবেলায় বিজয়া দশমীর কথা মনে হলেই মনে পড়ে যায় মায়ের হাতের নিমকি, নারকোল ছাপা, গোকুল পিঠে আর কিমার ঘুগনি। আমাদের পাড়ার ছেলেরা রীতিমতো বায়না করে বিজয়া করতে আসতো, “ কাকীমা কাল আপনার বাড়ী বিজয়া করতে আসব আমরা, আপনার হাতের কিমার ঘুগনি কিন্তু চাই।“ মাও ওদের আবদার মেনে কিমার ঘুগনি খাওয়াতেন। এটা যখন কার কথা বলছি তখন আমার বয়স এই সাত আট বছর। তখন পাড়ার সবার বাড়ী বিজয়া করতে যাবার চল ছিল। পাড়ার দিদিদের সাথে আমরাও যেতাম আশপাশের বাড়িতে বিজয়া করতে। এক এক বাড়ী একেক রকম। যে সব বাড়িতে বেশি মিষ্টি খাওয়াত, তাদের বাড়ী প্রথমে যাওয়া হত। যাতে সব মিষ্টিগুলো খাওয়ার জায়গা থাকে পেটে। আর যারা তেমন ভালো খাওয়াত না তাদের বাড়ী পরে গেলেও চলতো। পাড়ার জয়দাদের বাড়ী ঢোকার আগে বুলুদি আমায় শিখিয়ে দিয়েছিল, “ শোন, যেই কুঁচো গজার প্লেটটা দেবে , খাবলা করে যতটা পারবি তুলে নিবি বুঝলি?”
আমরা বাড়িতে ঢুকে কাকু আর কাকীমাকে প্রণাম করে বাইরের ঘরের বেতের সোফার উপর লক্ষ্মী মেয়ের মত বসে আছি। কাকীমা একটা মাঝারি আকারের থালায় চুড় করা কুঁচো গজা নিয়ে এসে সামনের টেবিলের উপর রাখলেন। বড় দিদিরা একে একে হাত ভরে ভরে কুঁচো গজা তুলে নিলো। আমি সবার ছোট তাই সবার শেষে নেব। আমি দেখলাম তখনও প্লেটে অর্ধেকের বেশি কুঁচো গজা রয়েছে। আমি ভাবলাম অনেক তো আছে তাহলে আর খাবলা খাবলি করার কি আছে? আমি দুটো গজা হাতে তুলে খেতে শুরু করলাম। ভাবলাম পরে আবার নেব। কিন্তু আমি গজা তোলার সঙ্গে সঙ্গেই কাকীমা প্লেটটা উঠিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তারপর আর একটা ট্রে তে আমাদের জন্য জলের গ্লাস নিয়ে এলেন। ওদের বাড়ীর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বুলুদির হাতের একটা গাট্টা টাই করে পড়লো আমার মাথায়, ”এতো করে শিখিয়ে নিয়ে গেলাম , দেখলি তো কিছুই পেলি না।“ আমি ছলছল চোখে নিঃশব্দে গাঁট্টাটা হজম করলাম।
বিজয়াতে ছোটরাই বড়দের বাড়িতে প্রণাম করতে যায়, এটাই রীতি কিন্তু আমাদের বাড়িতে আমার মায়ের এক দূরসম্পর্কের মাসিমা প্রতিবার আসতেন। সারা বছর যদিও আমরা তার দেখা পেতাম না। কিন্তু বিজয়ার পর অবশ্যই তিনি আসতেন আর এসেই বলতেন, “ এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলুম, ভাবলুম দেখা করে যাই। আমি ওসব বড় ছোট মানি না। তোমরা সব পাঁচ কাজে ব্যস্ত। তোমরা কি আর আসতে পারো?”
মা ওনাকে প্রণাম করতে করতে হেসে বলতেন,” তাতে কি হয়েছে? আপনি এসেছেন আমার খুব ভালো লাগছে।“ তারপর মা প্লেট ভরে নিমকি, নারকোল ছাপা, গোকুল পিঠে সব সাজিয়ে দিতেন।
“সব তুমি নিজে বানিয়েছ ? কত গুণ তোমার, আজকাল তো সবাই কেনা মিষ্টিই দেয়। “ তারপর নিজের কাঁধ ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বার করতেন যার মধ্যে অনেক মিষ্টি আগে থেকেই ভরা থাকতো।
“আমার আবার ডাইবিটিস, মিষ্টি খাওয়া বারণ। তাই নাতিটার জন্য নিয়ে যাই।” বলে প্লেট শুদ্ধু জিনিষ ঢেলে দিতেন ওই প্যাকেটের মধ্যে। প্যাকেটের মধ্যের নোনতা মিষ্টি মিলে যে খিচুড়ি টা তৈরি হত সেটা দেখে আমরা ভাবতাম ওগুলো কি আর খাওয়া যাবে? একথা পড়ে যদি আপনাদের মনে এই ধারণা হয় যে, আহা! মহিলা নিশ্চয় খুবই গরিব, তাহলে বলে রাখ, উনি নিজের গাড়িতে আসতেন। আর ওনার ব্যাগটা ওনার ড্রাইভার বয়ে নিয়ে যেত।
নাগপুরে বিজয়া শুরু হয় বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে। কারণ একাদশীর দিন থেকে বাচ্চাদের পরীক্ষা শুরু হয়। তাই ঠাকুর ভাসানের সময় যা প্রণাম কোলাকুলি হল , ব্যাস, তারপর পরীক্ষা শেষ হোলে আবার শুরু হয় বিজয়া। আমরা বিজয়া শুরু করি শ্রুতিদের বাড়ী থেকে কারণ শ্রুতির মা ওদের সঙ্গে থাকেন। তাই আমরা সবাই একদিন ওনাকে প্রণাম করেতে যাই। সাধারণত দিনটা হয় শনিবার বিকাল। মাসিমা কে প্রণাম করে আমরা ওদের বাড়ীতেই রাতের খাওয়া সেরে অনেক রাতে বাড়ী ফিরি। এই দিনটায় হয় আমদের পুজোর রি-ক্যাপ। পুজোর কয়দিন কি কি হল, কে কি করলো বা না করলো সেই নিয়ে আলোচনা। সাধারণত বাচ্চারা আগে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বা টিভি দেখে। আর আমাদের জোরদার আলোচনা চলতে থাকে মাঝরাত অবধি। পরেরদিন রবিবার হওয়াতে কারুর বাড়ী যাবার তাড়া থাকে না।
শ্রুতির বাড়ির পর আমরা উমা বউদির বাড়িতে বিজয়া করতে যাই। উমা বৌদি আর রবিদা আমাদের থেকে বয়সে একটু বড়। উমা বউদির স্বভাবটা খুব মিষ্টি। ওনাকে কখনো রাগতে বা জোরে কথা বলতে দেখিনি। ওনারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই খুবই শিক্ষিত ও মার্জিত। চারিদিকে বাগানে ঘেরা ওনাদের বাড়িতে ঢুকলেই মনে হয় যেন একটা শান্তির নীড়ে ঢুকলাম। এ হেন উমা বউদির বাড়িতে প্রতি বছর বিজয়ার সময় আমরা সবাই একসাথে মরুভূমির ধুলোর ঝড়ের মত গিয়ে ঢুকি। আমাদের বাচ্চারা এক তলায় আর আমরা বড়রা দুতলায় হুল্লোড় করতে থাকি। ওনারা অবশ্য আমাদের এই অত্যাচার হাসি মুখে মেনে নেন।
সেবারও আমরা সবাই একসাথে ওনাদের বাড়িতে হামলা করেছি। তুমুল গল্প হচ্ছে। উমা বৌদি প্রচুর রান্না করেছেন। আমরা স্নাক্স খেতে খেতে গল্প করছি। আমাদের কোন হুঁশ নেই দেখে উমা বৌদি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বাচ্চাদের ডেকে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। সবাই মিলে একটা পিকনিকে যাবার পরিকল্পনা চলছিল। হঠাৎ আমাদের খেয়াল হল যে অনেক রাত হয়ে গেছে। তখন তড়ি ঘড়ি করে আমরা খাবার খেয়ে বেরোনোর তোড়জোড় শুরু করে দিলাম। প্রতিবারই বাড়ী ফেরার সময় উমা বউদি আমাদের কিছু না কিছু প্যাক করে দিয়ে দেন। সেবারও তার ব্যতিক্রম হল না। উনি তাড়াতাড়ি ওনার বানানো পাটিসাপটা disposable container এ প্যাক করে আমাদের দিয়ে দিলেন। আমরাও টিপিকাল “বাঙালীর মেয়ের” মত গুছিয়ে ছাঁদা বেঁধে যে যার গাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম। তখনও পিকনিকে কি খাওয়া হবে, কে কি বানিয়ে আনবে, এই সব আলোচনা হয়ে চলেছে। আমরা শাড়ী, ভ্যানিটিব্যাগ, ছাঁদা সামলে গাড়িতে উঠলাম, আর আমাদের বরেরা বসলো স্টিয়ারিঙে। আলোচনা তখনও চলছে। গাড়ী চালু করে আমরা বেরোতে যাব, এমন সময় দেখলাম উমা বৌদি উদভ্রান্তের মতো বাগান দিয়ে ছুটে এসে আমাদের গাড়ি গুলোর সামনে লাফিয়ে পড়লেন। আমরা হকচকিয়ে যে যার গাড়িতে ঘচাং ঘচাং করে ব্রেক মারলাম। উমা বউদি হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে উঠলেন ,” আরে তোমাদের বাচ্চাগুলো নিচের ঘরে ঘুমোচ্ছে, ওদের কেও নিয়ে যাও প্লিস”।