বিজয়িনী
বিজয়িনী
আজকে সকালে কাজে যেতেই বড়বৌদি বলল ‘মালতী আজকের দিনটা তো তুই ছুটি নিতেই পারতিস। কালকে তোকে এতবার করে বললাম যে আজকে কাজে আসতে হবে না, কিন্তু তুই তো কানেই নিলিনা। আর কেউ না বুঝুক আমি তো বুঝি তোর কাছে আজকে তোর যুদ্ধ জয়ের দিন।’ মালতী তার স্বভাবগত একগাল হেসে বলল ‘বৌদি এই কাজটা ছিল আর তোমার মত মানুষ ছিল বলেই আমি যুদ্ধটা চালাতে পেরেছি, তাই বলে আজকে পুরোনো দিনগুলো কি করে ভুলে যাই বল। আর আমি জানি আজকের দিনের আনন্দ তোমার কাছেও কিছু কম নয়।’ এই কথা বলতে বলতে মালতী তার রোজকার কাজগুলো করতে লাগলো।
মালতীর আজ বারবার মনে পড়তে লগলো সেইদিনের কথা। যেদিন তার বর আর একটা বিয়ে করে এনেছিল আর তার কোলে পাঁচ বছরের মেয়েকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘ছবছর ধরে অনেক গিলেছিস। এবার রাস্তায় গিয়ে মা মেয়েতে ভিক্ষে করে খা। একটা ছেলে বিয়োতে পারিসনি, তোকে আর তোর মেয়েকে আমি বসে বসে গেলাবো ভেবেছিস?’
মালতী বাপ মা মরা মেয়ে দুকূলে তার আপন বলতে ছিল এক দূর সর্ম্পকের পিসি, তার দয়াতেই সিন্দুর জুটেছিল মালতীর কপালে। তা সে পিসিও দুবছর হলো সগ্গে গেছে। যাহোক করে লাথি ঝ্যাঁটা খেয়ে পড়েছিল এখানে কিন্তু এবার তো তার কপাল পুড়লো। নিজের বিদ্যে নেই এই মেয়ে নিয়ে সে কি করবে ভেবে তার বরের হাত পা ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো, কিন্তু কিছুতেই কোনো ফল হলো না। তাকে সংসার থেকে বের করেই দেওয়া হলো।
জামাকাপড়ের পুঁটলি আর মেয়ের হাত ধরে পথে বেরিয়ে যখন সে ভাবছে কি করবে তখনই মুখুজ্জ্যে বাড়ির বড় বৌয়ের সাথে দেখা। এরা থাকতো কোলকাতায়। মাঝে মাঝে দুএকদিনের জন্য আসতো গাঁয়ের বাড়িতে। বড়বৌদি সব শুনে বলল ‘তোর কোনো চিন্তা নেই তুই আমার সাথে কোলকাতায় চল। আমার বাড়িতে কাজ করবি।’ মালতীও চিনতো বড়বৌদিকে, বড় ভালো মানুষ। তাই সেও এককথায় রাজি হয়ে গেলো।
প্রথম প্রথম বড়বৌদির বাড়িতেই কিছুদিন ছিল সে ও তার মেয়ে মিলি। তারপর একটা ছোট্ট বাসা দেখে সেখানেই মা ও মেয়ের সংসার শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই মিলি বড়বৌদিকে ‘বড়মা’ বলে ডাকে। বড়বৌদি অবশ্য বলেছিল ‘মালতী তোর আলাদা বাসা নেওয়ার দরকার নেই। তুই আমাদের এখানেই থাক।’ মালতী রাজি হয়নি বলেছিল ‘না বড়বৌদি তুমি আমার অনেক উপকার করেচো যার ঋণ আমি কোনদিন শুধতে পারবোনি। তাই আমি দশবাড়ি কাজ করে মা-ঝিয়ের পেট আর ঘরভাড়া চালিয়ে নোবো।’ বড়বৌদি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গিয়েছিল মালতীর জেদের সামনে।
যেকদিন মালতী তাদের বাড়িতে ছিল তাকে কাজ বাবাদ মাইনে দিতে গেলে সে বলল ‘থাকতে দেছো, খেতে দেছো, এ পয়সা আমি নিতে পারবোনি।’ তাই সে কমাসের টাকা বড়বৌদি জমিয়ে রেখেছিল নিজের কাছে। মালতীর নতুন সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়েছে তা দিয়ে। কিন্তু এবার যখন মালতী নিজের মেয়েকে নিয়ে বাসায় থাকতে শুরু করলেও আগের মতোই সব বাড়ির কাজ সেরে বড়বৌদির সংসারের সব কাজ করতে লাগল তখন মাসের প্রথমে বড়বৌদি তাকে মাইনে দিতে গেলে সে বলল ‘মাপ করো বৌদি আমি তোমার থেকে কিছুতেই টাকা নিতে পারবোনি।’ বড়বৌদি এবার একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলল ‘সব সময় তোর কথা শুনতে হবে এর কোনো মানে নেই। এবার তুই আমার কথা শোন তুই যখন টাকা নিবিই না তখন এই টাকা দিয়ে আমি মিলিকে স্কুলে পড়াবো। আর এটাই আমার শেষ কথা।’ এবার আর মালতী না করতে পারলোনা। বড়বৌদি যে নিজের সন্তানের মতোই মিলিকে ভালোবাসে। সেই থেকেই মিলির পড়াশুনার শুরু।
বরাবরই মেধাবী ছাত্রী ছিল মিলি তাই স্কলারশিপের পয়সায় আর বড়মার সাহায্যে পড়াশোনা চালাতে তার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
এই সময় মালতীর চিন্তাকে বিঘ্নিত করে সদর দরজা দিয়ে ভেসে এল একটা কন্ঠস্বর ‘মা, বড়মা তোমরা সব কোথায় গেলে।’ বড়বৌদি ও মালতী প্রায় দৌঁড়ে গেলো সদর দরজার কাছে। দুজনকে একসঙ্গে দেখে মিলি তাদের প্রণাম করে বলল ‘আমি জানতাম এইসময় মাকে এখানেই পাওয়া যাবে তাই বাড়ি না গিয়ে সোজা এখানেই চলে এলাম।’ এই বলে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে দুটো মেডেল বের করে মা আর বড়মার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল ‘আমি খুব মন দিয়ে পড়েছি জানোতো কারণ আমার যে একটা মেডেল পেলে হবে না। তাই আমি শুধু আমার কলেজেই নয় স্টেটের মধ্যেও প্রথম হয়েছি ডাক্তারি পরীক্ষায়।’
মিলিকে দুজনে বুকে জড়িয়ে চোখের জলে ভাসিয়ে দিল এতদিনের জমানো দুঃখগুলো।