ইচ্ছে ডানা

Romance Tragedy

3  

ইচ্ছে ডানা

Romance Tragedy

বিচ্ছেদ

বিচ্ছেদ

11 mins
330


 পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে দুটি প্রেমিক হৃদর তাদের সাদা ক্যানভাসের মত স্মৃতির পাতায় রোমন্থন করতে থাকে অতীতে ফেলে আসা রঙিন তুলির টানে অঙ্কিত সুন্দর সাজানো এক চিত্রপট।যেখানে বিভিন্ন রঙের উপস্থাপনায় জীবন হয়ে উঠেছিল সবুজ প্রাণবন্ত,কালো রঙের সূক্ষ্ম বিন্দু মাত্র ছিল না।সব কিছুই ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দিনের আলোর মত স্পষ্ট।কিন্তু হঠাৎ জীবনের নির্মল আকাশে কালো ঘন মেঘরাশির মত সন্দেহ বাসা বাঁধায় ভালোবাসায় নির্মিত পর্ন কুটির খড়কুটোর ন্যায় ভেসে গেছে।বয়ে গেছে দুটি ভালোবাসার মানুষ জীবনের মূল প্রবাহ থেকে আপন আপন গতিপথে।


তিথি আর তমাল একটি প্রাইভেট সেক্টরে একত্র কাজ করার সুবাদে পরিচিতি লাভ করে।দীর্ঘ পরিচিতির সূত্রধরে একে অপরের সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব পরে তা আরও সুগভীর হয়ে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়।মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তমাল।বাবা,মা,ছোট বোন আর তমাল,চার জনের এই ছোট্ট পৃথিবী।অবসর প্রাপ্ত বৃদ্ধ বাবা,তার পেনশানের সামান্য অর্থ দিয়ে সংসার চালাতে অক্ষম,তাদের একমাত্র আশা-ভরসা হল তাদের একমাত্র পুত্র তমাল।তমাল যা উপার্জন করে তা দিয়ে হাসতে খেলতে কেটে যায় ওদের জীবন।মানসিক তৃপ্তি যেখানে থাকে সেখানে অর্থের অভাব সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারে না।তমালের বোন তৃষা,সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়ায় ওর পড়ায় সমস্ত খরচ তমাল বিনা দ্বিধায় নিজে বহন করে।দুই ভাই বোনের মধ্যে অসম্ভব মিল,পরস্পর ঝগড়া,খুনসুটি করলেও একজন আরেকজনকে চোখে হারায়।


তিথি অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের মেয়ে।পোশাক আশাক, চাল চলন,দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সবকিছুর মধ্যেই এক উশৃঙ্খলতা পরিলক্ষিত হয়,কিন্তু মনের দিক থেকে তিথি অনেক উন্নত,উদার মনভাবাপন্ন।বাহ্যিক আবরণের অন্তরালে যে এক কোমল ও দয়ালু চিত্ত বর্তমান,তার অনেক প্রমান আছে।দরিদ্র মানুষের বেদনায় তিথির মন কাঁদে, নিঃস্বার্থ ভাবে তাদের জন্য কিছু করতে পারলে সে মানসিক পরিতৃপ্তি লাভ করে।নিজের উপার্জনের থেকে অর্থ বাঁচিয়ে দুস্ত অভাবী মানুষদের সাহায্যে তা নিয়োজিত করে।বেশ খোলামেলা মনের মেয়ে তিথি,নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই তার বন্ধু এবং সে সবার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ট।


তমালদের পরিবার মধ্যবিত্ত হওয়ায় পরিবারের মানসিকতাও একটু জটিল।যেমন মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরতে পারবে না,যত্রতত্র যেথায় সেথায় বিচরণ করতেও তাদের মানা,অনেকটা পুরুষদের পদতলে থাকার মত,নিজের ইচ্ছা বলতে কিছুই যাদের থাকবে না।তৃষা ছোট থেকেই এমন একটা পরিবারে বেড়ে উঠায় এই সব প্রতিবন্ধকতা মন থেকে মানতে না পারলেও প্রতিবাদ করেনি কখনও।ওর দৃঢ় বিশ্বাস এসব নিয়ম শৃঙ্খলায় আবদ্ধ হয়ে যখন কোন খারাপ কিছু হচ্ছে না তাহলে তা মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়।ছোট থেকে কড়া অনুশাসনে বেড়ে ওঠায় এবং নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকার দরুন তমালও অতটা মুক্ত ও স্বাধীন মনভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারেনি।মনের কোণে কোথাও সেই দ্বন্ধ একটু ছিল।


তিথি আর তমালের সম্পর্কটা ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার সুবাদে মাঝে মাঝেই নানা অজুহাতে বেশ রঙিন পানিও সহযোগে লেট নাইট পার্টি হত যেখানে সকলে মিলে আনন্দ, নাচ,গানের মধ্যে দিয়ে সেই রঙিন পানিও সেবনের মধ্যে দিয়ে পার্টি উপভোগ করতো।তিথি বা তমাল কেউই এর ব্যতিক্রম নয়।তবে এদের পান করার মাত্রা অত্যন্ত সীমিত,বেহুশ হওয়ার মত অতিরিক্ত পানিও সেবন এরা কেউই করে না।পার্টি সমাপান্তে তমালই তিথিকে তার গৃহে পৌঁছে দেয়।এটা প্রায় রোজকার কাজের মধ্যে পড়ে বললেই চলে।তমালও তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে এতটুকু পথ একসঙ্গে চলার সুযোগটুকু হস্তচ্যূত হতে দিতে চায় না।প্রেয়সীর সঙ্গে এতটুকু পথ চলতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান বলে প্রতিপন্ন হয় তমালের।


সুযোগ পেলেই অফিস ছুটির পর দুজনে চলে আসে একাকী নিরিবিলি স্থানে সময় কাটাবে বলে।রাতের অন্ধকারে হাজার তারার আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে লেকের ধারের স্ট্রিট লাইট গুলি যেন এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করে।চারিদিকে নিস্তব্ধতা,লেকের জলে রঙিন আলোর প্রতিবিম্বের হাওয়ার দোলায় উদ্দাম নৃত্য এক অনন্য অনুভূতির সৃষ্টি করে।এমতাবস্থায় দুটি প্রেমিক হৃদয় একে অপরকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পাওয়ার বাসনা কি অসম্ভব কিছু।লেকের শীতল জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে তিথি ও তমাল।চারিদিকে বইতে থাকা শীতল বাতাস তিথির শরীরে যেন শিহরণ তুলে যায়,তা পরিলক্ষিত হওয়া মাত্রই তমাল তার দুবাহু প্রসারিত করে তিথিকে জাপটে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের মাঝে।আর নিজের ঠোঁটের উষ্ম ছোঁয়ায় উষ্ণতা প্রদান করতে থাকে তিথিকে।তিথিও ভালোবাসার মানুষের উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পিত করতে থাকে।


তিথি আর তমালের কলিগ রাহুল।দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম আর ধনী পরিবারের ছেলে,বড্ড মিশুকে এবং আমদপ্রবন ব্যক্তি।এই রাহুলের সঙ্গে তমাল যখনই নিজের প্রেয়সীকে একটু হেসে বাক্যালাপ করতে দেখে ওর প্রেমিক হৃদয় হিংসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে।একদন্ডও নিজেকে স্থির রাখতে পারে না তমাল।কাওকে অত্যাধিক পরিমান ভালোবাসলে হয়ত এমনটাই হয়,যেটা নিজের সেটাকে কেউ স্পর্শ করবে বা দর্শন করবে তা বোধহয় ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। চোখের সামনে অনেকক্ষন ওদের এভাবে বাক্যালাপ করতে দেখে নিজেকে আর রুদ্ধ করতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে বলে,"excuse me," তমালের কন্ঠস্বর শুনে দুজনেই তাকায় সেইদিকে।"বলছি তিথি আমার সঙ্গে একটু এদিকে এসো তো,"তমালের এরূপ আচরণে তিথি খানিকটা অবাক হয়ে এগিয়ে আসে তমালের দিকে,"কি হয়েছে?তুমিএভাবে আমাকে ডাকছ কেন?" তমাল তিথির কথায় কোন উত্তর না দিয়ে তিথির হাতের কব্জির ওপর চেপে ধরে টেনে ওখান থেকে নিয়ে যায়।


অফিসের ব্যালকনিতে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় তিথিকে,তর্জনী তুলে উচ্চ কণ্ঠে চিৎকার করে বলে,"তোমাকে আর কতবার বলবো তিথি!তুমি কারোর সঙ্গে এভাবে হেসে কথা বলবে না," তিথি নিস্পলক চোখে তমালের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তমাল নিজের রাগকে সামলে নিয়ে তিথির দু'কাঁধে হাত রেখে চোখে চোখ মিলিয়ে করুন সুরে বলে,"তুমি কেন বোঝনা তিথি,আমি যে তোমাকে খুব ভালোবাসি,আমার ভালোবাসাকে কেউ এভাবে তার লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে গিলবে,তা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি কি করে বল,তাই একটু বেশি রিয়াক্ট করে ফেলেছি, প্লিজ,রাগ করো না লক্ষ্মীটি,আমার মনের অবস্থাটা একটু বোঝ।"তমালের বর্তমান মানসিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে তিথি তার নরম হাতের আলতো স্পর্শ দেয় তমালের গালে,আর মৃদু কণ্ঠে বলে,"এত ভালোবাসো আমায়, যে কারোর সঙ্গে একটু কথা বলায় তুমি এত মানসিক আঘাত প্রাপ্ত হও,হুমম।" তমাল আর কোন কথা না বলে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তিথিকে নিজের বক্ষ মাঝে আর তিথির ললাটে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দেয়।তমালের উষ্ণ স্পর্শে তিথি সামান্য কেঁপে উঠে আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়।


তিথির পারিবারিক স্বচ্ছলতা তমালদের তুলনায় অনেকাংশে ভালো।প্রথমে তিথির বাড়ির সদস্য বৃন্দ ওদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে তিথির জেদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে ওর পরিবারের সদস্যরা তিথি আর তমালের সম্পর্ক মেনে নিতে বাধ্য হয়।আসলে ছোট থেকেই তিথি কোন জিনিসের অভাব সেভাবে উপলব্ধি করে নি,যা চেয়েছে তাই নির্দ্বিধায় হাতের কাছে পেয়ে এসেছে,দারিদ্র তথা অভাব কি জিনিস সেটা তিথি জানে না,তাই তমালদের পরিবারে ও কি করে মানিয়ে নেবে সেটাই চিন্তার বিষয়।সর্বোপরি তিথি স্বাধীন,সে নিজের মত চলা ফেরা,পোশাক আশাক ব্যবহার করে,ওর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে সেটা তিথির একদম অপছন্দ।শত বাঁধা সত্বেও তিথির পরিবারের সদস্যরা এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনি।অগত্যাএক শুভ দিন দেখে তিথি আর তমালের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয় আর দুটি প্রেমিক হৃদয় সাত পাকের বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ হয়ে নব দাম্পত্য জীবন প্রারম্ভ করে।


তিথি আর তমাল ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন চিন্তাধারা নিয়ে বেড়ে উঠেছে।তিথি ছিল যথেষ্ঠ স্বাধীন,মুক্ত চিন্তার অধিকারিণী।অপরদিকে তমালের জীবন ছিল পিতা মাতা কতৃক নিয়ন্ত্রিত নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ,স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তা করার অবকাশ সেখানে নেই বললেই চলে।প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করার জন্য তিথির পোশাক ছিল একটু খোলা মেলা ধরণের,আধুনিক।তথাকথিত বাঙালি পরিবারের নব বধূর ঐতিহ্য বহন কারী শাড়ি সে একেবারেই বর্জন করেছিল।তমালের পরিবার যেহেতু পুরনো ভাব ধারায় বিশ্বাসী সেহেতু তিথির এই অতিরিক্ত বেপরোয়াপনা তাদের কাছে ক্রমশ বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছিল।তমালের তিথির প্রতি অতিরিক্ত পসেসিভনেস ওদের ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনকেও ঢিলে করতে শুরু করে।


রাহুল ওদের অফিস কলিগ হলেও তমালের মনে ওকে নিয়ে একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করত সবসময়,তিথিকে হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক।রাহুল আর তিথির বন্ধু হওয়া সত্বেও রাহুল ও তিথির সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখত তমাল।একটা সন্দেহ ধীরে ধীরে বাসা বেঁধেছিল ওর মনে,যার সূক্ষ্ম জাল কেটে তমাল কোন মতেই বেরিয়ে আসতে পারেনি।আর এই সন্দেহকে ও নিশ্চিত রূপে প্রতিপন্ন করে যখন একদিন তমাল অফিসে না যাওয়ায় তিথি ড্রিংক করে রাহুলের গাড়ি করে বেশ রাতে বাড়ি ফিরেছিল, মাথা এলিয়ে দিয়ে প্রায় অর্ধ নির্মিলীত নয়নে রাহুলের কাঁধকে অবলম্বন করে।ওদের দুজনের সুখের সংসারে তো আগে থেকেই সন্দেহের অগ্নি স্ফুলিঙ্গ ছিল কিন্তু তা দাবানলের রূপ ধারণ করে যখন তমাল তিথিকে এই অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করে।সেই সময় কোনমতে নিজেকে সামলে নেয় তমাল,কিন্তু মনে তখনও ক্রোধের আগুন বর্তমান।তিথিকে অচৈতন্য দেখে তমাল ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়।একমনে তিথির ঘুমন্ত মুখের দিকে নিরাশ নয়নে চেয়ে থেকে আপন মনে বলতে থাকে,"কেন করলে তিথি এরকম,কি দোষ ছিল আমার,আমি তো তোমাকে মন থেকে ভালোবেসেছি,তাহলে কোথায় খামতি ছিল যে এভাবে আমাকে চিট করলে," দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তমালের।


বিপত্তি ঘটে পরের দিন সকালে,যখন তমালের বাবা মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে তিথির ঘুম ভেঙে যায়।তিথি বিছানায় শুয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে,কিন্তু কি? সেটা জানার জন্য তিথি আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে ড্রইং রুমের সামনে এগিয়ে যায়।গিয়ে যা দেখে তাতে তিথির চক্ষু পুরো স্থির ,এ যেন পরিবারের চার সদস্যের গোল টেবিল বৈঠক,আর আলোচনার বিষয়বস্তু আর কেউ নয়,স্বয়ং তিথি।কি হয়েছে জানার জন্য তিথি ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তমালের দিকে।সকলের সামনে দাঁড়িয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে যা জানতে পারে তাতে তিথি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না,কি শুনছে এগুলো,যার সঙ্গে দূর দূর পর্যন্ত ওর কোন সম্পর্ক নেই।সব কিছু শোনার পর তিথি ওর পক্ষে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে,পরিবারের কেউ ওর কথা শুনতে চায় না,বরং আরও কটু বাক্য বর্ষণ করতে থাকে তিথির ওপর।স্বাধীন জীবন ও চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তিথি তমালের পরিবারের দ্বারা এ হেন অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারে না,উত্তেজিত হয়ে পড়ে তমালের বাবা মাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তমাল সোফা থেকে উঠে তিথির হাত শক্ত করে ধরে জোর করে টেনে ওদের ঘরে নিয়ে যায় ।


তমালের হাতটা জোড়করে ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলে তিথি,"এগুলো কি তমাল,তোমার বাড়ির লোকেরা এসব কি বলছে,আমি,আমি নাকি......" তিথিকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে তমাল উচ্চস্বরে তর্জনী তুলে বলে ওঠে,"চুপ,একদম চুপ,কোন কথা বলবে না,তোমার মত আমরা ওত স্বাধীন ভাবে মানুষ হয়নি বলেই হয়ত আমরা এখনও জীবনের সঠিক পথে আছি,তোমার মত পথ চ্যূত হয়ে পরিনি।" তমালের কথাগুলো শোনার পর তিথি ভ্রু কুঁচকে বলে,"কিইইইই! কি বলতে চাইছো তুমি,আমি কিছু বুঝতে পারছি না,পরিষ্কার করে বলো।"একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তমাল বলে,"অনেক হয়েছে তিথি,আমি আর পারছি না,তোমার এই অতিরিক্ত স্বাধীনতা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব,তাই আমাকে মুক্ত করো প্লিজ,চলে যাও আমার জীবন থেকে,"দু'হাত জোড়করে কপালে ঠেকিয়ে অনুরোধ করে তমাল।তিথির চোখ দিয়ে তখন অজস্র বারি ধারা প্রবাহিত হচ্ছে,নিজের হয়ে কিছু বলার মত পরিস্থিতি যে আর নেই,তাই আর বৃথা চেষ্টা না করে তমালের চাওয়া টাকে প্রাধান্য দিয়ে ওর জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তিথি আর সেইমত সকলকে সুখ দিতে তমালের সংসার পরিত্যাগ করে।


তমাল নিজের অফিসে কাজ করলেও সেদিনের পর থেকে তিথি আর ওই অফিসে যায় নি।এরপর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর।দুটি ভালোবাসার মানুষ একে অপরের থেকে শারীরিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও মানসিক ও হৃদয়ের দিক থেকে আজও অভিন্ন।আজও দুজন দুজনাকে মনে প্রানে ভালোবাসে,অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারে।কিন্তু পরিস্থিতি আর ইগোর কারণে কেউ কারোর সম্মুখে উপস্থিত হতে পারে না।সেইদিন তিথি বাড়ি ও তমালের জীবন থেকে চিরতরে বিদায় নেওয়ার পর তমাল আর তিথির কোন খোঁজ রাখে নি,মনের মধ্যে একরাশ অভিমান নিয়ে কোন রকমে দিন যাপন করতে থাকে কিন্তু মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি তিথিকে।তিথি অফিস ছাড়ার পরেই রাহুলও অন্য স্থানে বদলি নিয়ে চলে যাওয়ায় তমালের মনে যে সন্দেহ ছিল তা আরও দৃঢ় হয় এই ভেবে যে হয়তো ওরা একই সঙ্গে আছে এবং সুখে সংসার করছে।যদিও এগুলো তমালের মনগড়া এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমান ওর কাছে নেই।


 একদিন অফিস থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ করেই ধাক্কা লাগে তমালের,রাহুলের সঙ্গে।এত বছর পর দুজন একে অপরকে দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।তমালের মনে এইমুহূর্তে যে কি প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে তা আন্দাজ করতে পেরে রাহুল নিজেই তমালের উদ্বেগ দমন করতে বলে ওঠে,"কি দেখছিস ওভাবে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে তিথির কথা,তাই তো!"তমাল রাহুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমতা আমতা করে বলে,"না,মানে!" তমাল কে বলতে না দিয়ে রাহুল একটু ধমকের সুরে বলে,"এই রাখতো তোর ওই সব ন্যাকামো, এই পৃথিবীতে যদি কেউ গাধা থেকে থাকে তো সেটা তুই,বুঝলি!" তমাল রাহুলের কথার অর্থ বুঝতে না পেরে তর্জনী তুলে রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,"কি যা তা বলছিস,তুই কিন্তু তোর সীমা অতিক্রম করছিস।""এই রাখতো তোর সীমা,উহ্হ্!


ভালোবাসে,যেখানে ভালোবাসার মানুষের ওপর বিশ্বাস নেই,সেখানে কিসের ভালোবাসা?মানছি তিথি একটু বেশি স্বাধীন তার মানে এই নয় যে ওর চরিত্র খারাপ।সেদিন ও কোন ড্রিংক্স করে নি,পার্টিতে কেউ একজন শয়তানি করে ওর সফ্ট ড্রিংক্সের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল,সেদিন তোর ভাগ্য ভালো ছিলো যে আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম,না হলে একটা অঘটন ঘটে যেত, আমরা ভালো বন্ধু তাই বন্ধুর বিপদে নিজেকে আটকে না রেখে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম।আর তুই? তুই কি করলি,কোন কিছু বিচার না করেই ওকে বিনা দোষে শাস্তি দিয়ে দিলি,বের করে দিলি নিজের জীবন থেকে,ছি!"রাহুল নিজেকে সামলাতে না পেরে তমালের ওপর ওর সমস্ত রাগ উগরে দিতে থাকে।এত কিছু শোনার পর তমালের মনে হলো ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন এক ঝটকায় সরে গেছে,নিজের এত বড় একটা ভুল বোঝার কারণে নিজের হাতেই সে তার সুখের সংসারে আগুন লাগিয়েছে।শারীরিক দিক থেকে বিচ্ছেদ হলেও তিথি যে ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে সেটা অস্বীকার করবে কি করে,ও যে একদিনের জন্যও তিথিকে ভোলে নি,তিথির বিরহে রাতের পর রাত নির্ঘুম ভাবে কাটিয়েছে।তমালের চোখ ফেটে অশ্রু নির্গত হতে থাকে।


কাঁধে রাহুলের হাতের স্পর্শ পেতেই তমাল ওর ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে রাহুলের হাত চেপে ধরে নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার অভিপ্রায়ে কাতর ভাবে মিনতি করতে থাকে তিথি কোথায় আছে তা জানার জন্য।তিথি রাহুলকে বন্ধুত্বর দিব্যি দেওয়া সত্বেও তমালের কাতর প্রার্থনাকে উপেক্ষা করতে না পেরে রাহুল তমালের নিকট তিথির বর্তমান অবস্থান সবিস্তারে বর্ণনা করে।তমাল রাহুলের এই কৃতজ্ঞতা কোনোদিনও ভুলবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয়।তিথির ঠিকানা তো এখন ওর অজ্ঞাত নয় তবুও এক দ্বিধা তমালের মনকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে,যে অন্যায় ও তিথির সঙ্গে করেছে,তারপর কোন মুখ নিয়ে নির্লজ্জের মত ও তিথির সামনে গিয়ে উপস্থিত হবে।বড্ড দো'মনায় আছে তমাল,মন আর মস্তিষ্কের দোলাচলে সে আবদ্ধ।কি করবে কিছুই স্থির করতে পারছে না।


দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে তিথি দরজা খুলে বিস্ফারিত চোখে সামনে তাকিয়ে যাকে দেখে তাতে ও নিজের মনকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে ওর সামনে বিষণ্ণ মুখে তমাল দাঁড়িয়ে।উস্কখুস্ক চুল,গাল ভর্তি দাড়ি,চোখে একরাশ নিরাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে।এত বছর পর দুজন দুজনার সম্মুখে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,কারোর মুখ থেকেই কোন কথা সরছে না।তিথির চোখ মুখ থেকে কেবলমাত্র তীব্র অভিযোগ ঝরে পড়ছে,যাতে অভিমানের মেঘও যে বেশ ঘনীভূত তা তমালের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় নি।খানিকক্ষণ দরজায় এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিথি কোন কথা না বলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়,আর তমাল ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে।


কি বলবে তমাল,কি বলেই বা ওর কৃতকর্মের ক্ষমা চাইবে,কিন্তু তবুও সাহস করে এগিয়ে আসে তিথির দিকে,হঠাৎ করে তিথির হাতটা নিজের দুহাতের মধ্যে চেপে ধরে তমাল।এই রকম একটা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তিথির ঠিক কি করা উচিৎ তা স্থির করতে পারে না ,উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে থাকে তমালের চোখের দিকে।আবার অনেক বছর পর সেই ঘোর লাগা চাওনি, সেই চেনা মানুষের স্পর্শ পেয়ে শিউরে ওঠে তিথি,যার গায়ের গন্ধ আজও তিথিকে আকর্ষণ করে মোহময় করে তোলে।কিন্তু তিথি দুর্বল না হয়ে নিজেকে সেই মোহর বাঁধনে আবদ্ধ না করে তমালকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে,বজ্র কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠে,"তুমি এখানে?কি চাই তোমার? চলে যাও এখান থেকে," তিথির এই কথাগুলো বলতে যে কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তা ওর চোখ দিয়ে বইতে থাকা লবনাক্ত বারিধারাই প্রত্যক্ষ প্রমান।

আজ তিথির কোন কথাই তমাল গ্রাহ্য করবে না,ও যে অন্যায় তিথির সঙ্গে করেছে তার সামনে তিথির এই রূঢ় ব্যবহার নিতান্তই তুচ্ছ।সেদিন তিথিকে নিজের স্বপক্ষে কিছু বলতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় নি,তাই আজ তিথি নিজের মনের আকাশে যত অভিমানের মেঘ জমিয়ে রেখেছে তা যেন অবারিত ধারায় বয়ে গিয়ে উত্তপ্ত মানস ভূমিকে শান্ত স্নিগ্ধ করে, তমাল মনে প্রানে সেটাই চায়।তিথির নিরন্তন অশ্রু প্রবাহ দেখে তমাল আর দূরে সরে থাকতে না পেরে এক হ্যাঁচকা টানে তিথিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জাপটে ধরে নিজের বক্ষ মাঝে যেন বহুকালের তৃষিত বক্ষ আজ তিথির স্পর্শ পাওয়া মাত্র শীতলতা প্রাপ্ত হল।তমালও নিজের আবেগকে ধরে রাখতে না পেরে তিথির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অশ্রু সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়।দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মিলনের যে কি পরম সুখ প্রাপ্তি ঘটে তা বিরহে কাতর প্রেমিক যুগল ছাড়া কারোর পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।বিরহের মাধ্যমে মিলনের দ্বারাই প্রকৃত প্রেমের স্বার্থকতা যা তিথি ও তমালের ভবিষ্যৎ জীবনকে আরও সুখময় ও মধুর করে তুলেছে যা জন্মজন্মান্তরের।


 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance