অন্তরালে
অন্তরালে
সম্ভ্রান্ত পরিবার,টাকা- পয়সা,অর্থ- সম্পত্তি,কোন কিছুরই অভাব নেই সেখানে।এমনই এক পরিবার চৌধুরী পরিবার।অমিয় চৌধুরী সেই পরিবারের সর্বময় কর্তা।চৌধুরী বাবুর ঠাটবাট এমন যা দেখলে সকলেরই চক্ষু স্থির হয়ে যায়।কোচা দেওয়া ধুতি,ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি,নাগড়াই জুতো,হাতে একটা ছড়ি যার হাতল স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত সিংহের মাথা যুক্ত। প্রচন্ড দাম্ভিক ও একরোখা ব্যক্তি।গ্রাম তো গ্রাম পরিবারের সকলেই এই দাম্ভিক লোকটির রোষানল থেকে সবসময় দূরে থাকার চেষ্টা করে।
অমিয় চৌধুরীর দুই পুত্র।অর্থের অভাব না থাকায় দুজনেই দেশের বাইরে থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে পারিবারিক ব্যবসায় চৌধুরী বাবুর সঙ্গে এসে যুক্ত হয়।অমূল্য,অম্লান ও অমিয় বাবুর উদ্যোগে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠে চৌধুরীদের পারিবারিক ব্যবসা।ব্যবসায়িক উন্নতি এতটাই যে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয় দেশের বাইরেও তার বিরাট ব্যাপ্তি।বড় ছেলে অমূল্য আর ছোট অম্লান।দুজনের বয়সের তফাৎ খুব একটা নয়।সম্ভ্রান্ত পরিবার তায় আবার টাকার কুমির,সেই পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে অমিয় বাবুর দুই পুত্রের বাহ্যিক রূপ সম্পূর্ণ রাজকুমারদের মত।প্রকৃত সুন্দর বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই,একেবারে নিখুঁত।চৌধুরী বাবু যেমন দাম্ভিক তেমনি তার গিন্নিটিও নিতান্ত কম নয়,একেবারে দাপুটে মহিলা।সবসময় রাজরানীর বেশ ধারণ করে পাট রানী সেজে বসে থাকেন আর সকলকে হুকুম করতে থাকেন।তার হুকুম তামিল করতে সকলে একপ্রকার বাধ্য।অন্দর মহলের সর্বেসর্বা চৌধুরী গিন্নি লাবণ্য বালা দেবী।তার হুকুম তামিল না করার দুঃসাহস আজ পর্যন্ত কারোর হয় নি।
বাড়ির বাইরে যদি অমিয় বাবুর রাজত্ব চলে তাহলে অন্দর মহলে লাবণ্য বালা দেবীর। দুই পুত্র ও তাদের স্ত্রীরা লাবণ্য বালা দেবীকে যমের মত ভয় পায়। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে লাবণ্য বালা দেবীর যা চেহারা। তাতে আবার চওড়া সিঁথি ভর্তি সিঁদুর,কপালে চাঁদের মত গোল লাল টিপ,নাকে নত, গা ভর্তি গয়না,মুখে গাম্ভীর্যতা ভয় না পেয়ে উপায় আছে? পান থেকে চুন খসলেই বাজ খাই গলায় পুরো বাড়ি মাথায় নিয়ে বসেন। তার কর্কশ কণ্ঠস্বরের জ্বালায় বাড়ির ছাদে কাক পক্ষীও বসতে পারেনা বললেই চলে। লাবণ্য বালা দেবীর দেখা শোনার জন্য মালতী নামে এক বিশেষ পরিচারিকা আছে। যার সারাদিনের কাজ হল কেবলমাত্র গিন্নিমা অর্থাৎ লাবণ্য বালা দেবীর ফাই ফর্মাস খাটা। এক প্রকার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলা যেতে পারে মালতীকে। গিন্নি মার পায়ে আলতা পরানো থেকে শুরু করে মাথার চুল আঁচড়ে দেওয়া সব ওই মালতীর কাজ। আর এই একনিষ্ঠ কাজের এতটুকুও ভুল ত্রুটি লাবণ্য বালা দেবী সহ্য করেন না।
অমিয় চৌধুরীর বয়সও নিতান্ত কম নয়। তবুও নিজের একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ের নিমিত্ত ব্যবসার মূল কান্ডারি তিনি। ছেলেরা অমিয় বাবুর মতামত ব্যতীত ব্যবসায়িক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচল। কারণ ব্যবসায়িক যে কোন সিদ্ধান্ত অমিয় বাবুই গ্রহণ করেন। একবার তার দুই পুত্র অমিয় বাবুর পরামর্শ ছাড়া ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিপুল আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছিল। সেই থেকেই তাদের কাছ থেকে এই অধিকার একপ্রকার কেড়েই নিয়েছেন অমিয় বাবু। চৌধুরী পরিবারের অর্থ সম্পত্তি প্রচুর থাকলেও এক মানসিক অশান্তির শিকার পুরো পরিবার। তার কারণ এতবড় সম্পত্তির উত্তরসূরী দিতে দুই পুত্র বধূই অপারগ। সেই কারণে বিমলা আর আশালতা এই দুই পুত্র বধূকে তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিপদে। যেহেতু নামজাদা পরিবার তাই সকলের সম্মুখে পুত্র বধূদের বিতাড়িত করে পুনরায় ছেলেদের বিয়ে দিতে অসমর্থ চৌধুরী দম্পতি। যার দাপটে পুরো গ্রাম তটস্থ সেই পরিবারে দুই ছেলের সন্তান হীনতা গ্রামবাসীদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলেও সর্বসমক্ষে বলার সাহস কারোরই নেই। যদি ঘুণাক্ষরেও এই সমালোচনার আচ চৌধুরী বাবুর কানে গিয়ে পৌঁছয় তো আর রক্ষা নেই। তাই একপ্রকার পিঠপিছেই চলে সে আলোচনা।
রাতের আহার গ্রহণের পর চৌধুরী দম্পতি যখন বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় লাবণ্য বালা দেবী তার পরিবারের অভ্যন্তরস্থ কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োগ করে বলেন," বলছি কর্তা মশাই একটা যুক্তি করলে কেমন হয়?" অমিয় বাবু তার এই গিন্নিটিকে হারে হারে চেনেন ।কিছু একটা আন্দাজ করে দু'ভ্রু কুঁচকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন," কিসের যুক্তি? সেটা কি একটু খুলে বলা যাবে?" লাবণ্য বালা দেবী তার অন্তরের জটিল প্যাঁচ কষে যে যুক্তি তিনি অমিয় বাবুকে দিলেন তাতে করে অমিয় বাবু তার এই স্ত্রী রত্নটির প্রশংসা করে বলেন," হুমমম,,বিষয়টা কিন্তু মন্দ নয়। একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? তবে কি বলতো গিন্নি,এখন বুঝতে পারছি আমি যোগ্য লোককেই আমার অর্ধাঙ্গিনী করে এনেছিলাম।" স্বামীর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে লাবণ্য বালা দেবী আনন্দে গদ গদ হয়ে ওঠেন। আসলে চৌধুরী বাবু যেমন বাইরে তেমনি লাবণ্য বালা দেবী বাড়ির অভ্যন্তরে কূটনৈতিক চালে একবারে সিদ্ধ।
দুপুরে মালতী সকল কাজ সম্পন্ন করে নিজের শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে লাবণ্য বালা দেবীর ঘরে ঢুকে বলে," কই গো গিন্নি মা,তোমার পানের বাটাটা কোথায়? দাও দেখি তোমায় একটা পান সেজে দিই,তারপর তুমি তো আবার বিশ্রাম নেবে তখন মাথায় বিলি কেটে দেবক্ষন।" লাবণ্য বালা দেবী তখন পালঙ্ক থেকে মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। মালতীকে দেখে মুখে একটা হাসি এনে নিজের পাশে বিছানা দেখিয়ে বসার ইঙ্গিত করতেই মালতীর তো চক্ষু স্থির হওয়ার অবস্থা। নিজের মনেই হটাৎ ভাবতে থাকে," আজ হল কি গিন্নি মার? এত দিন কাজ করছি কোনদিন তো এত তোষামোদ করেন নি,তবে আজ কেন?"মালতীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। মালতীকে দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাবণ্য বালা দেবী হেসে বলেন," আরে ওত কি ভাবছিস ওখানে দাঁড়িয়ে? এদিকে এসে বোস না? দরকারি কথা আছে।" ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মালতী বেশি কিছু আর না ভেবেই গিন্নী মার পায়ের কাছে মেঝেতে গিয়ে বসে।
একটা পান মুখের মধ্যে নিয়ে চিবোতে চিবোতে লাবণ্য বালা দেবী বলেন," হ্যাঁ রে মালতী তোর স্বামীর কোন খোঁজ পেলি?" কিছুক্ষন নিস্তব্ধ থেকে মালতী একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। লাবণ্য বালা দেবী "হুমম" বলে আবারও বলা শুরু করেন,"ওমন অকৃতজ্ঞ, বেইমান আমি জীবনে দুটি দেখিনি। কম তো করিস না তুই সংসারের জন্য তবুও সে এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে গেল?" মুখ বিকৃত করেন লাবণ্য বালা দেবী। অশ্রু যুক্ত নয়নে মালতী অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে," সবই আমার কপাল গিন্নি মা,না হলে আমাদের এভাবে কষ্ট করতে হয়? যাক ছাড়ুন সে কথা,আপনি কি বলবেন বলছিলেন?" একটু সংকোচ বোধ করে লাবণ্য বালা দেবী বলেন," আচ্ছা মালতী তোর মেয়ে পলির যেন কত বয়স এখন? আর কি করে ও?" মালতী একটু অবাক হয় গিন্নি মার মুখে নিজের মেয়ের কথা শুনে। তা সত্ত্বেও বলে ওঠে," এই তো এ বছর একুশ পূর্ণ হলো। আমরা গরিব মানুষ তবুও চেষ্টা করছি মেয়েটাকে পড়িয়ে যদি একটু মানুষ করতে পারি। আমাদের মত ঘরের মেয়েদের আবার স্বামী ভাগ্য খুব একটা ভালো নয় কিনা?" লাবণ্য বালা দেবী মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে গলা ঝেড়ে বলেন," বলছি মালতী আমার একটা আর্জি আছে তোর কাছে। যদি শুনিস তবে মালামাল হয়ে যাবি।আর যদি নাও শুনিস তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কি করে কাজ হাসিল করতে হয় সেই পথও আমার জানা আছে।" লাবণ্য বালা দেবীর কণ্ঠে আর্জির থেকে যে হুমকির সুরই অধিক সেটা বুঝতে মালতীর ভুল হয়নি একটুকুও। একটা ঢোক গিলে ভীত হয়ে মালতী তাকায় লাবণ্য বালা দেবীর দিকে।
একটা বিকৃত হাসি দিয়ে কোন ভঙ্গিমা না করেই লাবণ্য বালা দেবী দৃঢ় কণ্ঠে বিস্ফারিত নয়নে তর্জনী নির্দেশ করে বলে ওঠেন," আমার বড় ছেলে অমূল্যর এক রাতের শয্যা সঙ্গিনী হবে তোর মেয়ে পলি। আমার বংশের উত্তরাধিকারী চাই। যত টাকা চাই দেব। তোর মেয়ের যত্নের কোন ত্রুটি রাখবো না। চৌধুরী বংশের সন্তান গর্ভে ধারণ করবে যে তোর মেয়ে,সে কি কম সৌভাগ্য নাকি? হুমম!" মালতী দরিদ্র তায় অসহায়। গিন্নি মার এই কথা শুনে মালতীর আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে আর্তনাদ করে জড়িয়ে ধরে লাবণ্য বালা দেবীর পদযুগল। এক অসহায় মায়ের করুন আর্তি," আমায় ক্ষমা করুন গিন্নি মা,আমরা গরিব,অসহায়। আমাদের সম্মান টুকুই যে সব। কোন কিছুর বিনিময়েই যে তা বিকনো সম্ভব নয়।" লাবণ্য বালা দেবী এক ঝটকা দিয়ে মালতীকে নিজের থেকে সরিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলে ওঠেন," চুপ! একদম চুপ! উমমম,গরিবের আবার সম্মান? ভালোয় ভালোয় কথা শুনিস তো ভালো,না হলে আমাকে বিকল্প পথ গ্রহণ করতে হবে। সরে যা।" লাবণ্য বালা দেবী যেতে উদ্যত হলে পুনরায় ফিরে এসে মালতীর উদ্দেশ্যে বলেন," আর হ্যাঁ কালই তোর মেয়েকে নিয়ে আসবি। এর অন্যথা যেন না হয়।" দাপটের সঙ্গে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান লাবণ্য বালা দেবী। আর মালতী নিজের ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
গ্রামের অভ্যন্তরে একটা ভাঙা ঝুপড়ি মা ও মেয়ের একান্ত শান্তির নীড়। এতদিন দৈনতা থাকলেও মানসিক শান্তি ছিল। কিন্তু আজকের পর থেকে সেই শান্তি যে চিরতরে সমাপ্ত হতে চলেছে। অত্যন্ত ক্লান্ত ও বিষন্ন মুখে বাড়ি ফেরে মালতী। মালতীকে ওই ভাবে ঘরে ফিরতে দেখে ছুটে যায় পলি। মায়ের এইরূপ বিধ্বস্ত অবস্থা এর আগে কখনও দেখেনি সে। হ্যাঁ, সেবার যখন পলির বাবা চলে গিয়েছিল সেই সময় মালতীর এমন হয়েছিল বৈ কি। তবে পলি অনেক ছোট থাকায় সেকথা ওর একটুকুও স্মরণে নেই। মালতীর সামনে এসে পলি বলে,"কি হয়েছে মা? তোমাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?" মালতী একটা ঘোরের মধ্যে থাকায় পলির কথা ওর কর্ণ কুহরে প্রবেশ করেনি সেটা অনুমান করতে পেরে পলি মালতীর হাত স্পর্শ করে জোর করে ঝাঁকিয়ে বলে,"আরে ও মাআআ! কি হয়েছে তোমার?"মালতী ঘোর লাগা দৃষ্টিতে পলির দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,"কিছু না! কিছু না তো!"পলির পাশ কাটিয়ে চলে যায় মালতী। পলি বুদ্ধিমতী মেয়ে মালতীর যে কিছু একটা হয়েছে সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারে। রাতের খাবার খেয়ে পলি ঘুমিয়ে পড়লেও মালতীর যেন কিছুতেই ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে হাজারও পরিকল্পনা ভর করলেও এই আসন্ন সমস্যা থেকে পরিত্রানের পথ সে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেনা। একবার ভেবে ছিল বটে যে এই রাতের অন্ধকারে পলিকে নিয়ে আত্মগোপন করার কথা। কিন্তু ওরা গরিব মানুষ,হতদরিদ্র।চৌধুরী বাবু যা ক্ষমতাশালী তাতে তার দৃষ্টি এড়িয়ে জীবন অতিবাহিত ওত সহজ নয়। সারারাত ভেবেও মালতী এর কোন সুরাহা খুঁজে না পাওয়ায় লাবণ্য বালা দেবীর কুপ্রস্তাব একপ্রকার অনিচ্ছা কৃত মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। না হলে অকালে যে দুটো প্রাণ খোয়াতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো পলিকে বোঝাবে কি করে? পলি এখন কলেজে পড়ে,সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মালতী অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে।
প্রাতরাশ করতে বসে লাবণ্য বালা দেবী অমূল্য সহ সকলের উদ্দেশ্যে তার এই মহান পরিকল্পনার কথা জানালে সকলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ওনার প্রতি। বিশেষ করে বিমলা। বংশের প্রদীপ দিতে অপারগ হলেও স্বামী অমূল্যকে তো আর কম ভালোবাসে না? সেই ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারোর সঙ্গে রাত্রি যাপনের কথা শ্রবণ মাত্রই সে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে। যা সেখানে উপস্থিত সকলের চোখেই ধরা দেয়। কিন্তু কারোর বুকের পাটায় ওত সাহস নেই যে লাবণ্য বালা দেবীর মুখের ওপর কোন কথা বলবে। বিমলাকে উদ্দেশ্য করে লাবণ্য বালা দেবী বিদ্রুপ করে বলেন," উমমম! ঢং, নিজের তো কোন ক্ষমতা নেই আবার বড় বড়---।" বিমলা নিজের অক্ষমতার কথা মনে করেই বিনা বাক্য ব্যয়ে নিঃশব্দ অশ্রু ক্ষরণ করতে থাকে। ভাগ্যের ওপরে কেউ নয়,তাইতো বিমলাও নিজের ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য। ধনী পরিবারের সন্তান হলেই যে তার চরিত্র গত ত্রুটি থাকবে না এমনটা কিন্তু নয়। লাবণ্য বালা দেবীর এহেন সিদ্ধান্তে বাহ্যিক দিক থেকে বিমূর্ষ হওয়ার অভিনয় করলেও মনে মনে ভীষণ খুশি হয় অমূল্য। আসলে পলি যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি সুউচ্চ। যে কোন পুরুষের মনে জ্বালা ধরাতে সক্ষম। স্বভাবতই পলিকে দেখার পর থেকেই ওকে কাছে পাওয়ার কামনা অমূল্যকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে। কিন্তু কোন পথ খুঁজে পায়না অমিয় চৌধুরীর ভয়ে। আজ সেই সুযোগ ওর মা লাবণ্য বালা দেবী ওকে করে দিয়েছেন দেখে মনে মনে বেশ আনন্দ উপভোগ করতে থাকে অমূল্য। তার বহুদিনের অভিপ্রেত মন বাসনা পূর্ণ হতে চলেছে,শয্যা সঙ্গিনী হতে চলেছে পলি তাও আবার খুব শীঘ্রই। সকলের অলক্ষ্যে একটা গোপন হাসি হাসে অমূল্য।
সারারাত মালতী দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি। নিজের মন আর চিন্তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে গেছে তবুও এই সমূহ বিপদের হাত থেকে পরিত্রানের পথ সে কিছুতেই পায় নি। ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হলে আখেরে যে ওদেরই বিপদ,প্রাণ নাশের সম্ভাবনা। তাই মালতী লাবণ্য বালা দেবীর প্রস্তাবকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একপ্রকার মেনে নিতে বাধ্য হয়। সারাদিন মালতী চৌধুরী বাড়ির ছায়া মারায় নি বটে তবে যত সন্ধ্যে আসন্ন হতে থাকে মালতীর মনেও ভীতির সঞ্চার হতে থাকে। সারা ঘরময় মালতীকে পায়চারি করতে দেখে পলি এগিয়ে এসে বলে," কি হয়েছে মা? কাল থেকে লক্ষ্য করছি তুমি খুব বিচলিত আর রাতে ঘুমোও নি পর্যন্ত। কি হয়েছে বলো?" মালতী এই প্রশ্নের উত্তর কি দেবে ভেবে না পেয়ে পলির হাত ধরে বলে ওঠে," আজ একবার তোকে আমার সঙ্গে ও বাড়ি যেতে হবে। পারলে আমায় ক্ষমা করিস মা! এছাড়া যে আর কোন পথ নেই। না হলে দুজনকেই অকালে প্রাণ হারাতে হবে।" পলির এসবের মাথা মুন্ডু কিছুই বোধগম্য হয়না,শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে মালতীর দিকে তাকান ছাড়া।
সন্ধ্যের একটু পরে মালতী পলিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয় লাবণ্য বালা দেবীর নিকট। সম্মুখে ওদের নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাবণ্য বালা দেবী একটা ব্যাঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে মালতীর উদ্দেশ্যে বলেন," তা সারাদিন টিকিটির দেখা পায়নি তো কোথায় ছিলি? নাকি ভেবেছিলি আমাকে ফাঁকি দিয়ে গা ঢাকা দিবি। শেষে হয়তো দেখলি ওসব করে তুই পার পাবি না তাই হয়তো এসেছিস। তা ভালোই করেছিস, না হলে তোকে আস্ত রাখতাম না।" লাবণ্য বালা দেবীর দৃষ্টি হতে যেন অগ্নি ঝড়ে পড়ছে। যা দেখে মা ও মেয়ের প্রায় গলা শুকানো অবস্থা। মালতী শেষ বারের মত লাবণ্য বালা দেবীর সামনে কর যুগল হয়ে কাতর কণ্ঠে বলে," আর একবার একটু ভেবে দেখুন না গিন্নি মা! আমাদের দয়া করা যায় কি না? আমার মেয়েটার কথা একবার অন্তত ভাবুন। দয়া করুন।" "চুপ! একদম চুপ! আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তার যেন এতটুকুও নড়চড় না হয়। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ওকে এখন যেতে হবে," লাবণ্য বালা দেবীর দিক বিদীর্ণ করা কণ্ঠস্বর শুনে মা মেয়ে দুজনেই কম্পিত হয়ে ওঠে। আর কোন উপায় নেই জেনেই মালতী চুপ করে থাকে। আর পলি,সে হতভম্বের মত চেয়ে থাকে তার মায়ের মুখ পানে।
খানিক পর মিতু নামে আর একজন পরিচারিকা এসে লাবণ্য বালা দেবীর কাছে পলিকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলে লাবণ্য বালা দেবী তাতে সম্মতি দেন। পলি তো কিছুই বুঝতে না পেরে মালতীকে ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে," ও কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে মা ? আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। ও মাআআ,বলো না কোথায় নিয়ে যাবে আমায়?" মালতী মেয়ের প্রশ্নের কি উত্তর দেবে। কিছুই যে আর বলার নেই শুধু অশ্রু বর্ষণ ছাড়া। মিতু পলির হাত ধরে যেই ওকে নিয়ে যেতে উদ্যত হবে ওমনি পলি মিতুর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মালতীকে। মা মেয়ের ভগ্ন হৃদয়ের ক্রন্দন ধ্বনি আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করলেও পাষান বৎ লাবণ্য বালা দেবীর হৃদয়কে বিগলিত করতে পারেনি এতটুকুও। এক প্রকার বল পূর্বক লাবণ্য বালা দেবী মিতুকে দিয়ে পলিকে প্রেরণ করে অমূল্যর ঘরের দিকে। মেয়ের এই চরম সর্বনাশ মা হয়ে রুখতে না পারার অন্তহীন বেদনা নিয়ে নত জানু হয়ে বসে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মালতী। এত অসহায়ও যে কোন মা হতে পারে মালতী তারই দৃষ্টান্ত। আর পলি বেচারি সবকিছুর অগোচরে নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাসের শিকার। যার থেকে নিষ্কৃতি কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
এই ঘটনার পর মুহূর্তে চৌধুরী বাবুর বড় পুত্র,পুত্র বধূর সঙ্গে আরও দুটি প্রাণী হটাৎই গ্রাম থেকে বেপাত্তা। বুদ্ধিমান ও কূটনীতি সম্পন্ন অমিয় চৌধুরী সারা গ্রাম এটাই প্রচার করেন যে তার বড় ছেলে অমূল্য স্বস্ত্রীক বিদেশ ভ্রমণে গেছে, বছর খানেক পর দেশে ফিরবে। কিন্তু মালতী আর পলি! হটাৎ করে কাওকে কিছু না জানিয়ে এরাই বা গেল কোথায়? এই রকম বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন গ্রাম বাসীদের মনে ভিড় করে আসলেও সম্মুখে জিজ্ঞেস করার সাহস কারোরই ছিলোনা। আসলে অমূল্য,বিমলা,মালতী আর পলি এই চারজন একই সঙ্গে আছে সকলের অলক্ষ্যে নিভৃত স্থানে। সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা। যাতে করে চৌধুরী বাড়ির এই কীর্তি কারোর বোধগম্য না হয়,সব দিক থেকে যেন সবকিছু বজায় থাকে। অর্থের জোড় যে কি ভয়ঙ্কর চৌধুরী বাবু তা প্রমাণ করে দিলেন। একজন সদ্য যৌবনে পদার্পন কারী কন্যার মতের বিরুদ্ধে তাকে বলপূর্বক ভোগের সামগ্রী বানানোর নিমিত্ত যে পরিকল্পনা তা সর্ববিদ সাফল্য মণ্ডিত করে তোলা তাও আবার লোক চক্ষুর আড়ালে সেটা কি চারটে খানি কথা নাকি। অর্থ আর ক্ষমতা আছে বলেই না সেটা সম্ভব হয়েছে। অমিয় চৌধুরী আর লাবণ্য বালা দেবী তাদের যৌথ ক্ষমতার প্রদর্শন করতে পেরে ভীষণ গর্বিত।
বছর দুই পর চৌধুরী বংশের উত্তরাধিকারীকে সঙ্গে নিয়ে স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করে অমূল্য। নৃত্য,গীত ও বাদ্য সহযোগে সমগ্ৰ গ্রামবাসীদের সম্মুখে অভ্যর্থনা জানান হয় বংশের প্রদীপ ছোট্ট অমিয় বাবুকে। শিশুটি দেখতে রাজপুত্রের থেকে কোন অংশে কম নয়। একমাত্র চৌধুরী পরিবারের সদস্য ব্যতীত এই ঘোর রহস্যের উন্মোচন থেকে সমগ্ৰ বিশ্ব অজ্ঞাত। অমিয় চৌধুরী ও লাবণ্য বালা দেবী নিজেরদের বোনা স্বরযন্ত্রের জাল বুনতে সক্ষম হওয়ায় অত্যন্ত খুশি। অপরদিকে মালতী আর পলি? এই চক্রান্তের নিরীহ শিকার। বিশ্ব প্রকৃতির জনারণ্যের ভিড়ে নিখোঁজ। অমিয় চৌধুরীর মত ধুরন্ধর ব্যক্তি তার অপকীর্তির প্রমান রাখবে এতটাও বোকা তিনি নন। অগত্যা যা হওয়ার সেটাই হলো। সারাজীবনের মত দুটি নিষ্পাপ মানুষকে অকালেই চুপ করিয়ে দেওয়া হলো কঠিন সত্যের উন্মোচনের নিমিত্ত। চিরতরে তারা হারিয়ে গেল নিরুদ্দেশের অতল গহ্বরে যার রহস্য সকলের কাছেই রয়ে গেল অজানা। ক্ষমতা এমন এক ঐশ্বরিক শক্তি যার কাছে বলি হতে হয় মালতীর মত নিরীহ মানুষদের। আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তরালে অব্যাহত থাকে এই ভাবেই মুখ বন্ধ করে দেওয়ার নির্মম ষড়যন্ত্র। যার রহস্য চাপা পড়ে থাকে অর্থের বলিষ্ঠ স্তম্ভের তলদেশে।
*****

