ইচ্ছে ডানা

Romance Inspirational

4  

ইচ্ছে ডানা

Romance Inspirational

দেবদূত

দেবদূত

11 mins
698


বাড়িতে ঢুকেই চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে নীলাদ্রি।আজ অফিস থেকে সন্ধ্যার একটু আগেই সে বাড়ি ফিরে এসেছে,ফিরেই বাড়ির এই পরিবেশ তাকে ভাবাচ্ছে বৈকি।বিয়ের এক বছর পর থেকেই তো এটাই ওর জীবনের নৃত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে।ভয়ে ভয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে।হ্যাঁ,যে ভয় পেয়েছিল সেটাই হয়েছে,আজও তমশা অচৈত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে আর শিয়রে বসে সুমিতা দেবী পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বিধ্বস্ত ক্লান্ত শরীরে হাতে থাকা ব্যাগটি দরজার পাশে টেবিলের ওপর আস্তে করে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তমশার দিকে।নিজে ক্লান্ত,অবসন্ন তবুও নিস্তেজ,জেল্লাহীন তমশার মুখের দিকে চেয়ে নীলাদ্রির যেন চোখ ফেটে অশ্রু নির্গত হতে চাইছে।কত সুন্দর হাসমুখ,প্রাণোচ্ছল মেয়েটি আজ এই চার বছরে কেমন যেন নিষ্প্রান হয়ে পড়েছে।ছেলের দিকে চেয়ে মৃদুকণ্ঠে সুমিতা দেবী বলেন," মাঝে মাঝে যা হয় আর কি,আজও তমশা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল,কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না,আর অবশেষে," কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলাদ্রি আস্তে করে বিছানায় বসে তমশার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ডাক্তার এলে নীলাদ্রি একরাশ ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,"কেমন দেখলেন ওকে," ফ্যামিলি ডাক্তার হওয়ায় তিনি নীলাদ্রিকে সুপরামর্শ দিয়ে বলেন,"তমশার অবস্থা বিশেষ ভালো নয়,এই ঘটনা টা একবার বৈ তো নয় প্রায় কয়েকবার ঘটেছে,যার ফলে ও ভীষণভাবে মানসিক আঘাতগ্রস্থ,বেশি দেরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে,তুমি আর দেরি না করে ওর হাওয়া বদলের ব্যবস্থা করো,সেটাই ওর শরীর মন দুটোর পক্ষেই ভালো।" ডাক্তার চলে যেতেই নীলাদ্রি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে।তমশার জ্ঞান ফিরলে দেখে নীল ওর দিকে হাসি মুখে চেয়ে আছে,কতক্ষন যে ও এভাবে বসে আছে কে জানে।তমশা উঠে বসার চেষ্টা করতে নীল ওকে ধরে বসিয়ে দিতে দিতে বলে,"তো কেমন আছেন ম্যাডাম! এখন কি একটু ইজি ফিল হচ্ছে,হুমমম!"তমশা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে নীল তমশার দুগালে হাত রেখে,মুখটা একটু উঁচু করে বলে," তুমি এত কেন দুশ্চিন্তা করো বলো তো,আমি তো আছি না কি?আমার কথা কি তোমার একটুকুও মনে পড়ে না,না কি আগের মত আর আমাকে ভালোবাসোনা? আমরা দুজন দুজনের জন্য আছি তো বলো,তাহলে বাইরের একজনের কথায় কি আসে যায়,আর এমন বোকামি করবে না,ঠিক আছে।"তমশার কপালে ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীলাদ্রি,আর তমশার দু'চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সকালে নীলাদ্রিকে ভীষণ ব্যস্ত দেখে তমশা এগিয়ে গিয়ে বলে,"কি ব্যাপার! এত সকালে তুমি কোথায় যাচ্ছো,তোমার অফিসের সময় তো এখনও হয় নি।" নীল টুক করে তমশার গালে একটা কিস দিয়ে বলে,"একটা সারপ্রাইজ আছে ম্যাডাম,এখন তো বলা যাবে না,সময় হলে ঠিক বলবো,আসছি," হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়।তমশা এর মাথামুন্ড কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মত নীলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুমিতা দেবী বলেন,"তনু,মাআআ,এখন কেমন আছিস মা!" গলার স্বর শুনে তমশা ফিরে বলে,"আরে মাআআ,তোমাকে না কতবার বলেছি,এই বয়সে হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে বারবার ওপরে আসবে না,তোমার শরীর খারাপ করবে তো,কেন বোঝনা তুমি,বলতো!" গালফুলিয়ে,রাগ দেখিয়ে বলে তনু।সুমিতা দেবী হেসে তমশার চিবুক স্পর্শ করে বলেন,"দেখো মেয়ের কান্ড,নিজে অসুস্থ আর আমার জন্য চিন্তা করছে,বলি মেয়ে অসুস্থ হলে কি মা শান্ত থাকতে পারে?মায়ের চিন্তা হয় না বুঝি।" তমশা আর কিছু না বলে সুমিতা দেবীর গলা জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকে।সুমিতা দেবীও তমশা কে আদর করে সুখে শান্তিতে থাকার আশীর্বাদ করেন।

সুখে,শান্তিতে থাকার কথা শুনেই তমশার মুখের হাসিটা হটাৎ ম্লান হয়ে যায়।যেটা ওর জীবন থেকে বিধাতা মুছে দিয়েছে সেটা ও পাবে কি করে।মা না হওয়ার যন্ত্রণাটা যে কি,সেটা যে মা হতে পারবে না,সে ছাড়া কারোর বোঝার কোন ক্ষমতা নেই।সন্তান হীনতার বেদনা যে কিভাবে হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে ,সেই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি কেবল মাত্র সেই নারী ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।নারী জীবনের স্বার্থকতা তো মাতৃত্বের মধ্যে আর তার দ্বারাই তো সে জীবন স্বার্থক।তমশা হলো সেই নারী যে এই সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত।আজ পাঁচ বছর হয়েছে ওদের বিয়ের কিন্তু আজ পর্যন্ত তমশার কোল শুন্য,সেই শুন্য হৃদয়ের হাহাকার এই সমাজ,সংসার শুনতে পায় না।বরং বধিরের ভূমিকা পালন করে,সেই নারীর অক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে কথার তীব্র বর্ষণে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে।সমাজের এই বিদ্রূপতাকে তমশা মেনে নিতে পারে না,ধীরে ধীরে সে তার আত্মসংযম হারাতে থাকে,যেটা তার অসুস্থতার প্রধান ও অন্যতম কারণ।সামান্যতম উত্তেজনাও তমশার জন্য ক্ষতিকারক,যার জন্য সে থেকে থেকেই অচৈত্যন হয়ে পড়ে যা নীলাদ্রির চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে।তমশার এখন মানসিক স্থিতির প্রয়োজন যা ওর মনকে শীতলতা প্রদান করবে।আর তমশাকে সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলতেই নীল এখন তৎপর হয়ে পড়েছে।

নীল সবসময় তমশাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে থাকে।ওদের লাভ ম্যারেজ,দুজনের ভালোবাসার মধ্যে কোনদিন কোন খাদ ছিল না,অফুরন্ত ভালোবাসা ছিল ওদের মধ্যে,কিন্তু এই চার বছর যাবৎ তমশা কেমন যেন একটু ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে নীলাদ্রির প্রতি।অল্পেতেই ভীষণ রাগান্বিত হয়ে ওঠে,এই ক্ষিপ্রতার কারণ ওর একাকীত্ব।আর এই একাকিত্বের অনুভূতিই ওকে সন্তান প্রাপ্তির প্রতি বেশি আকৃষ্ট করেছে।নীল কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর তমশা আর সুমিতা দেবী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই,এই এত্তো বড় সুনসান ফাঁকা বাড়ি তমশাকে যেন গ্রাস করতে আসে।বাড়িতে যদি একটা ছোট্ট প্রাণ থাকতো ,যে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দৌড়ে বেড়াত সারা বাড়ি ময়,যার পায়ের মলের আওয়াজে মুখরিত হত এই গৃহ প্রাঙ্গণ তাহলে তমশার জীবনটাও হাসি খুশিতে ভরে উঠতো।পাঁচ বছর হয়ে গেছে ওদের বিয়ে হয়েছে এখনও পর্যন্ত সন্তানের মুখ দেখতে না পারায় তমশা ভীষণ ভাবে মানসিক অবসাদপ্রাপ্ত,ও যে কোনোদিন মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে না তা কিন্তু নয়,কোন এক অজানা কারণ বশত সেটা হয়ে উঠছে না।নীল অনেক চেষ্টা করেছে তমশাকে বোঝানোর,যে এত অল্পেতেই ভেঙে পড়লে হবে না,নিজেদের মনকে শক্ত করতে হবে ও ভাগ্যকে ভরসা করতে হবে।কিন্ত মেয়েদের মন কি ওতো সহজেই সব কিছু মেনে নেয়,না,সে তো সন্তান প্রাপ্তির আশায় আরও মরিয়া হয়ে ওঠে।যার ফল স্বরূপ তমশা আজ অসুস্থ,চিত্তে শান্তি নেই,সবসময় এক দুশ্চিন্তায় নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখে।

অফিস ছুটির দিন হলেই নীল তমশাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে।সারাদিন হৈ হুল্লোড়,খাওয়া দাওয়া করে ঠিক সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে আসে।বিয়ের পর এক বছর এটাই ছিল ওদের উইকএন্ড কাটানোর ভালো পন্থা।কিন্তু তারপর থেকেই এতে ভাটা পড়তে শুরু করে।আজ অনেক দিন পর অফিস ছুটি পাওয়ায় নীলাদ্রি ঠিক করে বিকেলে তমশাকে নিয়ে একটু বেরোবে যাতে ওর অশান্ত মন একটু শান্ত হয়।সেইমত বিকেলে গাড়ি করে না গিয়ে তমশার পছন্দের প্রিয় বাইকে করে ঘুরতে যাবে বলে নীল মনস্থির করে।এই বাইকটা ওদের ভালোবাসার সাক্ষী।কত ভালো লাগার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাইককে ঘিরে।আজ আবার সেই পুরোনো স্মৃতি তাজা করতে তৎপর নীলাদ্রি।পড়ন্ত বিকেলে অস্তগামী সূর্যের লাল আভায় রঞ্জিত পশ্চিম আকাশের অপূর্ব দৃশ্য গঙ্গার তীরে বসে উপভোগ করতে কার না ভালো লাগে।নীল তাই তমশাকে সঙ্গে করে গঙ্গার ঘাটে একটা সান বাঁধানো সিঁড়িতে গিয়ে বসে।গঙ্গার তীরে বইতে থাকা শীতল ঠান্ডা বাতাসে তমশার খোলা চুল এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে,তাই দেখে অন্তরে সুপ্তপ্রায় আগের সেই প্রেমিক হৃদয় পুনরায় জেগে ওঠে,আস্তে করে নীল নিজের হাতটা রাখে তমশার হাতের ওপরে,যে এতক্ষন সুদূর পানে শুন্য দৃষ্টিতে চেয়ে নিজের জীবনের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত।

ভালোবাসার মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখে নীলাদ্রি তার সেই সদা সর্বদা মন ভোলানো হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে তমশার দিকে।মৃদু হাসে তমশা, সেই হাসিতে যে কত যন্ত্রনা লুকিয়ে আছে তা কেবল ওই জানে।নীল যে কিনা তমশার প্রতিটি রন্ধ্রের গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত,সে সহজেই বুঝে যায় তমশার মনের কথা।চোখের ইশারায় আস্বস্ত করে বলে," কেন এতো ভাবনা তোমার? আমি আছি তো তোমার সাথে তোমার পাশে,নিজের জীবনের থেকেও তো আমি তোমায় ভালোবাসি,তাহলে কেন এতো অনিশ্চয়তায় ভোগ তুমি? একটু বিশ্বাস,ভরসা রাখো আমার ওপর,দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।" নীলাদ্রির কথায় তমশা একটু স্বস্তি অনুভব করে,শুধু হেসে নীলের কাঁধে মাথা রেখে সম্মুখে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ করেই বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে নীল তমশাকে তাড়া দিয়ে বলে," চলো,তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও,আমরা একটু বেরোবো।" তমশা নীলের কথায় অবাক হয়ে ভাবতে থাকে,কি বলছে নীল! বলা নেই কওয়া নেই কোথায় যাবো এখন,স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তমশা।তাই দেখে নীল উত্তেজিত হয়ে বলে," উফফফ! তোমার এই চিন্তা বাদ দাও তো দেখি,আর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।" তমশা কিছু একটা বলতে উদ্যত হলে ওকে থামিয়ে দিয়ে নীল বলে," কোন কথা নয়,যা বলছি করো," এক প্রকার জোর করেই তৈরি হতে পাঠায় নীল,তমশাকে।ওরা একটা শপিং মলের সামনে দাঁড়ালে তমশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে," এখানে কেন আমরা?চলো বাড়ি চলো," ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে নীলের প্রতি।নীল তমশার কথার তোয়াক্কা না করেই গাড়ির দরজা খুলে হাত ধরে নামিয়ে মলের ভেতরে প্রবেশ করে।আগে তমশা এই সব শপিং করতে খুব ভালোবাসত কিন্তু কয়েক বছর ধরে তার এই শখটাও ম্লান হয়ে গেছে।ওর প্রকৃত খুশি এখন আর এইসব দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের মধ্যে নিহিত নেই,ও এখন একটা জ্যান্ত পুতুল চায়,যে ওর জীবনটাকে খুশিতে ভরিয়ে দেবে।একপ্রকার জোর করেই তমশাকে শপিং করিয়ে ফেরার সময়,একজায়গায় তমশাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নীলাদ্রি পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটি পুতুলের মত বাচ্চার দিকে স্নেহপূর্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমশা মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসি নিয়ে।আর ঠিক পরক্ষণেই গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে দেখে এগিয়ে যায় নীলাদ্রি আর কোনক্রমে তমশাকে বুঝিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

এর ঠিক কয়েকদিন পর তমশার হাতে দুটো ট্রেনের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে নীল বলে,"সারপ্রাইস! আমরা ঘুরতে যাচ্ছি,অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় নি,তাই ভাবলাম একটু ঘুরেই আসি,কি বলো," তমশা তো নীলের প্রোপোজালে কি রিয়াক্ট করবে কিছুই বুঝতে পারে না,কেবল নিরাশ নয়নে তাকিয়ে থাকে নীলের দিকে।নীল তমশার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ওর গালে হাত রেখে বলে," তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি,আমারও কি ভালোলাগে বলো,দুজনে একটু নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন কাটালে শরীর মন দুইই ভালো থাকবে,চিন্তা করো না,ওকে," ভালোবাসার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নীল জড়িয়ে ধরে তমশা কে নিজের বক্ষ মাঝারে,আর ঠোঁটের উষ্ম স্পর্শ এঁকে দেয় তমশার ললাটে।পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট গ্রামে ওরা কয়েকটা দিন কাটবে বলে বেরিয়ে পড়ে।

চতুর্দিকে পর্বত বেষ্টিত প্রায় জনমানব শুন্য প্রকৃতির কোলে এসে তমশার ঠোঁটে হাসি খেলে যায়।দু'বাহু ছড়িয়ে বুক ভরে এই দূষণমুক্ত পরিবেশের সুবাস গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।চারিদিকের মন মুগ্ধ করা পরিবেশ বাতাসে ভেসে বেড়ানো মেঘেদের ভেলা,আর পাথরের বুক চিরে নানা রঙের পাহাড়ি ফুলের সমাহার,পার্বত্য প্রকৃতিকে করে তুলেছে মনোরম যা দারুন উপভোগ্য।একে অপরের হাতে হাত রেখে চড়াই উতরাই বেষ্টিত পার্বত্য পথে পায়ে হেটে প্রকৃতির শোভা উপভোগের মধ্যেও বেশ একটা রোমান্টিক ভাব ফুটে ওঠে।আর সেই রোমান্টিকতা প্রেমিক হৃদয়কে করে তোলে আরও ব্যাকুল,প্রেমিকাকে কাছে পাওয়ার তীব্র মানসিক আবেগ চারা দিয়ে ওঠে।আর সেই ফল স্বরূপ এই নিসর্গ প্রকৃতি মাঝে নীল নিজের আত্মসংযম হারিয়ে তমশাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বক্ষ মাঝে আর তমশার তির তির করে কাঁপতে থাকা ভেজা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে আহরণ করতে থাকে তার পরম সুধা,তমশাও নীলের এই প্রেম নিবেদনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুধা সংগ্রহের পদ্ধতিকে আরও ত্বরান্বিত করে।একসময় হাঁপিয়ে উঠে একে অপরকে ছেড়ে দাঁড়ায়।তমশার চোখে মুখে এক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে যা দেখে নীল মানসিক শান্তি পায়।

হাসিখুশি ও কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্ত কাটিয়ে পাঁচ ছয় দিন ওদের বেশ কেটে যায় পাহাড়ের কোলে ওই ছোট্ট গ্রামে।এবার ঘরে ফেরার পালা।যথারীতি তৈরি হয়ে ওরা বাড়ি ফেরার পথে রওনা দেয়।কিছুটা আসার পরেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা খাদের ধারে একটা কিছুতে চোখ আটকে যায় তমশার,গাড়ি দার করিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে যায় সেই দিকে।নীলাদ্রি কি হচ্ছে সেটা অনুমান করার জন্য তমশার পিছু পিছু এলে,দেখে রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে একটি ছয় মাসের শিশু গলা ফাটিয়ে কাঁদছে।শিশুটির সেই কান্না যেন তমশার হৃদয়কে সহস্র ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত করছে।বেদনায় ব্যাকুল হয়ে শিশুটিকে কোলে নিয়ে আকড়ে ধরে বুকের মাঝে,যেন কত দিনের হারান ধন সে ফিরে পেয়েছে।নীলাদ্রি হতভম্ব হয়ে দিশাহীন ভাবে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে,শিশুটির বাবা-মাকে।অনেক খোঁজাখুঁজির পর বুঝতে পারে শিশুটির ভাগ্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই,খাদের মধ্যে একটি জ্বলন্ত গাড়িকে পরে থাকতে দেখে নীল অনুমান করে হয়ত বা শিশুটির পিতা-মাতা আর বেঁচে নেই।শিশুটি বিধাতার বরে কোনক্রমে এ যাত্রায় রক্ষে পেয়েছে। একদিকে শিশুটির মাতৃ বিয়োগ আর অপর দিকে অযাচিত ভাবে সন্তান প্রাপ্তি ঘটায় তা কোন ভাবেই হাতছাড়া করতে নারাজ তমশা।সে মাতৃ হৃদয়ের সমস্ত হাহাকার শান্ত করতে চায় এই শিশুটির মাধ্যমে।তাই স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সমস্ত ফর্মালিটি পূর্ণ করে শিশুটিকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসে নীলাদ্রি।তমশা যেন শিশুটিকে পেয়ে স্বর্গ লাভ করেছে,তার আর সুখের সীমা নেই,সে তার ছোট্ট পুতুলের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত।বিষণ্ণতার ঘন কুয়াশা সরে গিয়ে মাতৃ স্নেহের স্নিগ্ধতার রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সারা আঙিনায়।আর যার জন্য তমশার ঘোর অন্ধকারময় জীবনে তীব্র আলোর প্রকাশ ঘটেছে সেই হৃদয়ের টুকরো হলো ওদের আদরের মন,হ্যাঁ,এই নামেই শিশু পুত্রটি পরিচিতি পায় নীল-তমশার সন্তান হিসেবে।

এত বছর পর প্রানপ্রিয় মানুষটিকে প্রাণখুলে হাসতে দেখে নীলাদ্রির স্বস্তি ফিরে আসে।ছন্দ ছাড়া গতিহীন জীবন আবার তার মুলস্রোতে ফিরে আসে মনের আগমন হেতু।চঞ্চল চপলা হরিণী হয়ে ওঠে তমশা যে নিরাশার অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল।পরিবারে এই ছোট্ট শিশুর আগমন আনন্দের বারিধারা বর্ষণ করতে থাকে আর সেই বারিধারায় সকলে স্নিগ্ধ স্নাত হয়।সংসারের রুক্ষ মৃত্তিকা সবুজতা তথা সতেজ হয়ে ওঠে।বেশ খুশির আর আনন্দঘন হয়ে ওঠে ওদের জীবন।

এভাবে আনন্দের স্রোতে বেশ প্রবাহিত হতে থাকে ওদের জীবন।হটাৎ করে একদিন তমশা শারীরিক দুর্বলতা ও অস্থিরতা বোধ করতে থাকে।বিষয়টি বাড়ির সকলের চিন্তার কারণ হয়ে পরে,ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন দেখা দিলে তমশা বিচলিত হয়ে ওঠে কোন এক অজানা আশঙ্কায়।আগে ওদের জীবনে কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না কিন্তু এখন ওদের বিস্তৃত জীবন জুড়ে মনের আধিপত্য।মনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই তমশা মানসিক ভাবে পুনরায় অস্থির হয়ে ওঠে।তাই দেখে নীল তমশা কে শান্তনা দিয়ে বলে,"তুমি সবসময় কেন এত দুশ্চিন্তা করো বলো তো? ভয় পেও না,সব ঠিক হবে দেখো," তমশা শুধু নির্লিপ্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে নীলাদ্রির প্রতি।পাশে খেলতে থাকা মনকে কোলে তুলে আদর করতে থাকে তমশা,আর তাই দেখে নীল প্রশান্তির হাসি হাসে।

তমশাকে ডাক্তার দেখানো হলে তার পরামর্শ মত সবকিছু পরীক্ষা করতে দেয় নীল। এদিকে দুশ্চিন্তায় তমশার জীবন প্রায় জেরবার তার সঙ্গে শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটতে থাকে।নিজের মনে চিন্তার পাহাড় নিয়ে তমশা মনের সঙ্গেও প্রাণখুলে খেলা থেকে বিরত থাকে।বেশ কিছুদিন পর,"মা,ওওও মা,কোথায় তুমি? তমশা,তমশা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে একপ্রকার দৌড়েই বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে নীল।সুমিতা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন," কি হয়েছে নীল,এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?""মা,মা," বলে এগিয়ে যায় নীল সুমিতা দেবীর দিকে,কাঁধ ধরে দুপাক ঘুরিয়ে বলে ওঠে," ওহঃ মা,আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে তোমায় কি বলবো,ভগবান যেন সমস্ত পৃথিবীর আনন্দ আমার ঝুলিতে ঢেলে দিয়েছে",অশ্রু গড়াতে থাকে নীলের চোখ থেকে। তমশা এ সবের কিছু বুঝতে পারছিল না,ও মনের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত ছিল,এগিয়ে এসে নীলের কাঁধে হাত রেখে নীলকে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলে," কি হয়েছে নীল?আমাকে কি একটু বলবে,আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।" একঝটকায় নীল বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তমশা কে,কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে," ভগবান আমাদের হৃদয়ের ডাক শুনেছেন,তমশা,আমাদের শুন্য ঝুলি তিনি পূর্ন করেছেন,আমাদের সমস্ত আশা- আকাঙ্খার পরিসমাপ্তি ঘটেছে,তুমি তোমার মধ্যে এক নব প্রানের বীজ ধারণ করেছ,তুমি সন্তান সুখ পেতে চলেছ তমশা,"এই কথা শোনা মাত্র তমশা খানিকক্ষণ পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে,নীলের স্পর্শে নিজের চেতনায় ফিরে এলে কান্নায় ভেঙে পড়ে তমশা।একে অপরকে জড়িয়ে যে কান্নারত অবস্থায় কতক্ষন ছিল,তার ঠিক নেই।

নিজেকে একটু সংযত করার পর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তমশা আপন মনে ক্রীড়ারত মনের দিকে।মেঝে থেকে মনকে কোলে তুলে নিয়ে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে তোলে সমগ্ৰ মুখমন্ডল,আর কাঁদতে থাকে,"আমার দেবদূত,আমার দেবদূত,",বুকে আগলে ধরে তমশা মনকে।

হ্যাঁ,দেবদূতই তো বটে,যে মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের জন্য তমশা মরিয়া হয়ে ছিল,সেই মাতৃ হৃদয়ের আংশিক তৃষ্ণার পরিতৃপ্তি ঘটেছে এই মন ওদের জীবনে প্রবেশ করার কারণে,আর আজ নিজের রক্ত,মাংস দিয়ে গড়া এক ভ্রূণকে সে ধারণ করেছে তার নিজের শরীরে,আর এসব কিছুই কেবল মাত্র এই শিশুর জন্য,হ্যাঁ,দেবশিশু,মনের রূপ ধরে যার পদার্পন ওদের বিস্বাদ ও আশাহত জীবনে করেছে অনাবিল আনন্দ আর মানসিক শান্তির গৃহপ্রবেশ।অবশেষে সকলের এত দিনের অপেক্ষায় অবসান ঘটলো।

নির্দিষ্ট দিনে তমশার কোল আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে রাজকুমারী,যার চোখ ঝলসানো অপরূপ সৌন্দর্য্য,ঠিক যেন এক পরি,পূর্ণতা পায় তমশার নারী জীবন।ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে তমশার মন মুগ্ধ করা হাসি দেখে অশ্রু সিক্ত নয়নে নীলাদ্রির ঠোঁটেও এক সুন্দর হাসি খেলে যায়।এই দিনটারই তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ওরা দুজন।বাড়ির প্রধান প্রবেশ পথে হাতে বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমিতা দেবী হাসি মুখ করে।নীল,তমশা,মন ও তাদের ছোট্ট রাজকুমারীকে একত্রে বরণ করে ঘরে তোলেন সুমিতা দেবী,আজ এই পরিবার সম্পুর্ন দেখে আনন্দে অশ্রু নির্গত হয় সরলা দেবীর ।দুহাত তুলে নাতি নাতনি সহযোগে পুত্র ও পুত্র বধূকে সুখী ও দীর্ঘ আয়ু প্রাপ্তির আশীর্বাদ করেন।হ্যাঁ,এভাবেই কারোর কারোর জীবনে আকাঙ্খা পরিসমাপ্তি লাভ করে এই দেবদূতদের মত ছোট্ট শিশুর হাত ধরেই আর অবশেষে পূর্ণতা পায় সে জীবন..


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance