বিভীষিকাময় দুপুর
বিভীষিকাময় দুপুর
'এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘন-ঘোর বারিষায়'।
কিন্তু কোথায় পাবো তারে?সে যে হারিয়ে গেছে এমনই এক ঝড় বাদলের দিনে।হয়তো কবি না হলে বর্ষার দিনের কথা অনুভব করা সম্ভব নয়।কিন্তু আমার জীবনে বর্ষা আসে বেদনার অশ্রু হয়ে।চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে এক হতে।বাইরে যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে তখন আমার হৃদয় গভীরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়;থাকেনা কোন ভাবনা চিন্তা,থেকে যায় একটা ব্যথার অনুভূতি। যে ব্যথা থেকে আমি আজীবন বেরোতে পারবোনা।
মানুষের জীবনের পরিসর ক্ষুদ্র।এই ক্ষুদ্র জীবনের প্রতিটা দিনই নানান বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে । কিছু ঘটনা মনে এমনভাবে গেঁথে যায় শত চেষ্টা করেও তাকে ভুলা যায়না।এইসব ঘটনা বারবার অতীতে টেনে নিয়ে যায়।
স্মৃতির খাতায় ময়লা জমলে অক্ষরগুলো হয় অস্পষ্ট।কিন্তু মুছে কোনটাই যায়না।মাঝে মাঝে কোন বিস্মৃত নাম কখনো বা বিস্মৃত ঘটনা মনের মধ্যে জেগে ওঠে।স্মৃতির বাসরে প্রত্যেকের জীবনই ঘটনাবহুল।কিছু কিছু ঘটনা চির অম্লান।
তখন আমি ফাষ্ট ইয়ারে পড়ি।কলেজের প্রথম দিন থেকেই অনিকেত আমার খুব ভালো বন্ধু।মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এই বন্ধুত্বের গণ্ডিটা পেরিয়ে আমরা কাছকাছি চলে আসি।
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি যতদূর দৃষ্টি যায় সমস্ত আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে আছে।ঘোলাটে এক পাংশু আকাশ।মা কলেজে বেরোতে নিষেধ করলেন।কিন্তু আমি জানি এই বৃষ্টির মধ্যেও অনিকেত কলেজে আসবেই।ট্রেন লেট থাকলে তার হয়তো একটু দেরি হবে
কিন্তু কোন অবস্থাতেই সে কলেজ কামাই করবেনা।মাকে বললাম,'আজ কলেজে যেতেই হবে মা।'
মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।চুড়িদার ভিজে চপচপে।কলেজে পৌঁছে দেখি আমার আগেই অনিকেত এসে গেছে।উপস্থিতির হার এতোটাই কম ছিলো প্রথম ক্লাসটা কোনমতে হয়েই কলেজ ছুটি হয়ে যায়।
আমি ও অনিকেত দু'জনে দু' টি ছাতা মাথায় রাস্তা পার হয়ে চপ খাওয়ার জন্য কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লাম।আমি বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ 'গেলো' ' 'গেলো' একটা চিৎকার শুনে পিছন ফিরে দেখি অনিকেতের উপর এক ইলেকট্রিক তার ছিড়ে পড়েছে কিছুটা সময় সে ছটফট করে নিস্তেজ হয়ে পড়লো।আমি দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ সেখানে জড় হওয়া কিছু পথচারী আমায় আটকে দিলো।অসহায়ের মত ছটফট করতে লাগলাম।খবর দেওয়া হল ইলেকট্রিক অফিসে।বৃষ্টি থামলে তারা আসলো।ঘন্টা দুয়েক ভিজে কাপড়ে চোখের জল আর বৃষ্টির জলের ধারা এক করে এক দৃষ্টিতে অনিকেতের ওই নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলোনা।
এই ঘটনার পর জীবন আরও বিশটা বছর এগিয়ে গেছে।দু'সন্তানের মা আমি।ভুলতে পারিনি আজও অনিকেতকে।কোনদিন ভুলতে পারবোও না।কিন্তু এই বৃষ্টির দিনে যেন আরও বেশি করে মনে পড়ে তার কথা।জীবন হয়তো কারও জন্যই থেমে থাকেনা।না,আমার জীবনও থেমে নেই।কিন্তু যে ক্ষতটা বিশ বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে সেটা আজও একই রকম রয়ে গেছে।কবির কল্পনা আর প্রেমিক মানুষের মনে বৃষ্টি যতই নয়নাভিরাম হোকনা কেন আমার কাছে তা বিভীষিকাময়।