Maheshwar Maji

Inspirational

3  

Maheshwar Maji

Inspirational

বহু প্রতীক্ষার পর

বহু প্রতীক্ষার পর

4 mins
582


(১)


নির্ঝর হ্যান্ড স্ট্রিকটা গুটিয়ে তড়িঘড়ি চায়ের দোকান দিকে যাচ্ছিল।

...এত আনন্দ!

...এত খুশি!

..উত্তেজনায়,যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।

ভাবতেই গা টা কাটা দিয়ে উঠল।এত নামি,দামি,বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভিড়ে আজ সে তার কৃতিত্বের দাবি নিয়ে হাত তুলতে পেরেছে। আজ থেকে সেও একজন সম্মানীয় ব্যক্তি।

শুধু অন্ধ নয়। তার পরিচয় এবার আবদ্ধ গন্ডির বেড়া টপকে সমাজের বিস্তৃতি পরিসরে ছড়িয়ে পড়ল।

আজ থেকে তার নতুন পরিচয়।কবি নির্ঝরপ্রকাশ মজুমদার।একজন অন্ধ কবি।

বুকের হাহাকারগুলো আজ মিলিয়ে গেল হাজার হাততালির হর্ষধ্বনিতে।

যন্ত্রণাগুলো উপশমের মলম পেল।শত রাতজাগার ক্লান্তি অবশেষে তার ধুসর জীবনে রামধনু আঁকতে পারল।

এরই নাম প্রাপ্তি!!


(২)

--সরি...সরি ম্যাডাম। আপনার লাগেনি তো?

দোষটা সম্পূর্ণ কাবেরীর। একে তো মুখটা আঁটোসাঁটো বেঁধে রেখেছে। ঠিক যেন চোখদুটি দেখা যায়।

তাই বার, বার চোখের কাছটাই ঢাকাটা গুটিয়ে রাখতে হচ্ছে।

তার উপর অন্য মনস্ক হয়ে সরু রাস্তার উপর মোবাইল ঘেটে হাঁটছে।

আসলে উত্তেজনা, তার বুকেও ঝড় তুলেছে। সেও বহু প্রতীক্ষিত প্রাপ্তির খুশিতে শিশির ভেজা শিঙি মাছের মতই ভেতরে, ভেতরে নাচছে। সেরা দশ জন সাহিত্যিকের মধ্যে তার নামও রয়েছে।


কী লজ্জা!... কী লজ্জা!

এই প্রাপ্তি সে জীবনে কোনদিন কল্পনা করেনি।

তাই আবার হয় নাকি?

শুধুমাত্র তার বাবা, মেয়ের শত অগ্রাহ্যকে উপেক্ষা করেও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "যে ফুল ফোটেনি" সাহিত্য সম্মান প্রতিযোগিতায় একটা কপি জমা করে দিয়েছিলেন।

নির্বাচক কমিটিতে কাবেরী শুনেছে, তার প্রিয় কবি জয়জিৎ গাঙ্গুলিও ছিলেন।


....কী লজ্জা...কী লজ্জা!!

উনাকে উদ্দেশ্য করেও কাব্যগ্রন্থে তিনটে কবিতা রয়েছে। তখন তো আর জানত না। এই গোপন কবিতাগুলো একদিন খোলা আঙিনায় শত, শত হৃদয়ে হিল্লোল জাগিয়ে তুলবে?


মনের উত্তেজনাকে সংবরণ করে দু হাত জড়ো করে নির্ঝরের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, সরি..সরি দাদা।...আরে আপনি যে! বিশিষ্ট কবি শ্রীযুক্ত নির্ঝরপ্রকাশ গাঙ্গুলি।

আপনি যে সত্যি সত্যিই একজন অন্ধ মানুষ। আপনার লেখা পড়ে, আমার মন, কখনো তা মানতে চাইত না।

ভালোই হল। দেখা হয়ে গেল। বিশ্বাস করুন আপনার সাথে আমার দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। অনেক কথা আছে।...ওই তো সামনেই চায়ের দোকান।একটুখানি বসবেন?


নির্ঝর, ঘটনার আকস্মিকতায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। এখন অনেকটা নিজেকে গুছিয়ে বলে উঠল, আপনার নাম?


---মিস কাবেরী জানা।


নির্ঝর গলা ঝেড়ে বলে উঠল,তাই বলুন!!.. ভাবছি আমার লেখা এত প্রচার পেল কোত্থেকে?...আপনি এই পত্রিকায় লেখা অনেক কম দিতেন। যে কটা দিতেন, আমি অন্তত দশবার করে শুনতাম।

আপনার কাব্যগ্রন্থের সবকটা কবিতা বাবাকে দিয়ে পড়িয়েছি। দু,একটা মুখস্ত পর্যন্ত হয়ে গেছে।...সেই যে "গোলাপ মুখী" তে লিখেছেন

---"যে ব্যথা বুকে নিয়ে সুরভী

         ছড়ায় আমি,

  শুধু কাটা কেন সারা গায়ে

      আমরা ক'জন জানি?


...আবার অন্য এক জায়গায় বলেছেন


 ---"এইভাবে ঝরে যাব একদিন

    প্রেমিকের হাতের ছোঁয়াতে,

    ...দাও যত ওষ্ঠ পরশ

      এ মনের রক্ত দোয়াতে।"

     

....আপনার বুকে এত যন্ত্রণা!!...অথচ নির্বিকারে তাদের এতদিন বন্দি করে রেখেছিলেন?...ভারি অন্যায়। যন্ত্রণাকে ভাষা দিয়ে মুক্ত আকাশে ওড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হয়।

-শুধু আলো নিয়ে পৃথিবী সুন্দর নয় ম্যাডাম। তেমনি বাঁচার মাঝেও যন্ত্রণা, জীবনটাকে অনেক বেশি বাগ্ময় করে তোলে।

....তা আপনি মঞ্চে উঠলেন না কেন?...ঘোষণায় শুনলাম আপনার বাবা সম্মানপত্র আর ট্রফি নিতে এসেছেন।এমন করার কারণ?

কাবেরী একটা দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বলে উঠল,

---চলুন। এক জায়গায় বসে,গল্প করা যাক।

তারপর সব কথা বলছি।


(৩)


---এই হল আপনার জীবনের কাহিনী!...তাই তো?...উহু..একদম না কাবেরীদেবী। দয়া করে কাঁদবেন না।আজকের এমন একটা আনন্দঘন দিনে আপনার এমন সুন্দর দুটি আঁখি পেলবে বরষা মানায় না। আমি মানছি। আপনার সাথে অন্যায় হয়েছে। তাবলে নিজের ভাষাকে হারিয়ে ফেলবেন না যেন।...ওরা আপনার মুখের সুন্দরতা তীব্র অ্যাসিডের জ্বালায় শেষ করে দিয়েছে।

মনটা তো আর না। আজো সেই একই রকম সুন্দরতা নিয়ে কাব্য রচনা করে চলেছে। আপনি একদম ঘাবড়াবেন না ম্যাডাম। আমি আপনার সাথে আছি।


কাবেরী মুখের ঢাকাটা আর একবার ঠিক করে নির্ঝরের দিকে তাকাল।

দুটো চোখ নেই। অথচ এমনভাবে পৃথিবীর রূপ, রসের বর্ণনা দেন। যেন তিনিই এই প্রকৃতির সৃষ্টা!

...প্রকৃতি তার সাথেও অন্যায় করেছে।যেমন তার সাথে করেছে এই সমাজের হিংস্র একদল মানুষরূপী জানোয়ার।

নিজেকে সংযত করে কাবেরী বলে উঠল,


---আপনিই বলুন...এই মুখ বাঁধা অবস্থায় কী করে মঞ্চে উঠব?..অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। হয়ত মুখটাও দেখতে চাইবেন। সে আমি পারবো না।...আমি নিজেই আয়নায়,নিজের মুখটা দেখে ভয় পাই। অন্যদের অবস্থা কী হবে সেটা আমি আন্দাজ‌ করতে পারি। কলেজের সেরা সুন্দরী ছিলাম।কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না। নিজের পড়াশুনোর উপর সমস্ত মনযোগ দিয়ে, স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।...তারপর কাল পর্যন্ত অনেক দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়ালাম।

আজ এই শেষবেলাতে এসে এতটুকু হলেও নিজেকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।

তাছাড়া এই পৃথিবীতে কেই বা আছে মুখপুড়ির দিকে চাইবে?...অন্যের ভালবাসা চাওয়ার অধিকার আজ আমার নেই, নির্ঝরবাবু।


নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজের টি-শার্টের ভাঁজ টেনে বলে উঠল,...আমার জীবনেও কোন রঙ নেই ম্যাডাম।

তবু সবকিছু কে রঙিন দেখি ।

যেমন এই মুহূর্তে আপনাকে দেখছি।

আমার চোখে আপনি বিশ্বসুন্দরী।

আমি তো আর সুন্দরতা চোখ দিয়ে যাচাই করতে পারি না ।

আমি বস্তুর উপর নিজের কল্পনার রঙ মাখিয়ে কাব্যের ঘর সাজায়।

আমার কাছে আপনি তাই আস্ত একটা পৃথিবী।

নির্ঝর হাতের ছড়িটা সোজা করে বলে উঠল, আপনার হাতদুটো তো খালিই আছে। একটা বাড়াবেন প্লিজ।...দুজনে মিলে আরো কয়েকটা যৌথ কাব্যগ্রন্থ রচনা করতাম। যদি বেশি কিছু চেয়ে থাকি। তারজন্য ক্ষমা করবেন।

তবে ভেবে দেখবেন।...আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব।নমস্কার।


কাবেরী স্থির হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইল। নির্ঝরের পথের দিকে চেয়ে। চোখ দুটো খুশির জলে ঝাঁপসা হয়ে উঠল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational