Sonali Basu

Drama

4.7  

Sonali Basu

Drama

ভাঙ্গাগড়ার খেলা

ভাঙ্গাগড়ার খেলা

7 mins
2.2K


তোর্ষা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। ভোরের আমেজ ছড়িয়ে আছে সারা চরাচর জুড়ে। একটু পরেই সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সব। এসি স্লিপারে আছে বলে জানলা খুলতে পারছে না। তাই পর্দাটাই সরিয়ে জানলায় মুখ ঠেকিয়ে দেখছে ও। একটু আগেই ঘুম ভেঙেছে ওর। ট্রেনের বেশীরভাগ যাত্রী এখনো গভীর ঘুমে। যাদের গন্তব্য এসে পড়েছে তারাই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে ব্যাগপত্র নামাতে শুরু করেছে বা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের গতি কমে এসেছে তার মানে একটু পরেই ষ্টেশনে ট্রেন গিয়ে ঢুকবে। ট্রেনের চাকা এক লাইন থেকে অন্য লাইনে সরে যাচ্ছে। ট্রেনের লাইন বদল দেখতে দেখতে তোর্ষার মনে পড়লো এইভাবে একদিন ওর আর চন্দ্রীলের জীবনের লাইন আলাদা হয়ে গিয়েছিল।

“ম্যাডাম চা” তোর্ষা জানলা থেকে ঘুরে তাকালো প্যান্ট্রি কার থেকে আসা লোকটার দিকে।

“একটু পরে নেবো” বলতে লোকটা বাকিদের (যারা জেগে)চা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে চলল বাথরুমের কাজ সেরে নিতে। ফিরে এসে সিটে বসতেই দ্বিতীয়বারের জন্য চা এসে পড়লো। তোর্ষা চা নিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলো ট্রেন ষ্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে---ময়নাগুড়ি। এখানে সাধারণত এই ট্রেনটা দাঁড়ায় না, তাহলে? কোন সমস্যা আছে হয়তো। স্টেশনটা দেখতে দেখতে পুরনো দিনে গড়িয়ে গেলো ওর স্মৃতি।


এখানেই চন্দ্রীলের সঙ্গে ওর আলাপ। ও ওর দিদি তিস্তার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসেছিল কলেজে গরমের ছুটি পড়াতে। আর চন্দ্রীল এসেছিল ওর বন্ধুবান্ধবের সাথে ডুয়ার্স ঘুরতে। সেই জঙ্গল ঘুরতে গিয়েই ওদের আলাপ, প্রথমে জামাইবাবু আবিরদার সাথে তারপর তার থেকে এদের দুই বোনের সাথে। জঙ্গল হাতি গণ্ডার বাইসনের ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে চন্দ্রীল কখন ওর ছবিও তুলেছে সেটা তোর্ষা বুঝতে পারেনি। পড়ন্ত বিকেলে যখন ওদের জীপ জঙ্গলের এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ ওর কোলে একটা কাগজের দলা এসে পড়েছিল। কাগজ ফেলে দিতে গিয়েও কৌতুহলবশত খুলে দেখেছিল তাই দেখতে পায় ওতে চন্দ্রীলের নাম আর ফোন নম্বর। ও সামনে পেছনে তাকাতে চন্দ্রীলদের গাড়ি ওদের গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখলো। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে চন্দ্রীল ইশারা করলো ফোন করার। তোর্ষা তো ওর কাণ্ড দেখে হতবাক। সামান্য আলাপ হওয়া মেয়েকে এরকম ফোন করতে বলা যায়? ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল ও। তাই ফোন নম্বরটা পেলেও ও কিন্তু ওকে ফোন করার কথা ভাবেনি।


ভুলেই গিয়েছিল সেই ক্ষণিকের আলাপ কিন্তু দিদির ফোন ওকে আবার মনে করিয়ে দিলো। প্রায় মাসখানেক পর এক দুপুরে গল্পের মাঝে দিদি বলল,

“জানিস তোর্ষা আমাদের বাড়ির ঠিকানায় আজ একটা খাম এসে পৌঁছেছে”।

“তাতে কি হল?”

তোর্ষা জানে জামাইবাবুর কাছে ওর অফিসের নানা রকমের চিঠিপত্র আসে। তাই ও অবাক হয়নি। তিস্তা বলল,

“খামে কি আছে, জানিস? তোর ছবি”!

“আমার? কে তুলল? আর তোদের ওখানে পাঠালো কে?”

তিস্তা সব বলল। তোর্ষার মনে পড়লো চন্দ্রীলের কাগজে ফোন নম্বর দেওয়ার ঘটনাটা। কিন্তু কাগজটা তো ও রাখেনি, তাহলে এখন ফোন করে উদ্দেশ্য জানা যেত এই ছবি তোলার। তাই দিদিকে বলল,

“তোদের ঠিকানা জানলো কি ভাবে?”

“তোর জামাইবাবুর থেকে”।

“তাহলে তুই চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করতে পারতিস কেন ও তোর বোনের ছবি তুলেছে”?

“প্রশ্ন করবো কি রে, ও নিজেই জানিয়েছে ও তোর প্রেমে পড়েছে”?

“অ্যাঁ”!

“অ্যাঁ নয় হ্যাঁ! তোর সাথে কথা বলতে চায়। তোর নম্বর চেয়েছিল। তোর জামাইবাবু সেটা দিয়েও দিয়েছে”।

“এটা আবিরদা ঠিক করলো না”।


জামাইবাবুর সাথে মান অভিমানের পালা চলল শালী জামাইবাবুর মধ্যে।কিন্তু তোর্ষা অবাক হয়ে দেখলো নম্বর থাকা সত্ত্বেও চন্দ্রীল ওকে ফোন করলো না। তোর্ষা দিদির কাছ থেকে ওর ছবিগুলো চেয়ে নিলো। প্রতিটা ছবি মন দিয়ে দেখে বুঝলো ছবি তোলার কায়দা ভালোই জানা আছে ছেলেটার নাহলে এতো সুন্দর ছবি ওর কোনদিনই ওঠেনা। শেষে ঐ একদিন ফোন করলো চন্দ্রীলকে। চন্দ্রীল ফোন রিসিভ করে বলল,

“বাবাহ! এতদিনে সময় হল ফোন করার?"

তোর্ষা বলল,

“আপনি কি করে ভাবলেন যে নম্বর দিলেই আমি ফোন করবো”?

“ভাবিনি তবে আশা করেছিলাম। আমার মনও বলছিল করবেন, আগে হোক বা পরে। তাই অপেক্ষাতেই ছিলাম। যাক! ছবি পছন্দ হয়েছে?”

“গিয়েছিলেন তো জন্তু জানোয়ারের ছবি তুলতে আর তুললেন আমার?”

“জঙ্গলের মাঝে ময়ূরী দেখে নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি”।


ফোনালাপ এগিয়ে গেলো মুখোমুখি আলাপের পর্যায়ে। তারপর প্রেম প্রস্তাব। তোর্ষা গ্রহণ করলো ওর ভালোবাসা। কেউ যে ওকে এতো ভালোবাসে এতোটা চোখে হারায় এটা ও কোনদিন আগে অনুভব করেনি। আজ যখন করলো আনন্দে আটখানা হল ও। বিয়ের প্রস্তাব দিতেও চন্দ্রীল দেরী করেনি। দুই বাড়ির সম্মতিতে বিয়ে হয়ে গেলো ওদের। কিন্তু বিয়ের পর থেকে বোঝা গেলো চন্দ্রীল আর ওর মধ্যে কোন কিছুরই মিল নেই। তোর্ষার খারাপ লাগলেও মানিয়ে নিতে খুব চেষ্টা করে চলেছিল। কিন্তু চন্দ্রীলের অনমনীয় মনোভাব ওর মানসিক যন্ত্রণা বাড়িয়ে চলল। শেষে ও সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হল। চলে যেদিন আসে ঐ বাড়ি ছেড়ে চোখের জলে ভেসেছিল ও। কিন্তু এটাও বুঝেছিল ছিঁড়ে যাওয়া তার জোড়া লাগেনা।    


ট্রেন ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে।


আলিপুরদুয়ারে ট্রেন থামতে দু একটা পরিবার নেমে পড়লো আর কয়েকজন উঠলো। ওর উল্টোদিকের যাত্রীরা নেমে গেছে। ফাঁকা সিটের দিকে না তাকিয়ে আবার জানলায় মন দিলো ও। জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল বলে ও খেয়ালই করেনি ওর উল্টো দিকের নতুন যাত্রীকে।

“স্যার চা নেবেন?”

“হ্যাঁ দিন”!

গলার আওয়াজ শুনে তোর্ষা ঘুরে তাকালো নতুন সহযাত্রীর দিকে। আর ঘুরতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো সহযাত্রীর সাথে। চন্দ্রীল! ও চোখ ঘুরিয়ে নেবে নাকি কিছু বলবে নাকি বলবে না, ঠিক করে উঠতে পারলো না ও। চন্দ্রীলই প্রথম বলল,

“কেমন আছো?”

ওর সহজভাবে প্রশ্ন করার ফলে তোর্ষাও খানিক সহজ হয়ে উঠতে পারলো। উত্তর দিলো,

“ভালো... তুমি?”

“আছি এরকম”!

তারপর চায়ে একটু চুমুক দিয়ে বলল,

“যাচ্ছ কোথায়?”

“ত্রিপুরা, দিদির বাড়ি। আবিরদা এখন ওখানে চাকরি করছেন। তুমি?”

“বেড়াতে যাচ্ছি, আপাতত আসাম। আমার সেই যাযাবর স্বভাবটা রয়েই গেছে। বাড়িতে মন না বসলেই বেরিয়ে পড়ি”।

“শুনেছিলাম বিয়ে করেছ, তোমার স্ত্রী সন্তান এরা বেরোয়না তোমার সাথে?”

“না মিলি একটু বেশিই ঘরকুনো, ওর এতো ঘোরাঘুরি ভালো লাগে না। তাছাড়া টুকু, আমাদের মেয়ে এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তাই ওদের নিয়ে সেরকম বেরনো হয় না”।

খানিক থেমে আবার বলল,

“তোমার সম্পর্কে কিছু বললে না তো?তোমার স্বামী সংসার সম্পর্কে”!

তোর্ষা একটু হাসলো। তারপর বলল,

“এখনো বিয়ে করিনি”!

“কারণ জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”

“হ্যাঁ। একজনের কাছে ঘা খাওয়ার পর আর ইচ্ছেই রইলো না সংসার করার”।

“ও”!

তোর্ষা বলল,

“তবে দিদি জামাইবাবু তো এখনো আমার অভিভাবক। ওরা আবার ধরে পড়েছেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। জামাইবাবুর পরিচিত একজনের সাথে আমার আলাপ করাতে চান। ওই ছেলে নাকি জামাইবাবুর ওখানেই চাকরি করে। আমাদের সম্পর্কে ওদের বলেছে। ছেলের নাকি কোন আপত্তি নেই বিয়ে-ভাঙ্গা মেয়েকে আবার বিয়ে করতে। আমার কোনো ইচ্ছেই ছিল না কিন্তু বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে”।

“তোমার দিদি জামাইবাবু তো তোমার ভালোই চাইবেন। তাই না?তা তোমার দিদির ছেলে মেয়ে কত বড় হল?”

“ছেলে ক্লাস সেভেন আর মেয়ে ক্লাস ফোর”!


গল্পে গল্পে সময় কেটে গেলো। আসাম মেল এসে পৌঁছালো তার গন্তব্যে। তোর্ষা ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি খুঁজলো। আবিরদার আসার কথা। আবিরদা না আসতে পারে যদি তাহলে ওর গাড়ি আসবে। চোখে পড়লো আবিরদাই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখতে পেয়েই বলল,

“এসো হে শালিসাহিবা” আর বলতে বলতেই চোখে পড়লো চন্দ্রীলের ওপর। ওকে দেখে বলল,

“কি হে কেমন আছো?”

“মোটামুটি আর তুমি?”

“ভালো কিন্তু এখন তো তোমার মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, তাই নয় কি? বেড়াতে এসেছ”

“হুম”!


তোর্ষা দুজনের কথপকথন শুনলো কিন্তু বলল না কিছুই। ওর মনে শুধু একটাই প্রশ্ন কি ভাবে আবিরদার সাথে চন্দ্রীলের এখনো সম্পর্ক টিকে আছে? ওর সাথে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও!! এরপর দুজনে গাড়িতে উঠে পড়লো চন্দ্রীলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। বাড়ি পৌঁছে দিদির সাথে গল্প খাওয়াদাওয়ায় সময় বেশ কেটে গেলো প্রথম দিনটার।

পরেরদিন আবির বলল,

“শালিসাহেবা আজ আমাদের বাড়িতে একজন আসবে তোমার সাথে আলাপ করাবো। তৈরি থেক” বলে চলে গেলো অফিসে।


তোর্ষার খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও বিকেলে তৈরি হল দিদির ঠেলায়। সন্ধ্যার মুখেমুখে জামাইবাবুর গাড়ি ফিরলো অফিস থেকে। বাইরের ঘরে বসেই ওরা দুই বোন টিভি দেখছে। এমন সময় আবির আর তার বন্ধু এসে ঢুকলো বাড়িতে। তোর্ষা অবাক হয়ে দেখল আবিরদার সাথে চন্দ্রীল। ও ভারি অবাক হয়ে গেলো। ও বলেই ফেলল,

“এ আপনার অফিসের বন্ধু? এর সাথে আপনি আমার আলাপ করাতে চান?”

আবিরের উত্তর,

“আহা হা রাগ করো কেন তোর্ষা? হ্যাঁ ওর সাথেই আবার তোমার আলাপ করাতে চাইছি। কারণটা তুমি ওর কাছেই জেনে নাও”।

তোর্ষা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আমার কোনো কারণ জানার দরকার নেই। আর দিদি তুইও তো সব জানিস বলেই মনে হচ্ছে। আর এই কারণেই আমাকে ডেকে পাঠানো। আমি কালই কলকাতা ফিরে যাবো”।

তিস্তা কিছু বলার আগেই চন্দ্রীল বলল,

“আমাকে কি কিছু বলারও সুযোগ দেবেনা তোর্ষা?”

আবির বলল,

“তোর্ষা একবার শুনে নাও তারপর যদি ভালো না লাগে তো তোমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারো”।

তিস্তা বলল,

“তোমরা কথা বলো আমরা আসছি”।

চন্দ্রীল বলল,

“আমি জানি তোর্ষা আমি ভীষণ অন্যায় করেছি। যা করেছি তা আমার সাথে হলে আমিও তোমার মতোই বলতাম। তুমি যখন ছিলে তখন তোমাকে না বুঝলেও তুমি যেই চলে গেলে তখন তোমার অভাববোধ ভীষণভাবে অনুভব করলাম। প্রথম কয়েকটা মাস যে কি দুঃসহ কেটেছে তোমায় সেটা বলে বোঝাতে পারবো না! কিন্তু আমি জানি তুমিও সেই একই কষ্ট পেয়েছ। অনেক ভেবে দেখলাম কিন্তু তুমি ছাড়া আমি অচল। আজ ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই আমার তবু যদি তুমি আমার কথাটা একটু ভাবো তাহলে আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে পারি”।

“তুমি আবার আমার সাথে সংসার করার কথা ভাবো কি করে?তোমার না স্ত্রী আছে মেয়ে আছে”!!

“সবটাই গল্প, কেউ নেই আমার জীবনে তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে”!


তোর্ষা চুপ করে বসে রইলো। কি উত্তর দেবে ও? ও যে চন্দ্রীলকে ভুলতে পারেনি এটা তো ঠিক! কিন্তু ভয়ও হয় আবার সেই আগের পরিস্থিতি ফিরে আসবে না তো? দ্বিতীয়বার সংসার শুরু করে ভেঙে বেরিয়ে আসার মতো মানসিক ক্ষমতা তো নেই ওর। শেষে বলল, “আমায় ভাবার কিছু সময় দাও”।

“ঠিক আছে আমি অপেক্ষায় আছি আর অপেক্ষাতেই থাকবো”....।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama