ভাঙা কাঁচ
ভাঙা কাঁচ
লোকে বলে তুমি নাকি আমাকে ধোঁকা দিয়েছো, বোকা বানিয়েছো। কেউ কেউ বলে ল্যাং মেরেছো। আমি কিন্তু সেদিনও বিশ্বাস করিনি যে তুমি আমাকে ঠকিয়েছো, আজও করিনা। স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই আমাদের আলাপ। একে অপরকে ভালো লাগতে থাকার শুরু। মেলামেশা করাটা কখন যে শুধু বন্ধুত্বের দাবীটাকে নস্যাৎ করে দিয়ে মনের দুয়ারে গিয়ে ধাক্কা মারতে শুরু করেছিল, সেটা তুমি বা আমি কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। স্কুল পার হয়ে কলেজে ওঠার পরে আমাদের ভালোলাগা ইচ্ছেগুলো আরো অনেক রঙিন হয়ে প্রজাপতির পাখায় ভর করে ফুলের বিস্তৃত বাগিচায় বাধাহীন মুক্ত পাখির মতো স্বাধীন ভাবেই উড়ে বেড়াতে লাগলো। তোমার কাছেই জানতে পেরেছিলাম যে তোমাদের কলেজটা ছিল আবাসিক। হোস্টেলে থেকেই তোমাকে পড়াশোনা করতে হতো। সপ্তাহান্তে শনি-রবি দুটো দিন ছুটি থাকায় বাড়ি আসার সুযোগ তুমি পেতেই। আর তখনই ছিল আমাদের দেখা করার, কথা বলার, আবেগে ভেসে যাওয়ার মতো মূল্যবান কিছু সময়। তুমিই বলেছিলে রাতের ডিনার সেরে যখন হোস্টেলের লনে একটু পায়চারি করতে, সেসময় তোমার মন জুড়ে এসে পড়তাম আমি। সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা লনে তোমার প্রতি পদক্ষেপে আমায় নিয়ে চিন্তা করে তোমার মনে জেগে উঠতো আলোড়ন। ওপরে আকাশের বুকে চাঁদ তারাদের মেলা। স্নিগ্ধ আলোর মন মাতানো উজ্জ্বলতা। শরীরে স্নেহের পরশ দিয়ে যেত মৃদু মন্দ আবেশে মোড়া হালকা শীতল বাতাস। আর ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে, আকাশের তারার দিকে চেয়ে তুমি গেয়ে উঠতে, 'আকাশ প্রদীপ রহে, দূরের তারার পানে চেয়ে'। আমিও সে সময় রইতাম তোমার চিন্তাতেই বিভোর। মনের মাঝেই খুঁজে বেড়াতাম তোমায়। নিজের অন্তরের মাঝেই যে ভাবনার উদ্রেক হতো তাতে বুঝতে পারতাম,'আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে'। আমাদের দুজনের উথাল পাথাল মন 'ব্যাথার বাদলে যায় ছেয়ে'। আমি তো সন্ধ্যের আগেই কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে আসতাম। একটু খেলাধুলা, একটু পড়াশোনার পর, রাতে খাবার খেয়ে নিয়ে চলে যেতাম ছাদে। পায়চারি করার সময় আমার মনের আঙ্গিনা জুড়ে রইতে শুধু তুমি। মনের মাঝে তুমি ভেসে উঠতেই একটা অজানা বেদনা কাঁপিয়ে দিয়ে যেত অন্তরের অন্তঃস্থলকে। অন্ধকারেই খুঁজে বেড়াতাম তোমায় ভালোবাসার ছোঁয়া। এতো ভারী বোধ হতে থাকতো এই সুন্দর মনটাকে যে আর বেশিক্ষন তাকে টেনে বেড়ানোর ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে যেত। নিজের মনকে আশ্বাস দিতাম এই বলে যে সপ্তাহের শেষে দেখা তো হবেই, তখন সমস্ত ভার লাঘব করে নেবো। ভালোবাসা কথাটার অভ্যন্তরে চুপ করে লুকিয়ে থাকে বিরহ, বেদনা। ভালোবেসে কষ্ট পেতে হয় নিয়মিত।
সে সময় তো মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছিল না। তাই রাত বিরেতেও ফোনের মাধ্যমে তোমাকে বিরক্ত করার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। সে কারণে হাতে লেখা চিঠিই ছিল আমাদের ভাব ভালোবাসা আদান প্রদানের একমাত্র মাধ্যম। আমার লেখা রূপক ধর্মী চিঠিগুলো পাবার আগ্রহেই তোমার কলেজের দিনগুলো যে স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই কেটে যেত, সেকথা তুমিই তো আমায় জানিয়েছিলে। তোমার পাঠানো চিঠিগুলো আমি আজও সযত্নে রেখে দিয়েছি আমার ডায়েরির পাতার ভাঁজে ভাঁজে। মনটা যখন খুব খারাপ লাগে তখন তোমার পাঠানো, তোমার নিজের হাতে লেখা পুরোনো দিনের সেই চিঠিগুলো বার করে পড়তে থাকি। অদ্ভুত এক অনাবিল আনন্দে মনটা তখন দুলে ওঠে। ফিরে যেতে চাই খুশিভরা সেই দিনগুলোতে যখন তোমার একটু দেখা পাবার আশে কাটিয়ে দিতে পারতাম আমার জীবনের এক একটা প্রহর। কোনোদিন হয়তো তোমার সাথে দেখা হতো, কোনোদিন হতোই না। দেখা না হলেও তখন দুঃখ পেতাম না এই কারণেই যে সর্বদা ভাবতাম তুমি তো আমারই আছো। ভাবতাম, আজ দেখা হলো না তো কি হয়েছে, কাল হয়তো আবার দেখা হবে, তখন মনের যত জ্বালা ভুলে গিয়ে, অভিমান ভেঙে দিয়ে একসাথে পথ চলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ করে নেবো।
আমার চোখের সামনেই আমার স্বপ্নের খেলাঘর হঠাৎ করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। অনুভব করতে পারি আমার মতোই তোমায় হৃদয়ের ভঙ্গুর কাঁচের জানালাগুলো বাড়ির গুরুজনদের কথার আঘাতে আঘাতে চৌচির হয়ে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারোনি সেদিন। তোমাকে আমি দোষ দিই না। আসলে, আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠেছি যেখানে গুরুজনদের বাক্যই আমরা বেদবাক্য বলে মনে করে এসেছি। তাদের চোখে চোখ রেখে মুখের ওপর জবাব দেবার স্পর্ধা দেখাতে পারিনি। আমরা তো তাদের শিক্ষাতেই বড় হয়ে উঠেছিলাম। তারাই তো আমাদের চরিত্র গঠন করে দিয়েছেন। তারা আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। বাধা দিয়েছেন। তাদের বাধাদানের কারণেই আমরা আমাদের ভালোবাসাকে, মনের ইচ্ছেগুলোকে, দুহাতে পিষে শেষ করে দিয়েছি। কষ্ট হয়েছে। মনের মধ্যে অনেক জমাট বাঁধা কান্নাকে চেপে রেখেছি। ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রকাশ পেতে দিইনি। নিজেদের কথা চিন্তা করার আগে বড়দের সম্মানের কথা চিন্তা করেছি। চেষ্টা করে গেছি,শুধুমাত্র আমাদের জন্যই যেন কোনো কারণেই বহির্জগতে তাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশে না যায়। আজ নিজের মনেই ভাবি যে আমরা মোটেই সেদিন ঠিক কাজ করিনি। জীবনে কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতে হয়। তোমাকে নিজের করে পেতে হলে আমাকে একটু সাহস সঞ্চয় করতেই হতো, প্রতিবাদের বজ্রমুষ্টি মাথার ওপর তুলতেই হতো। আমরা যেটা করেছি সেটা বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পনের সমতুল্য। তবু কেন জানিনা, লোকের চোখে তুমিই অপরাধী হয়ে গেলে। যদিও আমি জানি, তোমার কোনো দোষ ছিল না। দোষী তো ছিলাম আমিই। তুমি হয়তো অবগতই ছিলে না সেই সামান্য ঘটনাটা যা লোককে তোমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করার ইন্ধন জুগিয়েছে। আসল ব্যাপারটা তোমার জেনে রাখার প্রয়োজন আছে। তাই তোমাকে জানিয়ে রাখছি। কলেজের পরীক্ষার শেষে তুমি যেদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে, সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম অনেক দেরিতে, তোমারই এক প্রতিবেশী বান্ধবীর কাছ থেকে। বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। এ অবস্থায় আমার ঠিক কি করা উচিত হবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ছুটিতে বাড়ি এসেছো অথচ আমার সাথে দেখা দেখা করতে আসছো না। আমি প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের দেখা করার জায়গায় উপস্থিত থাকছি কিন্তু তুমি আসছো না। সত্যি কথা বলতে কি তোমার ওপর রাগও হতে শুরু করেছিল একটু একটু। হঠাৎই তোমার ওই বান্ধবীর সাথে দেখা। আমি কেন তোমার সাথে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করছি না, জানতে চাইলো । বললাম, আমি তো প্রতিদিনই তোমার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করে করে ফিরে আসছি। তোমার বান্ধবী আমার ওপর খুবই রাগ দেখালো। কথায় বার্তায়, হাবে ভাবে সে বুঝিয়ে দিতে থাকলো আমি সত্যিই বড় অন্যায় করেছি তোমার সাথে দেখা না করে। কেন আমি এতদিন তোমার কোনো খোঁজ নিই নি। কেন আমি আমার ভালোবাসাকে দূরে দূরেই সরিয়ে রেখেছি । তারপরেই জানালো যে তুমি নাকি খুব অসুস্থ। তোমার এই অসুস্থতার সময়ে আমার অন্ততঃ একবার তোমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত ছিল।
কথাটা শোনার পর থেকেই আমার পায়ের নিচের জমি কাঁপতে শুরু করে দিয়েছিলো । নিজেকে দোষারোপ করতে শুরু করলাম। কেন যে আমি তোমার কোনো খোঁজ খবর নিইনি। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতে লাগলো। এতদিন হলো তুমি বাড়ি ফিরেছো অথচ আমার সাথে দেখা করতে আসছো না, সেই কারণটা কি হতে পারে বোঝার চেষ্টাই করিনি। প্রতিদিনই নিয়ম মাফিক আমি আমাদের দেখা করার নির্দিষ্ট জায়গায় এসেছি,তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছি। মনের মধ্যে এই ধারণায় বহন করেছি যে আজ হয়তো কোনো কারণে তুমি আসতে পারো নি, পরের দিন নিশ্চয়ই আসবে। পরের দিনের ছবি এবং কাহিনীও একই রকম। তুমি এলে না। অথচ দেখো কি মূর্খ আমি। কোনো সময়েই আমার নিরেট মাথায় এই কথাটা ভেসে ওঠেনি যে তুমিও অসুস্থ হতে পারো। তোমারও শরীর খারাপ হতে পারে। তুমি কেমন আছো এই খবরটা নেবার ইচ্ছেটাও জেগে ওঠে নি মনে।
তোমার অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। নিজের মনের মধ্যে সমস্ত সাহস জোগাড় করে পরদিনই গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া তো দূরের কথা, বাইরের গেটেই আমাকে আটকে দেওয়া হলো। বাড়ির ভেতর যেতেই দেওয়া হলো না। অনেক ভয় দেখানো হলো, ক্যারিয়ার নষ্ট করে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দেওয়া হলো। পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখানো হলো। জেল-ফাটকে পুরে দিয়ে জীবনের সব আনন্দ ঘুচিয়ে দেওয়া হবে বলে শাসানিও দেওয়া হলো, কিন্তু একটি বারের জন্যও তোমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হলো না। সে দিনের মতো বাড়ি ফিরে আসলেও ভালোবাসার টানে পরের দিন আবার গেছিলাম তোমার সাথে দেখা করার আশায়। আমার ভালোবাসার মানুষটি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিশ্চয়ই আশা করছে যে অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও আমি আসবো তার কাছে, পাশে বসে ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে সুস্থ করে তুলবো। কিন্তু, তুমি তো জানতেই পারলে না যে আমি তোমার অসুস্থতার খবর পেয়ে প্রতিদিন এসেছি শুধুমাত্র তোমার সাথে দেখা করার অদম্য ইচ্ছেটুকুকে সঙ্গী করে। কিন্তু পারিনি তোমার সাথে দেখা করতে। সদর দরজা থেকেই আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যতবার চেষ্টা করেছি, অনুরোধ করেছি, হাতজোড় করে দেখা করার অনুমতি চেয়েছি, প্রত্যেকবারই আমাকে লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে হয়েছে। সেসব তুমি জানতে পারোনি। তোমাকে বোঝানো হয়েছে যে, আমি একটিবারের জন্যও তোমার এই অসুস্থতার সময়ে দেখতে আসিনি। আমার মতো এমন নীচ, এমন হীন মনের মানুষের সাথে তোমার মেলামেশা না করাই ভালো। বোঝানো হয়েছে যে আসলে আমি তোমাকে ভালোই বাসি না। তোমার বাপির অগাধ সম্পত্তি ধীরে ধীরে হস্তগত করার বাসনা নিয়েই আমি নাকি তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, প্রেম, এ সবই আমার শুধুমাত্র লোক দেখানো কাজ। আসলে আমি আমার স্বার্থসিদ্ধির আশাতেই তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। আর তুমি জানলে, আমি নীচ, আমি লোভী, আমি ঘৃণ্য । ধীরে ধীরে সেই কল্পকাহিনীই তোমার মনের মধ্যে স্থিতিশীল জায়গা করে নিলো, যেখানে দাঁড়িয়ে আমার মতো ছেলেকে আর মনের কথা জানানো যায় না, ভালোবাসা যায় না, শুধু ঘৃণা করা যায়। তাই তো সরিয়ে নিলে নিজেকে আমার থেকে দূরে, বহুদূরে। নিজের ওপর রাগ হলো, অভিমান হলো, আফশোসও হলো। হতাশ হয়ে পড়লাম। নিজের কাছেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি তোমায় চিনতে ভুল করেছিলাম নাকি আমাদের ভালোবাসা নিছকই অল্প বয়সের পাগলামি ছিল। নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দে এমনই আত্মহারা ছিলাম যে ভালোবাসার গভীরতা কতটা ছিল সেটা মেপে দেখার মতো মানসিকতা তৈরী হয়েই ওঠেনি। তবে যাই হোক, তোমার বাড়ির লোকেদের প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছে সেটা তো স্বীকার করতেই হবে। আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে পেরেছে, সেটাই তাদের সাফল্য, পরম প্রাপ্তি।
-----x-----

