ভালোবাসি শুধু
ভালোবাসি শুধু


মোবাইলের রিংটোন বাজতে থাকলো ভালোবাসি ভালোবাসি গান। ওটা রিং টোন কিন্তু ফোনের মালকিন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাই দু দুবার গান হয়ে থেমে গেলো। পাশের ঘর থেকে মোনা চেঁচিয়ে দু তিনবার পলক কে ডাকলো কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না দেখে ঘরে এসে ঠেলা দিয়ে বললো
"কি রে কলেজ যাবি না, দেখ ঘড়িতে কটা বাজলো, রোজ কি তোকে ডেকে ডেকে তুলতে হবে?
এবার পলক ধরফরিয়ে উঠে বসলো
"কি রে আর একটু আগে ডাকতে কি হয়েছিল, আজ মনে হয় এম কের ক্লাস টা করা হবে না"
বেশ বিরক্তির সঙ্গে ওর দিদি মোনার দিকে তাকিয়ে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। মোনা তাও চেঁচিয়ে বলতে থাকে
"হ্যা আমি তো তোর সব ঠেকা নিয়ে বসে আছি, দরকার হলে একটা লোক রাখ, তোকে রোজ ঘুম থেকে ডেকে দেবার জন্য, আমার বয়েই গেছে রোজ তোকে ডেকে দিতে"
আসলে মোনা আর পলক দুজন কাজিন, প্রায় সমবয়সী। পলক কলকাতা ইউনিভার্সিটি তে ইংলিশ নিয়ে এম এ পড়ছে। ওদের বাড়ি হবিবপুর, কলকাতা থেকে বেশ দূরে, তাই এখানে ভাড়ায় দুই বোন থেকে পড়াশুনা করে। তবে ওরা সমবয়সি হলেও পলক কিন্তু মোনার থেকে পড়াশুনায় অনেক টাই পিছিয়ে, বাংলা নিয়ে সেকেন্ড ইয়ার সবে। মোনার কাছে ও সব কিছুতেই পিছিয়ে, মোনার উজ্জ্বল ত্বক, দুধের মত ফর্সা, মুখের গড়ন ও যেনো লক্ষ্মী প্রতিমা। সে দিক থেকে পলক খুব সাধারণ মানের। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চেহারাও খুব একটা আকর্ষণীও নয়, অন্তত এখনও কারো মুখে ও শোনে নি, ওর প্রশংসা। সে দিক থেকে ওর যে যে বন্ধুরা মোনাকে দেখেছে তার মধ্যে এমন কেউ নেই যে বলে নি
"সত্যি তোর দিদিকে দেখতে খুব সুন্দর"
পলক এটা শুনে খুশি হয় না তা নয়, তবে মনীশের কাছে মোনার প্রশংসা শুনলেই ওর মনটা যেনো কেমন খারাপ হয়ে যায়।
মণীশ ওর কলেজের বন্ধু তবে ওর থেকে সিনিয়র। মনিশকে দেখার পর থেকেই কেমন যেন একটা ভালো লাগা পলকের মনটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। ও ভাবে মনীশের ওর মতই হাল কিন্তু একটু কম কথার মানুষ বলে ঠিক ব্যক্ত করতে পারে না। এই বিষয়ে মোনাকে এখনও কিছু জানায় নি পলক, সম্পর্ক টা আর একটু এগোলে , মানে মনিষ ওকে প্রপোজ করলে তারপর জানানো যাবে, এই ভেবে চুপ করে আছে। শুধু প্রথম থেকে এই ব্যাপারটা জানে সমীর, ও পলকের ক্লাস ফ্রেন্ড। পলক জানে সমীর একথা কাউকে বলবে না, আসলে সমীর ওর শুধু বন্ধু হতে পারে কিন্তু কেমন যেনো একটা টান অনুভব করে ও সমীরের প্রতি। এটা অবশ্য সমীরের জন্যই হয়েছে। ওর সব বিপদে আপদে ও সমীরকে সব সময়ই পাশে পায়। আর সমীরের সাথে মনের কথা বলে ও যা শান্তি পায় বা বলা যেতে পারে মনটা হালকা হয় তা আর কাউকে বলে হয় না।
তবে ভালোবাসার মানুষ হিসাবে কিন্তু পলক কখনোই সমীরকে কল্পনা করতে পারে না, তখন ওর মনীশের কথা ই মনে আসে।
সেদিন কলেজ পৌঁছাতে অনেক দেরী হয়ে গেলো পলকের। গেটে ঢোকার আগেই দেখে সমীর দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে, ওকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলো
"কি ম্যাডাম, ফোনটা রিসিভ করতে এত কষ্ট? তিন বার ফোন করেছি তোকে, একবারও ধরিস নি"
পলক যেতে যেতে বলে উঠলো
"আমার ফোন আমি রিসিভ না করতেই পারি, তাতে তোর কি?"
"হ্যাঁ সেটা একদম হক কথা, তবে যে খবর টা দেওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম সেটা আর তোকে শুনতে হবে না" মুচকি হেসে কথাটা বলে সমীর পলকের পাশ দিয়ে হন হন করে কলেজে ঢুকে যায়।
পলক জানে সমীর এটা মিথ্যে করে বলছে, আসলে কিছুই বলার ছিলো না, এইরকম ও করতেই থাকে।
প্রথম ক্লাস টা আর করা হলো না, পলকের জন্য সমিরও মিস করল। সকালে কিছু খাওয়া হোয় নি তাই পলক কান্টিনে ঢুকলো কিছু স্ন্যাকস খাবে বলে। দ্যাখে সমীর আগে থেকেই ওখানে , সঙ্গে পল্লবী আর মেধা। ওকে দেখে সমীর ডাকলো
"কি রে খিদে পেয়েছে, আয় আজ পল্লবী আমাদের খাওয়াবে বলছে, তুইও আয়"
পলক অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
"কারণ টা কি খাওয়ানোর, পল্লবীর বিয়ে লাগলো না কি?"
পল্লবী স্মিত হেসে উত্তর দেয়
"হবে হবে বন্ধু, এতো তাড়াহুড়ো কিসের, আগে তো প্রপোজ টা হোক, তারপর বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে"
পল্লবীর কথায় ওর মনে পড়ে গেলো, হ্যাঁ আজই তো প্রপোজ ডে। পলকের দৃষ্টি ক্যান্টিনের সারা ঘর ছুঁয়ে গেলো কিন্তু যাকে দেখতে চাইছে তাকে পেলো না। সমীরের চোখ এড়ালো না
"কি রে কাকে খুঁজছিস, সে আজ খুব ব্যস্ত"
পল্লবী বেশ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
"কি রে পলক, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস যে বড়ো, বন্ধু কি শুধু সমীর, আমাদের তোর সিক্রেট টা বলবি না?"
পলক চোখ বড়ো বড়ো করে সমীরের দিকে তাকিয়ে বলে
"ও তোরা জানিস না বোধ হয় সমীর তো আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি, তাই আমার কথা তোরা এবার থেকে ওর কাছেই জেনে নিবি"
কথাটা যে সমীরের উপর রাগ করে বলে গেলো সেটা সবাই বুঝতে পারলো। সমীর ও পলকের পিছন পিছন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যেতেই ওদের নিয়ে শুরু হয়ে যায় চর্চা। মেধা তো বলেই ফেলে
"সমীর একটা গাধা, পলক ওকে কখনোই পাত্তা দে বে না জেনেও ওর পিছন পিছন ঘুরছে সারাক্ষণ, কিন্তু পলকের নজর সবসময় মনীশের দিকে"
পল্লবী তৎক্ষণাৎ টেবিল চাপ রে বলে উঠলো
"ছার ছার তোরা কিছুই জানিস না, মনীশের ভালোবাসা হলো পলকের দিদি মোনা, আর জেনে রাখ আজ মোনাকে ও প্রপোজ করবে আমাকে বলেই গেছে"
সবাই অবাক হল বটে তবে মনিষ যে কিছু ভুল করছে না এটাও বললো।
কথাটা যে ভুল নয় তা শুধু পলক ছাড়া সবাই জানে, এমন কি সমীর ও। পলক কিছুতেই এর এটা বিশ্বাস করবে না এটা সমীর বেশ ভালো করেই জানে, তাই এই প্রসঙ্গ নিয়ে পলকের সাথে খুব একটা আলোচনা করে না। আসলে সমীর খুব ভালোবেসে ফেলেছে পলক কে। ওর সরল সাধারণ মুখ সমীরের হৃদয়ে সবসময়ই ভেসে বেড়ায়। সমীর জানে পলক মন থেকে চায় মনিষ এর ভালোবাসা কিন্তু মনিষ যে মোনাকে পাগলের মত ভালবাসে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। একবার সমীর এটা পলক কে বোঝাতে গিয়েছিল কিন্তু বোঝা তো দূরের কথা সমীরের সাথে প্রায় একমাস কথাই বলে নি।
সমীর কলেজের বাইরে গিয়ে আর পলক কে দেখতে পায় না। ভাবে হয় তো ক্লাস এ ঢুকেছে কিন্তু না সেখানেও নেই। সমীর ফোন করার আগেই পলকের ফোন
"তুই ঠিকই বল তিস সমীর, মোনার কাছে জানলাম মনিষ ওকে আজ প্রপোজ করেছে"
গলাটা কান্নায় বুজে আসছে তাও থামছে না আজ
"শোন আমি কাল বাড়ি চলে যাবো, তুই ভালো থাকিস" বলেই ফোন কেটে দেয়। সমীর নির্বাক শ্রোতা হয়ে সব শোনে কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পায় না।
সমীর ছোট্ট একটা মেসেজ করে পলক কে
"শুধু তোকে ভালোবাসি"
উত্তরের আশা নেই জেনেও এবার লিখলো
"তোর রূপ নয়, তোর হৃদয় টাকে আমি পেতে চাই"
এবার একটা উত্তর এলো
"আমার মত বাজে দেখতে মেয়েকে ভালোবেসে ভুল করিস না, পরে পস্তাতে হবে "
সমীর একটু মুচকি হেসে লিখলো
"প্লিজ আজ একবার দেখা কর, করবি তো" সমীর যদিও জানে পলক কোনো উত্তর দেবে না কারণ পলকের রাগ হলে ও কাউকে পরোয়া করে না, নিজের বাড়ির লোকেদের হাজার কথা শুনিয়ে দেয়, আর সমীর কে তো সারাক্ষণই নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।ওপার থেকে আর কোনো উত্তর এলো না। সমীর বুঝতে পারলো ওর এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। পলক আগের চেয়ে বেশি খারাপ ভেবেছে হয়তও। শেষে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ির পথ ধরে সমীর। কিছুটা যেতেই পলকের ফোন
"কি রে দেখা করতে বলে নিজেই চলে যাচ্ছিস"?
সমীর পিছনে ঘুরে দ্যাখে পলক। চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে এই টুকু সময়ের মধ্যে যেনো এক বড় ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে।
"সমীর, এটাই ভালো হলো জানিস, যে আমাকে কোনদিন ভালোবেসেই নি তাকে আমি কি করে ভালবাসতাম? তুই আমাকে বলেছিস কিন্তু আমি বিশ্বাস না করে তোকেই খারাপ ভেবেছিলাম, তবে আজ একটা অনুরোধ করবো"?
এতক্ষণ সমীর একটাও কথা বলে নি, এবার বলল,
বল, আজ আর আমি কিছু বলবো না তুই বলবি, আমি শুনবো"
পলক সমীরের বেশ কিছুটা কাছে এসে বলে
"তোর জীবনে আমায় একটু জায়গা দিবি?"
সমীর এবার পলকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে
"আমি তোকে খুব ভালোবাসি, আমার জীবনটা শুধু তোর বুঝলি?"
দুই নির্ভেজাল ভালোবাসার মিলন হলো।