ভালোবাসায় ফেরা
ভালোবাসায় ফেরা
বন্যা আজ রান্নাঘরের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে স্নান পুজোও শেষ করে নিয়েছে। তারপর পুজোর শাড়ি ছেড়ে একটা ভালো শাড়ি পড়ে সুন্দর করে সেজেছে। সব কাজ শেষ করে জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির এই পূবের জানলা দিয়ে দূরের রাস্তাটা দেখা যায়। রাধিকাপুর থেকে শুরু হয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে এই রাস্তাটা একেঁবেঁকে স্টেশনের দিকে চলে গেছে তারপর রেললাইন পেরিয়ে রেলবাজারের পাশ দিয়ে কুসুমপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়েই তমাল প্রতিদিন ফেরে রেল স্টেশন থেকে। কুসুমপুর হল্ট স্টেশনের সে স্টেশনমাস্টার।
আজ তমালের একটু আগে আসার কথা দুপুরের খাবার খেতে। আজ দিনটার একটা বিশেষত্ব আছে বন্যার কাছে। আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। নয় বছর হল ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে ও তমালের সাথে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক সময়ের খানিকটা ঘরকুনো বন্যার আজ এই প্রায় যাযাবর জীবন খুব একটা খারাপ লাগে না। নতুন জায়গা নতুন লোকজন। কিন্তু এই ভালোলাগাটুকুও বোধহয় ওর জীবনে আর বেশীদিন আছে বলে মনে হয় না ওর।
স্টেশনের পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পেলো ফেরিওয়ালার হাঁক। রকমারি জিনিস ফেরি করে ওরা তার মধ্যে বাসনকোসনই বেশি। গ্রামের পথে একটা দুটো বাসনওয়ালা প্রায়ই যাতায়াত করে ‘বাসন চাই... বাসন... এলুমিনিয়ামের হাড়ি গামলা বালতি’ বলতে বলতে। খানিক দূরে চলে গেলে সেই হাঁকডাক বেশ আবছা হয়ে যায়। সেই হাল্কা ভেসে আসা আওয়াজ ওর মনে ঘুরপাক খেয়ে আওয়াজ তোলে ‘বন্যা...এই বন্যা’ এভাবে ওর বান্ধবীরা ওকে ডাকতো খেলতে ডাকতে এলে পড়তে যাওয়ার পথে স্কুলে যাওয়ার সময়। কত সুখের ছিল সে দিনগুলি।
‘বন্যা... বন্যা’ বলে ডাকতো আরও একজন। সে তমাল! স্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার বদলে নদীর পাড় কখনো কখনো পার্কের গাছের আড়ালে প্রেমপর্ব বেশ জোরদার চলছিলো। তখন একদিন দেখা না হলেই দুজনের মনেই বিরহের ব্যকুলতা দেখা দিত। কিন্তু স্কুল জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রথম অঙ্কুরিত ভালোবাসার চারা কলেজ জীবনের আঙ্গিনায় পা দিতে দিতেই এমনই মহীরুহ আকার নিয়েছিল যার কারণে দুই পরিবারের ইচ্ছেয় ওদের পরিণয়ের সুতোয় বেধে দেওয়া হল। কিন্তু সেই সুতো কি দড়ির আকার ধারণ করেছে যে পেঁচিয়ে গিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করছে, যার কারণে কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে, বন্যা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যে খবর ওর কানে এসেছে তাতে ও আজ পুরো নিশ্চিত যে ঘটনাটা সেই রাস্তাতেই মোড় নিচ্ছে।
প্রথম যখন জেনেছিল এমন এক সম্ভবনার কথা বিশ্বাস করেনি বরং যে খবরটা দিয়েছিল তাকেই দুটো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে ঘটনা একটু একটু করে সামনে এসেছে, কিছু কিছু প্রমাণও পেয়েছে। খুব কেঁদেছে ও একান্তে ঈশ্বরের কাছে মাথাও ঠুকেছে তবে তমালের সাথে ঝগড়া চেঁচামেচিতে যায়নি। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হলে একজনের প্রতি আরেকজনের সামান্য সম্মানটুকুও অবশিষ্ট থাকে না। সম্পর্কে ঘুণ ধরে গেলে সেটা ঠিক করতে আবার দুজনকেই হাত লাগাতে হয় একজনের দ্বারা তো সম্ভব নয়, ওর ইচ্ছে থাকলেও তমালের ইচ্ছেটা আছে বলে ওর মনে হচ্ছে না।
কে যে ওর নাম রেখেছিল বন্যা কে জানে! কারো জীবনে ও বন্যার মতো ধেয়ে আসেনি কিন্তু ওর জীবনের সুখগুলো অন্য কারোর ধাক্কায় বন্যার মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে চলে যেতে চাইছে। হঠাৎ সাইকেল বেলের আওয়াজে ওর চটকা ভাঙলো। তমাল আসছে। মোটরসাইকেল থাকা সত্ত্বেও এটুকু রাস্তার জন্য ও সাইকেলটাই ব্যবহার করতে পছন্দ করে।
তমাল এসে দরজার কড়া নাড়ার আগেই ও সদর দরজা খুলে সামান্য সরে দাঁড়ালো। প্রতিদিন ও দরজার পাল্লাদুটো শুধু ভেজিয়ে রাখে, কাছাকাছি থাকে না। তমাল কি সামান্য অবাক হয়েছিল? তাই মুখ তুলে তাকাল আর চোখাচোখি হয়ে গেলো বন্যার সাথে। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে ঢুকল ও তারপর প্রতিদিনের মতো স্নানে গেলো। মিনিট কুড়ি পর তমাল এসে যখন টেবিলে বসলো খেতে বন্যা খাবার বেড়ে থালা এগিয়ে দিলো। খাবার দেখে তমাল আরও একবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল তারপর শুরু করলো খাওয়া। প্রতিটা রান্নাই ওর খুব পছন্দের আর প্রতিটা পদের স্বাদও হয়েছে দারুণ। খাওয়া যখন প্রায় শেষের মুখে চাটনির প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বন্যা বলল ‘আজ একটা বিশেষ দিন সেটা কি তোমার মনে আছে তমাল?’
মনে না থাকলেও তমাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। বন্যা অবশ্য ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল না। ও বলল ‘আজকের দিনে নয় বছর আগে আমরা এক সাথে চলার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলাম। এতদিন চলার পথ একসাথে থাকলেও সম্প্রতি আমার মনে হয়েছে এবার এই পথ আলাদা হলেই ভালো। আমাদের মধ্যে জোর শক্ত করতে যে বন্ধন দরকার ছিল তাও আসেনি। ... যাক তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম আর বেশি করছি না। ঘরে তোমার টেবিলের ওপর একটা কাগজ রাখা আছে ওটা একটু পড়ে সই করে দিয়ো তাহলেই হবে’
তমালের ভ্রূ কুঁচকে উঠলো কিন্তু ও ধীরেসুস্থে উঠে হাত ধুয়ে ঘরে গিয়ে কাগজটা দেখল। ওটা বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ! যে কাগজে সই নেবে বলে কতদিন ধরে ও আর নন্দিতা নানা রকম আলোচনা করে চলেছে সেই কাগজ বিনা কোন দোষারোপ করে বন্যা সই করে রেখে দিয়েছে। তমালের মনে যেন জোর ধাক্কা লাগলো।
বন্যা জানলা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ও নিশ্চিত আর একটু পরেই সই দেওয়া কাগজটা হাতে এসে যাবে ওর আর তারপর এখানকার বাস শেষ। কিন্তু তার বদলে একটা হাত এসে পড়লো কাঁধে। বন্যার চোখে জল চলে এলো। আজও প্রিয় মানুষের সেই ছোঁয়াটুকু শরীর বুঝতে পারে। কত ভালোবাসার ওম ছিল এই ছোঁয়াটুকুর মধ্যে যার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু না, যা শেষ হয়ে যাচ্ছে তার জন্য মনের দুর্বলতা দেখানোর কোন মানে হয় না। চোখের জল সামলে ও ঘুরে তাকাল তমালের দিকে।
তমাল বলল ‘এতক্ষণ তোমার সব কথা শুনলাম এবার আমাকে কিছু বলার সময় দাও। এক সময় আমিই তোমায় প্রথম ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিলাম আবার সেই আমিই নন্দিনীর দিকে ঝুঁকে পড়তে সময় নিইনি। নন্দিনীর সাথে আমার পরিচয় চাকরির সূত্র ধরেই। ও রেলের পরীক্ষা দিয়ে আমার মতোই চাকরি করে। অবশ্য এই কাছাকাছি আসাটায় নন্দিনীর কতটা দোষ বলতে পারবো না তবে আমার অনেকটাই। তুমি অনেকটাই একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলে আমার জীবনে। তাই নতুনত্বের স্বাদ নিতে... তোমার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম, ভাবছিলাম কি ভাবে তোমাকে কথাটা জানাবো কিন্তু তুমি যখন কাগজটা নিজেই ধরিয়ে দিলে তখন মনে হল কি বড় একটা ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আমাকে আরেকবার সুযোগ দেবে কি আবার একবার চেষ্টা করতে চাই’
বন্যা আস্তে করে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল ‘আজকের দুপুরটুকু আসার একটু আগেও হয়তো তোমার মনটা চাইছিল এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি। এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, আর যে মেয়েটা তোমাকে ঘিরে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে তারও কিছু আশা আছে তোমার কাছে। তাই শুধু দায়িত্ব কর্তব্য থেকে আমার সাথে তোমায় থাকতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি তোমায় ভাবার অফুরন্ত সময় দিয়ে। তুমি ভাব কি করবে। যদি কোন সময় আমাদের ভালোবাসার টুকরো মুহূর্ত তোমার মনে পড়ে আর সেটা তুমি ফিরে পেতে চাও বাকি জীবনের জন্য তখন ডেকো চেষ্টা করবো ফিরতে’
তমাল বন্যার হাতটা ধরে বলল ‘না বন্যা। আমি একবার ভুল করেছি আর সে ভুল করতে চাই না। আমি আমাদের ভালোবাসার মুহূর্তগুলো ভুলিনি তবে অন্য আকর্ষণ আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো। আজ আমি তোমার হাত ধরেই পাড় করতে জীবনের বাকি দিনগুলি। আমায় ছেড়ে যেও না তোমার ভালোবাসা দিয়ে আবার টেনে নাও আমায়’
লজ্জায় রাঙা বন্যা তমালের বুকে মুখ লুকালো।