ভালোবাসার ঠিকানা
ভালোবাসার ঠিকানা
মৌমি আজ অনেকদিন পর কলকাতায় ফিরছে । কলেজ জীবন শেষ করে সে আজ পাঁচ বছর হল দিল্লিতে রয়েছে । সেখানেই সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছে। কলকাতার সাথে মৌমির অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে । এখানে তার জন্ম,বড় হয়ে ওঠা,পড়াশোনা,ভালোবাসা সবকিছুই তার এখানে।
ট্রেন হাওড়ার স্টেশনে থামল,মৌমি ট্রেন থেকে নেমে তার মা-কে ফোন করল , তাদের বাড়ির নতুন ঠিকানা জানার জন্য ।
মৌমি বলল , 'মা , তোমাদের নতুন বাড়ির ঠিকানাটা বলতো?'
মা বলল,'মানে? তুই কোথায়?'
মৌমি হেসে বলল,'কলকাতার হাওড়ার স্টেশনে । এবার তো বলো।'
মৌমির মা বলল, '৭৮/এ ,বোস পুকুর, বালিগঞ্জ।'
বালিগঞ্জ নামটা শুনতেই মৌমির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল।মৌমি ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে সেই ঠিকানায় পৌছে দেওয়ার কথা জানাল । ট্যাক্সির জানালার দিকে তাকিয়ে মৌমি ভাবছিল তার কলেজ জীবনের প্রথম ভালোবাসার কথা ।
কলেজে সে তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী,আগাগোড়াই সে সকলের সাথে মিশতে ভালোবাসে।মৌমিকে দেখতে সুন্দর হওয়ার দরুন অনেক ছেলেই তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে ছিল, কিন্তু তাদের কাউকেই তার ভালোলাগে নি।একদিন কলেজের লাইব্রেরিতে একটি ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। ছেলেটি ছিল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।হঠাৎ সে মৌমিকে জিজ্ঞাসা করে বসল ,'তোমার জন্য আমার বন্ধু মরতে বসেছিল ।?
মৌমি বলল,'মানে?আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।'
ছেলেটি বলল, 'তুমি মৌমি ঘোষ তো?'
মৌমি বলল,'হ্যাঁ।'
ছেলেটি বলল , 'আমার বন্ধু অপু তোমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল , তুমি বেচারাকে এমনভাবে না করে দিয়েছ যে ও আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল ।'
মৌমি জিজ্ঞাসা করল, 'তোমার নাম কি?'
ছেলেটি বলল,'ময়ূখ সেন।'
একথা মনে পড়তেই হঠাৎ সে হেসে উঠল।আজ অনেক বছর হয়ে গেল ময়ূখের সাথে তার আর কোন যোগাযোগ নেই । কখন যে তাদের খুনসুটির সম্পর্ক থেকে বন্ধুত্ব হল,বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থেকে বিচ্ছেদ হল সে আজও বুঝতে পারেনা।ময়ূখের সাথে কাটানো সময় ছিল তার কাছে এখনও স্বপ্নের মতোন।
ট্যাক্সি থামলো মৌমির মা-এর দেওয়া প্রদত্ত ঠিকানায় ।
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলল ২৯ - ৩০ বছরের একটি ছেলে । মৌমি ছেলেটির দিকে তাকাতেই চমকে উঠল।
মৌমি বলে উঠল, 'ময়ূখ ,তুমি?'
মৌমি জানত যে,ময়ূখরা বালিগঞ্জে থাকে, কিন্তু কোথায় থাকে এই বিষয়ে ছিল সে অজানা ।
ময়ূখ বলল,'কাকিমা, আপনার মেয়ে এসে গেছে ।'
মৌমির মা-বাবা ওপর থেকে নেমে এল ।
রাতে খাওয়ার পর মৌমি ছাদে উঠল,দেখল ময়ূখ ছাদের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছে । সে ভাবলো তাকে ডাকবে না। কিন্তু তারপর সে ডেকে বসলো।
'ময়ূখ?'
ময়ূখ মৌমির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,'জানো,আমি ভেবেছিলাম,আমাদের আর কখনো দেখা হবে না ।'
মৌমি বলল,'হ্যাঁ ।'
ময়ূখ বলল,'আমি তোমাদের ঘরের ফটোতে তোমাকে দেখেছিলাম।নয়তো তোমার মা-বাবাকে চিনতে পারতাম না। তুমি তো কখনো আলাপ করিয়ে দাওনি ।যদিও আমিই কখনো সুযোগও দিইনি ।'
ময়ূখ আরো বলল,'মৌমি,আমার তোমাকে কিছু কথা বলার আছে ।'
মৌমি বলল,'বল । আমি শুনব।'
ময়ূখ বলল,'আমি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইনি। তুমি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে , আমি তখন সেই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই নি। বাবার মৃত্যুর পর আমি মা-কে নিয়ে একা থাকি।মা-এর পেনশনের টাকা আর বাড়ি ভাড়ার টাকায় আমাদের সংসার চলত । অর্ধেক টাকাই খরচ হয়ে যেত মা-এর চিকিৎসার পিছনে । আর আমি তখন বেকার ছিলাম, জানি ,তুমি বলেছিলে আমাকে চিন্তা করতে না , তুমি চাকরি কর তাই তুমি এই সংসারের দায়িত্ব নিতে পারবে।কিন্তু আমি চাইনি তোমাকে সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিতে । তাছাড়া, আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম , যাতে তুমি ভালো থাকো।তাই আমি সেদিন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম । পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও ।'
মৌমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হেসে বলল,'হুম্ ......,এখন চাকরি করছো,আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি আর তোমার পর কাউকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। আর তুমি?'
ময়ূখ মৌমির দিকে একটু ঝুঁকে হেসে বলল,'চাকরি ও পেয়েগেছি , তুমি ও ভালোবাসো,আর আমিও তোমাকে ভালোবাসি,তাহলে তো আর কোনো অসুবিধাই নেই ।'
মৌমি হেসে বলল , ' জানো , আমি আজ বাবা-মা কে কিছু না বলে এসে চমকে দিতে চেয়েছিলাম । কিন্তু আমি যে নিজেই এভাবে চমকে যাবো বুঝিনি।আমি নতুন ঠিকানায় এসে যে ভালোবাসার ঠিকানায় পৌছে গেলাম।'
ময়ূখ হেসে বলল,'অনেক রাত হল , ঘুমাবে না ?'
মৌমি বলল,'হ্যাঁ ।'
ময়ূখ বলল,'শুভরাত্রি ।'
মৌমি বলল,'শুভরাত্রি ।'
___________________