ভালোবাসার রং
ভালোবাসার রং


সকালে মোবাইল বাজতে ঘুম চোখে পিউ বালিশের তলা থেকে হাতড়ে বার করলো সেটাকে। গার্গী মেসেজ করেছে – হ্যাপি হোলি
পিউর মুখে হাসি ফুটে উঠলো ও উত্তর দিলো – সেম টু ইউ
- কখন বেরোবি দোল খেলতে
প্রশ্নটা দেখেই পিউর ঘুম পুরপুরিই চটকে গেলো। রং খেলার কথা মনে পড়তেই ওর মনটা আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো রাজার কথা। কিছুদিন আগেই যা বলেছে ওকে তাতে ওর মন থেকে রং খেলার আনন্দ উড়ে গেছে। কিন্তু গার্গীকে কি উত্তর দেবে এখন? ও লিখল – দেখি
ওপাশ থেকে গার্গী লিখলো – ঠিক আছে, আমিই তোর বাড়ি পৌঁছে যাবো তারপর ওখান থেকে শ্রীপর্ণাদের বাড়ি যাবো
পিউ একটা স্মাইলির ছবি পাঠিয়ে দিলো
কিন্তু কি করবে ও এখন সেটাই ঠিক করে উঠতে পারলো না।
পিউরা বেশীদিন আগে এই শহরে আসেনি। ওর বাবা বসন্ত চাকরিসুত্রে আজীবন বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন আর তার সাথে ওদের মা জয়ন্তী, পিউরা তিন ভাইবোন(পৃথা পলাশ আর পিউ) বাইরে বাইরে ঘুরেছে। হাওড়ার পৈত্রিক বাড়িতে ফিরে এসেছে বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। বহুদিন বাড়ি ছাড়া বলে চাকরি থেকে আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছেন বসন্ত। এখন তাঁর ইচ্ছে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার, পৈত্রিক বাড়ির কাছাকাছি বাজারে একটা দোকানঘর ভাড়াও করে ফেলেছেন, খাবারের দোকান নাম দিয়েছেন পলাশ’স ফুড এন্ড ক্যাটারিং। এই মাসখানেক হল উদ্বোধন হয়েছে, বাবা আর দাদা বসে। বাবার দোকান তাই ওরা বোনরা প্রায় যায় সেখানে।
একদিন দোকানে পিউ একাই গিয়েছে, পৌঁছে দেখে দাদার সাথে একটা ছেলের বচসা বেধেছে। যার সঙ্গে বেধেছে তাকে চেনে না পিউ তবে দেখে মনে হচ্ছে বয়েসে দাদার থেকে ছোট। ছেলেটাও বয়েস মেনে কথা বলছে না কিন্তু পলাশের কঠিন অবস্থান দেখে ফিরে যেতে যেতে বলল “দেখে নেবো” আর ফিরতেই একেবারে পিউর মুখোমুখি। চেহারা খারাপ নয় তবে রুক্ষ। ওকে দেখেই এমন বাঁকা হাসি হাসলো ছেলেটা যে পিউর ভালো লাগলো না। যেতে যেতে ওর পাশ দিয়ে ফিসফিস করে বলল “রসালো!” তার ওপর এমনভাবে তাকালো পিউর মনে হল দৃষ্টি দিয়ে চেটে দিলো। বাবাও সেই মুহূর্তে দোকানে নেই, পিউ ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। তাই ছেলেটা চলে যেতে ও বলল “দাদা কি দরকার এইসব বদমাশদের সাথে কথা বলার। বাবা জানতে পারলে তোমায় বকবে তো”
পলাশ ব্যপ্যারটা খেয়াল করেছিলো তাই বোনকে বলল “বদমাশদের তোয়াক্কা করতে নেই তাহলে ওরা মাথায় চড়ে বসে। সবসময় শক্ত হাতে ওদের মোকাবিলা করতে হয়”
পিউ আর কথা বাড়ালো না তবে ওর মন খুঁতখুঁত করতে থাকলো।
বাড়িতে এসে দিদিকে ব্যাপারটা বলেছে ও। দিদি একটাই কথা বলেছে ওকে “দ্যাখ নিজের সেফটি নিজের কাছে। তবে বন্ধুদেরও ব্যাপারটা বলে রাখবি যাতে অসুবিধায় পড়লে তারা সাহায্য করতে পারে” মায়ের কাছে কিছু জানায়নি কারণ মা বেশ নিরীহ গোছের এসব ব্যাপারকে ভয় পায়।
এরপর ও খেয়াল করলো যখনই ও বাড়ি থেকে বেরোয় তা সে কলেজ যাওয়ার জন্যই হোক বা অন্য কোথাও রাজা আসেপাশে ঠিক থাকে। আর যখনই চোখাচোখি হয়ে যায় রাজা হাসে। ওর হাসিটা পিউ’র মোটেও ভালো লাগে না। শয়তানি হাসি! যাইহোক ওকে পাত্তা দেয়নি ও, প্রতিদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে দরকার মতো।
কিন্তু দিন দুই আগে কলেজের পর টিউশনি ফেরত যখন বাড়ি আসছে তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে বেশ রাত হয়ে গেছে। প্রতিদিন এতো রাত হয়না তবে দোলের কারণে ছুটি থাকবে বলে এক্সট্রা ক্লাস করেছে। বাজার এলাকাটা পেরলে রাস্তাটা একটু ফাঁকা ফাঁকা। চারদিকে খেয়াল করতে করতে এগোচ্ছে ও তবু হঠাৎ ভূতের মতোই ওর সামনে এসে দাঁড়ালো রাজা। একাই এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু পিউ আন্দাজ করছে আসেপাশে ওর সঙ্গী থাকবে। ওকে দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠলেও মুখের ভাব পরিবর্তন না করার চেষ্টা করলো পিউ। মুখে বলল “রাস্তা আটকাচ্ছেন কেন, সরুন”
“অনেক জায়গাই তো আছে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাও” পিউর মনে হল পেছন ফিরে বাজারে ফিরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে তাই রাজার কথার উত্তর না দিয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগেই রাজা আবার এসে ওর রাস্তা আটকেছে। এবার ওর পাশ কাটাতে চাইলে রাজা খপ করে ওর হাত ধরে বলল “পালাও কেন? আমার তোমাকে খুব ভালো লাগে সেটাই বলতে তোমার অপেক্ষা করি কিন্তু সুযোগ আজ পেলাম। বন্ধুত্ব করবো”
পিউ ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো তারপর সাহস করে বলল “হাত ছাড়ুন আর আমি আপনার বন্ধুত্ব পছন্দ করছি না”
রাজার গলার মিষ্টতা পাল্টে গেলো নিমেষে রুক্ষ স্বরে, প্রশ্ন করলো “কেন?”
“কোন বিশেষ কারণ নেই এমনিই পছন্দ হচ্ছে না”
“কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসি”
“কিন্তু আমি ভালোবাসি না”
এবার হিসহিসে স্বরে রাজা বলল “আমি না শুনতে অভ্যস্ত নই”
“কিন্তু আমি আমার মনের কথাটা জানালাম। বুঝলেই ভালো”
“এর ফল ভালো হবে না। পস্তাতে হবে তোমায়”
হঠাৎ কেউ পেছন থেকে বলল “ছেড়ে দে ওকে। ও তো ওর কথা বলেই দিয়েছে তাহলে বিরক্ত করছিস কেন?”
পিউ মুখ ঘুরিয়ে দেখলো একটা যুবক সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ওর কথা শুনেই রাজা বলল “দ্যাখ সায়ন নিজের চরকায় তেল দে”
সায়ন নামের যুবক বলল “ওকে ছেড়ে দে এক্ষুনি নাহলে বুঝতেই পারছিস কি হবে”
রাজা পিউর হাত ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো তারপর বলল “তোদের দুটোকেই যদি দুদিনের মধ্যে যদি শায়েস্তা না করতে পারি তো আমার নাম রাজা না” বলেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। পিউকে সায়ন বলল “চলুন আপনাকে কিছুটা এগিয়ে দি” পিউ মাথা হেলিয়ে ওর সাথে চলতে শুরু করলো।
খানিকটা আসার পর বাড়ির গলি আসতে পিউ ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসে। এরপর দিন তো বাড়ি থেকে বের হয়নি। আজ দোল। বন্ধুদের সাথে বেরোবে তো নিশ্চই কিন্তু ওদিকে রাজার হুমকি, কি করবে বুঝতে পারছে না।
গার্গী এলো ঠিক দশটায় সাথে একটা ছেলে। চেহারাটা চেনাচেনা মনে হল ওর তবে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারলো না। গার্গী পরিচয় করিয়ে দিলো “ও শঙ্খশুভ্র মিত্র, আমাদের পাড়ায় থাকে,ডিপ্লোমা করছে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ”
পিউ বুঝলো ও ভুল করেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে শ্রীপর্ণাদের বাড়ি গেলো ওরা। কলেজের আরও কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিলো, সারাদিন হৈহৈ করে রঙ খেলা চলল। দুপুরে যখন ফিরবে তখন শঙ্খ পিউকে হঠাৎ বলল “চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই”
পিউ আপত্তি করলো না, গল্প করতে করতে ফিরছে হঠাৎ শঙ্খ ওকে ধাক্কা দিলো। পড়ে যেতে যেতে ও খেয়াল করলো শঙ্খও কায়দা করে মাটিতে বসে পড়ে পা’টা এগিয়ে দিয়ে একজনকে ফেলে দিলো। যে পড়ে গেলো সে পড়ে গিয়েই চিল চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। হতভম্ব হয়ে পিউ খেয়াল করলো কিছু ছেলে দৌড়ে পালালো কিন্তু যে পড়ে গেছে সে পালালো না। দোলের দুপুর, তাই রাস্তার লোকজনও জড়ো হয়ে গেলো, বাজার ফেরত ওর বাবা দাদাও এসে পড়লো। পুলিশও এলো। ওরা দুজনেই ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারপর সবাই ঘটনাটা জানলো। রাজা পিউর ওপর এ্যসিড ছুঁড়বে বলে তৈরি হচ্ছিলো শঙ্খর ধাক্কায় পিউ রক্ষা পেয়েছে আর উল্টে রাজা নিজের এ্যসিডে নিজের শরীর পুড়িয়েছে। বসন্ত বলল “বাবা সায়ন তুমি ছিলে তাই আজ পিউ’মা বেঁচে গেলো” পুলিশ নিয়ে গেলো রাজাকে।
এতক্ষণে পিউ বুঝতে পারলো কেন শঙ্খকে ওর চেনাচেন মনে হচ্ছিলো। বসন্ত সায়নকে জোর করে নিয়ে এলো ওদের বাড়িতে। তারপর বাড়ির সবাই জানলো পুরো ঘটনা শুনে ওর উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করলো, ওকে ধন্যবাদ দিলো। বসন্ত এও জানালো সায়ন প্রায় ওদের দোকানে আসে হোম ডেলিভারি নিতে। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর মা অসুস্থ তাই রান্নাবান্না করতে পারেন না। খাওয়াদাওয়ার পর বসেবসে যখন গল্প হচ্ছে তখন পিউ বলল “আপনি আজ সকালে একবারও বললেন না কেন যে সে সন্ধ্যায় আপনিই আমায় বাঁচিয়েছিলেন?”
সায়ন বলল “আমি দেখছিলাম আপনি আপনার হিতাকাক্ষিকে চিনতে পারেন কি না”
পিউ আর বললো না যে ওর মন ওকে চিনেছিলো কিন্তু ওর মুখের ভাব সায়নের কাছে সব বলে দিলো।
********
আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গভীর হল তারপর মন দেয়া নেওয়াও। পরের দোলে সায়নের নেমতন্নে পিউ ওদের বাড়িতে উপস্থিত। ওকে আসতে দেখে সায়নের মা, কেয়া বললেন “যাও তোমরা গল্প কর ততক্ষণে আমার রান্না হয়ে যাবে”
পিউ বলল “না তা হয় না কাকিমা। এই মাস তিনেক হল আপনি একটু সুস্থ হয়েছেন তার ওপর একদিনে এতো ধকল আপনার শরীরে সহ্য হবে না। আজ আপনি বিশ্রাম নিন আমি বরং বাকী রান্নাগুলো সেরে নিচ্ছি”
“তার দরকার নেই পিউ’মা, আমি বেশী কিছু রাঁধছি না আজ। তাছাড়া আমি আজ রান্না করবো ঠিক করেছি তোমায় খাওয়াব বলে। এবার তুমি গল্প কর গিয়ে”
পিউ পায়ে পায়ে সায়নের ঘরে উঁকি দিলো কিন্তু ওকে দেখতে পেলো না। তবে হয়তো ছাদে গেছে এই ভেবে ও ছাদে উঠে এলো। কিন্তু এখানেও ও নেই। ছাদ থেকে নীচের বাগানে উঁকি দিলো ও, যদি ওখানে থাকে এই ভেবে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ওকে জড়িয়ে ধরলো তারপর বলল “এবার ধরেছি পাখিকে আর তো ছাড়ছি না”
কিন্তু পিউ বেশ কায়দা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সায়ন বলল “বাবাহ ট্রেনিং ভালোই হয়েছে দেখছি। যাক আমি নিশ্চিন্ত”
“তুমিই তো ক্যারাটে শেখালে তা শিষ্যা পরীক্ষায় পাশ করেছে তাহলে” একটু থেমে পিউ বলল “তা যে পাখী নিজেই ধরা দিতে চায় তাকে নিয়ে কি করবে?”
সায়ন হঠাৎই লাল আবিরে ওকে পুরো রাঙিয়ে দিয়ে বলল “এভাবে আপন করে নেবো”