ভালোবাসার বিশ্বাস
ভালোবাসার বিশ্বাস
মনির মনে প্রাণে বিশ্বাস ছিল সুকান্ত দেশের যে প্রান্তেই থাকুক না কেনো, জন্মদিনে একটা অন্তত ফোন করবে। মনির একটুও ইচ্ছা ছিল না এত দূরে স্বামীকে চাকরি করতে পাঠানোর। বছর চার বিয়ে হয়েছে একদিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে থাকে নি। ওই সকালে গেছে আর বিকালে ফিরেছে। শাশুড়ি প্রায় পঙ্গু, কোনো কাজই করতে পারে না। ওদের দু বছরের ছেলে মন্টুও বাড়ী ফেরার জন্য হাঁক পাক করে। আর সুকান্ত তো যাওয়ার আগেই বলে দেয় "বিকালের আগেই বাড়ী ঢুকবে, নইলে মাথা গরম হয়ে যাবে কিন্তু"। মনির যে দুদিন বাপের বাড়ি থাকতে ইচ্ছে করে না তা নয়, তবু স্বামীর অবাধ্য হয়ে না কখনো। আসলে সুকান্ত গরীব হলেও ওদের সংসারে ভালোবাসার অভাব নেই। ছেলে হওয়ার পর হঠাৎ করে সুকান্তের অফিস টা কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়। একে সংসারের দায়, তার উপর ছেলের খরচ, সুকান্ত দিশেহারা হয়ে পড়ে। কয়েকজন বন্ধুকে বলে রেখেছিলো চাকরির খোঁজ দিতে, তার মধ্যেই একজন সমর একদিন মুম্বাইতে এক চাকরির খোঁজ দেয়। মনি প্রথমে কিছুতেই রাজি হয় নি। সেলসের কাজ, তাও আবার এত দূরে, সে বেঁকে বসে কিছুতেই যেতে দেবে না। শেষে সুকান্ত অনেক বুঝিয়ে বউ কে রাজি করায়। সামনের সপ্তাহে ছয় মাস পূর্ণ হবে সুকান্তের মুম্বাই যাওয়ার। অভাব কাটলেও মনির মনে একটুও শান্তি নেই। বিয়ের পর এই প্রথম আলাদা থাকছে। ফোন করলেই আসার কথা জিজ্ঞেস করে কিন্তু সুকান্ত কেমন করে যেনো উত্তরটা এড়িয়ে যায়। আসলে সুকান্ত চায় বেশ কিছু টাকা জমিয়ে তবেই বাড়ী ফিরবে। এই কথা অনেকবার মনিকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ও ক্লান্ত, সে এক কথা বার বার জিজ্ঞাসা করে। তাই কথা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া ওর আর উপায় নেই।
সুকান্ত মুম্বাই গিয়ে এক মাসের ভিতরেই আগের চাকরি ছেড়ে এক আরো ভালো কোম্পানিতে জয়েন করেছে। মাইনে পত্তর ও বেশ ভালো। প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠানোর সময় মনিকে চিঠি লেখে। তবে তাতে আসার কথা কিছু লেখা থাকে না। মনির মোবাইল ফোন না থাকায় বন্ধু শম্ভুর ফোনে মনির সাথে প্রায়ই কথা বলে। মনি অসুস্থ শাশুড়ি আর ছোটো ছেলের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে চলে। কিন্তু রাতে তার মন বিরহের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। বাড়ির ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে মনে কত কথা বলে সুকান্তের সাথে। হঠাত কেউ দেখলে নির্ঘাত পাগলী বলবে। মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে রমা বৌদি চিৎকার করে ওঠে "অ্যাই, এলো চুলে ছাদে উঠেছিস কেনো, ভূতে ধরবে, আবার কার সাথে বির বির করছিস, মাথাটা খারাপ হলো নাকি?"। মনি যেনো শুনেও শোনে না। সেই এক ভাবেই কথা বলে যায়।
মনি আস্তে আস্তে ভিতর থেকে ভেঙ্গে পড়ছিল। খাওয়া দাওয়া প্রায় করতো না বলা চলে। নিজের শরীরের উপর যেনো প্রতিশোধ নিচ্ছিল। সুকান্তের ফোন এলে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা করতো।এভাবে মনি কয়েক মাসের মধ্যেই বিছানা নিলো। মনির মা নাতিকে নিজের কাছে নিয়ে গেলো কারণ শরীরের এই অবস্থায় ছেলের দেখা শুনা করা কষ্টকর। সুকান্তের মানী অর্ডারের সাথে এখন আর চিঠি আসে না। মনির খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবে জন্মদিনে সুকান্ত ঠিক আসবে সে যেভাবেই হোক। তাই ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ওকে সুস্থ হতে হবে, বিশেষ করে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেই হবে, না হলে সুকান্ত সেই আগের মত বলবে "আমার কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবে"। কথাগুলো ভেবে নিজের মনে মনেই এক চোট হেসে নিল মনি। ছেলে বাড়ী ফিরলো বটে কিন্তু জন্মদিন পার হতে চললো, সুকান্ত তো এলোই না, একটা ফোন পর্যন্ত করলো না। মনির ইচ্ছা করছিল চিৎকার করে কেঁদে বুকটা হালকা করতে কিন্তু তা সম্ভব নয়। প্রায় দশটা বেজে গেছে, রাত বারোটার পর এই দিনের তারিখটা পাল্টে যাবে, ওর জন্মদিন থাকবে না। তবু মন যেনো সুকান্তের আসার আশা কিছুতেই ছাড়তে পারছে না। পৌনে বারোটা় দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মনি, অশ্রু ভরা চোখে চাঁদ টাকে কেমন ঝাপসা মনে হলো। নিজেকে নিজেই সান্তনা দিল, "এই চাঁদটা তো সুকান্ত দেখতে পাচ্ছে, আমিও দেখছি"। উঠে দাঁড়ালো কিন্তু কে যেনো পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর চোখটা চাপা দিয়ে বলে উঠলো "হ্যাপি বার্থডে মনি"। হ্যাঁ সুকান্ত ফিরেছে তার বউয়ের জন্মদিনে। মনির মন তাকে ভুল বলে নি। এটাই ভালোবাসার বিশ্বাস। সুকান্ত না বলে এসেছে মনিকে সারপ্রাইজ দেবে বলে তবে এত দেরি ট্রেন লেটের জন্য। মনির সেই খুশি মুখটাই এভাবে দেখতে চেয়ছিল সুকান্ত।

