Sonali Basu

Drama Tragedy

3  

Sonali Basu

Drama Tragedy

ভালোবাসার আহ্বান

ভালোবাসার আহ্বান

6 mins
3.0K


অফিস থেকে প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যায় সোমলতার। এক বিজ্ঞাপন সংস্থায় উঁচু পদে কাজ করে ও, মাইনে যেমন বেশি তেমনি দায়িত্ব অনেক কাজের চাপও প্রচুর। ফেরার আগে যদি ইচ্ছে যায় তো বাইরের কোন হোটেল থেকে রাতের ডিনার সেরে আসে, আবার কোনদিন বাড়ি ফিরে পছন্দমতো কিছু রান্না করে নেয়। মাঝে মাঝে ওর খাওয়ার টেবিলের সাথী হয় কুশল। আজ সকালে যাওয়ার সময়ই ভেবে রেখেছিলো আজ মায়ের পছন্দের সব রান্না করবে। মায়ের পছন্দের পদগুলো অবশ্য ওরও খুব পছন্দের। সেইমতো জিনিস কিনে যখন ফিরল তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা। আজ কুশল আসেনি, ভালোই হয়েছে নাহলে ওকে বারণ করতে হতো। আর কুশল একটু সেন্টিমেন্টাল কি জানি বারণ করলে যদি অন্য ভাবে নেয়। অন্যদিন হলে হয়তো আর রান্নায় হাত লাগাত না কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুম ঘুরে ও রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। ভাত নানা শব্জী দিয়ে মুগ ডাল আলু বড়ি পোস্ত আর টমেটোর চাটনি ব্যস। সব শেষ হতে হতে রাত দশটার বেশী হয়ে গেলো। সব সুন্দর করে থালায় গুছিয়ে আর এক টুকরো গন্ধরাজ লেবু ভাতের পাশে দিয়ে নিয়ে ও চলে এলো মায়ের ঘরে। পূর্ব দেয়ালে মায়ের ছবিটা বড় করে বাঁধানো। তার সামনের টেবিলে থালাটা নামিয়ে বলল ‘মা আজ সব তোমার পছন্দের বানিয়েছি। তুমি খুশি তো?’ মায়ের ছবির উজ্জ্বল হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে ও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো তারপর নিজের খাবারটা নিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। মায়ের থালার পাশে রেখে ওর নিজেরটা শেষ করলো। মায়ের জন্য যা থালায় বেড়েছে তা ঢাকা দিয়ে রাখবে আর পরের দিন সকালবেলায় কোন ভিখারিকে ডেকে খাইয়ে দেবে।

আজ চার বছর ও এটাই করে চলেছে। শেষের কয়েক বছর মা তো আর কাউকেই চিনতে পারছিলো না, এমনকি ওকেও না। সারাক্ষণ ঘুমের ওষুধের ঘোরে থাকত। আর যখন একটু চেতনা ফিরত খেতে চাইতো। এতদিন মালা’ই সব করে করে এসেছে। মায়ের দেখাশোনা রান্নাবাণ্ণা ঘরের সব কাজ সব। কারণ ওর চাকরি করাটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। মায়ের চিকিৎসার এলাহি খরচ কে দেবে? সবই চলছিলো নিয়মমাফিক কিন্তু মারা যাওয়ার দুদিন আগে বোধহয় হঠাৎ করে মায়ের সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে এসেছিলো। সেদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে মায়ের ঘরে গিয়ে বাকি দিনের মত দেখে ফিরে আসবে এমন সময় মা বলে উঠেছিলো ‘আমাকে একটু নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবি?’ ও ভারী অবাক হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন ও সব নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিল। ও ভীষণ খুশি হয়েছিলো এই ভেবে যে তাহলে মায়ের পুরনো সব কিছু মনে পড়ে গেছে। কিন্তু না পরের দিন থেকে অবস্থার আরও অবনতি হলো এতটাই বাড়াবাড়ি যে হাসপাতালে দিতে হল। হাসপাতাল যাওয়ার দেড় দিনের মাথায় মা চলে গেলো চিরদিনের মতো। যাদের জন্য এসব হল তারা কোনদিনই কিছু জানতে পারবে না।

এসব ভাবতে ভাবতে সেদিন ও শুয়ে পড়েছিলো। পরেরদিন যথারীতি আবার অফিস।

প্লেনটা তার বিশাল দেহ নিয়ে আকাশে উড়তে সোমলতার এক অন্য অনুভূতি হলো। এ অনুভূতির ও আলাদা করে ঠিক নাম দিতে পারবে না। অনেকদিন পর ফিরছে ও কলকাতায়, তা প্রায় বছর পনেরো। ফেরার বিশেষ কোন কারণ যদি দেখাতে হয় তাহলে বলতে হবে বাবার সঙ্গে দেখা করা। অবশ্য সেটাও সঠিক কারণ বলে দাবি করতে পারবে না ও। আসলে সপ্তাহ খানেক আগে ওর মেলএ কল্যাণকাকু মেসেজ করেছিলো – যদি পারো একবার বাবাকে দেখে যেও। সেটাই এক রকম কারণ ধরে নিয়ে আসছে ও। একই দেশের দু প্রান্তে একই পরিবারের দুজন নিজ নিজ জগতে রয়ে গেলো। এর জন্য কাকে দোষ দেওয়া যায় বলতে পারবে না ও। ‘ম্যাম ইয়োর কফি’ এয়ারহোস্টেসের ডাকে চিন্তার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সৌজন্যের হাসি বিনিময়ে কফির কাপ হাতে নিলো ও। কফি খেতে খেতেই শুনলো সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ। এয়ারপোর্টে নেমে খানিকক্ষণের জন্য ও দাড়িয়ে রইলো তারপর বেরিয়ে গাড়ি ভাড়া করে আগে বুক করা হোটেলে যাওয়ার নির্দেশ দিলো ও। যেদিন মা আর ও এখান থেকে শেষবারের মতো প্লেনে ওঠে মুম্বাই যাওয়ার জন্য সেদিন সানগ্লাসের পেছনে মায়ের চোখদুটো যে ছলছল করছিলো তা বুঝতে না পারার মতো বোকা আর ছিলো না ও। কিন্তু কোন প্রশ্ন করেনি ও আর। তখন থেকেই ওর ভবিষ্যতের ইতিকর্তব্য ছকে নিয়েছিলো।

হোটেলে এসে ওঠার পর স্নান খাওয়া শেষ করে খানিক বিশ্রাম নিলো ও। তারপর কল্যাণকে ফোন করলো ও। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ বলার পর ও বললো ‘সোমলতা বলছি। আমি কোলকাতায় এসেছি। আপনাদের ওখানে কখন যাওয়া যাবে বলুন। আমার বেশীদিনের ছুটি নেই’

কল্যাণ বলল ‘তুমি আজই চলে এসো, দাদা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন’

‘ঠিক আছে আর আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবো’

সোমলতা তৈরী হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো তারপর ট্যাক্সি ধরে আধঘন্টার মধ্যে বাড়ির সামনে গিয়ে নামলো। এই সেই বাড়ি, উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানার অহংকারে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে। এই অহংকারই ভালবাসায় পাগল দুই হৃদয়ের মধ্যে এক অভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছিলো। ওর ইচ্ছে হল ওই বন্ধ দরজার ওপাশ থেকেই ফিরে যায় কিন্তু না যা করবে বলে ভেবে এসেছে তা তো করে যেতেই হবে। ও এগিয়ে কলিংবেল চেপে ধরতেই দরজা খুলে দিলো কল্যাণ। ‘এসো এসো’ বলে তিনি সরে দাঁড়ালেন। বাড়িটার সাজসজ্জায় কোন পরিবর্তন আসেনি যেন এইতো কাল চলে গিয়েছিলো আজ ফিরে এসেছে।কল্যাণ হয়তো বুঝতে পারছিলো ওর চিন্তার দিক তাই বললেন ‘দাদা কিছুই পাল্টাতে চাননি তাই’ সোমলতা একবার ওঁর মুখের দিকে তারপর সিঁড়ির দিকে এগোলো। ‘দাদা নীচের ঘরে থাকেন পড়ার ঘরের পাশেরটা’

ও অবাক হয়ে আরো একবার কাকুর মুখের দিকে তাকালো তারপর বাঁদিকে এগোলো। মায়ের খুব পছন্দের ছিল এই পড়ার ঘরটা। আসলে এই ঘরে বসে মা ছবি আঁকতো। আর্ট কলেজের সবথেকে কৃতি ছাত্রী যার আঁকা ছবি কলেজ থেকে বেরোনোর আগেই বিক্রি হয়ে যেত। মায়ের আরেকটা গুণ ছিলো খুব ভালো কবিতা লিখতো। এসব গুনই আকৃষ্ট করেছিলো চন্দ্রশেখরকে। দুজন দুজনের প্রেম জালে বাঁধা পড়লো কিন্তু না থাক সে গুণাবলীর কীর্তন! আগে জানা যাক কি কারণে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বাঁদিকের ঘরের পর্দা ঠেলে ঢুকতে ওর চোখাচোখি হল আরামকেদারার ওপর বসা বাবার সঙ্গে। ও বোধহয় ওর অপেক্ষাতেই দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তবে ও আশা করেনি বাবাকে এই চেহারায় দেখবে। সেই রাজকীয় চেহারা নেই যা দেখলে সম্ভ্রম জাগত, এখন দামি ধুতি পাঞ্জাবীর ভেতর এক ভাঙাচোরা মানুষ বসে রয়েছে।

সোমলতা একবার কল্যাণের মুখের দিকে তাকালো তারপর পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে এলো তারপর নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। চন্দ্রশেখর বলল “থাক আমাকে প্রণাম করতে হবে না তোমায়। আমি সেই অধিকারটা বোধহয় হারিয়েছি। কেমন আছ তুমি?”

“আছি... ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?”

“আমি কেমন আছি... হুম আছি বেঁচে আছি এই পর্যন্তই... থাক আমার কথা... আরে বসো বসো দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন?”

“হ্যাঁ বসছি” বলে সোমলতা ঘরের কোণে রাখা আর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে মুখোমুখি বসলো। তারপর বলল “এবার বলো আমাকে খবর দিয়ে ডাকানোর কারণটা কি?”

“কারণ” কথাটা বলেই শেখরের চেহারায় বেশ ভাবান্তর হল। ওর চুপ করার ফাঁকে সোমলতা খেয়াল করলো বাবার চেহারায় হাজারটা বলিরেখার চিহ্ন। এই চেহারা কত সুন্দর ছিল কার্ত্তিক ঠাকুরের মতো। ছোটবেলায় ওর মনে প্রছন্ন অহংকার ছিল ওর বাবা এতো সুন্দর বলে। হঠাৎ বাবা বলে উঠলো “এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছি যে মেয়ের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করলেও কারণ দেখাতে হয়”

সোমলতা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। শেখর বলল “যা পেরিয়ে গেছে তা চাইলেও আর তো ফেরত পাব না। এমনই ছিলাম যে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও ধরে রাখতে পারলাম না। সে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। আজ হাজার মাথা কুটলেও তাকে ফেরাতে পারবো না আর যতদিন না ওপরে যেতে পারছি ক্ষমাও চাইতে পারছি না। তবে শুধু তো তার প্রতি নয় আরও একজনের প্রতি আমি অন্যায় করেছি সে হচ্ছ তুমি। তা সেটা শোধরাবার একটা সুযোগ চাই। যদি একটা অনুরোধ করি... রাখবে?”

“কি সেটা জানতে পারি?”

“তুমি যদি এখানে থাকো আমার সাথে”

সোমলতার চোখ থেকে নীরবে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এই আশায় এতদিন ছিল ওরা দুজনে। মা তো জেনে গেলো না বাবা তার ভুল বুঝেছে আর স্বীকারও করেছে তার অন্যায়। একজন কষ্ট পেয়ে চলে গেলো তেমনই আরেকজনও তো অনুতাপে সারা জীবন পুড়ে গেলো। আর কি দরকার তাকে কষ্ট দেওয়ার। ও আস্তে করে মাথাটা হেলিয়ে বলল “হ্যাঁ”


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama