Sonali Basu

Drama Tragedy

3  

Sonali Basu

Drama Tragedy

ভালোবাসা আজও ওর পাশে রয়েছে

ভালোবাসা আজও ওর পাশে রয়েছে

7 mins
3.9K


পাঁচতলার ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাপিয়া পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। ঘড়ির সময় অনুযায়ী এখন সূর্যাস্তের সময়। তবে চারদিকে এতো ফ্ল্যাটের সমাহার যে ঘড়িতেই সূর্যোদয় সূর্যাস্তের ব্যাপারটা বোঝা যায়, চোখে পড়ে না। আকাশের একফালি চোখে পড়ে তাও যদি অনেক কায়দা করে ঝুকে ওপর দিকে তাকায় তবেই। আজ মনটা ওর একটু ভার। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বাবা মায়ের খবর পায়নি অনেকদিন। ভালোই আছে নিশ্চই! চিঠির যুগ শেষ হয়ে গিয়ে এখন মুঠোফোনের সময়। কিন্তু ওর হাতে ফোন নেই। বিয়ের আগেরটা দাদা কেড়ে নিয়েছিলো আর দেয়নি আর কৌশিক এখনো ওকে ফোন কিনে দেয়নি শুধু বলেছে দরকার হলে ওর ফোন থেকেই মা বাবার খবর নিতে। একদিন এক মিনিটের জন্য মা শুধু কুশল প্রশ্ন করেছিলো আর ও শুধু হ্যাঁ আর না তে উত্তর দিয়েছে। ওইটুকু সময়ের জন্যও ওকে চোখের দৃষ্টি থেকে আড়ালে যেতে দেওয়া হয়নি। ভাস্বতী এসে জিজ্ঞেস করলো “চা খাবে তো?”

পাপিয়া উত্তর দিলো “এখন না পরে”

ও রান্নাঘরের দিকে ফিরে যেতে পাপিয়া আবার সামনের দিকে তাকাল। উল্টো পাশের নতুন তৈরি ফ্ল্যাটগুলিতে এক এক করে আলো জ্বলে উঠছে। অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ব্যাল্কনিতে আসতে দেখা যায় না। ওরা ওই পায়রার খোপটুকুতেই সুখী। পায়রার কথা মনে আসতেই ওর মনে পড়লো কানন মাসিমার কথা, উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির বাড়িওয়ালী। ওই বাড়ির ছাদে এক ঝাঁক পায়রার বাড়ি ছিল। সকালে মাসিমা উঠোনে চাল গম ছড়িয়ে ‘আয় আয়’ বললেই ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসতো। সারা বাড়ি ওদের বকমবকমে ভরে উঠত। আর এখানে কত নিস্তব্ধতা। আজ তিন দিন হল ওরা উত্তর কলকাতার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে মধ্য কলকাতার এই ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে। ওরা বলতে ও কৌশিক ভাস্বতীদি আর সনৎদা। আগের বাড়িটা খারাপ ছিল না কিন্তু তাও কৌশিক রাজি হল না ওখানে দেড় সপ্তাহের বেশি থাকতে। তাড়াতাড়িই খোঁজখবর নিয়ে উঠে এসেছে এখানে। এখানে ওর একটুও মন টিকছে না। আগের বাড়ির বাড়িওয়ালী মাসিমা খুব গল্প করতে ভালোবাসতেন, ওনার মেয়ে দোলনের সঙ্গে তো বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। কৌশিক সকালে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর দুপুরের দিকে ওদের গল্পের আসর বসতো। ওনাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বাড়ির কথা মনে পড়ে যেত পাপিয়ার। ওদের সাথে গল্প করে ভারি মন হাল্কা করে নিত ও। কিন্তু ওর ননদ ভাস্বতীর এই গল্পের আসর ঠিক পছন্দ হয়নি। সন্ধ্যার চা একসঙ্গে খেতে বসলেই এই কথাটা তুলত “তোমার অতো কি গল্প বাড়িওয়ালির সাথে? ভাড়াটিয়াদের একটু সমঝে চলাই উচিত। ওদের সাথে আমাদের মনের মিল হবে না’

ও উত্তর দিতো না। দিন পনের হল বিয়ে হয়েছে ওর আর কৌশিকের। এত অল্প সময়ে ওর সব দোষগুণ না বুঝতে পারলেও এটুকু বুঝতে পেরেছিল দিদির সাথে তর্ক করা ওর পছন্দ নয়। একদিন এ নিয়ে বেশ কড়া কথা শুনতে হয়েছে ওকে। এই বাড়িতে দিদির কথাই শেষ কথা। জামাইবাবু মানুষটিকে ও বুঝেই উঠতে পারেনি। সকাল হলে বাড়ির দুটো পুরুষ একই সঙ্গে বেরিয়ে যায় রাতে ফেরে নিজের নিজের পছন্দের সময়ে। কৌশিক একটা জিমের ইন্সট্রাকটার, এরকমই জানে পাপিয়া। সম্বন্ধটা এনেছিল বাবার এক পরিচিত যে হাওড়ায় থাকে। বিশেষ খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, সময় কোথায় তখন। কোনমতে চন্দনের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনে তাড়াতাড়ি কৌশিকের সাথে সাতপাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

সন্ধ্যার পরপরই দরজার বেল বাজলো। ভাস্বতী রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল “পাপিয়া দরজা খোলো। ভাই ফিরেছে”

পাপিয়া খানিক অবাক হয়েই দরজা খুলল। আর সত্যি কৌশিকই ফিরেছে। দিদি জানলো কি করে যে আজ ও তাড়াতাড়ি ফিরবে? সকালে বলে গিয়েছিল কি, পাপিয়া মনে করতে পারলো না। ফোন করেছিল কি? কিন্তু দিদির তো ফোন বাজেনি! কৌশিক হাতের ব্যাগটা ওর হাতে ধরিয়ে বলল “ব্যাগে যা রয়েছে তা দিদিকে বলো ঘুছিয়ে রাখতে টেবিলের ওপর”

পাপিয়া ব্যাগের ওজন আর যে সুগন্ধ বের হচ্ছে তাতে অনুমান করলো কোন খাবার আনা হয়েছে। ও ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে গেলো তারপর কৌশিকের কথাটা আর একবার পুনরাবৃ্ত্তি করল। ভাস্বতী ব্যাগটা নিলো তারপর বলল “চা তৈরি, তুমি ট্রেটা নিয়ে বসার ঘরের টেবিলে রাখো। আমি ব্যাগে কি আছে দেখে, গুছিয়ে নিয়ে আসছি”

খানিক পরে ভাস্বতী নিয়ে এলো ডিমের চপ প্লেটে সাজিয়ে। কৌশিকও ততক্ষণে বাথরুম থেকে ঘুরে এসেছে। তিনজনে সোফায় বসে চায়ে চুমুক দিতে যাবে সেই সময় সনৎদা এসে পৌঁছালো। ভাস্বতী রীতিমত হৈহৈ করে উঠলো সনৎ তাড়াতাড়ি ফেরাতে। চারজনে চায়ের আসর জমিয়ে তুলল। এরকম চায়ের আসর ওদের বাড়িতে প্রায়ই বসতো। তিন দাদা এক দিদি ও আর বাবা মা। তবে চায়ের সাথে বেশির ভাগ মুড়ি আলুভাজা চলতো। মাঝে মধ্যে মা বা বড়দি পেঁয়াজি বানাতো। ডিম বা ভেজিটেবিল বা মাংসের চপ ও আর চন্দন খেত যখন ওরা কলেজ থেকে বেরিয়ে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো।

“কি গো চপটা দারুণ না খেতে?” ভাস্বতীর প্রশ্নে পাপিয়া অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলো এক লহমায়। উত্তর দিলো “হ্যাঁ দিদি” এ বাড়ির কাউকে ও বুঝতে দিতে চায় না যে এই বিয়েতে ও সেভাবে খুশি হতে পারেনি। কৌশিক বলল “অফিস থেকে আসতে আসতে চোখে পড়লো তাই নিয়ে এলাম”

পাপিয়া বেশ অবাক হচ্ছিলো আজ। বেশ ভালো লাগছিলো এই পরিবেশ। সকাল থেকে ওর মনের গুমোটভাবটা এখন এই আনন্দময় পরিবেশে কেটে যাচ্ছে। ওদের বাড়ির পরিবেশ তো এরকমই ছিল। বরং বিয়ের পর এ বাড়ির সব মুখ গোমড়া কেজো মানুষদের ভিড়ে ওর বেশ দমবন্ধ অবস্থা হতো। এরকম গল্পের আসর কোনদিন বসেনি এর আগে। নানান গল্পে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল। পাপিয়া বলল “দিদি দেখিয়ে দাও কতটা আটা মাখবো রাতের রুটির জন্য”

ভাস্বতী উত্তর দিলো “আজ খাবার করতে হবে না। কৌশিক রাতের খাবার নিয়ে এসেছে”

সনৎ চপে কামড় দিতে দিতে বলল “তাই নাকি শালাবাবু। এতো দারুণ ব্যাপার। কোন স্পেশাল ব্যাপার আছে নাকি?”

কৌশিকের উত্তর “না না আজ ইচ্ছে হল। তাই আর কি!”

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পারেনি পাপিয়া। তার বদলে বাবা দাদাদের সম্বন্ধ করে আনা পাত্রের গলাতেই মালা পরিয়েছে। চন্দনকে ভুলতে পারেনি ও। কিন্তু আজ মনে মনে ও বাবা দাদাদের ক্ষমা করে দিলো। বিয়ে ওর ভালো ছেলের সাথেই হয়েছে, ভাবলো পাপিয়া।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর খুব ঘুম পেতে শুরু করলো ওর। পাপিয়া বলল “দিদি যদি কাল সকালে বাসনগুলো মেজে দিই কোন অসুবিধে হবে? আজ খুব ঘুম পাচ্ছে”

“কোন অসুবিধে নেই তুমি শুয়ে পড় আমি কাজ সেরে নিচ্ছি”

পাপিয়া শুয়ে পড়লো গিয়ে। ঘুম পাওয়ার কারণ হিসেবে ভাবলো আজ মনটা খুব খুশি খুশি তাই জন্য বোধহয়।

পরেরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেশ বেলা গড়িয়ে গেছে। বিছানায় উঠে বসে পাপিয়া খুব অপরাধ বোধে বিদ্ধ হল। আগের দিন রাতে ও কাজ করে দেবে বলেছিল কিন্তু উঠতেই তো দেরী করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমেই বাথরুম গেলো। বেরিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো ও। রান্নাঘরে দিদি নেই। কৌশিক সনৎ এরা নাহয় কাজে বেরিয়ে গেছে কিন্তু দিদি কোথায় গেলো। কোথাও গেছে ভেবে খানিক চুপ করে বসে রইলো। বেলা আরও বেড়ে যেতে খিদে বোধ হতে শুরু করলো। রান্নাঘরে শুধু বিস্কুট পরে আছে। রান্নঘরে ও বিশেষ যায়নি এই পর্যন্ত তাই কিছু আছে কি না তা ওর জানাই নেই। সারাদিন ওই বিস্কুট খেয়ে কাটানো গেলো না। কিন্তু ওরাও ফিরল না। আবার খিদে পেতে আলমারি খুলল তার থেকে টাকা বার করতে, খাবার কিনতে হবে তো! কিন্তু টাকা তো নেই ওর যা জামাকাপড় গয়নাগাটি ছিল তাও নেই। এটা কি করে সম্ভব তা ও প্রথমে বুঝতেই পারলো না। অনেকক্ষণ পরে বুঝল ওকে ছেড়ে ওরা পালিয়েছে। এটা বুঝতেই ও প্রথমে ঘাবড়ে গেলো। এবার কি হবে? কি ভাবে ফিরবে বাড়ি!

ফিরে এলো ও বাড়িতে, কিভাবে সেই বিস্তারিত গল্পে গিয়ে লাভ নেই। দাদা বাবা ঘটনা শুনেই ছুটলো থানায়। তারা তদন্ত করবে আশ্বাস দিলো। কিছুদিন পড় জানা গেলো ওরা ঠকবাজ, ওভাবেই অনেক বিয়ে করেছে তারপর সব কেড়ে পালিয়ে গেছে। বাড়ির লোক হায় হায় করলো গালাগালি দিলো তারপর পাপিয়ার কপাল মন্দ বলে আফসোস করতে থাকলো। জীবন একটু একটু করে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছিলো ওদের বাড়িতে। কিন্তু আকাশ ভেঙে পড়েছিল পাপিয়ার মাথায়। পড়াশোনাটা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হল কিন্তু এখন তো বোঝা গেছে সেটাও মরীচিকাই। কিন্তু এখন কি করবে ও?

সেদিন ও যাচ্ছিলো বাজারের প্রান্তে সেলাই দিদিমণির বাড়ি, সেলাই শিখে যদি কিছু করা যায় এই ভেবে। রাস্তায় কেউ ওকে পিছন থেকে ডাকল। আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছিল চন্দন। চন্দন কাছে এসে বলল “কেমন আছো পিয়া?” “যেমন থাকার কথা ওরকম বিয়ের পরে”

“যদি অসুবিধা না থাকে তো চলো কোথাও বসে একটু কথা বলি”

দুজনে ওদের পুরনো পরিচিত কফি আর খাবারের দোকানে বসলো। চন্দন বলল “সব শুনেছি। তা কি করবে এখন ভাবছ?”

“কি আবার সেলাই শিখবো যদি রোজগার করতে পারি তা শিখে”

“পড়াশোনা ছেড়ে দিলে একেবারে?”

“কি করবো পরীক্ষা তো দেওয়া হল না”

“তাতে কি হয়েছে? আবার ভর্তি হও। সামনের বারের জন্য তৈরি হও। তোমার যে স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল সেটা হতে চেষ্টা কর”

“বাড়ির সমর্থন পাব বলে মনে হয় না”

“এখন তো তুমি জোর করতে পারবে তোমার ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার সময় ওদের একটা ভুল সিদ্ধান্তে তোমার কিছুটা অমূল্য সময় নষ্ট হয়েছে তাই এখন আর ওরা তোমার কাজে বাঁধা দিতে পারবে না”

“আমার মনোবল বাড়াতে তোমাকে পাশে চাই চন্দন” দুরাশা জেনেও বলে ফেলে পাপিয়া। কিন্তু ওকে অবাক করে চন্দন বলে “আমি সবসময় তোমার পাশে আছি পিয়া। তুমি চাইলে সাড়া জীবনই তোমার পাশে থাকবো”

পাপিয়ার চোখে জল এসে গেলো। চন্দন ওর হাত দুটো ধরে মৃদু স্বরে বলল “কাঁদছ কেন? যা চলে গেছে তা একটা দুঃস্বপ্ন তাকে মনে করে কেঁদো না। সামনে তোমার বিশাল পথ পড়ে আছে সেদিকে শুধু লক্ষ্য করে এগিয়ে যাও”

পাপিয়া সিদ্ধান্ত নিলো আবার পড়াশোনা করবে তারপর নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আজ আর ও একা নয় ওর ভালোবাসা আজও ওর পাশে রয়েছে!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama