ভাই আত্মহত্যা করেছে!
ভাই আত্মহত্যা করেছে!


“ভাই আত্মহত্যা করেছে!” শুনেই আঁতকে ওঠে তনুজা।
বাবার সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা চলছিল ঠিকই, কিন্তু আত্মহত্যা!
ছোটবেলা থেকে যে ভাই আমাকে বাবা-মা এর স্থান দিয়েছিল, আমি গর্বে বলতাম, “তুইই বাড়ির বড়কর্তা”, আজ সে নেই! সহ্য করতে পারল না যখন বললাম, “তুই তো এখন ভোগকর্তা!” বলবো না কেন? সমস্ত টাকা-পয়সা, বাবার কিংবা মায়ের সাথে ওর বউয়ের নাম। বউই হ্যান্ডলিং করে। আর আমাদের ভাই নয়। এখন বউয়ের কথায় ওঠাবসা। ওর বউটা মরলেই তো পারত!
- ওগো শুনছ! ড্রাইভারকে ফোন কর। বাঁকুড়া যেতে হবে, ভাই আত্মহত্যা করেছে।
চারদিকে অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। মানুষগুলোর মধ্যে একটাই প্রশ্ন, “এত ভালো মানুষটা আত্মহত্যা করতে গেল কেন?” প্রতিষ্ঠিত চাকরি, বাড়ি, বন্ধুপ্রেমী, শিক্ষিত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ। তথাপি....
সকলের উপস্থিতিতে চৈতি তুলে দিল তনুজার হাতে একটা চিঠি – ভাইয়ের লেখা –
"উড়ো চিঠি,
আমি চললাম। আমার এই কর্মের জন্য আমি ক্ষমাপ্রাথ্যী। বহু দায়িত্ব অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। কিন্তু আমি তো লড়তে পারছিলাম না নিজের সাথে। প্রতি মুহূর্তে ভয় আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল – সম্মান হারানোর ভয়। হ্যাঁ, আমি তো সম্মানের ভিখারি ছিলাম, আর ছিলাম ভালোবাসার কাঙাল। কিন্তু এ সমাজ আমাকে বারবার অপমানিত করেছে, ছোট করেছে, ভীত করেছে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই আমার সমাজ নগ্ন হয়ে উঠল আমার কাছে। যে দিদিকে আমি হৃদয়ের মন্দিরে স্থান দিয়েছিলাম, যার ‘ভাই’ ডাক শুনে বড় হলাম, আজ আমিই তার প্রধান শত্রু, কারণ বাবার সম্পত্তি। অথচ মৃত্যুর আগে কোনও উইল বাবা করে যাননি, আমিও চাইনি। বয়সের ভারের জন্য বাবা-মা’কে যাতে ব্যাঙ্কে না যেতে হয়, তাই ওদের দু’জনের নামের সাথে চৈতির নাম দিয়েছিলাম। আর সমস্ত হিসাব ডায়েরিতে লিখে ছোট ভাইকে জানাতাম। অথচ চৈতি নাকি সব চক্রান্ত করে হাতিয়েছে! হ্যাঁ, বাবা চৈতিকে ভীষণ ভালোবাসতেন, কিন্তু কোনও সম্পত্তি দিয়ে যাননি, যা দিদিদের কাছে অবিশ্বাস্য। সমস্ত মিলিয়ে আমি ছিলাম সবার পরম শত্রু এবং সম্পত্তির ভোগকর্তা। শুরু হয় মানসিক অপমান, যা আমার কতখানি প্রাপ্য জানা নেই। যে পরিবারকে আমি একটা সুতোয় বাঁধতে চেয়েছিলাম, আজ সেই সুতোই আমার গলার ফাঁস।
এই সমাজের কাছে অনেক পেলাম, সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু রাজনীতির নোংরা মানসিকতায় আজ আমি নিহত। বেআইনি কাজের বাধা দিতে গিয়ে আমাকে ভীত হতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ভয়ে আছি, এই বুঝি চৈতি কিংবা মেয়ে কিংবা আমার ওপর আক্রমণ হবে! ভয় আমাকে জয় করে নিয়েছে।
এক বাল্যবন্ধু আমার কাছে টাকা নিয়েছিল বাড়ির সি.সি করে দেওয়ার জন্য। টাকাও গেল, সময়ও গেল, কাজ হল না। উপরন্তু বেশি টাকার লোভে সে আমার কাগজপত্র আমার বিবাদী পক্ষের হাতে তুলে দেয়। যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমার সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগিয়েছিল, আমাকে লড়াইয়ের ইন্ধন জুগিয়েছিল। ভগবান! আজ সেই স্কুলের বন্ধু বিরোধী আসনে!
মেয়েদের স্বপ্নই আমার স্বপ্ন। ছোটবেলা থেকে আমি কোনও স্বপ্ন দেখিনি বা কেউ দেখায়নি। তাই জীবনটা অগোছালোই ছিল। তবে রক্তে প্রেম সবসময়ই রয়েছে। আজ স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে মেয়ের দূরে চলে যাওয়া, তার না খেতে পারার কান্না বা পরিবারের প্রতি উদাসীনতা আমায় বারবার অপমানিত করেছে!
সবশেষে আসি চৈতির কথায়। বিরোধিতা করা, নারীর সহজাত গুণ কিনা জানি না, তবে আমার অনুভূতি তাই। যতবার ওর কিংবা পরিবারের ভালোর কথা ভেবে কিছু বলেছি, বাধাই পেয়েছি বারবার। মন অপমানিত হয়ে চিৎকার করে উঠেছে। কিন্তু লাভ হয়নি বিশেষ। তাই আর অপমান নিতে পারছি না। এতগুলো মানুষ যখন দেখিয়ে দিয়েছে ‘আমি ভুল’, তখন আমিই ভুল। তাই বিদায় নিয়ে সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করলাম। আমায় তোমরা ক্ষমা কর।