STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Classics

বেঙ্গল পুজো লীগ

বেঙ্গল পুজো লীগ

5 mins
297

আর মাত্র কয়েক মাস পরেই পুজো। তাই কৈলাশে মর্ত্য আগমনের প্রস্তুতির প্রসেস শুরু হয়ে গিয়েছে। আসলে পুরো প্রায় এক সপ্তাহ মর্ত্য গিয়ে থাকায়, কৈলাশের সব ব্যবস্থা করে যেতে হবে। "পুজোটা এবার বড্ড তাড়াতাড়ি, ধুস্‌ ভাল্লাগেনা, জলেকাদায় এবার আমাদের যে কি হবে! জলে ডুবে কলকাতার প্যাচপ্যাচে পথঘাটে পা মচকে সেবার আমার কি করুণ অবস্থা হল! আগের বছরের খুঁটিপোঁতার গর্ত এখনো বোজায়নি আর সেখানেই পা পড়ে ...তারপর সেখানে প্রোমোটার রাজের কৃপায় রাস্তায় চলাই দায়। স্টোন চিপস, বালি, ইঁট-কাঠে বোঝাই রাস্তার দুপাশ, ফুটপাথে হকার, খালপাড়ে ঝুপড়ি । তবে সেখানকার মানুষজন তোমাকে বড় ভক্তিছেদ্ধা করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটা বট কিম্বা অশ্বত্থগাছ হলেই তোমাকে পিতিষ্ঠা করে ওরা। আমি তো সেখানে পাত্তাই পাইনা। এই বছরে একবার যা পুজোর সময় আমাকে ওরা ফুলবেলপাতা ছোঁড়ে।" মা দুর্গা বললেন মহাদেবকে।

মহাদেব বললেন, "গিন্নী, তোমার যাবার যে কি দরকার তাই বুঝিনা...বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে প্রতিবছর এই আদিখ্যেতা আমারো আর পোষায়না। "

"সারাটাবছর তো এই ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে আছি আমরা। ন যযৌ , ন তস্থৌ অবস্থা । বলি তোমার অসুবিধেটা কোথায় বাপু? তোমার আবগারি বিলাসের তো ব্যবস্থা থাকছেই। আর ঐ ষাঁড় দুটো তো র‌ইলোই পাহারায়। থরে থরে সিদ্ধি-গাঁজা-আফিম-ভাঙ সব কিনেকেটে রেখে দিয়ে যাই তো।" দুর্গা বললেন ।


এবছর সুদূর ইটালি থেকে মহাদেবের এক ভক্ত ইলারিও এলাৎজি কৈলাস মানস সরোবর বেড়াতে গিয়ে মহাদেবকে একটি গন্ডোলা উপহার দিয়ে এসেছেন। এতক্ষণ ধরে মা-বাবার কথোপকথন শুনতে পেয়ে প্রত্যুৎপন্নমতি সরো বললে

"আইডিয়া! এবার তাহলে গন্ডোলাটা আমরা কলকাতায় নিয়ে যাব। "

লক্ষ্মী বললে, "বেড়ে বললি বোন আমার।"

গণশা ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে শুঁড়টা দুলিয়ে সম্মতি দিল। আর কেতো সেই কথা শুনে ঘরের বাইরে পার্ক করে রাখা গন্ডোলাটিকে ঘষেমেজে সাফ করতে উঠে পড়ে লেগে গেল। বলল, "ইয়েস! এবার আমরা আমাদের মত থিমসর্বস্ব গমন শুরু করব কৈলাস থেকে। গন্ডোলায় আগমন ও প্রত্যাবর্তন। দাঁড়াও সে গন্ডোলা এখন বরফের আস্তরণে বন্দী হয়ে আছে। তাকে চেঁচে নিয়ে, রং চং করে নিয়ে তবে আমাদের যাওয়া।"

গণশা শুঁড় নাচিয়ে বিজ্ঞের মত বললে, "নীল-সাদা রং লাগাস ভাই নয়ত কলকাতায় আমাদের ল্যান্ডিংটা সুখের হবেনা। আর সরো তুই সারা রাস্তা আর যাই গান গাস না কেন পশ্চিমবাংলায় ঢুকে রোবিন্দসংগীত ধরিস বাপু। কলা-কৃষ্টি-সঙ্গীত-বাদ্যের সার্বজনীন পীঠস্থান পশ্চিমবাংলা। "

দুর্গা সহাস্যে বললেন, "দেখো কেমন ছেলে বিইয়েছি! লোকে সাধে আমায় বলে রত্নগর্ভা! কিন্তু কৈলাস থেকে কলকাতা এই গন্ডোলা বয়ে নিয়ে যাবে কে?”

সরো বললে, "গুগ্‌ল ম্যাপস খুলে দেখে নিচ্ছি রুটটা। পালোয়ান সিং অসুর সামনে বসে দাঁড় বাইবে গন্ডোলার। আর মা তোমার সিংহকে বোলো তার সামনের হাতদুটো গন্ডোলার বাইরে রেখে জল কাটতে কাটতে যাবে সে । উল্টোদিকে কেতোর ময়ূরটা মুখ বের করে থাকবে। বাংলায় এমন নৌকতো ছিল আবহমান কাল ধরে।"

লক্ষ্মী বলল,”ময়ূরপঙ্খী যাকে বলে। শুধু রুটটা দেখেনে ভালো করে। কৈলাস টু কলকাতা। "

সরো বললে, "আমাদের গন্ডোলার নাম দেব সিংহ-ময়ূরপঙ্খী। আর বাকীরা কোথায় বসবে?”

মাদুর্গা উল্লসিত হয়ে বললেন, "কেন অসুরের পেছনে আমি। আমার দুপাশে তোরা দুইবোন যেমন থাকিস ।"

 কেতো বললে, "ভালো বলেছ। আমরা দুইভাই উল্টোদিকে মুখ করে ময়ূরের দিকে বসবখন। গণশা একাই ব্যালেন্স করে দেবে তোমাদের।"

সরো বললে, "হোয়াট এবাউট ইঁদুর?”

 লক্ষ্মী বললে "আমার রাজহাঁসের আর তোর প্যাঁচার বাবা কোনো জ্বালা নেই। সুন্দর ডানা মেলে গন্ডোলার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে যাবে প্যাঁচা। আর রাজহাঁস জল কেটে কেটে ঠিক সাঁতরে ম্যানেজ করে দেবে। মুশকিল হল ইঁদুরটাকে নিয়ে। তেনার আবার সারাদিন দাঁত বেড়ে চলেছে। কিছু কাটতে না পরলে আমাদের জামাকাপড় সব যাবে ওর পেটে।" 

গণশা বললে, "বেশ, আমার ইঁদুরকে নিয়ে তোমাদের যখন এত জ্বালা...”

লক্ষ্মী বলল্ "আহা, রাগ করছিস কেন? আমার ধানের ঝাঁপি থেকে ধান ছড়িয়ে রেখে দেব গন্ডোলার মধ্যে। ও সারাটা রাস্তা খুঁটে খেতে খেতে পৌঁছে যাবে।"  


সরো বললে, "গন্ডোলায় উঠে মাঝিকে গান গাইতে হয় কিন্তু। অসুর কি ঐসব সূক্ষ্ম, রুচির অধিকারী? “

দুর্গা বললেন, "সরো, তুই বাবা ওটুকুনি ম্যানেজ করে দিস।"

"আমার রুদ্রবীণা অবসোলিট। আমাকে বেস গিটার কিনে দাও তবে। "

মা দুর্গা বললেন্, "ও সরো, খালি গলাতেই গলা ছেড়ে গান গেয়ে দে মা এবারটার মতো। কলকাতা পৌঁছে তোর বেস গিটারের অর্ডার দেব।"

"রবীন্দ্রসংগীতকে অপেরার মত গাইতে দেবে ওরা? গন্ডোলায় অপেরা সঙ্গীত কিন্তু অবশ্য‌ কর্তব্য। ইলারিও বলে দিয়েছে বাবাকে। নয়ত গন্ডোলার ভরাডুবি। গলা ছেড়ে চীৎকার করে গাইতে হবে গান। আমাদের মাঝিমল্লার প্যানপ্যানে ভাটিয়ালি গাইলে হবেনা। ইটালির লোকগীতি কি যেন নামটা তার, ভুলে গেছি।" সরো বলে

কেতো ঝাঁ করে সার্চ করে বলল, "বার্কারোল। "

"হ্যাঁ, আমাদের লোকগীতির সাথে আকাশপাতাল তফাত। আমায় ডুবাইলিরে, ভাসাইলিরে মার্কা গান ওরা গায়না। ওরা থাকুক ওদের বার্কারোল নিয়ে। আমরা আমাদের মত করে গাইব ব্যাস্!” সরো বললে।  

কেতো বললে, "এসব তো ঠিক আছে। কলকাতায় পোঁছে বানভাসি পথঘাটে গন্ডোলা চড়ে আমাদের হোল ব্যাটেলিয়ান যখন নামবে তখন ভীড়টা আন্দাজ করতে পারছো? প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তখন থিমপুজোর মাতলামি, আমাদের নিয়ে হৈ চৈ ...সব মিলিয়ে আমরা ঘেঁটে ঘ।" 

 "যা বলেছিস। এদিকে বৃষ্টি রিমঝিম, ওদিকে পুজোর থিম। এ পাড়ায় জল থৈ থৈ, ও পাড়ায় শুধু হৈ চৈ...

তারপরে তারস্বরে মাইক, ভীড়ে ছয়লাপ মোটরবাইক। কলকাতার হকারময়তা, আর হকারদের কলকাতাময়তা । তারচেয়ে বরং এই বেশ ভালো আছি আমরা। ঐ কটাদিন জমিয়ে খাই, চমরীর দুধের মালাই। ব্রাহ্মণীহাঁসের রোষ্ট । এবারে পুজোয় যাওয়াটা পোস্টপন্ড কর! লেট আস প্ল্যান ফর এ প্লেজার অটাম ট্রিপ !” লক্ষ্মী বললে চিন্তিত হয়ে 

তাহলে আমাদের গন্ডোলা প্ল্যান? মা দুর্গা কেঁদেই ফেললেন ।

"মা তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব বলেছি যখন যাবই আমরা। আর গন্ডোলা চড়েই যাব। তবে কলকাতায় নয়। এবার অন্য কোথাও। "

কেতো বললে "সেখানে শিল্পীদের খুব সম্মান বুঝলি সরো? আমাদের মত আমাঅদমী পাত্তাই পাবেনা। 

তার ওপরে এবার শুরু হয়েছে বেঙ্গল পুজো লিগ (বিপিএল) এর হুজ্জুতি । "

-সেটা আবার কি রে ? লক্ষ্মী বলল।

-শোন্‌, ইংল্যান্ডের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। তার নকলে আমাদের হল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। যার ধাক্কায় ক্রিকেট প্লেয়াররা ক্রিকেট ভুলে গিয়ে ফ্যাশন মডেল ও টেলিভিশন ষ্টার হয়ে গেল। এখন ক্রিকেটের কাভার ড্রাইভের বদলে সেক্সি মন্দিরা বেদীর হল্টার বেশী পাত্তা পেল। কেতো বললে

-তার সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? সরো বললে। 

-শোন্‌ তবে, বলছি। প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেটারদের খাতির দেখে হকিওয়ালার করল হকিলিগ, ব্যাডমিন্টনে করল ব্যাডমিনটন লিগ। এরপর পেশাদারি ফুটবল লিগ ও কাবাডি লিগও হচ্ছে।

 -কিন্তু তার সাথে শারদীয় উৎসবের কি সম্পর্ক?

-এটাও বোঝোনা? কাগজ পড়োনা ? এখন আর পুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে হাত পা গুটিয়ে থুঁটো জগন্নাথ হয়ে পাঁচদিন অহোরাত্র বসে থাকলে চলবেনা। কমার্শিয়াল ব্রেকের ফাঁকে ফাঁকে হাত-পা ছুঁড়ে কিছু একটা তামাশা দেখাতে হবে। তবেই না দর্শকরা থুড়ি ভক্তরা আনন্দ পাবে আর পুজো এনজয় করবে। আর তবেই না প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফুটফল হবে। তবেইনা চ্যানেলের টিআরপি বাড়বে। আর তবেইনা স্পনসররা পয়সা ঢালবে আর তবেই না উদ্যোক্তারা সেই টাকায় মোচ্ছব করবে!

-তার মানে আমরা নিছক এনটারটেনার্?

-আজ্ঞে হ্যাঁমশাই। ঠিক যেমন খেলোয়াড়দের খেলায় পারদর্শিতার চেয়ে চিত্তবিনোদন করা বেশি জরুরী তেমনি আমাদেরো জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য, ভক্তির আর কোনো প্রয়োজন নেই। ওসব এখন অবসোলিট। আম আদমিকে খুশি করো, তাহলেই জুটে যাবে শারদশ্রী মার্কা একটা এওয়ার্ড।

-তাহলে আমাদের এখন কি করণীয় সেটা বল্‌।

-আমাদের তিন মহিলাকে বোল্ড এন্ড বিউটিফুল ড্রেস পরতে হবে। ঐসব আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির বেনরসী শাড়ি আর ব্লাউজ পরা চলবেনা। পারলে আইপিএলের চিয়ার লিডারদের মত উদ্ভিনযৌবনা হয়ে নাচতে ও নাচাতে হবে পাবলিককে। কেতো আর অসুরকে চুলবুল পান্ডে মার্কা ভায়োলেন্ট নাচ নাচতে হবে । পারলে মহিলা কনস্টেবলকে পাঁজাকোলা করে । লক্ষ্মী বলল।

গণশা বললে, "আমি বাপু নাচাকোঁদায় নেই।"

কেতো বললে, "ঠিক আছে, তোমাকে বীরাক্কেল কিম্বা হাস্যকবি সম্মেলনের মত কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে হবে। এই হল এবারের বিপিএল।"

-সো উই আর গোয়িং। দিস পুজো গন্না বি বিপিএল ! থ্রি চিয়ার্স ফর বিপিএল! হিপ হিপ হুররে! মাদুর্গার চার ছেলেপুলে মহা আনন্দে চীৎকার করে উঠল । এর সাথেই শুরু হয়ে গেল বেঙ্গল পুজো লীগ - এর প্রস্তুতি।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics