বৈশালীর সেই অমর প্রেমকাহিনী
বৈশালীর সেই অমর প্রেমকাহিনী
আজ যেখানে উত্তর বিহারের হাজিপুর, রাঘোপুর ,লালগঞ্জ, মজঃফরপুর ইত্যাদি নগর বিদ্যমান, যে অঞ্চলকে বলা হয় মিথিলা...
অতীতে ষোড়শ মহাজনপদের সময়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল-বজ্জি বা বৃজি প্রজাতন্ত্র, পৃথিবীর প্রথম বৃহৎ প্রজাতন্ত্র, গ্রীক সভ্যতারও অনেককাল আগের কথা। ভারতবর্ষ তখন সত্যিই ছিল এক পুণ্যভূমি। বলা হয়, এই বৃজি প্রজাতন্ত্রের প্রথম নৃপতির নাম ছিল নভাগা,যিনি ঈশ্বরকে সাক্ষী করে রাজমুকুট ত্যাগ করেছিলেন, যিনি বলতেন- রাজ্য জন্মভূমি। এই জন্মভূমির ওপর সকল সন্তানের সমানাধিকার থাকা উচিত। যাই হোক, রামায়ণের সময়ে এই বজ্জী প্রজাতন্ত্রের জনপ্রতিনিধি ছিলেন সুমতি, যিনি ছিলেন রাজা দশরথের সমসাময়িক। যিনি যোগ্যতা ও নানাবিধ গুণে অপরের অপেক্ষা বেশি পারঙ্গম হতেন,তাঁকেই প্রজারা রাজপ্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করত। বৌদ্ধ সংহিতা অঙ্গুত্তর নিয়ক আর জৈন গ্রন্থ ভগবতী সূত্র তেও এই বজ্জী প্রজাতন্ত্রের উল্লেগ পাওয়া যায়। চাণক্যও এই প্রজাতন্ত্রের কথা বলেছেন। বজ্জীর মধ্যে জনপ্রতিনিধিদের আটটা কুল (অষ্টকুল বা অট্টকুল) রাজত্ব করত,
এতো সুন্দর শাসনব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বৃজি প্রজাতন্ত্র যার সীমানা ছিল উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে গঙ্গা, পূর্বে কোশী এবং মহানন্দা থেকে পশ্চিমে গণ্ডকী নদী- সেই বৃজি প্রজাতন্ত্র পরে ভেঙে আটটা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় মহাবীরের জন্মের কিছু আগে, তাদের মধ্যেই একটা অংশ ছিল বৈশালী, যা পূর্বতন বৃজি প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ছিল। বৈশালীর এরূপ নামকরণের কারণ হল, বৈশালী নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা বিশাল।
এই বৈশালীর অধিবাসীদের বলা হত লিচ্ছবি, এই বৈশালীতেই ভগবান গৌতম বুদ্ধ 483 খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর মৃত্যুর আগে শেষ ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন। এই বৈশালীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে আমাদের কাহিনী। এই বৈশালী নগরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দরী রূপসী তথা খ্যাতনামা নগরবধূ আম্রপালি, যিনি পরে গৌতম বুদ্ধের মোক্ষ্যের মন্ত্রে দীক্ষিতা হয়ে পরিচিতা হন 'অরহান্ত্' হিসাবে।
এই আম্রপালির অপ্সরানিন্দিত সৌন্দর্যসুষমার সাথে আছে নানা বিচিত্র কাহিনী,শুনে মনে হবে যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা একের পর এক গল্প। সুস্তনী আম্রপালির রূপবহ্নি ও আঁখির কটাক্ষে মহানমন বলে এক জন সামন্ত এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ,যে তিনি তাঁর রাজত্ব আর অগাধ ধনসম্পদ ছেড়ে বৈশালীর অম্বর গ্রামের কাছে এক কুটীর নির্মাণ করে থাকতে শুরু করেন শুধু প্রিয়তমার একটু দেখা পাবার জন্য।
এই আম্রপালির রূপে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন বৈশালীর জনগণের নির্বাচিত শাসক মনুদেব। আম্রপালি তখন নৃত্যগুণ আর চৌষট্টি কলায় পারঙ্গিত। নৃত্যরতা আম্রপালির দেহবল্লরীর অপূর্ব চঞ্চলতা দেখে কামাগ্নি জ্বলে উঠেছিল মনুদেবের মনে এবং তিনি ছক কষে ছিলেন এই অপ্সরানিন্দিত দেহকে ভোগ করার। তখন আম্রপালির প্রণয়প্রার্থী ছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষ পুষ্পকুমার। যে রাত্রিতে আম্রপালীর সাথে পরিণয় হবার কথা ছিল প্রণয়ী পুষ্পকুমারের, সেই রাত্রিতে রাজষড়যন্ত্রে মৃত্যুর আঁধার নেমে এল পুষ্পকুমারের জীবনে, আর আম্রপালিকে রাজা ও কিছু স্তাবকবৃন্দ দ্বারা ঘোষণা করা হল 'নগরবধূ' হিসাবে, যিনি নগরের প্রত্যেক পুরুষের স্বপ্নের সহচরী হয়ে উঠবেন। এরপর আম্রপালির জীবনে কোনোরূপ হতাশা নেমে আসেনি, বরং সস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল রূপের ছটা। রূপের মদিরা এবং নয়নবহ্নির উদগ্র কামনায় আম্রপালির কাছে ম্লান হয়ে যেত স্বর্গের উর্বশী, রম্ভা, মেনকারাও। রাজা মনুদেবের সঙ্গিনী হয়ে আম্রপালি হয়ে উঠলেন রাজনর্তকী। সন্ধ্যাকালে আগে যখন সান্ধ্যপূজা করতেন মনুদেব, সেই সময় রাজপ্রাসাদে শোনা যেতে লাগল মৃদঙ্গ মন্দিরা ও নুপূরের সম্মিলিত ঝঙ্কার। নৃত্যপটিয়সী কোকিলকন্ঠিনী এই নারী হয়ে উঠলেন বৈশালী জনপদ কল্যানী।
ফুলের সুগন্ধ কোনোদিন চাপা থাকে না। এই আম্রপালির অতুলনীয় সৌন্দর্যের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল প্রজাতন্ত্র বৈশালী থেকে দক্ষিণের মগধে। আগে অত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে মগধের খ্যাতি ক্রমবৃদ্ধিমান। এই মগধের রাজধানী গিরিব্রজ (পরবর্তীকালে নাম হবে রাজগৃহ,বর্তমানে রাজগির), যা চতুর্দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা,অতি সুরক্ষিত। এই গিরিব্রজভূমির একজন ছিলেন যিনি দীপলক্ষ্মী আম্রপালির রূপের যশের সাথে ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু আম্রপালির চরিত্রের একটি দিকের সাথে তিনি তখনো পূর্ণরূপে পরিচিত হতে পারেন নি। বৈশালীর শাসকগণ ও অভিজাতশ্রেণী অপেক্ষা আম্রপালি কম সম্পদশালিনী ছিলেন না, আম্রপালীর অট্টালিকায় রত্নখচিত জ্যোতি, পুষ্পের সুগন্ধ, নুপূরের নিক্কন ধ্বনি স্বর্গের অলকাপুরীকেও হার মানাত। এছাড়াও ছিল সারি সারি সাজানো প্রদীপালোকের ঔজ্জ্বল্য।
গোধুলির রক্তিম আভা তখনোও সম্পূর্ণভাবে মুছে যায় নি। জনপদকল্যানী আম্রপালির অট্টালিকার সামনে দাঁড়ালেন এক তেজোদীপ্ত পুরুষ। ললাটে তাঁর পরিষ্কার রাজচিহ্ন। সর্বাঙ্গে বলদৃপ্ত পৌরুষ আত্মঘোষণা করছেন। আজ যেন অমরাবতী থেকে স্বয়ং নেমে এসেছেন পুরন্দর, অত্যন্ত রূপবান এই রাজপুরুষকে দেখে স্বয়ং স্বর্গের উর্বশীও যেন মোহিত হয়, আজ নিদাঘের সূচনায় গোধূলির এই রক্তিম আভায় প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে বসন্তের দখিনা বাতাস আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বৈশালীর বুকে। অবশেষে বাকি নৃত্যগীতপারদর্শিনী সঙ্গিনীদের সরিয়ে অপরিচিত রাজপুরুষের সামনে এসে দাঁড়ালেন আম্রপালি। তেজোদীপ্ত বলগর্বিত রত্নখচিত পোষাক পরা নীলচক্ষু ও স্বর্ণখচিত কেশদামের অধিকারী রাজপুরুষও চাক্ষুষ করলেন বৈশালী জনপদ কল্যানীকে। স্বর্ণাভ ত্বক, চোখদুটি যেন নীলপদ্মযুগল, তীক্ষ্ণ নাসিকা, চিকন ভ্রু যুগল যেন ডানা মেলা পাখির মতো যা এখনিই উড়ে যাবে অসীম নীলিমায়, রক্তিম ওষ্ঠাধর, কম্বু গ্রীবা, পীনোন্নত বক্ষ, সর্বাঙ্গ সুন্দরী। অমরাবতীর অধরা মাধুরী যেষ রূপ পরিগ্রহ করে এসে দাঁড়িয়েছে সেই পুরুষের সম্মুখে। আম্রপালিও বিস্মিতা, আজ এ কোন্ অপরিচিত অতিথি এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর স্বপ্নকক্ষিকার সম্মুখে। অতিথিও যেন বিদ্ধ হয়েছে কামদেবের শরে, পদ্মলোচনা স্বর্গবাসিনী এই সুন্দরীর অনিন্দ্যসৌন্দর্য, মৃণাল বাহু ও পদ্মকোরকের ন্যায় করকমল দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এই সুন্দরী নিশ্চিত অপরূপ গুণসম্পন্না। ইনি মগধের সাধারণ নারীদের মতো নন, বরং যেন স্বর্গের পারিজাত। কালভুজঙ্গের মতো দীর্ঘ বেণী। যুবকও অত্যন্ত সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, দৃঢ় ললাট, স্বপ্নময় দুটি চোখ, নির্ভীক ভাবভঙ্গি। এই নারীর সৌন্দর্যপ্রভায় যুবকের মানসে বেজে উঠল হাজার নাম না জানা রাগরাগিণী, তাহলে এই কি সেই স্বর্গীয় অনুভূতি মাগধী কবিরা যাকে বলেন ভালোবাসা! কেই বা জানে, আর কেই বা বলতে পারে! একটা কথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আম্রপালি সামান্যা নর্তকী নন,বরং সত্যিই রাজরাজেশ্বরী। যুবক অপলকে চেয়ে থাকায় চন্দ্রমুখী আম্রপালির মুখমণ্ডল সিঁদুরের ন্যায় রাঙা হয়ে উঠল। মগধের এই যুবক যেমন নৃত্যগীত ভালো বোঝেন, তেমনই শিল্পের মর্যাদা দিতেও জানেন। কিন্তু এখানে তিনি এসেছেন সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে, এখন দেখা দরকার কুলদেবতার কৃপায় তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় কিনা। পরলোকগত নিজের পিতার ক
াছে প্রতিজ্ঞা করেছেন পিতৃদেবের অপূর্ণ কাজকে পূর্ণ করবেন, আবার মগধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলবেন। সুতরাং,সুন্দরী রূপসীর প্রেমে হাবুডুবু খেলে তাঁকে হবে না! যুবককে দেখে আম্রপালির নীলোৎপল আঁখি প্রদীপের ন্যায় জ্বলে উঠেছে।
"দূর নগর থেকে এসেছি। আজ রাতে কি কোনো আশ্রয় হবে। শুনেছি বৈশালী শুধুমাত্র জনপদ নয়, এ এক মহামানবের তীর্থও বটে। কাল প্রাতে বৈশালীর পরিভ্রমণ করবার ইচ্ছা রয়েছে মনে।" মৃদুস্বরে বলে উঠলেন নবযুবক।
"কোথা থেকে এসেছেন জানতে পারি কি!" মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন আম্রপালি। আহা, স্বর তো নয়,যেন বীণার ঝংকার। এমনিই যুবক নিজেও বীণা খুব ভালো বাজান, এবং বীণা বাদনরত অবস্থাতে তাঁর মনে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি ফুটে ওঠে। একমাত্র সঙ্গীতই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম।
সখীপরিবৃত আম্রপালির এই অপ্সরানিন্দিত কন্ঠে তাঁর বুকে বাজতে শুরু করেছে জলতরঙ্গ। তবুও, নিজের মধ্যে জেগে ওঠা অনির্বচনীয় দুরন্ত অনুভূতিকে যথাসম্ভব দমন করে জলদগম্ভীর স্বরে উত্তর করলেন,"গিরিব্রজ।"
"আপনি অপরিচিত ব্যক্তি, কিন্তু অতিথিও বটে। অতিথি মানেই অভ্যর্থনার যোগ্য। দাসীর গৃহে প্রভুকে আসতে আজ্ঞা হোক।" গভীর চোখে এক অভূতপূর্ব রহস্যময়তা নিয়ে খিলখিল স্বরে হেসে উঠলেন বৈশালীর রাজনটী।
যুবকও আম্রপালির দুরন্ত শরীরী আবেদন আর উপেক্ষা করতে পারছিলেন না। আম্রপালির আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রবেশিলেন স্বপ্নকক্ষিকায়।
"তুমি তো শুনেছি, নৃত্যে পটীয়সী। সারা পূর্ব ভারতে তোমার খ্যাতি। আর কিছু জানো,আর কিছু জানা আছে কি!" যুবকেরও মনে হয়, হোক বা রাজনটী, এক গণিকা আর কিই বা জানবে!
"জানা আছে প্রভু, মা সরস্বতীর কৃপায় সঙ্গীতকলা নিয়েও সম্যক ধারণা আছে।আপনি যদি শুনতে চান শোনাতে পারি আপনাকে। দাসীকে অনুমতি দেবেন কি,শুনবেন কি সেই রাগ।" আম্রপালির গলায় আত্মবিশ্বাস।
যুবক চমৎকৃত হলেন। এক মুগ্ধতার আবেশ তাকে ঘিরে রইল। স্বচ্ছ শুভ্র বসনের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হচ্ছে আম্রপালির দুরন্ত যৌবন, দীপালোকে তা সুস্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে। কিন্তু তার আহ্বানে সাড়া দেওয়া হল না যুবকের। কিন্তু তাকে মুগ্ধ করল আম্রপালির মরালকন্ঠ।
তিনি নিজেও অপরূপ বীণা বাজাতে পারেন,সারা ভারতভূমে তাঁর মতো বীণাবাদক আর কেউ নাই। কিন্তু তিনিও অনুভব করলেন,তাঁর সম্মুখে এখন বীণাপাণি বাগদেবী মূর্তিমান হয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আর নিজের হৃদয়ের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না, তাঁর কন্ঠেও ধ্বনিত হল শাশ্বত প্রেমসঙ্গীত। এই যুগলের প্রেমসঙ্গীতে সারা স্বপ্নকক্ষিকাকে স্বর্গপুরীর ন্যায় মনে হতে লাগল।সঙ্গীতের রসে মগ্ন দুই মনের মধ্যে কেউ বুঝতে পারলেন না, কিকরে নিশা অতিবাহিত হয়ে গেল!
অবশেষে রাত্রি সমাপ্ত হল।পূর্বাকাশ রাঙিয়ে উঠলেন রক্তিম আদিত্যদেব। বিদায় নেবার সময় উপস্থিত। আবেগমুগ্ধ স্বরে বললেন যুবা,"সুন্দরী আমি অনেক দেখেছি,কিন্তু তোমার ন্যায় গুণসম্পন্না কাউকে দেখিনি। তুমি অনিন্দিতা,তুমি অনন্যা। " কিছুটা থেমে,কিছুক্ষণ ভেবে গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন,"আমি তোমার পদকমলেরও যোগ্য নই। কিন্তু তাও মনে কিছু রয়েছে কিছু আশা। করবে তুমি এই অধমের পাণিগ্রহণ,আমি চাই তোমার আগমনের সাথে সাথে গিরিব্রজে নেমে আসুক অকাল বসন্ত।" কিছুটা ভাবলেন সুন্দরী,ঠোঁটে মৃদু হাসি,তিনি ভালোবাসেন তাঁর নগরী বৈশালীকে,নগর তাঁকে যতোভাবেই প্রতারিত করুক না কেন,বৈশালী তাঁর কাছে মাতৃভূমি। তিনি শুধু রাজনটী নন,বৈশালী জনপদ কল্যানী। না আজ তাঁকে করতেই হবে অসাধ্য সাধন,রক্ষা করতে হবে তাঁর বৈশালীকে।
মৃদু হেসে বললেন আম্রপালি,"হে হর্য্যঙ্ককুলতিলক, আমার কাছে অবিদিত নয় আপনার গুণ। আমার কাছে অবিদিত নয় আপনার এখানে আসার উদ্দেশ্য। আপনি তো জানেনই,আমি বৈশালীর রাজলক্ষ্মী,(তখন নগরবধূদের এরকমই সম্মান ও জনপ্রিয়তা ছিল)। এই নগরীর হিতের জন্য রাজার থেকে আমার দায় কোনো অংশে কম নয়। সুতরাং ,আমি বৈশালী ছেড়ে যেতে পারব না কখনোই। বৈশালীর জন্য মরতে হলেও রাজি আছি।"
নবযুবার অরুণআভায় আলোকিত মুখমণ্ডল ছেয়ে গেল ঘন তমিস্রায়। বিষয়টা নজর এড়াল না আম্রপালির। আম্রপালি বললেন,"আমি বৈশালীকে ছাড়তে যেমন পারি না,তেমনিই আমার অধিকার রয়েছে প্রেমিক নির্বাচন করার। হে মগধশিরোমণি,আমারও বহুকালের ইচ্ছা আপনাকে প্রেমিক হিসাবে পাওয়ার। এখন সেই ইচ্ছা পূরণ হতে পারে একটাই শর্তে। ইচ্ছা হলে শ্রবণ করুন।"
অশ্রুসজল দীর্ঘ চক্ষু আর বিষাদবাষ্পে ভারাক্রান্ত কন্ঠে যুবক বললেন,"হে সুন্দরী,তোমাকে পাবার জন্য সবকিছু করতে রাজি আছি। স্বপ্ন দেখেছিলাম ,তুমি মগধলক্ষ্মী হবে। কিন্তু সেই আশার এখন সলিল সমাধি ঘটেছে। হে সুগায়িকা,হে মাধুরী,ব্যক্ত কর তোমার ইচ্ছা।"
আম্রপালির কন্ঠে ধ্বনিত হল,"হে মহান রাজা বিম্বিসার,আমার প্রেমিক তুমি একটা শর্তেই হতে পার,যদি তুমি বৈশালী জয়ের আশা পরিত্যাগ কর। আর নগর সংলগ্ন আম্রকুঞ্জে লুক্কায়িত মগধ সেনাদের আজই স্বদেশ পাঠিয়ে দাও। " এই কথাতে বজ্রাহত হলেন মগধের শ্রেনীক,তাঁর মতো নৃপতিকে কোনো নগরবধূ এই কথা শোনাতে পারে! এতোটা সাহস কারোর থাকতে পারে! আর কোথায় না মগধের মতো শক্তিশালী জনপদের পাটরাণী হবে,তা না। নিজের ক্ষুদ্র মাতৃভূমির প্রতি এত চিন্তা,তাকে এত ভালোবাসা- এই ঘটনা তো সমসাময়িক রাজাদের চরিত্রেও বিদ্যমান নেই।
একে একজন সাধারণ নগরবধূ বলে ভাববার জন্য ধিক্কার জানালেন নিজেকে,তাঁর সম্মুখের এই নারী সত্যিই অনন্যা,তাঁর রাজমহিষী না হোক,প্রিয়তমা হবার যোগ্যা বটে। প্রাণাধিকার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন বিম্বিসার,"হে তন্বী,তোমার নির্মম অনুরোধ স্বীকার করলে মগধের জনগণ আমাকে ভীরু বলবে। বৈশালীর জনসাধারণ আমায় নিয়ে উপহাস করবে। তবে আমি জানি তুমি সঠিক কথাই বলেছ। যুদ্ধে তো ধ্বংস ছাড়া কিছুই হয় না,যুদ্ধ কখনোও চিরস্থায়ী সমাধান হতে পারে না। "
থামলেন নৃপতি। তাঁর দিকে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে আছেন তাঁর প্রাণাধিকা। "হে সুন্দরী,আজ তোমার সঙ্গীত আমায় শুনিয়েছে শাশ্বত শান্তির বাণী। যতদিন বাঁচব,তোমার প্রেমের এই অমৃত নিয়েই বেঁচে থাকব।এই মণিমাণিক্যের ঔজ্জ্বল্যের কাছে শত শত হীরকও ম্লান হয়ে যায়। তবে সেনারাও সন্তানের মতো। আমি আজ প্রাতেই সেনাদের নিয়ে বৈশালী পরিত্যাগ করব। বিদায়ের অনুমতি দাও।" থামলেন বিম্বিসার।
তাঁর প্রাণাধিকার চোখ দিয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে মুক্তার ন্যায় অশ্রুবিন্দু। আজ পর্যন্ত কতো পুরুষ তিনি দেখেছেন,কতো পুরুষ তাঁকে ভোগ করেছে,তাঁর দেহকে দলিত মথিত করেছে,তিনি পরিচিত হয়েছেন মনুদেবের উদগ্র লালসার সাথে। তবুও কেউ তাঁকে এইরূপ প্রেমের কথা বলেন নি। দেহকে না ছুঁয়েও যে ভালোবাসা যায়,প্রেম মানে যে ভোগ নয়,প্রেম মানে ত্যাগ- এগুলো কোনো পুরুষের মুখে তিনি প্রথম শ্রবণ করছেন।
তাঁর বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু ত্যাগ তাঁকেও করতে হবে। গদগদ স্বরে বলে উঠলেন,"অনুমতি দিলাম।"
এই সেই আম্রপালি,যিনি আরোও কিছু বর্ষ পরে ভগবান বুদ্ধের সান্নিধ্য পেয়ে মোক্ষ্যের পথে যাত্রা করবেন। জাতকের কাহিনী সুরভিত হয়ে উঠবে তাঁর নামে।