Keya Chatterjee

Romance

3  

Keya Chatterjee

Romance

বাঁশিওয়ালা

বাঁশিওয়ালা

5 mins
881


" নাইন্টি টু পার্সেন্ট! থার্ড?" 

মা এর মুখ দেখে আদি বুঝল এটাই যথেষ্ট নয়। আরো চাই। ক্লাস সেভেন থেকে নিজের সাথে লড়াই চালিয়ে এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে আদি। রানাঘাটে থাকতো ওরা, ওখানকার এক নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। বাবার বদলি হওয়ার পর কলকাতা এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় সে। কিন্তু নতুন স্কুলটায় কোথায় যেন আন্তরিকতার অভাব। বিশেষত সে মফস্বলের ছেলে জেনে একদল ছেলে তাকে একটু এড়িয়েই চলতো। মা মিশে যায় নতুন বান্ধবীদের দলে। বাবা সারাদিনই অফিস নিয়ে ব্যস্ত। আদি একটু একাই হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ত রানাঘাটের বাড়ি, দুর্গাবাড়ি, মাঠ, পুকুর, স্কুল, বন্ধুদের। মায়ের উচ্চাকাঙ্খা দিন দিন বাড়তে থাকে। বন্ধুদের এইট্টি পার্সেন্ট, নাইন্টি পার্সেন্টের গল্পে তার চেষ্টা করে পাওয়া সেভেন্টি পার্সেন্ট কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে। তবু সবকিছু ভুলে নিজেকে মায়ের চোখে, বন্ধুদের চোখে, তাদের মায়েদের চোখে, বাবার অফিস কলিগদের চোখে বেস্ট বানানোর লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। আজ ক্লাস নাইনের ফাইনাল রেসাল্ট বেরোনোর পরেও মায়ের মুখে সেই খুশিটা দেখতে না পেয়ে কোনো কথা না বলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে আদি। মা বেশ কয়েকবার ডেকে গেলেও "পড়ছি" বলে কাটিয়ে দিয়েছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার। জানলায় মাথা রেখে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা গাড়ি দেখতে দেখতে কখন যেন চোখটা বুজে আসে।

 ঘুম ভাঙে একটা সুন্দর শব্দে। সোজা হয়ে বসে আরেকবার শুনল কান পেতে। হ্যাঁ, বাঁশির সুর। খুব সুন্দর। যেন দূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এল আদি। ঘরটা ফাঁকা। বাঁশির সুরটা তাকে যেন ডাকছে। যেন বহুদূর থেকে। তরতরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এসে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলো সে। একটু এগিয়েই দেখতে পেল ভিড়।

সবাই তার বয়সী বা তার থেকে বড় বা ছোট। সকলে সারিবদ্ধ ভাবে চলেছে। যেন সম্মোহিত হয়ে চলেছে সকলে। আদি চেয়ে দেখল এদের মধ্যে অনেকেই তার চেনা। তার স্কুলের বন্ধু, ক্লাসের ফার্স্ট বয়, স্পোর্টস এ প্রথম হওয়া ছেলেটা, পাশের বাড়ির খুব সুন্দর গান গাওয়া মেয়েটা। তারা সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলেছে যেদিক থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুরেলা ধ্বনি। আদি নিজেও যেন কিছুটা সম্মোহিত হয়ে পড়ল। কোথায় চলেছে তারা, কেউ জানেনা। 

 কিছুক্ষন পর ভিড়ের অভিমুখটা পাল্টে গেল। আদি দেখল ধীরে ধীরে তারা প্রবেশ করছে একটা বাগানে। খুব সুন্দর বাগান। চারিদিকে গাছ-গাছালিতে ভর্তি। পাখির কিচিরমিচির, ফুলের গন্ধ, ঝর্নার ঝরঝর কলতান, প্রজাপতির পাখার রং ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাগানময়। নরম সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে পরে আদি এই ভালোলাগাটা উপভোগ করতে লাগল। কতদিন ঘুরতে যাওয়া হয়নি তিনজন মিলে, কতদিন সমুদ্র দেখেনি সে। বই থেকে মাথা তুলে কতদিন আকাশ দেখা হয়নি।

কিন্তু কোথায় গেল সেই বাঁশিওয়ালা? কথাটা মনে পড়তেই উঠে পড়ল আদি। চারিদিকে ছেলেমেয়েরা খেলা করছে। ফার্স্ট বয় ক্রিকেট খেলছে, গান গাওয়া মেয়েটা বেশ করে ঝর্নার জলে ভিজছে, শান্ত মেয়েটা ভীষণ দস্যি হয়ে গাছের ডালে দোল খাচ্ছে, অংকে তুখোড় মেয়েটাও বসেছে ক্যানভাসে রং ভরতে। আদির চোখ ঘুরতে ঘুরতে আটকে গেল একটা উঁচু টিলার ওপর। ওই তো লোকটা। আরো কাছে যেতেই স্পষ্ট হলো চেহারাটা। মাথায় একটা গামছা বাঁধা, কোঁকড়া চুলগুলো তারই ফাঁক থেকে দেখা যাচ্ছে, গায়ের রং একটু চাপা যেন রৌদ্রে ঘুরে ঘুরে পুড়ে গেছে চামড়া, বসে আছে তবু বোঝা যাচ্ছে লোকটা বেশ লম্বা, চওড়া কাঁধ, ফতুয়া পরা, বাঁশি বাজাচ্ছে। আদি কাছে যেতেই তার দিকে ঘুরে তাকালো সে। হাসিটা ভারী মিষ্টি, যেন কোনো চিন্তা নেই, কোনো দুঃখ নেই জীবনে। চোখ দুটো উজ্জ্বল, পৃথিবীর সব ভালো, সব সুন্দরের স্বপ্ন দেখায়। আদি যেন কোথায় হারিয়ে গেল। লোকটা বলল, "কেমন লাগছে জায়গাটা আদি?" আদি চমকে উঠে বলল, "আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?" লোকটা হেসে বলল, "আমি তোমাদের সক্কলের নাম জানি। তোমাদের সকলের মনের গোপন ইচ্ছে জানি। তোমাদের সবার লুকোনো দুঃখও জানি।" আদি অবাক হয়ে বলল, "কিভাবে?" লোকটি আঙুলগুলো ঘুড়িয়ে বলল, "ম্যাজিক!"

তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ মাঠটার দিকে দেখিয়ে বলল, "এই যে এখানে এতো ছেলে মেয়েদের দেখছ এরা সকলেই কিছু না কিছুতে ভালো। কেউ গান গাইতে পারে কিন্তু অংক পারেনা, কেউ অংক পারে কিন্তু ইংলিশ বলতে গেলে হোঁচট খায়, কেউ আবার দুটোই পারে কিন্তু পড়ার চাপে আঁকতে ইচ্ছে করলেও পারে না। শুধু তুমি তোমার বাবা মায়ের ইচ্ছেপূরণ করতে দৌড়াচ্ছ না, এরা প্রত্যেকে দৌড়োচ্ছে। আজীবন দৌড়ে যাবে তোমরা একটা মিথ্যে সফলতার আশায়। ওই মেয়েটার মতো মার্কস, ওই ছেলেটার মতো স্পোর্টসে ফার্স্ট না হতে পারলে লোকে কি বলবে, এই ধারণাটা একদিন তোমাদের কারুর জীবনে কোনো ছাপ ফেলবে না। তুমি সফল তখনই হবে যখন তুমি মন থেকে খুশি হবে।" আদি প্রশ্ন করল, "তাহলে কি আমরা পড়াশুনা কমিয়ে দেবো বাঁশিওয়ালা?" বাঁশিওয়ালা মাথা নেড়ে বলল, "না, তা কেন? পড়বে। না পড়লে এই জগৎটাকে চিনবে কি করে?"

আদি বলল, "তাহলে?" বাঁশিওয়ালা আবার বসে পরে বলল, "তাহলে? নিজেকে কষ্ট না দিয়ে, নিজের ইচ্ছেগুলোকে দমিয়ে না রেখে পড়ো। শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, বিশ্বকে জানার জন্য পড়ো। বইয়ের জ্ঞানের বাইরে দেখো জীবনের জ্ঞান ছড়িয়ে আছে। দেখবে কতো ভাল লাগছে।" তারপর আদির দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার যে গল্প খবরের কাগজে ছেপেছে বলেছ বাড়িতে?" আদি চোখ গোলগোল করে বলল, "তুমি কি করে জানলে?" বাঁশিওয়ালা আবার আঙুল নেড়ে বলল, "ম্যাজিক!"

তারপর আবার মন দিল বাঁশির সুরে। সে সুর আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। হঠাৎ বাগানের দরজায় কে যেন দুমদুম করে আঘাত করতে লাগলো। সে আঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করলো। জোরে আরো জোরে। ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল আদি। এতক্ষন কি তবে স্বপ্ন দেখছিল সে? তার ঘরের দরজায় মুহূর্মুহু ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। সে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিয়ে দেখল সামনে মা বাবা দাঁড়িয়ে, বিধ্বস্ত অবস্থা। মায়ের চোখ মুখ কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে। বাবার চুল উস্কোখুস্কো। ফ্লাটের অনেকেই এসে পড়েছেন। এতক্ষন দরজা বন্ধ দেখে আর সাড়া না পেয়ে তারা খুব ভয় পেয়ে গেছে বুঝল আদি। কিন্তু কেউই কিছু বলল না। আদির বাবা এগিয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের কাছে কিছুক্ষন। তারপর বললেন, "ঘুমিয়ে পড়েছিলি? " আদি মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। ফ্লাটের একজন কাকু একটা কাগজ হাতে এগিয়ে এসে বললেন,"দেখো পার্থ তোমার ছেলে কতো গুণী। কাগজে ওর গল্প বেরিয়েছে। প্রথমে তো বুঝিনি এই আদিত্যই আমাদের আদি তারপর স্কুলের নাম দেখে চিনলাম।

আদি বাবা মায়ের মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো, এখুনি হয়তো বলবে “পড়ায় ফাঁকি দিয়ে এসব করেছিস। সেই জন্যই থার্ড হলি। নাহলে সেকেন্ড হতে পারতি।” কিন্তু আদিকে অবাক করে তার বাবা মাএর মুখে ফুটে উঠল আনন্দের জ্যোতি। তারা তড়িঘড়ি কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো। আদি ধীরে ধীরে জানলার কাছে গেল। সাততলা বিল্ডিংএর এই জানলা থেকে প্রায় গোটা শহরটা দেখা যায়। জানলার কাচে ফুটে উঠেছে আদির ছবি, ঠিক যেন সেই বাঁশিওয়ালার মতোই দেখতে আদিকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance