বাজি-তৃতীয় কিস্তি
বাজি-তৃতীয় কিস্তি


মার্চ,২০০৯
(৭)
“বাহ্! এতো দিন পর এলাম তাও মুখ ঘুরিয়ে থাকবে?”
“আমার ভালো লাগছে না কিছু।”
“কেন ম্যাডাম?”
“জানো আজ কলেজের সামনে আবার ওই প্রত্যুষ এসেছিল…”
আমার চোয়ালটা নিজের অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠলো, “কি বললো?”
“তুমি ভাবতে পারবে না আজ কি বলেছে আমাকে…”
“কি?”
“ও বললো… বললো যে… ধুরর বাদ দাও। তুমি শুনলে কষ্ট পাবে।”
“আরে বলোই না। কষ্ট পাবোনা কথা দিচ্ছি, বলো।”
“জানো তো, ও না বলছিলো তুমি নাকি আমাকে নিয়ে ওর সাথে কিসব বাজি ধরে দুহাজার টাকা নিয়ে ছিলে ওর থেকে। তুমি নাকি আমাকে ভালোবাসো না!
আরেহ!ওরকম মুখটা করছো কেন?আমি ওর কথা কিন্তু বিশ্বাস করিনি। সত্যি বলছি তোমাকে ছাড়া আমি ওদের কাউকে বিশ্বাস করিনা।”
সহসাই আমার বুকে মাথা রাখলো রেনেসাঁ। কোনোদিনও এরকম করেনা, আমি যদি কোনোদিনও একটু কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি দূরে সরে পালায় কিন্তু আজ… বোধহয় ওর বিশ্বাসের গভীরতাটা বোঝাবার জন্যই আমার বুকে মাথা রাখলো। কিন্তু আমি পারলাম না ওকে জড়িয়ে ধরতে… পা গুলো অসম্ভব কাঁপছে, শরীরের ভেতরটায় যেন একটা দুর্দমনীয় ঝড় ওঠেছে… হাত দুটো শিথিল করে দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানেই। আমার নিস্পৃহতা দেখেই বোধহয় আমার বুকের ওপর থেকে মাথাটা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো রেনেসাঁ, ওর দুচোখ ভর্তি জল।
“এরকম করছো কেন? আমি সত্যিই ওর কথা বিশ্বাস করিনি।”
রেনেসাঁর কথা শুনে মনে হলো অপরাধটা যেন প্রত্যুষের নয়, ওর নিজের। হঠাৎ করে ওর নরম ঠোঁট দুটো আমার থুতনি স্পর্শ করলো। আর পারলাম না নিজেকে সামলাতে, শরীর জুড়ে এক অন্যরকম শিহরন সৃষ্টি হলো। দুই বাহু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে, মিশিয়ে ফেললাম ওর শরীরটাকে নিজের শরীরের সাথে।
ওর কাঁধের ওপর ডুবিয়ে রাখা আমার মাথাটা সোজা করতেই চোখ চলে গেল সামনের আয়নাটার দিকে। এ কাকে দেখছি আমি! মনে হলো যেন হুবহু আমারই মতন দেখতে একজন যার ক্যানাইন দুটো ঠোঁট ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, সে নিঃশব্দে রেনেসাঁর কাঁধ থেকে শুষে নিচ্ছে রক্ত, পাগলী মেয়েটা বুঝতেও পারছে না।
আচ্ছা আমি কি প্রত্যুষের থেকে কম জানোয়ার! আর কাকে কাকে এভাবে ঠকাব আমি!
অক্টোবর,২০০৯
(৮)
“আর কতদিন অপেক্ষা করবো? কবে দেখাবে তোমার কবিতার ডায়েরিটা?”
“সবুর করুন মশাই, সবুরে মেওয়া ফলে।”
“বুঝলাম। আমার বোনকে দেখাতে পারো কিন্তু আমাকে না, তাই তো?”
“আহা রাগ করছো কেন? দাঁড়াও অন্য একটা জিনিস দিচ্ছি তোমায়।”
“কি?”
“সবুর করুন।”
“হুম।”
“যদি আজ এই বেলা হারিয়ে যাই
সময়ের পথ বেয়ে খানিকটা পিছু হেঁটে দেখো
ধোঁয়া ধোঁয়া আবছায়া গলি পথ ধরে
তোমার নিঃশ্বাসের স্রোতে ভেসে চলা ধূলিকনার
মতো করে ছুটতে দেখবে আমায়।
অসময়ের বৃষ্টিটাকে কখনো মুঠোয় চুঁইয়ে দেখো
তোমার শরীর জুড়ে শীতল স্রোতের মতো
খেলা করতে দেখবে আমায়।
কালের ধারা বেয়ে
তোমার শত উচ্ছাস আর উন্মাদনার ভিড়ে
তোমার অবাক চোখের চাহনি দিয়ে
ইচ্ছের অগোচরে চেয়ে দেখো
তোমারই ঠোঁটের হাসিতে ঝরে পড়তে দেখবে আমায়।
কোনো নিস্তরঙ্গ দিন গুনে
সূর্যকে ধরে রাখা স্বচ্ছ শিশির বিন্দুর মতো
মনের আয়নায় উঁকি দিয়ে দেখো
তোমারই মাঝে খুঁজে পাবে আমায়,
তোমার অবিচল প্রতিশ্রুতির মতো
তোমারই পাশে ক্ষণে ক্ষণে
তোমার অস্তিত্বে মিশে যেতে দেখবে আমায়।"
"কি হলো গো? ভালো লাগেনি?”
“ওই…”
“হুম!”
“এরকম কবিতা কেন লিখেছো?”
“কিরকম?”
“তুমি আমাকে ছেড়ে কোথায় চলে যাবে?”
“কোত্থাওনা… হিঃ হিঃ…”
“হাসছো কেন?”
“ওই!”
“বলো।”
“তুমি কখনো আমায় ছেড়ে চলে যাবে না তো?”
আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার বুকে মাথা রাখতে রাখতে প্রশ্নটা করলো রেনেসাঁ।
“ধুরর পাগলী… আমার এই পাগলিটাকে ছেড়ে যে কোথাও শান্তি পাবোনা আমি।”
ওর থুতনিটা ধরে মুখটা আমার মুখের কাছে টানলাম। ওর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভীষণ ভাবে ডুবে যেতে ইচ্ছে করলো ওর মধ্যে। ওই কালো তিলটায় একটা আলতো করে চুমু দিয়ে নিজের ঠোঁট দুটো ডুবিয়ে দিলাম ওর ওই গোলাপি নরম ঠোঁটে। জীবনের প্রথম চুম্বনের অনুভূতিতে দুজনের শরীরটাই কেঁপে উঠছিলো মুহূর্তে মুহূর্তে। শেষে লজ্জায় ও আমার বুকে মুখ লুকালো। আমিও দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওর নরম শরীরটা। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ থাকার পর আমার বুকে মুখ গুঁজে রেখেই বললো,
“আজ একটা কথা বলবো তোমায়?”
“হুম।”
“তুমি না… তুমি না আমার আপোলো।”
“আপোলো!”
“উম।”
“ধুরর।”
এবার মুখটা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে অভিমানী গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ধুরর কেন?”
“আমি আপোলো হতে যাবো কেন?”
“কারণ তুমি আমার সব কবিতার অনুপ্রেরণা।”
“তাই? আর আমি আসার আগে কে ছিলো তোমার আপোলো?”
“তুমি না… কে আবার থাকবে? কেউ ছিলো না।” রাগত স্বরে কথা গুলো বললো রেনেসাঁ।
আমি হেসে বললাম, “তবে তখন কবিতা লিখতে কি করে?”
“ভালো লিখতে পারতাম আর কই! ডায়েরির পাতাতেই তো বন্দি থাকতো সেসব। তুমি আসার পর সব অনেক পাল্টে গেছে।”
“বুঝলাম পাগলী।একি চোখে জল কেন? কি হলো?”
“ওই!”
“হ্যাঁ বলো কি হলো?”
“তুমি কোথাও হারিয়ে যাবে না তো?”
“মানে?”
“জানো তো এমন অনেক উপন্যাস বা লেখকের জীবনী পড়েছি যেখানে তাদের প্রথম প্রেম তাদের কাছে ছিল তাদের মিউজ, কিন্তু সেই সব প্রেমই শুধু সৃষ্টির অনুপ্রেরণা দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে হারিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে ...আমি তোমাকে হারাতে চাইনা… হারাতে চাই না।”
“ধুস… তুমি সত্যিই একটা পাগলী। তোমার ইমাজিনেটিভ ফ্যাকাল্টি দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।”
“তুমি ইয়ার্কি করছো আমার সাথে?”
“নারে বাবা। আমি কোথাও যাচ্ছিনা।”
“তুমি চলে গেলে দেখবে আমি সত্যি সত্যি পাগলী হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।”
“চুপ।”
আবার নজর পড়লো দেয়ালের আয়নাটার দিকে, দেখতে পেলাম সেই নর পিশাচটার প্রতিচ্ছবি যে প্রতিনিয়ত রক্ত চুষে চলছে এই মেয়েটার। আতঙ্কে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম আমি; ছুটে বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে। পালাতে হবে আমায়, ওই পিশাচটাকে যে আমার বড় ভয়!
ক্রমশ...