Sayandipa সায়নদীপা

Drama Romance

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Drama Romance

বাজি - তৃতীয় কিস্তি - 2

বাজি - তৃতীয় কিস্তি - 2

5 mins
1.2K



 “একটা কথা বলবো রাগ করবিনা তো বাবু?”

“বলো না।”

“আমার সাথে একটা জায়গা যাবি এখন? একজনদের বাড়ি?”

“এই বাজারের ব্যাগ নিয়ে?”

“হ্যাঁ রে, কিছু হবেনা।”

“ধুরর, তুমি যাওনা। আমি ব্যাগগুলো নিয়ে বাড়ি যাই।”

“তুই চলনা। ওরা তোর কথা জিজ্ঞেস করে বারবার, তো আমি বলেছিলাম তুই এবার এলে আলাপ করিয়ে দেব।”

“কার সাথে আলাপ করাবে?”

“ওই যে আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছেন স্যান্যালে বাবুরা, ওনার স্ত্রী তোর খোঁজ নেন মাঝেমাঝেই।”

“ধুরর, আমি যাবোনা। এই সাত সকালে আবার লোকের বাড়ি যায় নাকি!”

“আমি তো বলছি কিছু হবে না, আয় না।”


   অগত্যা মায়ের সাথে যেতে হলো স্যান্যালদের বাড়ি। বাড়িটার সৌন্দর্য সত্যিই চোখে লাগার মতো, খুব রুচিশীল মানুষ না হলে এতো ছিমছাম ভাবে বাড়ি তৈরি সম্ভব নয়। বোন কাল বলছিলো বটে আজ নিজের চোখে দেখলাম।



  খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে মায়ের পেছন পেছন ঢুকলাম, দরজা খোলাই ছিলো। এক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন বসার ঘরে। মা কে দেখেই একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে এলেন, 

“আরে সাধনা দি, আসুন আসুন।” 

অনুমান করলাম ইনি নিশ্চয় ডাক্তার স্যান্যালের স্ত্রী। মা ঘরের ভেতর ঢুকে ব্যাগ থেকে একটা টিফিন কৌটো বের করে বললেন, “এই যে অনু তোমার জন্য গয়না বড়ি এনেছিলাম।”

“আরে দিদি আপনার মনে ছিল! কিন্তু আমাকে কবে গয়না বড়ি দেওয়া শেখাবেন বললেন না তো?


আরে এই ছেলেটি… এই কি সংকেত?”

“একদম ঠিক ধরেছ অনু, এই আমার ছেলে সংকেত। পরশু এসেছে আবার কাল চলে যাবে।”

“আরে আরে এসো ভেতরে এসো, বসো বসো। সংযুক্তার কাছে তোমার কথা খুব শুনি।”



  মিসেস স্যান্যালের আন্তরিকতায় ভীষণ অবাক হচ্ছিলাম। একজন ডাক্তারের স্ত্রী অথচ বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। কি সহজে আমাকে আপন করে নিলেন।  

“মা আমাকে খেতে দাও।” গলাটা শুনে চমকে তাকালাম সামনের দিকে, দরজা পার করে আমার চোখটা চলে গেল… একটা নীল সাদা রঙের চুড়িদার পরে মাঝারি উচ্চতার শ্যামলা বর্ণের একটা মেয়ে দাঁড়িয়েছে এসে। চেহারার মধ্যে কোনো চটকদারী সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র ছিলো না কিন্তু তাও কেন জানিনা ওর চোখ দুটোর দিকে তাকাতেই যেন হারিয়ে গেলাম মুহূর্তের জন্য। এড্রিনালিন সিক্রেশন শুরু হয়ে গেল আমার ভেতরে। ও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল আমার অবস্থা, কেমন লজ্জা পেয়ে মুখটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের মধ্যেই মুচকি হাসলো। তখনই খেয়াল করলাম ওর ঠোঁটের পাশে একটা কালো তিল… সাধারণের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়।



   বাড়ি ফিরতেই ধাক্কাটা খেলাম। দেখলাম বাবা বুকটা চেপে ধরে বসে আছেন মেঝেতে, ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। বোন অসহায়ের মতো বাবাকে ধরে সামলানোর চেষ্টা করছে। আমাদের দেখেই কেঁদে ফেললো।



  পরের দিন আর হোস্টেলে ফিরে যাওয়া হলো না। বাবাকে নিয়ে ছোটাছুটি চলতে থাকলো। ই সি জি করে ধরা পড়লো বাবার হার্ট ব্লকেজ। এখানের ডাক্তাররা বলে দিলেন কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। কলকাতা নিয়ে গিয়ে চললো অনেক টেস্ট, ছোটাছুটি। শেষে শুনলাম এনজিওগ্রাম করতে হবে আর সেটাতে কাজ না হলে এনজিওপ্লাস্টি। সামনে তারমানে বিশাল অংকের একটা খরচা। এনজিওগ্রাম করার জন্য নার্সিংহোম থেকে ডেট পাওয়া গেল একমাস পর। বাবাকে মেদিনীপুরে রেখে ফিরে এলাম হোস্টেলে। এখানে এসে শুনলাম সেমিস্টার ফিজ জমা করার জন্য নাকি নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। আমার বুকের ওপর কেউ যেন হাতুড়ি পিটতে লাগলো। কিভাবে চাইবো বাবাকে টাকা! আর বাবাই বা দেবেন কোথা থেকে! টেস্ট আর ওষুধ মিলে ইতিমধ্যেই একটা বিশাল পরিমান টাকা খরচ হয়ে গেছে, এরপর এনজিওগ্রাম তারপর আবার ওষুধ…



   বাথরুমে ঢুকে মাথা নিচু করে বেসিনের জল নিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা মারতে থাকলাম পাগলের মতো।



                      ৬



“আরে সংকেত দা আপনি?”



বাড়ি আসছিলাম হোস্টেল থেকে, পাড়ার মধ্যে ঢুকতেই অপরিচিত কন্ঠস্বরটা কানে বাজলো। সামনে তাকিয়ে দেখি রেনেসাঁ দাঁড়িয়ে। একটু হকচকিয়ে গেলাম বৈকি। যে মেয়ে কাউকে পাত্তা দেয়না সে আজ নিজে যেচে এসে কথা বলছে মাত্র একবারের আলাপে! মুখে একটা কৃত্রিম হাসি টেনে বললাম, 

“হ্যাঁ এই বাড়ি ফিরছিলাম আর কি…”

“আপনি তো এতো ঘনঘন বাড়ি আসেননা!” 


বাব্বা আমার সম্পর্কে এতো খোঁজও রাখে আবার! 

“আসলে বাবার শরীরটা… হোস্টেলে থেকে খুব চিন্তা হয় তাই এখন প্রতি উইকেন্ডেই আসছি।”

“ওহ আচ্ছা আচ্ছা। আমি কালই গিয়েছিলাম কাকুকে দেখতে, সংযুক্তাও তো এখন আর আমাদের বাড়ি যেতে পারেনা। বড্ড ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা।” 

এবার ভালো করে তাকালাম রেনেসাঁর চোখের দিকে, কথাগুলো বলতে বলতে ওর দৃষ্টিটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেল, যেন বোনের কষ্টটা ও নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারছে। আজও আবার ওর চোখের দিকে তাকাতেই আমি কেমন যেন হারিয়ে গেলাম। 



“কি হলো কি দেখছেন?” লজ্জা লজ্জা মুখ করে জিজ্ঞেস করলো রেনেসাঁ। আমিও অপ্রস্তুতে পড়ে গেলাম, ওর চোখ থেকে চট করে চোখটা সরিয়ে নিয়ে বললাম, “আমি আসছি এখন হ্যাঁ? টায়ার্ড আছি একটু।”

“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রাখলাম।”

“না না ঠিক আছে।”



   মনের মধ্যে কেমন একটা ভালোলাগার আবেশ নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম। কানে শুধু যেন বাজছে রেনেসাঁর বলা কথা গুলো, চোখের সামনে ভাসছে ওর দুটো চোখ আর ওই কালো তিলটা…



“আরে বাবু দেখে ঢোক দরজায় ধাক্কা খাবি যে!” বাবার কথা গুলো কানে যেতে স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। বাবা কেমন যেন হতাশ গলায় বললো, “প্রতি সপ্তাহে আসার কি দরকার! আমি তো ঠিক আছি। সামনে সেমিস্টার তোর, আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করলে পড়বি কি করে!” 

ভীষণ ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে ছুট্টে বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরি, দিয়ে বলি, “তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাওনা বাবা আমি আবার ঠিক মন দিয়ে পড়াশুনো করবো।” কিন্তু পারলাম না তা করতে, জিভটাও যেন জড়িয়ে এলো। কোনো মতে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছো বাবা?”



   বিকালবেলায় রেনেসাঁ এলো বোনের সাথে গল্প করতে। বোন তবে ভুল কিছু বলেনি, ওদের দুজনের মধ্যে সত্যি খুব ভাব। মায়ের সাথেও যেভাবে কথা বলছিল সে সব দেখে জিৎ, প্রত্যুষ দের বর্ণনা করা মিস ইউনিভার্স ইমেজের সাথে বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পেলাম না। 



   দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ওদের; বোনের হঠাৎ খেয়াল পড়লো আমাকে। “এই দাদাভাই ভেতরে আয় না রেনেসাঁ দির সাথে আলাপ করিয়ে দি।”

“আলাপ তো আমাদের আগেই হয়েছে।” লজ্জা লজ্জা মুখে বললো রেনেসাঁ। 

আচ্ছা লজ্জা পাওয়াটা কি ওর স্বভাব! নাকি আমাকে দেখলেই… এই যেমন ওকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর যে লাব ডুব শুরু হয় তার ফ্রিকোয়েন্সির সাথে বোধহয় দশটা ড্রাম পেটার ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করে যাবে। 

“ভেতরে আসুন না।” 

বাহ্ আমার ঘরে আমাকেই ইনভাইট করছে! গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বসলাম খাটের কোণে। কেমন যেন ভেবলে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, “কি পড়েন এখন?” কিন্তু গলার স্বরটা কেমন জড়িয়ে গেলো। 

“মাফ করবেন বুঝতে পারলাম না!”

গলাটা ঝেড়ে নিয়ে আবার প্রশ্নটা করলাম। ও হেসে উত্তর দিলো, “টাউন কলেজে বাংলায় অনার্স করছি, ফার্স্ট ইয়ার। আমি কিন্তু আপনার সব ডিটেইলস জানি, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ফোর্থ সেম, তাই তো?”

“আপনি তো সবই জেনে বসে আছেন দেখছি!”

“সংযুক্তার কাছেই শুনেছি সব। আপনি তো দারুন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, সেভাবে প্রাইভেট টিউশন না নিয়েও মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে এত্তো ভালো রেজাল্ট! আমি তো ভাবতেই পারিনা!”

“আমার মা বাবা ইন্সপায়ার না করলে এসব কিছুই হতো না।”

“তা ঠিক, তবে আপনার নিজের অধ্যবসায় না থাকলে সেটা কখনোই সম্ভব হতো না। সংযুক্তার কাছে আপনার কথা শুনে নিজেকে মোটিভেট করার চেষ্টা করি; আসলে জানেন তো আমি বড্ড ইয়ে… মানে একটুতেই ভেঙে পড়ি।”

“কবিদের একটু আধটু সেন্টিমেন্টাল তো হতেই হয় নয়তো কলমের ডগায় কবিতা আসবে না যে।”

“আপনি কি করে জানলেন!”

“ওই একই সোর্স, আপনার সংযুক্তা আর আমার আদরের বোন।”

“বাহ্ বাহ্ দারুন… তখন থেকে হাজার বার আমার নাম বলে যাচ্ছিস তোরা অথচ আমি মানুষটা যে সশরীরে হাজির এখানে সে কথা বেমালুম ভুলে গেলি!” কপট রাগ দেখিয়ে কথাগুলো বললো আমার বোন। তিনজনেই একসাথে হেসে উঠলাম।



   বোনের অনুরোধেই রেনেসাঁ আর আমার ‘আপনি’ সম্বোধনের পর্ব মিটলো, শুরু হলো ‘তুমি’ বলার যাত্রা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama