অত্যাচার আর মিথ্যাচার
অত্যাচার আর মিথ্যাচার
"ও বড়লোকের বিটি লো ! তা আর কতক্ষন পালঙ্কে শুয়ে থাকবেন শুনি ? এদিকে সূর্য যে মাথার উপরে উঠেছে ?" ...শাশুড়ি মিনার চিৎকার শুনে ধড়মড় করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে শম্পা । চোখ ভর্তি ক্লান্তি , ডার্ক সার্কেল আর উস্কোখুস্কো চুল ..পরনে একটা সস্তার সুতির শাড়ি । মেয়েটার নাম শম্পা , বয়স মাত্র কুড়ি বছর কিন্তু এখনই যেন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে মেয়েটা ।
বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়েক মাস তার মধ্যেই গোলগাল শম্পা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে । এবার তো বাপের বাড়ি গেলে সকলে মিলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একসা করেছিল , কিভাবে একটা গলুমলু মেয়ে যে ডায়েট , জিম করেও রোগা হতে পারছিল না , সে রোগা দড়ি হয়ে গেছে ? বিএ পড়তে পড়তে ভালো সমন্ধ পেলে মা বাবা বিয়ে দিয়েছিল মেয়ের । পাত্রপক্ষ কথা দিয়েছিল যে শম্পা বাকি পড়াশোনা শশুড় বাড়ি থেকে করবে । পড়াশোনার পাঠ তো কবেই চুকে বুকে গেছে তার এখন তো দিনরাতের হিসাব নেই , সারাদিন কেটে যায় কাজ করতে করতে
। স্বামী নরেন ইঞ্জিনিয়ার আর কর্মসূত্রে সে আপাতত কয়েকমাস বিদেশে পাড়ি দিয়েছে । বিয়ের পর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দিন কাটিয়ে নরেন চলে যায় সুইজারল্যান্ডে । শম্পা রয়ে যায় শশুড় শাশুড়ির সঙ্গে , নরেন নাকি কিছুদিন পর ফিরে আসবে ভদ্রেশর । শাশুড়ি মিনা ভীষন জাঁদরেল মহিলা । ভোর রাতে উঠতে হয় শম্পাকে তারপর তিনতলা বাড়ির প্রতিটা কোনা কোনা মুছতে হয় । বাড়িতে জলের কল থাকতেও কুয়ো তলাতে কুয়ো থেকে জল তুলে বাসন মেজে , কাপড় চোপড় কেচে মিলে ফেলতে হয় । মিনা রোজ ভোর রাতে ওকে ডেকে দেন তারপর শুয়ে পড়েন । ঘুম থেকে উঠে উনি বাসী ঘরবাড়ি দেখতে নাকি একদম পছন্দ করেননা । বেলা নয়টা সময় যখন শাশুড়ি ঘুম থেকে ওঠেন ততক্ষণে শম্পা পুজো সেরে রান্নাঘরে ঢুকে যায় । রান্না সেরে তবে দুটো খেতে পাবে সে । মিনা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন এখন শম্পার কত সুখ ! বাড়িতেই জল , বাথরুম , রান্নাঘরে গ্যাস । ওনার সময় পুকুরে গিয়ে বাসন মজা , কাচাকুচি করতে হত । উনুনে রান্না করতে হত ওনাকে । এখন তিনতলা বাড়ি , সব সুখ শম্পা ভোগ করছে । বিয়ের পর শম্পা দেখেছে এবাড়িতে কাজের আর রান্নার লোক ছিল । তখন তারা কলের জল নিয়েই কাজ করত । দুবেলা এই তিনতলা বাড়ি কাজের লোক মুছত না , একবার সকালে মোছা হত । আর নরেন চলে যাবার পর পরই মিনা কাজের আর রান্নার লোককে ছাটাই করে দিয়েছেন ।
তারপর শম্পাকে দিয়ে এই প্রাসাদপম বাড়িকে দুবেলা মোছা তো করান উপরন্ত রোজ রোজ ছাদ পর্যন্ত ন্যতা বালতি নিয়ে মুছতে হয় শম্পাকে । জ্যৈষ্ঠ মাসের ভর দুপুরে গনগনে সূর্য আর শম্পা ছাদ মুছে নেমে আসে সিঁড়ি মুছতে মুছতে । পায়ে , হাতে তার হাজা , নখে নখকুনি । কোন রকমের জামাকাপড় পড়তে অনুমতি নেই তার শুধুমাত্র শাড়ি ছাড়া । খেতে ও সে পায়না যতক্ষন না শাশুড়ি বেড়ে দেবে । আর উনি শম্পাকে খেতে দিতে হলেই যত কিপ্টেমি দেখান । সকালে শুকনো মুড়ি আর লিকার চা , দুপুরে দুটো ভাত আবার সেই রাতের বেলা সকালের বেঁচে যাওয়া ভাত । শম্পা খিদে নিয়ে তাই খায় আর নীরবে চোখ মোছে । মনে পড়ে যায় এই শম্পা খাবার নিয়ে কত বায়নাই না করত । মা কোনদিন মোগলাই , কোনদিন চাইনীজ বানিয়ে কত অনুরোধ করত যাতে শম্পা খেয়ে নেয় কিন্তু শম্পা নানান ভাবে মাকে উত্যক্ত করত খাওয়া নিয়ে । বাবাকে ক্রিম , সাজসজ্জা , পকেট মানি নিয়ে বায়না করা মেয়েটা আজ দুটো ভাতের জন্য লোকের মুখাপেক্ষী । রাতের বেলা নিজের হাতে রুটি বানিয়েও খেতে পায়না শম্পা । সবসময় বেঁচে যাওয়া খাবার তার জন্য বরাদ্দ । তারপরেও সে মুখ বুজে সহ্য করছিল কারণ মনে আশা নরেন ফিরে এলেই তার এই নরক যন্ত্রনা শেষ হবে । নরেনের মা মিনা একদম কেঁচো নরেনের কাছে । ফোনে যোগাযোগ করতে পায়না শম্পা নরেনের সঙ্গে । কথা হলেও মিনার সামনেই বলতে হয় । নিজেকে খুব দুর্বল লাগে শম্পার , ঘুম আসে সবসময়ই । চোখে জল নিয়ে বারবার মনে মনে মা বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের অতীতের আচরণের জন্য । ও চাইলে মা বাবাকে বলে এখান থেকে চলে যেতেই পারত কিন্তু আর নতুন করে বাবা মাকে চিন্তা দিতে ভালো লাগে না ।
শশুড় মশাই মানুষটা খারাপ নয় তবে দজ্জাল স্ত্রীর উপরে কথা বলার সামর্থ ওনার নেই । এভাবে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে এসেছে তখনই ঠাকুর মুখ তুলে চান শম্পার দিকে । নরেন কাউকে না বলে কয়ে একদিন এসে হাজির । দুপুরে শম্পা তখন ছাদ মুছে সিঁড়ি মুছতে মুছতে নেমে আসছে । নরেন এসে শম্পার চেহারা দেখে অবাক ! তবে এই কারণেই কোনদিন ভিডিও কলে দেখা দেয়নি শম্পা । শুধুই বলত এসে দেখবে । নরেন নিজের মাকে খুব ভালো করেই চেনে , ফোনে বাবার ইঙ্গিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া কথা শুনে সন্দেহ হয়েছে নরেনের । তবে মা যে শম্পার এই হাল করবে সে সত্যি ভাবেনি । নরেনের উপরে কোনদিন তার মা মিনা ছড়ি ঘোরাতে পারেনি কারণ সেও ওনারই পেটের সন্তান । নরেনের সঙ্গে পেরে ওঠার ক্ষমতা ওনার নেই । মিনাকে নরেন সোজাসুজি চার্জ করলে উনি ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যাপারটা ঢাকার চেষ্টা করেন । শম্পা ও নিজের কাঁধে তুলে নেয় তার এই হাল হওয়ার দায় । সেবারের মত শম্পার জন্য ওর শাশুড়ি মিনা বেঁচে যান না হলে উনি জানতেন ছেলেকে বৌমা সব বলে দিলে ছেলে এক মুহূর্ত নেবে না এবাড়ি থেকে বউ নিয়ে বেরিয়ে যেতে । রাতের বেলা শম্পা কে নরেন জিজ্ঞাসা করে সে কেন মাকে বাঁচালো ? শম্পা ফুঁপিয়ে ওঠে , বলে তার মত কয়লাকে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে সোনা তৈরি হতে এই ঘটনা গুলো হয়ত প্রয়োজন ছিলো । সে এতদিন অনেক জ্বালাতন করেছে মা বাবাকে , এখন সে সেই অন্যায়ের অনুশোচনা করেছে মাত্র ।
তবে ভবিষ্যতে শাশুড়ি মায়ের কোনরকম অন্যায় সে মেনে নেবে না । এবং ঘটেও তাই , নরেন ফিরে আসার পর থেকে শম্পাকে অত্যাচার করার আর সুযোগ পেতেন না মিনা । এদিকে ধীরে ধীরে সংসারের রাস নিজের হাত থেকে বেরিয়ে যাবার কারণে বেশিরভাগ সময়ই মিনা বোনেদের বাড়ি , বাবার বাড়ি ঘুরে কাটাচ্ছিলেন । একদিন শম্পার শশুড় মশাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন । নাক দিয়ে ভীষণ রক্তপাত হওয়ায় ওনাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয় । শম্পা সঙ্গে সঙ্গে মিনাকে ফোন করে বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসতে বলে । আজ না কাল করে কাটিয়ে যান মিনা । হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নরেনের বাবা । শম্পা আর নরেন বাবার পার্থিব শরীর বাড়ি নিয়ে আসে । মিনা খবর পেয়ে ছুটে আসেন আর কেঁদে কেঁদে স্বামীর পায়ে পড়ে যায় । শ্রাদ্ধর দিন ইনিয়ে বিনিয়ে সকলের কাছে উনি বলতে থাকেন স্বামী ভীষণ ভালোবাসতেন ওনাকে তাই উনি থাকলে পৃথিবীর মায়া কাটানো সম্ভব হত না নরেনের বাবার । সেই জন্যই স্ত্রী আসার আগেই চলে গেলেন পরপারে । এবার একবাড়ি অতিথিদের সামনে প্রতিবাদ করে উঠলো শম্পা । সোজাসুজি ভদ্রভাবে শম্পা বলে , " মা বাবার মৃত্যুটা নিয়ে আর রাজনীতি না হয় নাই করলেন ! বাবা অসুস্থ হবার পর বারবার আপনাকে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে আপনি আসেননি । বাবা শেষবার আপনাকে দেখতে চেয়েও আপনাকে পাশে পাননি । আপনি নিজের অসুস্থ স্বামীর চেয়ে নিজের সুখকে প্রাধান্য দিয়েছেন । এর পর মৃত মানুষটার নাম নিয়ে এই ছলনা গুলো নাই বা করলেন ? আমার সঙ্গে যা যা করেছেন কোনদিন প্রতিবাদ করিনি আমি মা । আজ করছি কারণ যার নাম নিয়ে আপনি ছলনা করছেন উনি আমার সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ।
আর মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে , বাবাকে নিয়ে কোন ধরনের মিথ্যা সহ্য করতে পারেনা " ।বাড়িতে আলপিন পড়লেও শুনতে পাওয়া যাবে এমন নিস্তব্ধতা । সকলে অবাক শম্পার কথা শুনে ।মিনা স্তম্ভিত শম্পার ব্যবহারে । নরেন জানে বাবা কোনদিন সোজাসুজি মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে শম্পাকে সাহায্য করতে না পারলেও মেয়ের মত ভালোবাসতেন ওকে । আর বাপের প্রতি মেয়ের ভালোবাসা আজ রুদ্র রূপ ধারণ করে মিনার উপরে ঝড়ে পড়েছে । শান্ত শম্পা আজ প্রতিবাদ করেছে তার শাশুড়ি মিনার বিরুদ্ধে ।
