অসময়ের বৃষ্টি
অসময়ের বৃষ্টি
আজকে কলেজে যাওয়াটা খুব জরুরী ছিল রিমঝিমের। থিসিস পেপারটা জমা দেওয়ার আগে ভেবেছিল একবার ম্যাডামকে দিয়ে চেক করিয়ে নেবে। কিন্ত সকাল থেকে আকাশের মুখ এমন ভার হয়ে আছে আর তার সঙ্গে মাঝেসাঝে ঝিরঝিরি বৃষ্টি যে ওর কিছুতেই বাইরে বের হতে ইচ্ছা করছিল না।
এক কাপ চা নিয়ে বসে আছে সে তার অতি প্রিয় চিলেকোঠার ঘরটাতে। খোলা জানলা দিয়ে আসা জলের ঝাপটা যদিও তার শরীরে লাগছে তবুও তার চোখ যেন মেঘলা আকাশের বুকে কোন পরিচিত মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ইতিমধ্যেই মা দু-একবার জিজ্ঞাসা করে গিয়েছেন ‘কিরে কলেজে যাবিনা?’ কিন্তু মেয়ের কোন উত্তর না পেয়ে ফিরে গিয়েছেন তাঁর নিজের সংসারের প্রতিদিনের কাজে।
আজ কেন জানেনা রিমঝিমের কোন কাজের তাড়া নেই। আজ কেনই বা বারবার তার অরিনের কথা মনে পড়ছে তার কারণও বুঝতে পারছেনা তার অবুঝ মন।
অরিনের সাথে কলেজেই তার প্রথম পরিচয়। তার থেকে দুবছরের সিনিয়র অরিন। অল্পদিনের মধ্যেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে ওরা। একসঙ্গে কতসময় কাটিয়েছিল রবীন্দ্রভারতীর মাঠে বসে। গতবছর বর্ষার একটি দিনে অরিন ওকে বলেছিল ‘জানিস তো রিমঝিম তোর নামের মধ্যে কেমন যেন বৃষ্টির একটা ছন্দ আছে। তোর সাথে সময় কাটাতে আমার ততটাই ভালোলাগে যতটা ভালোলাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। তোর কাজল পরা চোখ দুটি যেন আকাশের বুকে জমে থাকা কালো মেঘের থেকে রং নিয়ে এত সুন্দর হয়েছে।’ রিমঝিম আজও মনে করতে পারে সেদিন ও একটা নীল রং এর শাড়ী পরেছিল। আর অরিন বলেছিল ‘তোকে এই রং টাতে খুব মানিয়েছে।’
সেদিন অরিনের কথাগুলি ওকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি। একটি ছেলের কাছ থেকে এইরকম প্রশংসা পেলে যতটা খুশি হতে পারে একটা মেয়ে, ততটা খুশি হয়নি রিমঝিম। তবে কি সে আরও কিছু শুনতে চেয়েছিল অরিনের মুখ থেকে? বুঝতে পারেনি সে।
এর ঠিক একমাস পর অরিন একদিন রিমঝিমকে এসে বলল ‘জানিস তো চাকরীর যে পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম সেটাতে আমি select হয়েছি। কালকে বাড়ী গিয়ে দেখি joining letter টা এসেছে। একদমই সময় নেই হাতে। সোমবারই join করতে হবে, প্রথম posting দিল্লিতে। তাই কালকেই রওনা দিতে হবে।’ অরিনকে খুব খুশি মনে হচ্ছিল। কিন্তু এত আনন্দের একটা খবরে যতটা খুশি হওয়া উচিৎ ছিল, সেদিন ততটা খুশি হতে পারেনি রিমঝিম। শুধু বলল ‘congratulation, তোমার ট্রেন ক‘টায়?’ অরিনের খুব তাড়া থাকায় সে শুধু ট্রেন সকাল ৭টায় জানিয়ে রিমঝিমের থেকে বিদায় নিল।
খুব ইচ্ছা থাকলেও রিমঝিম স্টেশনে যায়নি। কিন্তু কিসের অপেক্ষায় যেন ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বসে ছিল ফোনের কাছে। কিন্ত ফোন আসেনি। তার বারবার মনে হতে লাগল অরিন তো কোনদিন বলেনি তাকে ভালবাসে। তবে কেন অরিনের তার থেকে দূরে যাওয়াতে তার এত কষ্ট হচ্ছে। তবে কি সর্ম্পকটা বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু?
আজ প্রায় একবছর হতে চলল অরিন দিল্লি তে। মাঝেসাঝে ফোন করে তবে কথা হয়না খুব বেশি, খুব ব্যস্ত সে।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে গেল রিমঝিমের। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় অতীতের স্মৃতির জগৎ থেকে সে চলে এল বর্তমানে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল অরিন ফোন করেছে। আজকে অরিনের চেনা গলাটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হল। অরিন বলল ‘জানিস এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, অফিসে বসে আছি কিন্তু কোন কাজে মন নেই, শুধু তোকে মনে পড়ছে। তোর কাজল কালো চোখ দুটি, তোর বৃষ্টিতে ভেজা নীল শাড়ীর আঁচল খুব মিস করছি রিমঝিম। জানিনা একে কি বলে তবে এটা জানি যে তোকে ছেড়ে থাকতে পারবনা। তোকে আমি ভালোবাসি। তাই সামনের মাসে আমি আসছি তোকে নিতে।’ রিমঝিমের কোন উত্তরের অপেক্ষা অরিন করল না হয়ত বা উত্তরটা ওর জানা। অরিন আবার বলল ‘সামনের রবিবার বাবা মা তোদের বাড়ী যাবে কাকু কাকীমা কে বলে রাখিস। এখন রাখছি।’
ফোনটা কেটে যেতে রিমঝিম শুনতে পেল টিভির খবরে বলছে এটা নিম্নচাপের ফলে হওয়া বৃষ্টি। কলকাতায় বর্ষাকাল আসতে এখনো দেরি আছে। রিমঝিম নিজের মনে মনে বলল ভাগ্যিস এই অসময়ে বৃষ্টিটা হল তাই তো তার সেই বৃষ্টি ভেজা স্মৃতি অরিনের মুখে সেই কথাটা এনে দিল যেটা শোনার জন্য কতদিন, কতরাত অপেক্ষায় কেটেছে তার।

