অসম্ভব ও সম্ভব
অসম্ভব ও সম্ভব
সম্ভব কথাটা ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল কারণ অসম্ভব কথাটা সমাজে বিদ্যমান । কোন নারী যখন মা হয় প্রথমেই হাজার যন্ত্রণার মাঝখানে ও তাকে একটা প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয় সেটা হলো কি হয়েছে ? ছেলে না কি মেয়ে ?আচ্ছা আমাদের মধ্যে এই নারী পুরুষের বিভেদ কিসের জন্য ? দুই পক্ষই মানুষ যার বিজ্ঞানসম্মত নাম হোমো স্যাপিয়েন্স । পার্থক্য যতটা না শারীরিক তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক । এই পার্থক্য মেটানো অনেক সময় মনে হয় অসম্ভব । কিন্তু অসম্ভব শব্দেই উপস্থিত থাকে সম্ভব শব্দটি । তাই আমাদেরকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বিভেদ নির্মূলের পথে । শুরুটা শুরু করতে হবে নিজের বাড়ি থেকে । হ্যাঁ নিজেদের বাড়িতেই লুকিয়ে থাকে বিভেদের জীবাণু । আসুন সেই গল্পটাই আজকে ভাগ করেনি আপনাদের সঙ্গে ।রানুর জন্মের পর ওর ঠাকুমা আর বাবা খুব কেঁদেছিল কারণ প্রথমন সন্তান পুত্র না হয়ে কন্যা হলে নাকি কান্না ছাড়া আর কোন পথই খোলা থাকে না ।
রানুর মা লজ্জায় , কুন্ঠায় জড়োসড়ো হয়ে গেছিল সেদিন তাই সন্তান জন্মর কোন আনন্দই তাকে ছুঁতে পারেনি সেদিন । না রানুকে বাড়ি এনে ওরা অযত্ন করেনি কোনদিন । পরবর্তী কালে ওর ভাই হবার পর ও ওকেই ওর বাবা আর ঠাকুমা বেশি আদর দিয়েছে । এর পরেও রানু কিন্তু ওই সংসারে ব্রাত্যই ছিল । কারণ রানু একটু বড় হতেই বুঝে গেছিল ওকে এত যত্ন , এত আদর দিয়ে বড় করা হচ্ছে বাড়িতে পোষা সেই খাসি ছাগলটার মত যাকে বেশি চারা খাইয়ে বড় করলে ওর চকচকে শরীর দেখে কসাই বেশি মাংসর লোভে বেশি দাম দেবে । এক্ষত্রে রানুর যত্ন করা হচ্ছে ওকে নিখুঁত , সুন্দর , লাবণ্যময় বানিয়ে ওকে সুপাত্রে পাত্রস্থ করার জন্য । ওর রূপই তো ওকে সরকারী সুপাত্রর হাতে তুলে ধরতে সাহায্য করবে । এখানে সুপাত্র মানে হতেই পারে বয়সে সে রানুর বাবা কাকার বয়সী । হতেই পারে একঢাল কালো রেশম চুলের মালিক রানুর একদম বিপরীতে পাত্রের মাথায় চকচকে টাক । হতেই পারে সে দোজবরে বা বহুগামী স্বভাবের ।
তবে একটাই শর্ত সে আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্ন । এ ক্ষত্রে তাকে অশিক্ষিত হলেও বাধা নেই । রানু ছোট থেকে এগুলোই দেখে ও শুনে আসছে তবুও সে কোনদিন বিদ্রোহ করেনি । তার মনে হয়েছে ঠাকুমা আর বাবার যুক্তি গুলোই ঠিক হয়ত । রানুর মায়ের ও মনে হয়েছে এগুলোর প্রতিবাদ করা অসম্ভব । তবে রানু আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই বড় হয়েছে । সে পড়াশোনা শিখেছে , ও ভালো ফল ও করেছে । এবার শিক্ষার এই ধাপ পেরিয়ে এসে পূর্ন বয়সে এসে রানুর ও মনে হয়েছে ইতিহাসের পাতায় লেখা নারী চরিত্র গুলোও তো মিথ্যা নয় । রানী লক্ষী বাই , সিস্টার নিবেদিতা বা আরো পুরাতন যুগের লোপামুদ্রা , গার্গী ,অপলা এরাও মিথ্যা নয় । তা হলে ওই মধ্যযুগেও ওরা যদি নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে স্বমহিমায় ধরা দিতে পেরেছিল তো রানু কেন পারবে না ? হয়ত নিজের অধিকার বুঝতে চেয়ে বেলাগাম হলেই সমাজে রানুর যে গুড গার্ল ইমেজটা আছে সেটা নষ্ট হয়ে যাবে । তাতে কি আসে যায় ? ও নিজের মতো করে বাঁচতে তো পারবে ? দিনের শেষে নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি তো করতে পারবে যে ও নারীবাদী লড়াই লড়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে । ব্যাস আর কি বাবার দেখা সুচাকুরে চল্লিশ বছরের ভুঁড়িওলা পাত্রকে সে না করে দিয়েছে তাও পাত্র পক্ষের সামনেই । রানু পাত্রের বাড়ির লোক যখন ওকে চুল খুলে বা হেঁটে দেখাতে বলেছিল তখনই সকলকে অবাক করে মুখের উপর না করে দেয় ।
উপরন্তু পাত্র পক্ষের সঙ্গে আসা একটি সমবয়সী মেয়ের দিকে দেখিয়ে পাত্রকে বলে যে কাকু নিজের বয়সী একটা কাকীমা খুঁজুন , আমি আপনার ভাইঝির বয়সীই হবো ।ঠাকুমা আর বাবাকে অবাক করে সদা কুন্ঠিত আর লজ্জিত মাকে চার দেওয়ালের বাইরে নিয়ে এসে দুনিয়া দেখাতে শুরু করলো রানু । মাকে পার্লারে নিয়ে গিয়ে মা আর মেয়ে দুজনেরই মেকওভার করিয়ে নিলো । ঠাকুমা নাতনির লম্বা বিনুনি ছোট হয়ে পনিটেল হতে দেখে অবাক হয়ে বললেন , হতভাগী ছুরি কি অনিষ্ট করলো রে ?রানু কারোর একটা কথাও শোনেনি সে সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু বসেও থাকেনি , একটা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করতেও শুরু করেছে । কারণ চাতক পাখির মতো বসে থাকলে সময় বয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন লাভই হয়না। একটা স্কুটি কিনে সে নিজে নিজেই শিখেছে , অনেক বার পড়েছে গাড়ি থেকে কিন্তু হার মানেনি সে । বাবা মেয়ের মধ্যে দুর্দমনীয় জেদ দেখে একসময় নিজেই আফসোস করেছেন যে এই মেয়েকে ছোট থেকে আর একটু দেখলে হয়ত আরো উন্নতি করে ফেলতো । পরিবর্তন এসেছে বাবা , ঠাকুমা সবার মধ্যেই । মা ও আজ আর লজ্জিত বা কুন্ঠিত নয় কারণ তার সন্তান পুত্র বা কন্যা ভেদে নয় যোগ্যতার মাপকাঠিতে তুল্য । রানু কোন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার নয় ... সমাজে লড়াকু রানুরা কখনো বেসরকারি চাকুরে , কখনো সেলস গার্ল , কখনো দোকানদার । তবে লড়াই তো সকলেই করছে পেশাটা ভিন্ন মতাদর্শ তো এক ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটাই কামনা বইয়ের পাতায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও নারী স্বাধীনতার কথা শুধুমাত্র মেয়েগুলো মুখস্ত করে পরীক্ষায় নম্বর পর্যাপ্ত সীমাবদ্ধ না রেখে ওই সংগ্রামের নিগূঢ় অর্থ বুঝতে শিখুক । তা হলেই আর আমাদের ফেমিনিসম নিয়ে লড়াইয়ে নামতে হবে না । প্রত্যেক নারী খুব অল্প বয়সে থেকেই নিজের অধিকারটা বুঝে নিতে শিখবে । আর কোন মেয়েকে কেউ কেরোসিনে ভিজিয়ে আগুনে ভস্ম করে দিতে পারবে না । আর কোন বাবা মেয়ে হলে শোকে কাঁদবে না । মায়ের কোলে জন্ম হবে মনুর সন্তান মানবের , যে একটি শিশু মাত্র হবে । তাকে লিঙ্গ ভেদে দেখা হবে না ।
