Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational Others

4.6  

Sayandipa সায়নদীপা

Inspirational Others

অন্যরকম প্রতিবাদ

অন্যরকম প্রতিবাদ

6 mins
1.5K


"হ্যাঁ রে তোর শ্বাশুড়ি আর বড় জা রান্না করছে আর তুই বসে আছিস!"

"আসলে মা, দিদি আর মা তো আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না, তাই…"

"ঢুকতে দেয় না মানে?"

"মানে আমাকে বাড়ির কাজই করতে দেয় না। ওরাই সব সামলে নেয়।" 

একগাল হেসে জবাব দিল ঊর্মি। তাও মায়ের প্রত্যয় হয়েছে বলে মনে হল না। 


   একদিন পরেই মা বাড়ি ফিরে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ঊর্মি। ঠিক দু' দিন পর ঊর্মির বড় জা নিশার দাদা এলেন ওদের বাড়িতে। ওনার নাকি এই শহরে কী কাজ রয়েছে তাই সপ্তাহখানেক থাকবেন। ঊর্মি দেখল সারা সপ্তাহজুড়ে সে কী এলাহী খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। রোজ রোজ ভালোমন্দ খাবার খেয়ে একদিন তো অসুস্থই হয়ে পড়লেন ভদ্রলোক। সবটুকু দেখছিল ঊর্মি। তার মা যেদিন এসেছিল সেদিন একটা সবজি আর ছোট মাছের তরকারি হয়েছিল মাত্র, এমনকি সামান্য দুটো ভাজাভুজিও অতিরিক্ত হয়নি। ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল ঊর্মির কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না তার। সে জানে সে মাকে যতই মিথ্যে প্রত্যয় দেওয়ার চেষ্টা করুক, মা হয়ত ঠিক বুঝে গিয়েছে সব। আর বুঝে গিয়ে কত কষ্টই না পাচ্ছেন কে জানে! ঊর্মি রোজ দেখে ওর বড় জা নিশাকে চোখে হারায় শ্বশুর শ্বাশুড়ি, নিজেদের মেয়ে নেই বলেই হয়ত নিশাকে মেয়ের মতই যত্ন করেন ওরা। কিন্তু ঊর্মির সে ভাগ্য কোথায়! রোজ নির্জন দুপুরে ঊর্মি যখন ঘরে একলা থাকে তখন সে ভাবে এই বিয়েটা করে সে কী কোনো ভুল করেছে! কিন্তু তার অপরাধটা কী? 


   গ্র্যাজুয়েশন করতে করতেই কম্পিউটার কোর্স করতে ভর্তি হয়েছিল ঊর্মি। সেখানেই আলাপ হয় সৌজন্যের সঙ্গে। প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর ক্রমশ সম্পর্কটা প্রণয়ে পৌঁছায়। দু'জনের মধ্যে এত মিল ছিল যে বন্ধুরা ইয়ার্কি করে বলত- একেবারে যেন হর পার্বতী। বছর দুয়েক পর সম্পর্কে সেই কলেজ বেলার উন্মাদনা হারিয়ে গেলেও ভালোবাসায় আঁচড় পড়েনি একটুও, বরং যত দিন গিয়েছে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। যখন ঊর্মির বাবার অসুখ তখন সৌজন্য বলিষ্ঠ হাতে ঊর্মিকে সামলেছে, এমনকি ঊর্মির বাবার মৃত্যুর সময়ও সৌজন্য ঊর্মির পাশে থাকতে ভোলেনি। এদিকে চাকরির চেষ্টা করেও ব্যর্থ সৌজন্য যখন তিলে তিলে হতাশার দিকে চলে যাচ্ছিল, তখন শুধুমাত্র ঊর্মি তার মনটাকে বুঝে তার পাশে থেকেছে। হতাশা আর কটাক্ষের ভীড়ে ঊর্মির সঙ্গই সৌজন্যকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়েছে সেই সময়, ঊর্মির সাহচর্য তাকে বিশ্বাস করিয়েছে যে চেষ্টা করলে একদিন সফলতা ঠিক আসবে। তাই চাকরি পেয়েই সৌজন্য চেয়েছিল ঊর্মিকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিতে। প্রথম যেদিন সৌজন্য অফিসে যায় সেদিন অফিস থেকে ফিরেই সে ঊর্মিকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছিল। ঊর্মির চোখে জল এসে গিয়েছিল। তাদের সম্পর্ক যখন নতুন তখন একদিন ঊর্মি কথায় কথায় সৌজন্যকে জিজ্ঞেস করেছিল, "চাকরি পাওয়ার পর প্রথম কোন কাজটা করবি?"

সৌজন্য অপ্রত্যাশিতভাবে উত্তর দিয়েছিল, "তোকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করব।" 

সৌজন্য যে এত বছর পরও সেটা মনে রাখবে ভাবেনি ঊর্মি কিন্তু সৌজন্য কথা রেখেছিল। এরপরেও এই মানুষটাকে ছেড়ে থাকা যায়! 


  তাদের সম্পর্কের কথা শুনে ঊর্মির পরিবার থেকে আপত্তি না থাকলেও বাধ সেধেছিল সৌজন্যের পরিবার। সৌজন্যরা ব্রাহ্মণ আর ঊর্মিরা অন্য জাত। এই ছিল ঊর্মির অপরাধ, এই হল ঊর্মির অপরাধ। সৌজন্যের পরিবার কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি হয়নি, কিন্তু সৌজন্যও ছিল নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। ঊর্মির মা সেই সময় ঊর্মিকে বলেছিলেন এই অপমানের বিয়ে না করতে কিন্তু সৌজন্যকে ছেড়ে থাকার কথা ভেবেই বুক কেঁপে উঠেছিল ঊর্মির, তার মনে হয়েছিল সৌজন্যকে ছেড়ে সে হয়ত মরেই যাবে। সৌজন্য বলেছিল সে চেষ্টা করছে বাড়িতে বোঝানোর, তাকে সময় দিতে। আর বাড়িতে নেহাৎ না বুঝলে তারা নিজেরাই বিয়ে করে নেবে। কিন্তু এই প্রস্তাবে বেঁকে বসেছিলেন ঊর্মির মা, তিনি বলেছিলেন সৌজন্যের পরিবারের সম্মতি ব্যতীত এ বিয়ে হলে তিনিও আর ওদের মুখদর্শন করবেন না। তবে যাইহোক, ব্যাপারটা আর এতদূর গড়ায়নি। অনেক লড়াইয়ের পর সৌজন্যের পরিবার মেনে নিয়েছিল তাদের সম্পর্কটা। আজও সেই লড়াই করার দিনগুলোর যন্ত্রণাটা ভুলতে পারেনি ঊর্মি। বিয়ের সময় সে ভেবেছিল এবার সবটুকু ভুলে যাবে যাবে সে, সব তিক্ততা ভুলে সংসার করবে মন দিয়ে। কিন্তু ভাগ্যের ইচ্ছে ছিল কিছুটা অন্যরকম। ভাগ্য ঊর্মিকে কিছুই ভুলতে দেয়নি। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই ঊর্মি বুঝেছিল সৌজন্যের পরিবারের লোক ছেলের জেদের কাছে নতি স্বীকার করেছে মাত্র, তাকে মেনে নেয়নি। তাই এই বাড়ির ঠাকুর ঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘরে অবধি ঊর্মির প্রবেশ নিষেধ। একই বাড়িতে থেকেও ঊর্মি যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অথচ সৌজন্য থাকলে এদের ব্যবহারই পাল্টে যায়, সৌজন্য কিছুই টের পায় না। ঊর্মিও অভিযোগ করে না, নিজের ভেতরেই ক্ষত বিক্ষত হয়। একই বাড়িতে দুই জা, অথচ দু'জনের প্রতি ব্যবহার কত আলাদা। এই পক্ষপাত ঊর্মিকে কষ্ট দেয়। কিন্তু সে প্রতিবাদ করতে পারে না কারণ এই পক্ষপাতের প্রতিবাদ হয় না। সে যদি প্রতিবাদ করতে যায় তবে সমাধান হয়ত একটাই বেরিয়ে আসবে, তাকে আর সৌজন্যকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। কিন্তু ঊর্মি সংসার ভাঙতে শেখেনি। সে চায় না আলাদা হতে। সে বোঝে এই সমস্যার সমাধান গলা তুলে প্রতিবাদ করে হবে না, এই সমস্যার সমাধান তখনই সম্ভব যখন এই বাড়ির লোকগুলোর মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে। 


     সৌজন্য আজ দু' দিন হল অফিস থেকে ট্রেনিং নিতে ভুবনেশ্বর গিয়েছে। এদিকে আজ নিশার ভাইঝির জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঊর্মির ভাসুর আর নিশা নিশার বাপের বাড়িতে গিয়েছে। বাড়িটা আজ যেন অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সকাল থেকেই মন খারাপের মেঘ ঘিরে রয়েছে ঊর্মিকে। তারই মন খারাপ বুঝি দুপুরে আকাশের গায়েও লাগল। প্রথম উত্তর পশ্চিম কোণে অল্প অল্প মেঘ দেখা দিয়েছিল, ক্রমশ সেই মেঘ ঘনীভূত হয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যেতে লাগল চারিপাশ। ঊর্মি নিজের ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল আর তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি টিভি দেখেছিলেন বাইরের ঘরে। আচমকা শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনে ছুটে গেল ঊর্মি। দেখল শ্বশুরমশাই বুক চেপে ধরে মাটিতে উল্টে পড়েছেন। ঊর্মির বুঝতে অসুবিধা হল না হার্ট এটাক হয়েছে ওনার, ঊর্মির নিজের বাবার সঙ্গেও একই জিনিস হয়েছিল। সেদিন অজ্ঞতার কারণে মানুষটাকে আর সুস্থ করতে পারেনি তারা। কিন্তু আজ ঊর্মি আর কোনো ঝুঁকি নিল না। কিছুদিন আগেই এক ডাক্তারের ইউটিউব চ্যানেলে দেখেছিল হার্ট এটাকের রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা কেমন ভাবে করতে হয়। সে আর দেরী না করে শ্বশুরমশাইকে তুলে বসিয়ে দিয়ে সেই ডাক্তারের পরামর্শ মত পদ্ধতিতে ওনাকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে লাগল। ঊর্মি ক্ষতি করে দিচ্ছে ভেবে শ্বাশুড়ি চিৎকার করে বাধা দিতে এলেন, ঊর্মি তোয়াক্কা করল না। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে শ্বাশুড়ি টিভির রিমোট ছুঁড়ে মারলেন ঊর্মির দিকে। চমকে গেল ঊর্মি, এতটাও সে প্রত্যাশা করেনি। তবে ততক্ষণে তার কাজ শেষ। সে যথাসম্ভব শান্ত গলায় শ্বাশুড়িকে বলল সর্বিট্রেট এনে ওনার জিভের তলায় দিতে। কথাটা বলেই ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে গেল ঊর্মি। 



প্রায় আধ ঘন্টা পর ভেজা শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরল ঊর্মি। সঙ্গে একটি অপরিচিত লোক। ঊর্মি শ্বাশুড়ি মাকে জানাল হসপিটালে যাওয়ার জন্য গাড়ি ডেকে এনেছে সে। গাড়ির ড্রাইভারটি ঊর্মির শ্বশুরমশাইকে নিয়ে গাড়িতে তুলে বসাল। শ্বাশুড়ি মায়ের চোখে এখনও অবিশ্বাস। হসপিটালে পৌঁছে তড়িঘড়ি ঊর্মি শ্বশুরমশাইকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করল। ঊর্মির এক বান্ধবী এখানকার ডাক্তার, তাই ভর্তি করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। 



প্রায় ঘন্টা খানেক পর ঊর্মির বান্ধবী এসে ঊর্মির হাত দুটো ধরে বলল, "ডঃ বাসু বললেন তুই দারুণ কাজ করেছিস। তুই ফার্স্ট এইড ট্রিটমেন্টটা না দিলে আরও খারাপ কিছু হতে পারত তোর শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে।"

ড্রাইভার ভদ্রলোক তখনও ছিলেন ওদের সঙ্গে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, "শ্বশুরমশাই! আপনি যে বললেন বাবা।"

ঊর্মি মৃদু হেসে বলল, "শ্বশুরমশাইকেও তো বাবা বলেই ডাকি।"

ড্রাইভার ভদ্রলোক তখন ঊর্মির শ্বাশুড়ির দিকে ঘুরে বললেন, "সত্যি ভাগ্য করে এমন বৌমা পেয়েছেন। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে উনি যেভাবে অতটা পথ ছুটে ছুটে গিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন, তা সত্যিই অন্য কেউ হলে করত না।"

শ্বাশুড়ি মা কোনো জবাব দিলেন না। 



 দু' দিন পর শ্বশুরমশাই মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠতে শ্বাশুড়ি মা ঊর্মির কাছে এসে বললেন, "তুমি সেদিন আমাদের জন্য যা করেছো তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।" 

মৃদু হাসল ঊর্মি। বলল, "আমি কিন্তু ভেবেছি আমি আমাদের জন্য করছি।"

শ্বাশুড়ি মা খানিক অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন, বললেন, "আমি ঠিক ওভাবে বলিনি কথাটা।"

মাথা নাড়ল ঊর্মি, "জানি মা। বাবার জায়গায় অন্য মানুষ হলেও হয়ত আমি আমার সাধ্য মত সব চেষ্টাই করতাম। আসলে আমার মা বাবা আমাকে সব দিন শিখিয়ে এসেছেন মানুষকে মনুষ্যত্বের জন্য সম্মান করতে, কোনো জাতপাত, ধর্ম এসবের ভিত্তিতে নয়।"

ঊর্মির কথা শুনে একটা ঢোক গিললেন শ্বাশুড়ি মা। তারপর বললেন, "আমি তোমার বাবার কাছে যাব, তুমি রান্নাটা দেখে নিও।"

কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। নিজের মনেই মৃদু হাসল ঊর্মি। অর্থহীন পক্ষপাতের দেওয়াল আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করেছে, তবে পুরোটা ভেঙে পড়তে সময় লাগবে। সে লাগুক। ততদিন ধৈর্য্য ধরে নিজের এই অপ্রত্যক্ষ প্রতিবাদ চালিয়ে যাবে ঊর্মি। 



#WomanLead


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational