অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসাপর্ব-৩৭
অদৃত বলল,'পত্রলেখা তুমি এইদিকটা একটু দ্যাখো, আমি একবার মায়ের সাথে কথা বলেই আসছি।'
পত্রলেখা বলল,'এই... এখন এইখান থেকে যেও না সেটা ঠিক হবে না। যতই হোক আজকে মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তুমি। তুমি না হয় পরে আন্টির সাথে কথা বোলো, তুমি তো বাড়িতেই আছো।'
অদৃত অস্থির হয়ে বলল,'আমি যদি এখন কথা না বলি তবে অনেক দেরী হয়ে যাবে।'
পত্রলেখা কথাটার মানে ঠিক বুঝতে পারল না।
অদৃত ভাবলো,'আমার আর্যর সাথেও কথা বলতে হবে। কিন্তু আর্য কোথায়? ওকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না কেন?'
হঠাৎ সৌনক বলল,'দ্যাখো পত্রলেখা তোমার ভাগ্যটা কিন্তু ভালো। এই ছেলে সমস্ত মেয়েকে রিজেক্ট করে দিতো, কাউকে মন দিতো না । সেই অদৃত রায়ই আজকে বলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রীর প্রতি পাগল।'
অদৃত এইসমস্ত কথা শুনে বিরক্তবোধ করে বলল,'তোরা কথা বল আমি আসছি।'
সৌনক বলল,'আরে দাঁড়া দাঁড়া কোথায় যাচ্ছিস তুই? আজকে এতোবড়ো একটা খুশির দিন এই খুশির দিনে এরকম পালিয়ে বেড়ালে হবে।'
সৌনক অদৃতের মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করে বলল,'কিন্তু তোর মুখটা এরকম কালো হয়ে আছে কেন? আর তোকে এরকম অস্থিরই বা লাগছে কেন ?'
অদৃত বলল,'এমনি।'
সৌনক বলল,'না দাঁড়া কিছুতো একটা হয়েছে?বল?'
অদৃত এবার একটু গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,'বললাম তো তোরা কথা বল আমি আসছি।'
শ্রেয়সী তখন অতিথি আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। অদৃত তার কাছে গিয়ে বলল,'মা আমার তোমার সাথে কিছু কথা ছিল ।'
শ্রেয়সী বলল,'হ্যাঁ ঠিক আছে। আমি একটু পরে শুনছি।'
অদৃত বলল,'মা একবার শোনো।'
শ্রেয়সী বলল ,'একটু দাঁড়া তোর দিদা ফোন করছেন। আমি ফোনটা করেই আসছি।'
এরমধ্যে পত্রলেখার বাবা সুব্রত অদৃতকে দেখে বলল,'আরে অদৃত। ভালো হয়েছে তোমাকে ফাঁকা পেয়েছি। তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল। কিন্তু... তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?'
অদৃত স্বল্প হেসে বলল,'না এমনি।'
সুব্রত বলল,'বুঝেছি বিয়ের চিন্তায়। আমারও এরকম হয়েছিল। '
অদৃত বাঁকা হাসি হাসলো।
সুব্রত বলল,'বাবা অদৃত পত্রলেখা আমার একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকে ও যা চেয়েছে আমরা ওকে তাই-ই দিয়েছি, কখনো কোনোকিছুতে কষ্ট দিইনি। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে , ওকে একটু দেখো, ওকে ভালো রেখো। ও খুব কম মানুষকে বিশ্বাস করে, আর সেই তালিকায় তুমিও আছো। ও তোমাকে খুব বিশ্বাস করে। তুমি যেভাবে ওর অন্যায় আবদারগুলো মেটাও অন্য কেউ হলে হয়তো তারা করতো না। বিয়ের পর ওকে একটু দেখো, ভালো রেখো বাবা। আমি আর পিয়ালিও খুব নিশ্চিন্ত যে ও তোমার মতোন ছেলেকে পছন্দ করেছে জীবনসঙ্গী হিসেবে। তাই বলছি ওকে একটু দেখো।'
অদৃত একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে ঘাড় নাড়লো।
সুব্রত বলল,'আমাকে কথা দাও।'
অদৃত কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারল না। এরইমধ্যে পত্রলেখা ডাকলো,'অদৃত! এইদিকে একটু শোনো।'
সুব্রত বলল,'তোমার ম্যাডামের ডাক পড়েছে যাও শুনে এসো। নয়তো আমাকে এসে বকাবকি করবে।'
অদৃত পত্রলেখাকে বলল,'কি হয়েছে ডাকছো কেন?'
পত্রলেখা বলল,'আরে তোমার বন্ধুরা তোমাকে সবাই খুঁজছে।'
অদৃত কিছু বলল না। সেইমূহূর্তে তার দুটি চোখ খুঁজে চলল আর্যকে। কিন্তু সে গার্ডেনের কোথাও তাকে দেখতে পেল না।
কিছুক্ষণ পর অদৃত তার মা'কে ফাঁকা পেয়ে বলল,'মা এইদিকে একবার এসো।'
শ্রেয়সী বলল,'কি হয়েছে বল?'
অদৃত বলল,'মা তুমি আমাকে না জানিয়ে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিলে কি করে?'
শ্রেয়সী অদৃতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,'মানে?'
অদৃত বলল,'মানে আমি এই বিয়েতে রাজি নই। আমি এই বিয়েটা করতে চাই না মা।'
শ্রেয়সী অদৃতের কাঁধে হাত রেখে বলল,'দ্যাখ বাবা, আমি জানি আমরা জোর না করলে তুই কখনো বিয়ে করবি না,আর না ভাববি কখনো বিয়ে করার কথা। আর কতদিন এইভাবে আমাদের কথা ভাববি বলতো? এবার অন্তত নিজেকে নিয়ে একটু ভাব,
একটু নিজের জীবনটাকে গুছিয়েনে।'
অদৃত অধৈর্য হয়ে বলল,'মা তুমি কেন
বুঝতে পারছো না.....'
শ্রেয়সী বলল,'আমি সব বুঝতে পারছি তোর চিন্তা হচ্ছে আমাদের নিয়ে । যদি পত্রলেখা বিয়ের পর আমাদের না দেখে তাইতো? আরে পত্রলেখা ওরকম মেয়েই নয়। ও সবাইকে নিয়ে থাকতে জানে। তুই চিন্তা করিস না ও আমাদের ঠিক দেখবে। দেখিসনি আমাদের কারোর কোনো শরীর খারাপ করলে ও কিরকম অস্থির হয়ে ওঠে। শোন তুই বেকার ভাবছিস। ও খুব ভালো মেয়ে । দেখিস এই বিয়েটা করলে তুই আর পত্রলেখা দুইজনেই খুব সুখী হবি। আমি এখন যাই ওইদিকটা দেখে আসি।'
অদৃত বলল,'মা শোনো....'
শ্রেয়সী তার কথা না শুনেই চলে গেল।
ত্রিদিব ডাকলো,'অদৃত...।'
অদৃত বলল,'ও তোরা চলে যাচ্ছিস?'
ত্রিদিব বলল,'হ্যাঁ রে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আর্যর সাথে দেখা হল না। তুই একবার ওকে বলে দিস। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা ছেলেটা বড্ড অভিমানী, ওকে একটু দেখিস।'
অদৃত অবাক হয়ে বলল,'তুই...'
ত্রিদিব বলল,'আমি বিষয়টা একটু জানি। যাইহোক এখন এলাম রে।'
কথাটা বলে ত্রিদিব চলে গেলো।
অদৃত ড্রয়িং রুমে তাকে খুঁজে দেখলো, আর্যর ঘরে দেখলো, তার নিজের ঘরে দেখলো, সুইমিং পুলে দেখলো, তার ঘরের মধ্যে থাকা লাইব্রেরিতে খুঁজলো কিন্তু আর্যকে কোথাও দেখতে পেল না। অবশেষে ছাদে উঠে দেখলো আর্য ছাদে থাকা দোলনায় একা বসে আছে। অদৃত তার পাশে গিয়ে বসলে সে একটু সরে গিয়ে বসলো।
অদৃত বলল,'আমার ওপর রাগ হয়েছে ?'
আর্য চাপা গলায় বলল,'না তো।'
অদৃত বলল,'কষ্ট হয়েছে ?'
আর্য চুপ করে রইলো।
অদৃত বলল,'তোমাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে এখানে পেলাম।কথা বলছো না কেন?
অভিমান হয়েছে আমার ওপর?'
আর্য বলল,'যে সম্পর্কে অভিমান থাকে না সেটা আর যাইহোক ভালোবাসা নয়। আর আমিতো তোমাকে ভালোবাসি....'কথাটা বলে আর্য থেমে গেল , আর বলতে পারল না সে। তার গলার কাছে এক তীব্র বেদনা অনুভূত হল।
অদৃত তার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,'বিশ্বাস করো আর্য আমি এই বিষয়টা সম্পর্কে কিচ্ছু জানতাম না। আমি নিজেও অবাক হয়ে গেছি।আমি...'
আর্য বলল,'তুমি এই বিয়েতে রাজি?'
অদৃত বলল,'তুমি কি বলছো? আমি তোমাকে ভালোবাসি । আমি কেন এই বিয়েতে রাজি হতে যাবো। পত্রলেখাকে আমি আমার সবথেকে ভালো বন্ধু ভাবি ঠিকই কিন্তু তাই বলে আমি ওকে ভালোবাসি না। তাই এই বিয়েতে রাজি হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসছে না।'
আর্য বলল,'কিন্তু বাড়ির সকলেই তো রাজি আছে। পত্রলেখাও রাজি। '
অদৃত বলল,'বাড়ির সকলে রাজি তো কি হয়েছে আমি তো রাজি নই। আমি ঠিক করেছি কালকেই আমাদের সম্পর্কের কথাটা বাবা-মা'কে জানাবো। তুমি চিন্তা কোরোনা।'
আর্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো ,'সবটা শোনার পর যদি ওনারা আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে না নেন , তখন আমরা কি করবো?'
অদৃত বলল,'আমার বিশ্বাস যে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে সবটা জানলে বাবা-মা আমাদের মেনে নেবে। বাবা-মা আমাদের ঠিক বুঝবেন। তুমি ভেঙে পোড়ো না এইভাবে। সব ঠিক থাকবে।'
আর্য ভাবলো,'আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানি না তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে থাকবো। আমি তোমাকে ছাড়া যে এখন একটা দিনও ভাবতে পারিনা। যদি আমাকে কখনো পিছিয়ে আসতে হয় তোমার থেকে আমি জানি না কিভাবে তোমার থেকে পিছিয়ে আসবো। তোমার বিয়ে.......' না আর্য আর ভাবতে পারল না। আর্য কেঁদে ফেলল।
আর্য কাঁদতে কাঁদতে বলল,'এই পৃথিবীতে আমার তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি জানি না কেন আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। সবটা শোনার পর যদি কেউ কোনোদিনও আমাদের সম্পর্কটাকে মানতে না চায়?'
অদৃত আর্যর মাথাটা তার কাঁধের ওপর রেখে বলল,'আর্য , আর্য এরকম কিচ্ছু হবে না। আমি তো আছি তোমার পাশে। যদি মেনে না নেয় আমরা একসাথে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাবো।'
অদৃত কথাগুলো বলল ঠিকই কিন্তু তার মনের মধ্যেও এই বিষয়টা নিয়ে প্রবল দ্বন্দ্ব চলছে। সে মনে মনে ভাবলো,'আমারও তো ভয় হচ্ছে আর্য যদি না মানে? না সব ঠিক থাকবে,ঠিক থাকতেই হবে।'
আর্য বলল,'তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো?'
অদৃত আর্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,'না আর্য আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকাতো দূরের কথা; আমি তোমার কথা না ভেবেও থাকতে পারি না। তোমার পাশে আমি আছি আর্য।ভয় পেও না সব ঠিক থাকবে।'
কথাটা বলে অদৃত আর্যর চোখের জল মুছিয়ে আর্যর ঠোঁটের কাছে এগিয়ে তার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে আদর করল।
শ্রেয়সী পার্টিতে অদৃতকে কোথাও না দেখতে পেয়ে ইন্দ্রনীলকে জিজ্ঞাসা করল ,'বলছি তুমি অদৃতকে দেখেছো কোথাও?'
ইন্দ্রনীল বলল,'না। ওকে অনেকক্ষণই তো দেখতে পাচ্ছি না ।'
শ্রেয়সী বলল,'কোথায় গেল বলোতো ছেলেটা?'
ইন্দ্রনীল বলল,'এখানেই কোথাও আছে। পত্রলেখার সাথে আছে হয়তো দ্যাখো।'
শ্রেয়সী বলল,'না । পত্রলেখার সাথে নেই। পত্রলেখা বলছিল ও অনেকক্ষণ অদৃতকে দেখেনি। ঠিক আছে আমি দেখছি।'
ইন্দ্রনীল বলল,'তাহলে এদিক সেদিক আছে দ্যাখো।'
শ্রেয়সী বাড়ির সমস্ত জায়গা খুঁজে দেখলো কিন্তু অদৃতকে কোথাও দেখতে পেল না। সে অদৃতের ঘরে ঢুকে দেখলো, অদৃতের ঘরে থাকা লাইব্রেরিতেও খুঁজলো কিন্তু কোথাও সে তাকে দেখতে পেল না। অবশেষে ছাদে উঠে দেখলো, ছাদে থাকা দোলনায় আর্য এবং অদৃত দুইজনে পাশাপাশি বসে কথা বলছে। কিন্তু শ্রেয়সী অনেকটা দূরে থাকার দরুন তারা কি কথা বলছে তা সে শুনতে পেল না।
শ্রেয়সী হেসে ভাবলো,'আমি সব জায়গায় খুঁজছি আর এরা দুটোতে মিলে ছাদে বসে গল্প করছে। কিন্তু এতো কি কথা বলছে? আর এখানেই বা এসে কথা বলছে কেন? একবার ডাকি। সবাই নীচে আনন্দ করছে আর ওরা দুজনে এখানে বসে গল্প করছে।'
এইসব ভাবতে ভাবতে শ্রেয়সী তাদের ডাকবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে , হঠাৎ এমন সময় সে দেখলো, অদৃত আর্যর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে আদর করছে। এই দৃশ্য দেখে সে দিকবিদিকশূন্য হয়ে পড়ল, সে হতবাক হয়ে পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে রইলো।
To be continued.....................

