অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসা
অন্যরকম ভালোবাসা
পর্ব-৩৬
আজ সকাল থেকেই রায় বাড়িতে ব্যস্ততার অন্ত নেই, যতই হোক বাড়ির একমাত্র ছেলের জন্মদিন বলে কথা। সকাল থেকেই শ্রেয়সী রান্নাঘরে ব্যস্ত, ইন্দ্রনীল একা পুরো বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব দেখভাল করছেন।
আর্যকে নীচে নামতে দেখে ইন্দ্রনীল বলল,'আর্য ।'
আর্য বলল,'হ্যাঁ আঙ্কেল?'
ইন্দ্রনীল আর্যর কাছে এসে বলল,'তুমি যদি কিছু না মনে করো তাহলে একটা কথা বলবো?'
আর্য বলল,'বলুন না আঙ্কেল।'
ইন্দ্রনীল বলল,'তুমি একটু গার্ডেনের ডেকোরেশনটা দেখবে আসলে সৌনকরা মানে অদৃতের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী আসছে। তাই আমাকে ওইদিকটা একটু দেখতে হত। তাই যদি তুমি একটু এইদিকটা দেখতে।'
আর্য হেসে বলল,'অবশ্যই আঙ্কেল আমি দেখছি গিয়ে।'
ইন্দ্রনীল হেসে বলল,'আমাকে বাঁচালে আর্য।'
আর্য হাসলো।
আর্য গার্ডেনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সমস্তকিছু সাজালো। কিছুক্ষণ পর গার্ডেনের সাজানোর কাজ শেষ হয়ে গেলে সে নিজের ঘরে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে সৌনক এবং অলিভিয়া অদৃতদের বাড়িতে এসে হাজির হল।
সৌনককে দেখে অদৃত বলল,'আরে এতো দেরী হল কেন তোদের? কতক্ষণ ধরে তোদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।'
সৌনক বলল,'আর বলিস না খারাপ আবহাওয়ার জন্য একঘন্টা ফ্লাইট লেট করল।'
অলিভিয়া অদৃতকে বলল,'হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!'
অদৃত বলল,'থ্যাংক ইউ।
তোমরা বোসো প্লিজ!'
অদৃত জোরে হাক দিয়ে নিরঞ্জনকে ডাকলো,'নিরঞ্জন কাকা! ও নিরঞ্জন কাকা!'
ইন্দ্রনীল বলল,'তুমি কতছর পর এলে আমাদের বাড়িতে সৌনক। আগে কত আসতে এখনতো আর আসোই না।'
সৌনক বলল,'হ্যাঁ । অনেক বছর পর এলাম। এখানে থাকার সময় খুব আসতাম, এখন তো আর কাজের চাপে আসাই হয় না দিল্লিতে।'
ইন্দ্রনীল বলল,'অলিভিয়ার আমাদের বাড়িতে এটাই প্রথমবার তো?'
অলিভিয়া বলল,'হ্যাঁ আঙ্কেল।'
ইতিমধ্যে নিরঞ্জন এসে বলল,'তুমি ডাকছিলে অদৃতবাবা?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ । ওদেরকে ওদের ঘরটা একটু দেখিয়ে দাও, আর ওদের জিনিসপত্রগুলো একটু নিয়ে যাও।
আর তোরা তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে আয় লাঞ্চ করবো একসাথে। তারপর অলিভিয়াকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাবো।'
সৌনক বলল,'উফ্! তুই এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমরা তো এখন আছি এক সপ্তাহ মতোন। আঙ্কেল-আন্টির বিবাহ বার্ষিকী কাটিয়ে তারপরই যাবো।'
অলিভিয়া বলল,'হ্যাঁ অদৃত আমরা সব অনুষ্ঠান কাটিয়ে যাবো।'
ইন্দ্রনীল বলল,'একদম।খুব মজা হবে।'
অদৃত হেসে বলল,'নিশ্চই । এখনতো ফ্রেশ হয়ে নীচে আয়। তোদের ক্ষিদে পায়নি? আমার কিন্তু খুব ক্ষিদে পেয়েছে ।'
সৌনক ফ্রেশ হয়ে এসে অদৃতকে বলল,'পত্রলেখাকে দেখছি না তো? ও আসেনি এখনো?'
অদৃত বলল,'না রে।'
সৌনক বলল,'কখন আসবে?'
ইন্দ্রনীল বলল,'বলেছিলাম তাড়াতাড়ি আসতে কিন্তু কোথায়?'
শ্রেয়সী বলল,'একটা ফোন করনা অদৃত।'
অদৃত পত্রলেখাকে ফোন করতে যাবে এমন সময় পত্রলেখা এলো।
সৌনক বলল,'ওইতো পত্রলেখা এসে গেছে।'
অদৃত বলল,'তোমার এতো দেরী হল কেন? এটা তোমার আসার সময় হল?'
পত্রলেখা বলল,'আসলে কেকটা বানাতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল।
সৌনকদা কেমন আছো তুমি?'
সৌনক বলল,'এই তোমার কথাই বলছিলাম আমরা। আমি তো ভালোই আছি, তোমরা দুইজন কেমন আছো?'
পত্রলেখা লজ্জা পেয়ে বলল,'ভালো।'
সৌনক মজা করে বলল,'সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে জল্পনা চলছে, সত্যিই কিছু চলছে নাকি?'
অদৃত একটু বিরক্ত হয়ে বলল,'তোর এই ইয়ার্কিগুলো বন্ধ করতো।'
সৌনক বলল,'কেন?'
এরইমধ্যে অলিভিয়া নীচে এলো।
পত্রলেখা অলিভিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,'কেমন আছো? '
অলিভিয়া বলল,'ভালো। কিন্তু তোমার এতো দেরী হল কেন? তোমার তো আমাদের সকলের আগে আসার কথা। এটা ঠিক হল না।'
শ্রেয়সী বলল,'এবার সবাই খেতে বসবে চলো।'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ সেই বরং ভালো।'
অদৃত পত্রলেখাকে জিজ্ঞাসা করল,'আঙ্কেল - আন্টি আসবেন না?'
পত্রলেখা বলল,'হ্যাঁ আসছেন । আমি তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। বাবা-মা আমার বেড়ানোর একটু পরেই বেরিয়েছেন। এক্ষুনি এসে পড়বেন।'
অদৃত বলল,'আচ্ছা ।'
ইন্দ্রনীল বলল,'সৌনক তোমরা নিরঞ্জনের সাথে যাও, আমরা এক্ষুনি আসছি।'
সৌনক বলল,'ঠিক আছে আঙ্কেল।'
পত্রলেখা মুখটা একটু ব্যাজার করে অদৃতের হাত ধরে বলল,'তুমি কাল রাতে আমার ফোন ধরলে না কেন?'
অদৃত পত্রলেখার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,'বলেছিলাম তো আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম তাইজন্য ধরতে পারিনি।'
পত্রলেখার অদৃতের এইরূপ আচরণে খারাপ লাগল। সে বলল,'আচ্ছা।'
অদৃত অনেকক্ষণ ধরে আর্যকে না দেখতে পেয়ে শ্রেয়সীকে বলল,'মা আর্যকে দেখেছো?'
শ্রেয়সী বলল,'না তো। আমি তো সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলাম। ওর সাথে একবারও দেখা হয়নি আমার।'
ইন্দ্রনীল বলল,'কি হয়েছে? কি কথা বলছো তোমরা? ওইদিকে সুব্রত আর পিয়ালি চলে এসেছে।'
শ্রেয়সী বলল,'আচ্ছা । আমি দেখছি।'
অদৃত ইন্দ্রনীলকে বলল,'বাবা তুমি আর্যকে দেখেছো?'
ইন্দ্রনীল বলল,'হ্যাঁ আমিতো ওকে গার্ডেনের ডেকোরেশনের দিকটা দেখতে বলেছিলাম।খুব সুন্দর লাগছে গার্ডেনটা। ওর নির্দেশ মতোন ছেলেগুলো খুব সুন্দর সাজিয়েছে । ওকে নিজেমুখে কথাটা জানাতে পারিনি। আমিও খুঁজছিলাম এই কথাটা বলবো বলে কিন্তু নিরঞ্জন বলল, ও ঘরে আছে। হয়তো বিশ্রাম করছে তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।'
অদৃত বলল,'ঠিক আছে আমি ওকে নিয়ে আসছি।এমনিতেও তো লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।'
ইন্দ্রনীল বলল,'হ্যাঁ, সেই বরং ভালো।'
অদৃত আর্যর ঘরে গিয়ে দেখলো , আর্য দাঁড়িয়ে একমনে তার হাতে থাকা একটা ছবির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
অদৃত পিছন দিক থেকে আর্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,'কি দেখছো?'
আর্য বলল ,'কিছু না ।'
অদৃত বলল,'না কিছু তো একটা দেখছো। কি দেখছো?'
আর্য বলল,'তোমার গিফ্ট ।'
অদৃত বলল,'দেখি।'
আর্য হেসে বলল,'এখন না । নীচে গিয়ে দেবো যখন, তখন দেখবে।'
অদৃত বলল,'একবার একটুখানি দেখি তো।'
আর্য বলল,' আগে দেখে নিলে উপহারটা নেওয়ার সময় কোনো আর উৎসাহই থাকবে না। আর তাছাড়া আমি উপহারটা আগে দেখিয়ে দিলে সেটা তো আর তোমার কাছে সারপ্রাইজই থাকবে না ।'
অদৃত বলল,'ঠিক আছে। এমনিতেও আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এখন চলো তাহলে।'
ডাইনিং টেবিলে সৌনক আর্যকে দেখে রীতিমতোন অবাক। সৌনক কিছু বলতে যাবে এমন সময় অদৃত ইশারায় তাকে চুপ করতে বলল।
অলিভিয়া বলল,'তুমি আর্য না?তোমাকে আমি অদৃতের ফ...'
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই অদৃত বলল,'হ্যাঁ। আর্য বোসো, পত্রলেখা বোসো না। অলিভিয়া তুমি তো প্রথমবার আমাদের বাড়িতে এলে। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?'
অলিভিয়া বলল,'না। তোমাদের বাড়িটা আমার খুব ভালো লেগেছে।'
অদৃতের এমন আচরণে অলিভিয়া বেশ অবাক হল।
অদৃত বলল,'পত্রলেখা তুমি বসো।'
পত্রলেখা বলল,'হ্যাঁ বসছি কিন্তু তার আগে আমার তোমাকে কিছু দেওয়ার আছে।'
পত্রলেখা একটি ফুলের তোড়া এবং একটি রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহার অদৃতের সামনে রেখে বলল,'খুলে দ্যাখো পছন্দ হয়েছে কিনা?'
অদৃত বলল,'আরে এইসবের কি দরকার ছিল।'
পত্রলেখা বলল,'একবার দ্যাখো তো।'
সৌনক বলল,'হ্যাঁ দ্যাখতো। আমি আর উৎসাহ ধরে রাখতে পারছি না।'
অদৃত রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারটি খুলে দেখলো পত্রলেখা তার প্রিয় কবির দুটি দামী বই তাকে উপহার দিয়েছে।
অদৃত খুশি হয়ে বলল,'থ্যাংক ইউ সো মাচ! আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই মানুষটির লেখা বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে, ইনি হলেন আমার প্রিয় কবি।'
পত্রলেখা বলল,'জানি তো তোমার ওনার লেখা পড়তে খুব ভালো লাগে। ওইজন্যই আমি এনার বই দিয়েছি।'
শ্রেয়সী বলল,'পত্রলেখা আমাদের সকলের পছন্দ- অপছন্দের দিকে লক্ষ্য রাখে।'
আর্য চুপ করে রইলো।
সৌনক অদৃতের দিকে উপহারের ছোট্ট বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,'এইটা আমার আর অলিভিয়ার তরফ থেকে একটা ছোট্ট উপহার।'
অদৃত উপহারের বক্সটি খুলে দেখলো,বক্সটির মধ্যে রাখা আছে একটি দামী বিদেশী সেন্ট।
অদৃত বলল,'এতো কিছুর কি দরকার ছিল?'
শ্রেয়সী বলল,'এই স্যুটটা আমার তরফ থেকে।'
ইন্দ্রনীল বলল,'এই ফোনটা আমি দিলাম তোকে।'
সুব্রত বলল,'আমার আর পিয়ালির তরফ থেকে একটা ঘড়ি রইলো।'
আর্য এতকিছু দামী উপহারের মাঝে তার উপহারটি অদৃতকে দিতে লজ্জিত বোধ করল। সে উপহারটি নিয়ে বসে রইলো।
অদৃত বলল,'আর্য এবার দেখাও আমার উপহারটা।'
আর্য একটু সঙ্কোচ করে উপহারটি অদৃতের সামনে রাখলো। অদৃত দেখলো আর্য তাকে নিজের হাতে আঁকা ছবি উপহার দিয়েছে । ছবিটির কোথাও অধিক মূল্যের বাহুল্য নেই। ছবিটি খুব সুন্দরভাবে বাঁধানো । এই উপহারটি সে নিজেই আর্যর কাছ থেকে চেয়েছিল। সে দেখলো পেইন্টিংটিতে দুটি ছেলে সমুদ্রের সামনে একটা কাগজিফুল গাছের নীচে থাকা একটা চেয়ারে বসে আছে আর সেই গাছটি থেকে ঝড়ে পড়ছে অসংখ্য গাঢ় গোলাপী বর্ণের ফুল।
অদৃত ছবিটি দেখে বলল,'বাহ্! ছবিটা কি সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।'
শ্রেয়সী এবং ইন্দ্রনীল বলল,'আর্য ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে । তুমি এঁকেছো ?'
আর্য বলল,'হ্যাঁ।'
সন্ধ্যাবেলায় অদৃত আর্যর ঘরে গিয়ে বলল,'আর্য দ্যাখো তো আমাকে ভালো লাগছে?'
অদৃতের পরনে তখন গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবী এবং সাদা রঙের পাজামা । অন্যদিনের তুলনায় চোখের চশমার ফ্রেমটাও আজকে অন্যরকম লাগছে । আজকে তার চশমার ফ্রেমটা অন্যদিনের তুলনায় তুলনামূলক একটু মোটা।
আর্য বলল,'খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।'
অদৃত বলল ,'তোমাকেও ভালো লাগছে আর্য। সাদা শার্টটায় দারুণ মানিয়েছে তোমাকে। কিন্তু.....'
আর্য বলল,'কিন্তু কি?'
অদৃত বলল,'হেয়ার স্টাইলটা। হেয়ার স্টাইলটা একটু ঠিক করতে হবে। এইদিকে এসো।'
আর্য বলল,'উফ্! ঠিক আছে তো।'
অদৃত বলল,'না ঠিক নেই। চুপ করে বোসো ।'
আর্য টুলের ওপর বসে বলল,'সকালে আমার দেওয়া উপহারটা তোমার পছন্দ হয়েছে ? আমি সবার মতোন দামী উপহার দিতে পারিনি। কিন্তু.....'
অদৃত বলল,'মানে? উপহার দামী হলেই কি সেটা সুন্দর? সেটা আমার পছন্দ হবে?'
আর্য চুপ করে রইলো।
অদৃত বলল,'হ্যাঁ তোমার আঁকা ছবিটা অধিক মূল্যের নয়।'
আর্য অদৃতের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো।
অদৃত বলল,'কিন্তু তোমার আঁকা ছবিটা আমার কাছে বহুমূল্যের, ছবিটায় হয়তো অধিক মূল্যের বাহুল্য নেই,জাঁকজমক নেই। কিন্তু ছবিটার মধ্যে আছে তোমার অন্তরের ভালোবাসা। কারণ তুমি উৎসাহ নিয়ে তোমার সমস্ত পরিশ্রম, ভালোবাসা দিয়ে ছবিটা আমার জন্য এঁকেছো। তুমি ভাবলে কি করে আমার ছবিটা পছন্দ হবে না? তোমার কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটা উপহারই আমার কাছে বিশেষ এবং খুব পছন্দের । সত্যি বলছি আর্য আমার তোমার দেওয়া উপহারটা সবথেকে বেশি পছন্দ হয়েছে। তুমি জানো আমি ওটা নিজের ঘরে টাঙিয়েছি?'
আর্য উৎসাহ নিয়ে বলল,'সত্যিই তোমার পছন্দ হয়েছে?'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ খুব পছন্দ হয়েছে। তবে আর্য আমি তোমার কাছ থেকে যখন এরকম ধরনের ছবি চেয়েছিলাম,কখনো ভাবিনি তুমি বিষয়টা এমন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবে। খুব সুন্দর হয়েছে।'
আর্য সলজ্জ হাসি হাসলো।
হেয়ার স্টাইল করে দেওয়ার পর অদৃত বলল,'দ্যাখো আর্য কেমন লাগছে?'
আর্য বলল,'বাহ্!ভালো লাগছে।'
অদৃত বলল,'কে করেছে দেখতে হবে তো।'
এরইমধ্যে নিরঞ্জন ডাকলো,'অদৃতবাবা......!
অদৃতবাবা.......!'
আর্য বলল,'নিরঞ্জন কাকার গলা মনে হচ্ছে । তোমাকে ডাকছে।'
অদৃত বলল,'দেখছি।
কি হয়েছে নিরঞ্জন কাকা?'
নিরঞ্জন বলল,'তোমাকে নীচে সবাই ডাকছে। ম্যাডাম, পত্রলেখা দিদিমণি তোমার খোঁজ করছে। তাড়াতাড়ি এসো।'
অদৃত বলল,'আসছি।
আর্য আমি নীচে গেলাম। তুমি তাড়াতাড়ি এসো। দেরী কোরোনা।'
আর্য বলল,'ঠিক আছে।আমি আসছি।'
অদৃত গার্ডেনে গিয়ে দেখলো তাদের গার্ডেনটা আজ বেলুন, ফুল এবং অসংখ্য ছোট ছোট টুনি লাইটের আলোয় সেজে উঠেছে। গার্ডেনের পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেছে আজ। গার্ডেনে থাকা ছোট্ট ফোয়ারার চারপাশটা পদ্মফুল এবং মোমে সেজে উঠেছে । গোটা গার্ডেনে আজ কত আয়োজন।
ইন্দ্রনীল ব্যস্ত হয়ে বলল,'আরে তুই কোথায় ছিলিস? কতক্ষণ ধরে আমরা তোকে খুঁজছিলাম? তোর সব বন্ধুরা চলে এসেছে।'
অদৃত বলল,'এই তো এসে গেছি।'
সৌনক এবং ত্রিদিব বলল,'অদৃত তোকে আজকে দেখতে দারুণ লাগছে! '
অদৃত বলল,'আরে ত্রিদিব তুই কখন এলি?'
ত্রিদিব বলল,'এই একটু আগে।'
অদৃত বলল,'রাইমা আর মেয়ে এসেছে?'
ত্রিদিব বলল,'হ্যাঁ সবাই এসেছে।'
অলিভিয়া বলল,'অদৃত তোমার থেকে তো আমি চোখই সরাতে পারছি না।'
সৌনক বলল,'এই শুরু হল।'
অদৃত হেসে বলল,'আরেকজন কিন্তু জেলাস হয়ে পড়ছে।'
কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠলো।
সৌনক বলল,'একটা মিনিট তোরা কি রোম্যান্টিক রে! একসাথে দুইজনে একই রঙের ড্রেস পড়েছিস।'
অদৃত বলল,'তোরা মানে?'
সৌনক বলল,'অবশ্যই তুই আর পত্রলেখা।'
অদৃত বলল,'সৌনক শোন আমার তোকে কিছু ....'
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই পত্রলেখা অদৃতের হাতটা ধরে বলল,'বাহ্! অদৃত আজকে তোমাকে দেখতে দারুণ লাগছে। '
অদৃত বলল,'ধন্যবাদ ।'
পত্রলেখা বলল,'আচ্ছা,আমাকে শাড়ি পড়ে কেমন লাগছে?'
অদৃত পত্রলেখার হাতটা সরিয়ে বলল ,'হুম্ । ভালো লাগছে।'
পত্রলেখা অদৃতের এইরূপ ব্যবহার দেখে একটু ভুরু কুঁচকালো।
অলিভিয়া বলল,'তোমাকে খুব মিষ্টি লাগছে পত্রলেখা।'
পত্রলেখা বলল,'থ্যাংক ইউ!'
সৌনক বলল,'তোরা দু'জনে পাশাপাশি দাঁড়া তোদের একটা ছবি তুলে দিই।'
এরইমধ্যে আর্যকে গার্ডেনে আসতে দেখে অদৃত বলল,'আর্য এসো না এখানে ফটো তোলা হচ্ছে।'
আর্য তাদের দিকে যাবে এমন সময় পত্রলেখা অদৃতের হাত ধরে বলল,'প্লিজ অদৃত! তুমি আর আমি আগে একটা ছবি তুলে নিই তারপর না হয় তুমি সবার সাথে ছবি তুলো।
প্লিজ!প্লিজ অদৃত!প্লিজ!'
অদৃত হেসে বলল,'আচ্ছা ঠিক আছে।'
আর্য এই দৃশ্য দেখে সরে এলো। হঠাৎই ত্রিদিব আর্যর পিছন থেকে বলল,'আরে আর্য যে। আমি কখন থেকে তোমাকে খুঁজছিলাম, কোথায় ছিলে?'
আর্য বলল,'আসলে আমার তৈরী হতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, তাই এখানে আসতে দেরী হয়ে গেল।'
ত্রিদিব অদৃত এবং পত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলল,'তুমি অদৃতকে ভুল বুঝোনা।'
আর্য বলল,'না না আমি ভুল বুঝছি না।'
ত্রিদিব বলল,'আজকে আমার ভাইটাকেও খুব সুন্দর লাগছে। জামাটা খুব সুন্দর হয়েছে ।'
আর্য বলল,'এটা অদৃতই দিয়েছে।'
ইন্দ্রনীল বলল,'এইবার অদৃত কেক কাটবে তাই আপনারা সকলে একটু এইদিকে এগিয়ে আসুন ।'
কেকটা দেখে সৌনক বলল,'পত্রলেখা কেকটা কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে ।'
অলিভিয়া বলল,'সুন্দর হবে না আবার। ও এতো ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে বানিয়েছে।'
ত্রিদিব বলল,'আমাদের অদৃতও কিন্তু খুব ভালো কেক বানায়।'
অলিভিয়া বলল,'তাই!'
শ্রেয়সী বলল,'হ্যাঁ, রান্না করাটা ওর প্যাশন, খুব ভালোবাসে রান্না করতে। '
অদৃত কেক কাটলো। কেক কেটে সে প্রথম টুকরোটি তার মা'কে খাওয়ালো, তারপর তার বাবাকে, তারপর পত্রলেখাকে। আর্য মনমরা হয়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলো ।
অদৃত কিছুক্ষণ পর আর্যকে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বলল,'হা করো।'
আর্য বলল,'কেন?'
অদৃত বলল,'করোই না।'
আর্য বলল,'ঠিক আছে। '
আর্য হা করতেই সে তার মুখে ছোট এক টুকরো কেক পুরে দিয়ে বলল,'এবার এটা আমাকে খাইয়ে দাও। '
আর্য বলল,'কেন?'
অদৃত বলল,'আমি তখন তোমাকে খাওয়াতে পারিনি সবার মাঝে। হিসেব মতোন তো বাবা-মায়ের পর কেকটা তোমাকে খাওয়ানোর কথা ছিল।
যাইহোক তাড়াতাড়ি আমাকে খাইয়ে দাও।'
আর্য তাকে কেক খাইয়ে দিলো।
ত্রিদিব এসে বলল,'আরে তোরা এখানে। আন্টি আঙ্কেল তোকে খুঁজছেন অদৃত।'
অদৃত বলল,'হ্যাঁ আসছি। চলো আর্য।'
ইন্দ্রনীল অদৃতকে ডেকে বলল,'অদৃত এইদিকে আয়। পত্রলেখার পাশে দাঁড়া।'
অদৃত বলল,'কেন?'
শ্রেয়সী বলল,'এক্ষুনি জানতে পারবি।'
অদৃত হেসে বলল,'ঠিক আছে।'
ইন্দ্রনীল বলল,'প্রত্যেক বারের মতোই এই বছরও শ্রেয়সী এই সমস্তকিছু নিজের হাতে আয়োজন করেছে, আমরা প্রতিবছরই এইদিনটা খুব কাছের মানুষদের সাথে কাটাই। প্রেস , মিডিয়া এইসবের থেকে দূরে থাকি। আপনাদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ , এই অনুষ্ঠানে আসার জন্য। আপনাদের সকলের কাছে আমাদের আজ একটা বিশেষ ঘোষণা আছে। '
শ্রেয়সী বলল,'অদৃত কলকাতায় থাকাকালীন আমি ওকে বলেছিলাম ও এখানে এলে ওর জন্য একটা বড়ো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। আর সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমার মনে হয় জন্মদিনের থেকে ভালো দিন আর কিছু নেই।
আমার ছেলে অদৃত সারাজীবন নিজের তুলনায় অন্যের কথা সবসময় বেশি ভাবে, সবসময় অন্যের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখে। কখনো নিজের কথা ভাবে না। কিন্তু এখন আমাদের বয়স হয়েছে আজ আছি কাল নেই, তাই আমরা ঠিক করেছি এইবার অদৃতের একটা জীবনসঙ্গীনীর প্রয়োজন আছে, যে ওকে বুঝবে,যে ওর খেয়াল রাখবে, যে ওর কথা ভাববে আর যে ওকে খুব ভালোবাসবে। আর আমাদের কাছে এরকম মেয়ের খোঁজ আছে। আর সেই মেয়েটি হল পত্রলেখা। হ্যাঁ, আমরা পত্রলেখাকেই আমাদের বাড়ির বউমা করে আনতে চাই। তাই আমরা অদৃতের সাথে পত্রলেখার বিয়ে ঠিক করেছি। এতে আমাদের দুই পরিবারেরই মত আছে।'
কথাটা শুনে অদৃতের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল ।
শ্রেয়সী আরো বলল,'ওরা একে অপরকে ছোটবেলা থেকে চেনে, একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড। আর পত্রলেখা আমার বউমা নয় আমার মেয়ে। আমাদের কাছে পত্রলেখা অদৃতের উপযুক্ত জীবনসঙ্গীনী। ওর মতোন যোগ্য মেয়ে হয়তো আমরা আর পাবো না । ওর মতোন করে ভালো হয়তো আমার অদৃতকে কেউ রাখতে পারবে না আর না পারবে ওর মতোন করে ভালোবাসতে। আর আমার মনে হয় ওরা দুজনেই এই বিয়েতে রাজি তাইতো?'
পত্রলেখা সলজ্জ হাসি হেসে অদৃতের হাতে হাত রেখে বলল,'হ্যাঁ রাজি।'
কথাগুলো শুনতে শুনতে আর্যর মুখের হাসিটা ক্রমশ বীলীন হতে লাগল, চারপাশটা কেমন যেন তার ঝাপসা মনে হচ্ছে , দুটো চোখ ছল ছল করে উঠলো। নিষ্পলক তার সেই দৃষ্টি।
সৌনক বলল,'ওহহ্! পারফেক্ট ম্যাচ। দুইজনকে দারুণ মানায়। কিরে অদৃত আমরা যখন তোর পিছনে লাগতাম পত্রলেখাকে নিয়ে তুই এইজন্যই রেগে যেতিস? তুই পত্রলেখাকে নিয়ে এতোটা সিরিয়াস ছিলিস।'
অলিভিয়া বলল,'আরে এইভাবে বোলোনা ওরা তো লজ্জা পাবে।'
অদৃতের আরেক বন্ধু বলল,'অবশেষে বিয়ে। আমরা এইদিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম। সারাক্ষণ দুইজনে একসাথে থাকতো। দুজনের মধ্যে কত মিল। দুজনের প্যাশন রান্না করা, দুজনেই ঘুরতে ভালোবাসে। আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। নয়তো কেন সবসময় অদৃত পত্রলেখার আবদার মেটাবে? অথচ দুইজনের একজনও কেউ স্বীকারই করতো না ।'
আরো কত কি বলল তারা, সবাই তাদের দু'জনকে শুভেচ্ছা বার্তা জানালো ।
আর্যর কষ্টে বুকটা ফেঁটে যেতে থাকলো। তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে , তার ঢোক গিলতে রীতিমতোন কষ্ট হচ্ছে। সে থাকতে না পেরে চোখভর্তি জল নিয়ে গার্ডেন থেকে বেরিয়ে গেল।
To be continued.....................

