অন্য মনে[1m parbo]
অন্য মনে[1m parbo]


সপ্তপর্নী পাশের ঘর থেকেই শুনতে পায় সিদ্ধার্থের ঘরের জানালাগুলো ঝড় এর
দাপটে আওয়াজ করছে।যা বৃষ্টির ছাঁট আসছে এক্ষুনি সব ভিজে যাবে।ছুটে গিয়ে
জানালাগুলো বন্ধ করে দেয় সপ্তপর্নী।তাকিয়ে দেখে সিদ্ধার্থ পাশ ফিরে
ঘুমাচ্ছে।বেচারা কাল অনেক রাতে ফিরেছে, ঘুমাক আর একটু।একটু পরেই চা খেতে
ডাকব, ভেবে সপ্তপর্নী বেরোতে যাবার সময়েই সিদ্ধার্থ বলে ওঠে-
"কাল কখন এলেন?"
"ঘুমান নি আপনি?
কাল সকালে এসেছি, আপনি অনেক রাত্রে ফিরেছেন তাই আর দেখা করি নি।"-বললো
সপ্তপর্নী।
"হ্যাঁ কাল নদীর ওপারের গ্রামে একবার গিয়েছিলাম।ওখানে যে সাঁওতাল পাড়া
আছে ,এবারে দূর্গাপূজা করবে ঠিক করেছে।তাই আমায় একবার ডেকেছিল।হঠাত্
বৃষ্টি নামাতে আটকে পড়েছিলাম।"
"হ্যাঁ সারা রাতই তো বৃষ্টি হয়েছে।"
সিদ্ধার্থ জিজ্ঞাসা করলো -"আজ ই আপনার স্কুল খুলছে?"
"না না কাল।একদিন আগে থাকতেই আপনাদের জ্বালাতে চলে এসেছি"-হেসে বললো
সপ্তপর্নী।
সেই সময় ঘরে চা নিয়ে ঢোকে নমিতা।সপ্তপর্নীর কথাটা তার কানে যায়।হেসে
বলে-"হ্যাঁ গো দিদিমণি তুমি কবে আসবে তার জন্য দাদু নাতি হাঁপিয়ে
উঠেছিল।এখন আর এই নমিতার রান্না বাবুদের মুখে রোচে না।তুমি কি সব স্পেশাল
রান্না কর, ওসবই ভাল লাগে।"
"তাই বুঝি নমিতাদি?তা এই কথাটা কবে কখন বললাম তোমায়!"-বলে সিদ্ধার্থ
নমিতার কোলে শুয়ে পড়ে।
"ওসব কথা বলতে লাগে না মুখ দেখলেই বোঝা যায়।খাবার টেবিলে বসে ভাত নাড়া
চাড়া করে উঠে যাও দেখতে কি পাই না?"
"ঠিক আছে নমিতা দি তোমাকে আমি গোয়েন্দা দপ্তরে চাকরি দেব।তার আগে একটু
চুলে বিলি কেটে দাও তো।"
দুজনের খুনসুটি দেখে হাসতে হাসতে সপ্তপর্নী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।বারান্দায়
গিয়ে দাঁড়ায়।বৃষ্টির ছাঁট গুলো গায়ে এসে লাগে।খুব ভাল লাগে।ওর যেখানে
বাড়ি আধা শহর।এখানে এখনো চারপাশটা প্রচুর সবুজ টিকে রয়েছে।গ্রামটা খুব
নির্জন। স্কুলের চাকরি পাওয়ার পর এই গ্রামে যে কোথায় থাকবে ভেবে
কূলকিনারা পায় না সপ্তপর্নী।শেষে সিদ্ধার্থর দাদু দিগম্বরবাবু নিজেই
উপযাচক হয়ে সপ্তপর্নীকে বলেন তার বাড়িতে থাকার জন্য।দিগম্বর বাবু কলেজের
প্রাক্তন অধ্যাপক।সপ্তপর্নীর স্কুলের সেক্রেটারি।খুব
সজ্জন.ধীর,স্থির,রুচিশীল শিক্ষিত মানুষ।দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে
আসে।গ্রামের সবাই ওনাকে ভগবান বলে।আর একজনও তাদের চোখে ভগবান।সে হল
সিদ্ধার্থ। ।ছোট বেলায় পিতৃ-মাতৃহীন সিদ্ধার্থ তার দাদুর আদর্শে বড়
হয়েছে।এখন কাছের শহরের একটা কলেজের অধ্যাপক।আর গরীব দুঃখী
মানুষের একমাত্র সহায় সম্বল তাদের সিদ্ধার্থ দাদা।কোথায় মেয়ের বিয়ে হয়নি
টাকার অভাবে, কোথায় কে খেতে পায়নি, কার জমি বেনামে কেড়ে নিয়েছে, কার
চিকিত্সার টাকা নেই ,মোট কথা সব কাজে নির্দিদ্ধায় ঝাঁপিয়ে পড়ে
সিদ্ধার্থ।বিভিন্ন পার্টি থেকে ওকে বহুবার ভোটের টিকিট দিতে চেয়েছে
কিন্তু এসব ব্যাপারে ও একেবারেই জড়াতে চায় না।প্রথম দিগম্বর বাবুর সাথে
যেদিন সপ্তপর্নী এসেছিল, সিদ্ধার্থ বাগানে একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ
পড়ছিল।গেট ঠেলে ওরা ঢুকতেই কাগজ ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল।সপ্তপর্নীর
হৃত্পিন্ড যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সিদ্ধার্থের চোখের দিকে তাকিয়ে।এ চোখ
তো তার স্বপ্নের চোখ, বহু পুরুষ তার জীবনে আসতে চেয়েছে কিন্তু সে তো
অপেক্ষা করেছে শুধু এই রকম একটি চোখের আশায়।ভীষণ আপন ভীষণ চেনা লাগে
তার।রক্ত যেন চলকে ওঠে তার।
বাড়িতে মানুষ বলতে সিদ্ধার্থ, তার দাদু আর নমিতা।নমিতা যদিও এবাড়ির কাজের
লোক কিন্তু সেটা নামেই।নমিতাই সিদ্ধার্থর দিদি,মা সব।আর দিগম্বর বাবুর
মেয়ে,নাতনি সবটুকু।নমিতার মা কাজ করত এ বাড়িতে।তখন নমিতার 14 বছর
বয়েস।কিছুদিন আগেই বাবা মারা যায় নমিতার।এক রাত্রে নমিতার মা কাজ থেকে
ফেরবার পথে কিছু জানোয়ার ছিঁড়ে খায় তাকে।অপমানে সেদিন নিজেকে শেষ করে
দেয়।তখন ঐ ছোট্ট নমিতাকে বুকে তুলে নেন দিগম্বর বাবু।আশপাশের লোকজন এমনকি
তার ছেলেও আপত্তি জানায়, কিন্তু জেদী মানুষটা কোনো কথাই শোনে না।এর
কিছুদিন পরেই সিদ্ধার্থর বাবা-মা রোড অ্যক্সিডেন্টে মারা যায়।তখন চার
বছরের সিদ্ধার্থর মা,দিদি হয়ে ওঠে নমিতা।নমিতা মাধ্যমিক দেয় কিন্তু
বারবার দিগম্বর বাবু বললেও আর পড়াশোনা করে না শুধু মাত্র সিদ্ধার্থকে
দেখা শোনা করবে বলে।
দূর থেকে সাধু বাউল এর গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।সাধু বাউল পাশের গ্রামে থাকে।
মাঝে মাঝে এবাড়িতে এসে থাকে।দিগম্বর বাবুর সাথে খুব ভাল মেলে।দুজনের কথা
যেন ফুরাতেই চায় না।সাধু বাউল প্রকৃতপক্ষে বাউল যাকে বলে তা
নয়।শান্তিনিকেতন থেকে পড়াশোনা করে চাকরি পায়।কিছুদিন চাকরি করার পর কি হয়,
সব ছেড়ে ছুড়ে গ্রামে চলে আসেন।সকলে তাকে বাউল বললে হেসে বলেন-"দুর আমি
আবার বাউল, ওরে বাউল হওয়া কি আর এত সহজ।মনে গোপনে এখনও পাঁকের চটচটে
কাদা।ধোয়া মোছা তো এতদিনেও সাঙ্গ হল না।এ যে বড় কঠিন সাধনা।"বলেই দাড়ি
ভরা মুখে শিশুর মত হেসে উঠে হাতের একতারা বাজিয়ে গান শুরু করেন-"এ মন কি
আর বাউল হল রে/সাধন পূজন করা কি আর এ জনমে হল রে/ওরে মন,ওরে মন লোকে তবে কেন কয় মোরে ওরে বাউল রে।"
কোথাও একটা বাজ পড়ে।সপ্তপর্নী অল্প অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।বাগানের দিকে
তাকিয়ে দেখে কাঁঠাল গাছটা রাতের ঝড়ে একদম ভেঙে পড়েছে।ঐ গাছটাতেই তো
ছোট্ট ছোট্ট পাখি গুলো বাসা বেঁধে ছিল!দেখে, বাসাটা নীচে পড়ে।ছুটে বাগানে
যায় সপ্তপর্নী।
বৃষ্টিটা কিছুটা কমেছে ,ঘরটা বেশ গুমোট লাগে জানালাগুলো খুলে দেয়
সিদ্ধার্থ।বাগানে নজর পরে সপ্তপর্নী গাছের নিচে ঝুঁকে কি করছে আর একটা
গাছের ডাল এক্ষুনি ভেঙে পড়বে ওর মাথায়।একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে
যায় সিদ্ধার্থ।হ্যাঁচকা টানে টেনে নেয় সপ্তপর্নীকে।সপ্তপর্নী চমকে
ওঠে।সিদ্ধার্থ ভেবেছিল একটু বকবে সপ্তপর্নীকে কিন্তু ওর হাতে ছোট্ট ছোট্ট
পাখির ছানা গুলোকে দেখে আর কিছু বলতে পারে না।একমিনিটের জন্য দুজনের চোখ
থেমে যায় দুজনের চোখে এসে।এই প্রথম সিদ্ধার্থ মা,বোন,দিদি ছাড়াও আরও কিছু
যেন খুঁজে পেল সপ্তপর্নীর চোখেতে।কি এর নাম নিজেই বুঝে উঠতে পারে না।এর
নাম ই কি ভালবাসা!চিরকাল মেয়েদের মা আর দিদি-বোন এর চোখেই দেখে এসেছে কত
মেয়েই তাকে অন্য চোখে দেখে সে বুঝে ও বুঝতে চায়নি।তাদের সে বোনের মতই
ভেবেছে।(চলবে)