অন্য বড়োদিন
অন্য বড়োদিন


"কাকু, ও কাকু কেকটা কতো গো?" কদমতলার দোকানগুলোয় কেকের মেলা বসেছে যেন। দোকানের সামনে টেবিলের উপরে হলুদ রঙের লাইটিং পেপারে মোড়া নানান আকারের সব কেক। কেকগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা বছর সতেরোর বাচ্চা মেয়ে। পড়নে একটা মেরুন রঙের সালোয়ার আর একটা ছাই রঙা সোয়েটার। গুটি গুটি পায়ে সবগুলো স্টলেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনও টাই যেন ঠিক মনে ধরছেনা। হাতের মুঠোতে দুশো টাকার একটা নোট নিয়ে একটা স্টলের সামনে সমানে ঘুরঘুর করে চলেছে। ঐ তো ঐ তো ঐ কেকটা কি সুন্দর! উপরে লাল হলুদ সবুজ রঙের টুটি ফ্রুটি বসানো। আবার একটু মোরব্বাও দেখা যাচ্ছে না! হ্যাঁ তাই তো!
"ও কাকু ঐ কেকটার কতো দাম গো? দাও না গো ওটা!" উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে মুঠো করা হাতটা বাড়িয়ে দিল মেয়েটি।
"উফফফ বাবা কি জ্যাম!" টোটোটা নিয়ে এগোতে এগোতে মুখটা ব্যাজার করে মনে মনে বলে উঠলো নকুল। বছরের এইসব দিনগুলো ডিবিসি রোডের রাস্তাটায় প্রচুর ভীড় থাকে। সত্যি ই বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণই বটে।
" ও দাদা?" একজন মাঝবয়সি মহিলার ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নকুল, " দিনবাজার যাবেন?
" না" বিরক্ত মুখে বলল নকুল। এখন হাজার কেউ ডাকলেও ভাড়া আর তুলবেনা সে। নিজের সিটের পাশে রাখা প্যাকেটটাকে আরেকটু গা ঘেঁষে রাখলো।
"ও দাদা চলুন না। বেশি দূরে না! গলিতে ঢুকতে হবেনা। ঐ দিনবাজার পুলের মুখে নামালেই চলবে।" এবার একটু ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখতেই কেমন যেন লাগলো।এই হাঁড় কাপানো ঠান্ডায় মহিলার গায়ে একটা শতছিদ্র চাদর জড়ানো। চাদরের এককোণা দিয়ে একটা কিছু আঁকড়ে ধরে রয়েছে।
"চলুন।গলিতে ঢুকতে পারবোনা কিন্তু!"
" বাবা মা আমি তিনজনে মিলে খাবো কেকটা। কি মজা! " কেকটার দিকে তাকিয়েই মনটা নেচে উঠলো মেয়েটির, "কি মজা!" নিজের টিউশন এর টাকা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এই টাকাটা।
"ঐ যে ঐ যে ঐ কেকটা কাকু..."
"একটু তাড়াতাড়ি যাবেন দাদা? মেয়েটার জন্য কেকটা নিয়েছি তো..খিদে পেটে ছটপট করছে হয়তো... "
" হুমম। রাস্তায় যা ভিড় দিদি.." বিরক্ত মুখে বললো নকুল। উত্তরের প্রত্যুত্তর কিছু এলোনা। মিনিট দশেকের মধ্যেই দিনবাজারটা পেরিয়ে এলো টোটোটা। নকুল আঁচ করে দিনবাজারের পুলটা পেরিয়ে ঝাড়ুদার পট্টির দিকেই একটু এগিয়ে এলো।
" দাঁড়ান দাদা।" শুনেই নকুল রাস্তাটায় টোটো টা থামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মহিলাটি ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়বে। কিন্তু কোথায় কি? একটু বাদে ঘাড় ঘোরাতেই দেখে পেছনটা ফাঁকা। একি! এটুকু সময়েই মহিলা হাওয়া! কি হলো ব্যাপারটা! গেলেন কোথায়? এখন কোথায় খুঁজবে তাকে? মেজাজ টা খিঁচড়ে গেল নকুলের। এমনিতে উল্টো দিকে এলো তার উপর এমন ধারা চিটিংবাজি!
"ধুররর শালা।এরপর ঐ মহিলাকে রাস্তায় পাই শুধু কোনওদিন!শালা এজন্যেই বলে লোকের ভালো করতে নেই।"
"ও বাবা চলো না..." রাস্তাতেই বাবার হাতটা ধরে টানাটানি করছে একটা বছর সাতেকের বাচ্চা ছেলে। পাশাপাশি একজন বছর চল্লিশের ভদ্রলোক নির্দ্বিধায় ছেলের আবদার মিটিয়ে চলেছে। পায়ের ছেঁড়া মোজা পরিবর্তন করার বদলে ছেলের মাথায় সান্তাক্লজ টুপি সাজিয়েই তার আনন্দ।
" না বাবা ঐ গাড়িটা পরদিন কিনে দেব বাবা।" ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে একজন অসহায় বাবার আবেদন।
"না আমার আজকেই লাগবে.." ওদিকে অবুঝ ছেলের ছেলেমানুষি আবদারের বন্যা, "ও বাবা!"
"না বাবান.. আচ্ছা চল তো দেখি ওদিকে কি হয়েছে?" হাটতে হাটতে কদমতলার ক্রসিং টার কাছে এসেই একটু থমকে দাঁড়ায় ভদ্রলোক। একদিকে একটা জটলা মতো হয়ে রয়েছে, "ঐ জায়গাটায় কি হয়েছে চল তো দেখি! " বলে ছেলেকে কোলে তুলে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
রাস্তার একদিকে অনেক লোকজন জটলা পাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে। কানাকানি হচ্ছে সবার মধ্যে, ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। একবার মনে হয়েছিল বটে কাউকে জিজ্ঞেস করা উচিৎ! তারপর ভাবলো থাক না! নিজেই গিয়ে দেখি! ভীড়টা একটু পাশ কাটিয়ে দু তিনজন লোকের পেছন থেকে একটু উঁচু হয়ে ঘাড় বাড়িয়ে দেখলো জায়গাটা.....
"শালা!" এখনও রাগে গজগজ করে চলেছে নকুল। ঠান্ডার ঝাপটাতেও যেন তার রাগটা ঠিক শান্ত হচ্ছে না, "বাড়িতে বাচ্চা দুটো মুখিয়ে আছে কতক্ষণে গিয়ে পৌছাবো! তার ঠিক নেই! এজন্যই বলে শালা লোকের ভালো করতে নেই।" যতটা সম্ভব জোরে চালাতে শুরু করলো নকুল। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছাতে হবে। বেরোনোর আগে বিন্তিটা বারবার বলেছিল, "বাবা একটু কেক আনবে? অল্প এনো সবাই মিলে খাবো!" কথাটা মনে পড়তেই আরো জোরে এগিয়ে চললো নকুল।
মাশকলাই বাড়ির ব্রিজটার কাছে আসতেই একটু চমকে গেল। এই সময় টা সাধারণত জায়গাটা নিঃঝুম থাকে। খুব বেশি হলে দু একটা বখাটে ছোকরা দাঁড়িয়ে একটু সুখটান সহ আড্ডা দেয়। কিন্তু আজ বেশ দশ বারো জনের একটা ভীড় নজরে পড়ে নকুলের। ব্রিজের উপর দিয়ে ঝুকে কিছু একটা দেখছে। নকুল সাইড করে টোটো টা দাঁড় করিয়ে রেখে ব্রিজের ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়। পাশের কনক্রিটের রেলিং এর উপর ঝুঁকে নীচের দিকে তাকায় নকুল।
"ও বাবা? বাবা?" ছেলের আদুরে ডাকে ঘোর ভাঙে প্রশান্ত সরকারের। এতক্ষণ ধরে যে ছেলেকে নিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বেমালুম যেন ভুলেই গেছিল। ছেলের ডাকে এবার সম্বিত ফিরে পেল সরকার। ভীড় ঠেলে সামনের দৃশ্য দেখতে গিয়েই যেন কেউ টেনে এক অন্য জগতে নিয়ে গেল প্রশান্তকে। কোনও অচেনা জগৎ, নিষ্ঠুর কোনও এক জগৎ। বছর আঠারো হয়তো! বাচ্চা একটা মেয়ে। সালোয়ার পড়া। গায়ে ধূসর রঙের একটা সোয়েটার।
" ও কাকু। দাও না গো ঐ কেকটা! কত দেবো বলোনা?" টাকাটা এগিয়েই রেখেছে তখন থেকে। তবু যেন দোকানের কাকুটা কথাই শুনছেনা। কখন থেকে ডেকে চলেছে। তবুও কেকটা দিচ্ছে না। সেই কখন রাস্তার ঐ দিক থেকে দেখেছিল কেকটা। কি সুন্দর। তখনই তো দৌড়ে এদিকটায় আসতে গেল...
"ও কাকু দাও না ওটা... " এই তো এবার কাকু ঐ কেকটা তুলেছে। এগিয়ে দিল কেকটা। কিন্তু ওমা... মেয়েটিকে না!! দিল বটে তবে অন্য একজনকে। এবার খুব রাগ হলো রিম্পার। কখন থেকে তো ও ই এই কেকটা চাইছিল। অথচ ওকে না দিয়ে এই কেকটাই উনি নিয়ে গেলেন!! কেন? ও তো টাকাটা বাড়িয়ে রেখেছিল। এবার একবার মুঠোটা খুলে দেখলো রিম্পা, "একি!! আমার টাকা? কোথায়?? হাতেই তো ধরে ছিলাম এতক্ষণ!তবে? কোথাও পড়ে গেছে নাকি!" পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজে চলল। মাত্র তো দুশো টাকা। মাত্র দুমাসের পায়ে হাঁটা। মাত্র দু মাসের খিদে চেপে টাকা বাঁচানো। মাত্র একটা কেকের দাম জমিয়ে রাখা। মাত্র দুশোটা টাকা। দু একজনকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পেল না মেয়েটি। আচ্ছা ঐদিকে ঐ যে ভীড় টা!! ওনারা কেউ দেখেছেন নাকি? দৌড়ে গেল মেয়েটি। খুব সহজেই ভীড়ের মাঝখান দিয়ে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে গেল, কিন্তু কেউ কোনও উত্তর দিল না।
"কিরে পুলিশে খবর দিবি নাকি!! মহিলার বাড়ি কোথায় কে জানে! পুলিশ না এলে.. " ব্রিজের উপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে একটা সন্ডা মার্কা ছোকরা বলে উঠলো। ব্রিজের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা নেমে গেছে ঘাটের দিকে। ঘাটের একপাশে কিছুক্ষণ আগে দুজন নেমেছিল দুটো বিয়ারের বোতল নিয়ে। দৃশ্য টা প্রথম তারাই দেখে। জড়া জীর্ণ একটা শাড়ি পড়া এক মহিলা পড়ে রয়েছে। গায়ের শতছিদ্র একটা খয়েরি রঙের চাদর খানিকটা গায়ের উপর খানিকটা মাটিতে। আর চাদরের ঠিক পাশেই একটা কেকের প্যাকেট, ছোট্ট একটা কেক।
"দিনবাজারে ওনার বাড়ি!" বলতে গিয়ে গলাটা একটু যেন কেঁপে উঠলো নকুলের। এই শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে নকুলের কপালে।
"ঐ তো আমার দুশো টাকার নোটটা!" একটা মেয়ের হাতের মুঠোতে টাকাটা দেখে ওদিকে দৌড়ে গেল রিম্পা। রাস্তার একপাশে একটা মেয়ে পড়ে রয়েছে। ঐ মেয়েটির হাতেই একটা রক্ত মাখা দুশো নোট। নাক আর মুখ দিয়ে সরু একটা রক্তের ধারা বইছে। তাকে ঘিরেই যতো ভীড়। নাম না জানা অচেনা সামান্য একটা মেয়ে।
"বাবা ও বাবা? ও কে? ঐভাবে শুয়ে আছে কেন?" ছেলের অবুজ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা নেই সরকারের। সরকারের পিতৃত্ব যেন ভেতর ভেতর গুমড়ে কেঁদে উঠছে। পাঁজরের কাছটা যেন মুচড়ে উঠছে, "হা ঈশ্বর! এই বাচ্চা মেয়েটা! কার কোল খালি হলো!"
"ওমা! ও তো আমার মতোই দেখতে!" রিম্পা চেঁচিয়ে উঠলো। হাত নেড়ে নেড়ে সকলকে দেখানোর চেষ্টা করলো রিম্পা। কত বড়ো একটা আশ্চর্য ব্যাপার। রিম্পা নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এও কি সম্ভব! হ্যাঁ শুনেছিল বটে যে একই রকম দেখতে পৃথিবীতে সাতজন থাকে। তবুও...আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো মেয়েটি ওর সামনেই পড়ে রয়েছে একইরকম জামাকাপড় পড়ে! ঠিক যেন আয়না! হ্যাঁ আয়নাই বটে!
"কি দাদা আপনি নাকি জানেন মহিলার বাড়ি কোথায়? কি করে জানলেন?" একজন কনস্টেবল বাঁকা চোখে জিজ্ঞেস করলো নকুলকে।
"হ্যাঁ উনি আমার টোটো তে উঠেছিলেন একবার।"
"কোথায় নেমেছিল?"
"তা জানিনা স্যার। উনি টোটো থেকে কোথায় নেমে যান টের পায় নি।"
আর দু একটা প্রশ্ন করে ছেড়ে দেয় নকুলকে। কি জানি! হয়তো আবার ডাক পড়বে। নকুলের কথা ঠিক বিশ্বাস হয় নি তার! হায়! নকুল কি নিজেই ঠিকঠাক বিশ্বাস করতে পেরেছে! কিভাবে সম্ভব! হ্যাঁ হয়তো সম্ভব! একজনের চিন্তা মেয়ের জন্য একজনের মায়ের জন্য। দেখা টা হলো না বটে! তাই মজাটাও ভাগ হলো না। নাকি....হবে হয়তো...অন্য কোনও বড়োদিনে...অন্য কোনও খানে...অন্য কোনও ভাবে....