Anuvutir Kone Kanache
Anuvutir Kone Kanache
বাগানের ছাতিম গাছটা চোখে পড়তেই চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো আমার..জানলা থেকে চোখ সরিয়ে ক্যালেন্ডারের দিকে ঝাপসা চোখে তাকাতেই, মনের ভেতর থেকে গুমরে ওঠা কষ্টটা চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় উপচে পড়লো...
হ্যা আবার ভেতর থেকে কষ্টটা উথলে উঠে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বারবার... আজ আবার ঠিক সেই তারিখটাই,19th November... ভাবতেই আবার গলার কাছটায় পুরোনো কষ্টটা দলা পাকিয়ে জমাট বেধে জাকিয়ে বসে রুদ্ধ করে দিলো গলার স্বর.... সাথেই ভীষণ ব্যথা করে উঠলো গলাটা, বুকের ভেতরটাও...
বেলা গড়িয়ে এখন প্রায় বিকেল,সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মনের বিষণ্নতাটা ক্রমে বেড়েই চলেছে.. অথচ আজ এই মুহুর্তে এরকম অনুভব করাটা কি ঠিক হচ্ছে...? জানিনা, জানিনা কিচ্ছু জানিনা... শুধু জানি, বছর চারেক আগের এই দিনটা প্রতি বছরই আসে নিয়ম করে আর এসে আমাকে আরো বেশি করে বিপন্ন করে তোলে..... এই ঠিক যেমন আজ.. এখন.. আমি হয়ে আছি... বিপন্ন... অথচ আর মাত্র কিছুক্ষণ, তারপরেই...
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে মনে হলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা অসহায় প্রাণী... আচ্ছা, সত্যি কি অসহায় আমি নাকি......
"কিরে, দাদাভাই ... তোর হলো? আর কতক্ষণ লাগবে.. বাকিরা কিন্তু সবাই মোটামুটি ready.. কাকিমা পাঠালো আমায় তোর কতটা হলো দেখতে.."... হঠাৎ তানির গলা শুনে রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম আমি, ভাবনার তার ছিড়ে গেলো... তাড়াতাড়ি কায়দা করে মাথাটা নিচের দিকে নামিয়ে আড়ালে দু চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে দেখি, দরজা অল্প ফাঁক করে তা থেকে মুখটা সামান্য বাড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে তানি...
আমি ওকে এক প্রকার তাড়ানোর জন্যই দ্রুত কোনোরকমে উত্তর দিলাম," হ্যা... মাকে গিয়ে বল, আর... আর দশ মিনিট ব্যাস্... আমি আসছি..."....
"ঠিকাছে..", নীরস, মৃদু স্বরে ছোট করে সায় দিয়ে দরজাটা আবার আগের মতো বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো তানি... কেনো জানি না, মনে মনে খুব স্বস্তি পেলাম..... আবার সামনে তাকালাম, আয়নার দিকে.... নিজেকে একলা করে নিতেই আবার কোথা থেকে রাশি রাশি অশান্তি এসে বিরাট অজগর সাপের মতো নিজের শক্ত কুণ্ডলীর মধ্যে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরলো নিমেষের মধ্যে... সাথে সাথে পাশের জানলা থেকে চেনা ছাতিমের গন্ধ মাখা ঠান্ডা হাওয়া এসে সারা মুখে, শরীরে এক তীব্র ঝাপটা দিতেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি, উফ কি দম বন্ধ করা এই অনুভূতি...
বন্ধ চোখের কালো পর্দায় মুহুর্তে ভেসে উঠলো পাহাড়ি মেয়েটা... সারল্যে ভরা দুটো ডাগর গভীর চোখ, নরম ত্বক লালিত্যময়, সুঠাম শরীর জুড়ে উপচে পড়ছে যৌবন, বেশভূষায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট অথচ সুন্দর তার হাসিতে এতটুকু মালিন্যের ছোঁয়া নেই.... তাকে প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম, এই মেয়ে ছাই চাপা আগুন যা আমার মধ্যেকার ঘুমিয়ে থাকা পতঙ্গকে জাগায়নি শুধু, বরং ডানায় ভর দিয়ে উড়তে পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করেছে অনায়াসে..... সেই নিঃশব্দ হাতছানি, সেই নীরব আকর্ষণ উপেক্ষা করে, কার সাধ্য.....
পাহাড় আমি বরাবর ভালোবাসি, কিন্তু চার বছর আগে পাহাড়ে গিয়ে আমার মনে যে রঙ লেগেছিলো তা অনন্য, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, বলেও বোঝানো যায় না... সে রঙের পোড়া দাগ, পোড়া গন্ধ আজও একইরকম অক্ষত.. শিল্পী তার নিপুণ হাতে আমার মনের সাদা ক্যানভাসে নিজের সত্তার গাঢ় রঙ ঢেলে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিয়েছিলো... অথচ তাতে কি এক নিবিড় ব্যথা মাখা খুশি মিশে ছিলো আমি জানিনা, আমি তন্ময় হয়ে অপেক্ষা করতাম বারবার তার সামনে নতুন ক্যানভাস হয়ে ধরা দেওয়ার জন্য... যাতে আবার সে তার তুলির প্রতিটা এলোমেলো টানে, প্রতিটা হ্যাচকা আচড়ে আমার ভেতরটাকে নতুন করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পারে....
মনে আছে, সেবার আমাদের ভারত সেবাআশ্রম সঙ্ঘের এক আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিলো, বেশ কিছুদিন থেকেছিলাম সেবার... হরিদ্বার সংলগ্ন জায়গাগুলো দেখার জন্য প্রতিদিনই বেরিয়ে পড়তাম আমরা সবাই... এইভাবেই একদিন মন্দিরে গিয়েছিলাম, আনমনে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই চোখ আটকে গিয়েছিলো আমার, মন্দিরের সামনে ফুলের পসরা সাজিয়ে বসা সেই মেয়েটার দিকে..... আর চোখ সরাতে পারিনি আমি, সোজা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই মেয়েটা মায়াবিনীর মতো মৃদু হেসে, গলায় মাদকতাময় ঝংকার তুলে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করেছিলো, "ক্যয়া লেঙ্গে আপ..."...
সেই শুরু...... তারপর আর থামতে পারিনি আমি, বলা ভালো নিজেকে থামানোর চেষ্টা তো করিইনি উল্টে প্রশ্রয় দিয়ে গেছি অকাতরে, অবিরত...
এরপর থেকে বিকেলবেলা হলে আমি নিজেই চলে যেতাম সেখানে, সেই মন্দিরটায়.. ওর কাছে.... ও, ওর নাম... ওর নাম এখনও আমাকে আচ্ছন্ন করে তোলে.. 'রাভিয়া'... রাভিয়ার বেশিরভাগ সময়টা মন্দিরেই কাটতো, ওর বাড়িটাও ছিলো সেবাআশ্রমের কাছেই...
আমি প্রথম প্রথম এটা সেটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে ওকেও সহজ সাবলীল করে তুলেছিলাম, ঠিক নিজের মতোই... আমার ওর কাছে যাওয়ার সময়েরও এরপর থেকে ঠিক ঠিকানা রইলো না আর... সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে যখন যেটুকু ফাঁক পেতাম অমোঘ আকর্ষণে চলে যেতাম মন্দিরটার কাছে...গিয়ে বসতাম ওর সামনে... সামনে বসে আমি ওর কথা শুনতাম মোহিত হয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে...বুঝতাম, ওর রূপে মুগ্ধ হয়ে আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো মৌমাছিদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, তার মধ্যে ওখানকার অধিবাসী থেকে শুরু করে আমার মতো ট্যুরিস্টরাও আছে...... কিন্তু খেয়াল করতাম, ও আর কাউকে সেরকম একটা পাত্তা না দিলেও, আমার প্রতি যেন ওর একটা আলগা প্রশ্রয় আছে... যা দিন দিন ক্রমশ বেড়ে চলেছে...
আমাকে কোনোদিন রাভিয়া সরাসরি বা ইঙ্গিতে কোনোরকম বাধা দেয়নি, বরং দেখেছি ওর চোখেও আমার মতো একইরকম আগ্রহ, খুশি আর সুপ্ত সর্বনাশের আকাঙ্ক্ষা....... আমি জানিনা আমার মধ্যে কি এমন খুঁজে পেয়েছিলো ও... অটুট আগ্রহ, স্পর্শহীন এক তীব্র অনুভূতি যা গিয়ে বারবার আছড়ে পড়তো ওর ওপর.. না আমার পুরুষালী ভঙ্গী নাকি আমার শহুরে তথাকথিত সপ্রতিভ চাল চলন কোনটা আমার দিকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে এসেছিলো ওকে... তবে রাভিয়াও যে আমার মতো একই অনুভূতির পিপাসায় ততোটাই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলো তা আমিও বুঝেছিলাম কিছুদিনের মধ্যেই.....
রাতে আশ্রমে ফিরে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসতো না আমার... কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চুপ করে পড়ে থাকতাম ওপরে ছাদের দিকে তাকিয়ে... একমনে ভাবতাম, আমি কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি...?নাকি এটা শুধুই এক লোভনীয় নারী শরীরের প্রতি পুরুষ শরীরের টান..অনিবার্য আকর্ষণ...?মনের গহীন থেকে অকৃত্রিম জবাব উঠে এলে সহ্য করতে না পেরে নিজেকেই বোঝাতাম না না, এটা আমার অনুভুতি নয়, হতে পারে না.. এভাবে সমাজ আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে...না, এটাই ভালোবাসা.. কেনো সব ভালোবাসা কেই sublime বা platonic ই হতে হবে, কোথায় বলা আছে? কেনো এইভাবে ভালোবাসা যায়না...?? একটা খুব সাধারণ মানুষ হয়ে, খুব সাধারণ মানুষের মতো করে...? যেখানে শরীরটাও মানুষটার মতোই ততোটাই important... নাহলে, কটা মানুষ sexless সম্পর্ক carry করতে রাজি হবে বিয়ে হওয়ার পর..? তখন তাদের যাবতীয় sublime ভালোবাসা সস্তার lime soda-র মতো রাস্তার ফুটপাথে নেমে আসে, সামান্য রক্ত মাংসের মানুষের মতোই আদিম যৌনতাকে উদযাপন করে সুখ উপভোগ করে তারা... কারণ তখন তাদের সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পায়, so-called বৈধতা পায়... কিন্তু সব সম্পর্ক, সবাই তাদের মতো একইভাবে সামাজিক validation এর তোয়াক্কা নাও করতে পারে... কারণ কিছু মানুষ আমার মতোও হয়.. তারা খুব ভালো করে জানে, তোয়াক্কা করা মানেই নিজের অনুভূতিগুলোকে চেপে রেখে, কাছের মানুষটাকে প্রাধান্য না দিয়ে সমাজের দিকে হা করে তাকিয়ে বসে থাকা... সবই তো for show.. সেই সামাজিক দায়....!
কেনো নিজের অনুভূতিগুলোকে নিজের মতো করে সাজিয়ে পেতে চাওয়া কি সত্যি দোষের... কে জবাব দেবে... এটা তো ব্যক্তিগত, এই অনুভূতি তো সামগ্রিক বা সামাজিক নয়... আর সেই কারণেই হয়তো সমাজের সবথেকে বড় feminist মহিলাটিও সমাজের বাকি নির্যাতিতা মহিলাদের সাথে একটা বিষয়ে একই বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয়.... সেও বাকি মহিলাদের মতো একইরকম urge feel করে, সারাদিন মহিলাদের ওপর হওয়া patriarchal শোষণ নিয়ে চিৎকার করলেও দুর্বল মুহুর্তে actually she likes to be taken by the most wielding masculine figure of her own periphery... Don't those so called sublime figures feel attacked by the hormones at late night and simply want to be swayed by the most brilliant people they know....!
একটা ঠুনকো suppressive, oppressive civilization তৈরি করে তার মধ্যে সুষ্ঠ সামাজিক তকমা গায়ে জড়িয়ে কুকড়েই তো বাঁচি আমরা.. আমাদের দূর্বলতা, ভয় যে আমরা আমাদের স্বাভাবিক অনুভূতিটাকে পর্যন্ত স্বীকার করতে পারিনা, status quo ভেঙে পা বাড়াতে পারিনা, তাইতো বড় বড় সুন্দর সুন্দর label তৈরি করতে হয় আমাদের.... Sublime, heavenly, platonic ইত্যাদি... কিন্তু যতোই সাজানো হোক না কেনো, এর ভেতরে সেই আদিম বুনো গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নেই.....
আবার মনে হতো আচ্ছা, liberty র নামে আমি নিজের orgy কে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছি না তো.... পরক্ষণেই মনে ভেসে ওঠে, এই ধারণাটাও তো সমাজই দিয়েছে কোনটা civilization এর আওতায় পড়ে, কোনটা liberty, কোনটা orgy.... সমাজের কিছু মানুষ মিলেই তো ঠিক করে দিয়েছে সবটা.... সবটা... আচ্ছা, আমি আর রাভিয়া মিলে যদি ভেঙে দি নিয়মগুলো... কিচ্ছু না মানি...? আমরা যদি অচেনা কোথাও গিয়ে নতুন করে গড়ি আমাদের civilization... নতুন নিয়মে.. নতুন ভাবে...আবার আমি হারিয়ে যেতাম রাভিয়ার সাথে রাভিয়ার মধ্যে, সুখস্বপ্নে.... এভাবেই কাটছিলো আমার রাতগুলো,কিছুটা দ্বন্দ্বে আর কিছুটা মোহে.........
আর দিনগুলো...? ওর সামনে বসে থেকে....
দিনে দিনে রাভিয়ার সাথে কাটানো সময়ের পরিমাপ আরো বেড়ে চললো ক্রমশ... ও ফুল বিক্রি করার মাঝে মাঝে বিভিন্ন একঘেয়ে বিষয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে কতো কথা বলে যেতো আর আমি শুনতে শুনতে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম ওকে, ওর ষোলো সতেরো বছরের সদ্য ফোটা ফুলের মতো কোমল সতেজ আকর্ষণীয় দেহ সৌষ্ঠবকে, যেন পাহাড়ে ফোটা এক অবর্ণনীয় সুগন্ধি নরম ফুল.... মাঝে মাঝে হাত নিশপিশ করে উঠতো আমার, ইচ্ছে করতো এক ঝটকায় ছিড়ে তুলে নিয়ে মন ভরে ঘ্রাণ নি ওর, ওর শরীরের..... কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিতাম নিজেকে.... না না কি ভাবছি এসব... আবার খুব করে চেষ্টা করতাম, ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে.....
রাভিয়ার থেকেই জেনেছিলাম ও এই মন্দিরে ফুল বিক্রি করছে অনেক ছোট বয়স থেকে, মা মারা গেছেন খুব ছোট থাকতেই.. বাবা ধূপকাঠি বিক্রি করে সংসার চালাতেন, কিন্তু নানান অসুখে ভুগে এখন তিনি প্রায় ঘরকুনো...কোনোমতে টিকে থাকা সংসারের হাল ধরতে ওকেই তাই রোজ ফুলের পসরা সাজিয়ে বসতে হয় মন্দিরের সামনে.... আমার অদ্ভুত লেগেছিলো শুনে , ওর নাকি তাতে কোনো আক্ষেপ নেই বরং ওর নাকি বেশ ভালোই লাগে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া পূণ্যার্থীদের হাতে সাজিয়ে অর্ঘ্যের ফুল তুলে দিতে.... তবে অদ্ভুত লাগার এখানেই শেষ নয় আমার....
কেনো? কারণটা অবশ্য আমিও কয়েকদিন পড়ে জানতে পেরেছিলাম.....
এক সন্ধ্যেবেলায়.... মাথার ওপর আকাশে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে উঠেছিলো সেদিন পূর্ণিমার গোল চাঁদটা... জ্যোৎস্নায় থৈ থৈ করছিলো আশেপাশের সমস্ত নির্জন এলাকা....ততদিনে ওকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার আমার অভ্যেসটা বেশ পাকা হয়ে গেছে..
প্রতিদিনের মতো ওর বাড়ির পথে হেঁটে চলেছিলাম আমরা দুজন পাশাপাশি..আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে... মনে হচ্ছিলো কোনো প্রখর সম্মোহনী শক্তিতে ধীরে ধীরে আমাকে গ্রাস করে ফেলছে রাভিয়া... মৃদু হওয়ায় ওর মুখের পাশের উড়তে থাকা চুলে কি সুন্দর যে দেখাচ্ছিলো ওকে.... আবার আমার হাতটা কেমন যেন........
হয়তো রাভিয়াও বুঝেছিলো কিছু... হঠাৎ আমাকে কি একটা নাম না জানা লাল সাদা ফুল হাত ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো ওর মাথায় বেঁধে দিতে, সেদিন ওর চোখের সাথে সাথে উপচে পড়া মনের সেই ভাষাও পড়তে পেরেছিলাম আমি.... সে ভাষায় ছিলো জ্বলতে থাকা ধিকি ধিকি আগুন... রাভিয়ার মাথায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফুলটা বেঁধে দেওয়ার পর, ওকে দেখতে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করে, মনে আছে তখন একেবারে অন্যরকম হেসেছিলো ও.... হাসিটার মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার যে ইঙ্গিত ছিলো তার উন্মত্ত প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম সেই রাতেই.. প্রায় সাথে সাথেই.... যখন প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে হঠাৎ প্রথমবার ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, ও তাতে আবেগঘন সাড়া দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলো ওর মনের সমস্ত চেপে রাখা ইচ্ছেগুলো সব আমার জন্যই এতগুলো বছর ধরে আগলে রেখেছে সযত্নে....
ওকে নিজের কাছে আরো টেনে নিয়ে, গাল ছুয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম হিন্দিতে, "রাভিয়া, তুমহে ডর নেহি লগতা...? তুম মুঝে জানতি তক নেহি..."... টের পেলাম গলাটা আবেগে কেমন ধরা আর ফিসফিসে হয়ে উঠেছে আমার....
রাভিয়া আমার হাত চেপে ধরে সরল উত্তর দিয়েছিলো, "বাবু, জিসসে প্যায়ার হো wo আপনা... অর আপনোসে সে ডর ক্যায়সা... বাকিকা ভগwaন হ্যায়... সালো সে ফুল চঢ়াতে আ রহে হ্যায়... কুছ গলত নেহি হোনে দেঙ্গে... "..... কেনো জানিনা, সেই মুহুর্তে ওর সরলতা, অকপটতা আমার মনে ধাক্কা দিয়ে ওর প্রতি ভালোলাগাটা এক মুহূর্তে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো..... আর তাতেই আরো বেশি করে ওর মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আমি....
সেই রাতের অনুভূতি আজও আমার মনে ততটাই জীবন্ত, ততটাই টাটকা... ওইরকম মায়াবী আলো আধারিতে সামনে রাভিয়াকে নিজের এতো কাছে পেয়ে আমার মনে হচ্ছিলো তরল, পানীয় ইত্যাদি কিছু না ছুঁয়েই জগতের সবথেকে বড় নেশাটা হয়তো করে ফেলেছি আমি... এই জীবনে এর থেকে তীব্র, ঘন, গভীর আবেগ আর কখনও অনুভব করিনি আমি.... ওর নেশাতুর চোখ, ওই হাসি, নরম হাতের উষ্ণ ছোঁয়া, সরু পাতলা ফর্সা ঘাড়ে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা ঘন কালো চুল...উন্নত বক্ষ, তার নিচে মোলায়েম খাঁজকাটা সরু কোমর আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিলো...আর তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না আমি, চোখ নিদারুণ আবেশে নিজের থেকেই বুজে আসছিলো.... আমি আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে, না আজ আর নিজেকে মিথ্যে বলে ঠকাবো না.. ধরে রাখতে চাইনি নিজেকে...ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে কতক্ষণ একটানা সেই মাদকতাময় রসস্বাদন করেছিলাম মনে নেই...........
কোনোরকমে সামলে উঠে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পেছনে ফিরেছি হঠাৎ এক বৃদ্ধকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম আমি... তার মুখে কৃতজ্ঞতা মাখা অসহায় দৃষ্টি...
আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, "বেটা, ইনলোগোকো সালোসে দেখ রহা হু... বহৎ নেক লোগ হ্যায়... পর কিসমত.. উতনাহি খারাব... ইয়ে লড়কি বহৎ বদনসিব হ্যায় বেটা.. ইসকি মা চলি গ্যয়ি, বাপ লাচার হোকে পঢ়া রহেতা হ্যায়.. অর ইয়ে তো বিচারী জনম সে অন্ধি হ্যায়.. তুমহে উসকে সাথ ইয়হা দেখা...".. মাথা কেমন যেন ঘুরে গেলো অল্প, বৃদ্ধের নিরীহ নিচু স্বরে বলা একটানা কথাগুলো আর কানে যাচ্ছে না আমার..
আমি ভাঙা কাঠের বেড়া ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে অস্থির হয়ে বললাম," you mean she's blind...?? She... "বৃদ্ধ থেমে গিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বুঝলাম তিনি বেশ অবাক হয়েছেন... তবে সেটা আমার মুখে ভিনদেশী ভাষা শুনে নাকি আমি রাভিয়ার সাথে মেলামেশা করা সত্ত্বেও এই কথাটা এখনও জানিনা দেখে... তা জানিনা... আমি অপেক্ষাকৃত শান্ত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, "ও... মানে রাভিয়া দেখ নেহি সকতি... Wo.. Wo অন্ধি হ্যায়...?".... বৃদ্ধ একইরকম বিস্মিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু ওপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিয়েছিলো.... আর একটা কথাও হলো না.. আমি সাথে সাথে দ্রুত পা চালালাম আশ্রমের দিকে...
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, কি করে সম্ভব... আমি তো কখনো এক ফোটাও বুঝিনি... শুধু রাভিয়া ওর বয়সী অন্যান্যদের থেকে কেমন যেন রহস্যময় ভাবে শান্ত.. ধীর স্থির... যেন যুগের পর যুগ ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা মায়াবী অনুভূতির লোভনীয় খনি.... কিন্তু এইসব কি প্রমাণ করে যে রাভিয়া, যার কালো দীর্ঘ গভীর চোখ দুটো এতো জ্বলন্ত... সে অন্ধ....
তাহলে কি মানুষ নিজের অন্ধত্বের সাথে মানিয়ে নিয়ে এতোটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে যে সামনের মানুষটার চোখে অদৃশ্য পট্টি বেঁধে তাকে অন্ধ বানিয়ে ফেলতে পারে অবহেলায়..? যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে, চোখের অদৃশ্য কালো পর্দা সরিয়ে না দিলে বোঝার উপায়, ক্ষমতা কিছুই থাকে না... কি নিদারুণ এই অভ্যাস করার আর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা... সাথে আরো কটা প্রশ্ন আমার মনে আশপাশ থেকে উঁকি দিলো, কিন্তু রাভিয়া আমাকে বললো না কেনো.. সে আমাকে সত্যি ভালোবাসে, তাই কি হারাবার ভয় পায়.. নাকি আমাকে পেয়ে ও ওর চরম অক্ষমতাটুকুও ভুলে গেছে বেমালুম.... কোনটা...... এতকিছুর পাশাপাশি আরেকটা ভাবনাও মনের এক কোণে উঁকি দিয়ে উঠে এলো ক্রূর হাসি হেসে.. রাভিয়া অন্ধ, অসহায়, দুর্বল, দরিদ্র, অভিভাবকহীন উপরন্তু আমাকে ভালোবাসে...আর বাকিটা খুব সহজ......... নিজের ভাবনায় নিজেই যেন কিছুটা শিউরে উঠলাম আমি.... নাহ্, এখন আর ভাববো না কিছু... আশ্রমে পৌঁছে যা ভাবার ভাবা যাবে বলে আরো দ্রুত পা চালাতে শুরু করলাম আমি....
ফেরার পর সব সেরে সেদিন রাতেও বিছানায় শুয়ে জেগেছিলাম আমি, কিন্তু সেই রাতে রাভিয়াকে নিয়ে শুধুমাত্র সুখ ভাবনার মধ্যে ডুবেছিলাম না আমি বরং মাথায় এসে একে একে ভীড় করছিলো নানানরকম প্ররোচনা....
আর না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম আমি, খানিকক্ষণ ওভাবেই চুপ করে শুয়েছিলাম উপুর হয়ে...
কয়েক মিনিট পর মাথাটা হালকা হলে চোখে খুলে সোজা হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠেছিলাম, "তোমাকে এভাবে পেতে চাওয়াটা কি অন্যায়...? আমি বললে তুমি কি বুঝতে পারতে... বুঝলে তুমিও কি একইভাবে.... জানিনা সত্যি.. চলে যাবো আমি রাভিয়া, পরশু... তাই চলে যাওয়ার আগে একবার তোমাকে নিজের করে পেতে চাই.. তোমাদের জীবনে তো এরকম অনেক বাবুরা আসে রাভিয়া... চলেও যায়... তুমিও জানো.. সব জেনেও হাত যখন বাড়িয়েছো তখন একটাবার তোমাকে একেবারে নিজের মতো করে পেতে দাও... জানিনা আর কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হবে কিনা.... তুমি আমার জীবনে কস্তুরী মৃগ হয়েই না হয় থেকে যেও রাভিয়া... যে নিজে চলে গেলেও তার সুগন্ধ থেকে যায় চিরটা কাল.... সব ভালোবাসা যে একরকম হয়না রাভিয়া.. তোমাকে দূরে রেখে তার বিরহে থাকাও ভালোবাসা.... তোমাকে শুধুমাত্র শরীর ভেবে যেটুকু সময় নিজের সবটা উজাড় করে শুধু তোমাকেই দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সেটাও ভালোবাসা... তুমি আমাকে যে স্বাদে ধনী করেছো তা পেয়ে কখনো না ভুলতে পারাটাও ভালোবাসা.... এটা আমার ভালোবাসা রাভিয়া, একান্ত... একেবারে নিজের মতো করে ভালোবাসা... "..... মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিলো আমার মুখে...." যা একজন কর্কশ engineering student কে এইভাবে ভাবাতে পারে তা ভালোবাসা নয়? তাহলে কোনটা ভালোবাসা রাভিয়া.... সারাজীবন একে অপরের মুখের সামনে বসে বৃদ্ধাভাবের রেখা গোনা?... হতে পারে কিন্তু আমি তো তোমাকে সেই ভালোবাসায় জড়াইনি, বাধিনি তোমাকে...বরং তোমার ভালোবাসায় আমি খুলে দিয়েছি নিজেকেই... কই আর তো কারো সামনে নিজেকে খুলে দিতে ইচ্ছে হয়নি... একি ভালোবাসা নয়...? এও এক ভালোবাসা রাভিয়া... আমার ভালোবাসা.... হওয়ায় ভেসে বেড়ানো রামধনুর রঙে সাজানো স্বপ্নিল ভালোবাসা নয়, একেবারে পায়ে হেঁটে চলা ক্লান্ত একটা রক্ত মাংসের মানুষের ভীষণ আবেগী ভালোবাসা......"....
পরদিন সকালে বেরিয়ে মন্দিরে গিয়ে দেখি রাভিয়া যথারীতি এসে বসেছে ওর নির্দিষ্ট জায়গায়... দূর থেকে আজ দেখেছিলাম ওকে.... ভাবছিলাম, যার জন্য এতো সুখস্বপ্ন... যাকে এতো পাওয়ার ইচ্ছে, যাকে দেখে শুধু মন নয় শরীরও নড়েচড়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে সেই রাভিয়া.... যাকে নিজের করে পেতে চাই জীবনে অন্তত একবার... কে জানতো সেই পথ এতো সোজা সরল... ঠিক ওরই মতো, ভাবতেই আপনা থেকেই আমার ঠোঁটের কোণে সরু রেখা ফুটে উঠলো, স্পষ্ট বুঝলাম আমি... ওকে লক্ষ্য করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে....
সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু না বলতেই রাভিয়া সুন্দর হেসে জানান দিলো যে ও বুঝেছে আমি এসেছি... কি অদ্ভুত, সহজাত সেই ক্ষমতা কিছুতেই বোঝার উপায় নেই যে ও চোখে দেখতে পায় না..... তবে ওর হাসি মাখা উচ্ছ্বাস দেখে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো, গত রাতের সেই উদ্দাম মায়াবী সুখে শুধু আমি নই,সেই সুখে মজেছিলো রাভিয়া, কিন্তু কতটা... যতোটা ডুবে গেলে আমার মতো করে একটা মানুষকে পাগলের মতো নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে ততোটা কি সত্যি এগোতে পেরেছে রাভিয়া না পারবে কোনোদিনো জানিনা.... আর তাইতো.....
মৃদু হেসে ওর কাছে সিড়াটাতে বসলাম আমি.. এরপর রোজকার মতো একথা সেকথা বলার পর, বললাম সেই কথাটা যা আমার গতকাল গভীর রাতের নিমগ্ন ভাবনার একনিষ্ঠ ফল....
উত্তরটা যদিও খুব ভালো করেই জানতাম আমি, তাও গলায় যতটা সম্ভব আবেগ জড়ানো একটা উদাসভাব এনে বললাম, "রাভিয়া, তুম ইস মন্দির কো ছোড় কর কভি অর কহি গ্যয়ি হো..?... কহিঁ দূর.. যাহা খামোশি হি খামোশি হো.. ফিzaয়েঁ বাতেঁ করতি হো..নাশিলি মিঠি ধুপ খিলি হো চারো ওর... পানি কো ছুকে চলতি হুই হাওয়ায়োঁ কি সরসরাহট হো... মদহোশ কর দেনেwaলি রশনিমে ম্যহেকতা হুয়া ল্যাহেক হো, অর বিচ মে মেরে বাহোমে লিপটি তুম সিলভটে লেতি হুই নাzuক সি এক কলি..... "... দেখলাম ভীষণ লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিলো রাভিয়া, তারপরেই দুপাশে মাথা নেড়ে জবাব দিলো যে যায়নি.... সাথে সাথে বললাম," ম্যায় জানতা হু এ্যয়সি এক জাগহা... চলোগি মেরে সাথ.... "..... দেখলাম রাভিয়ার মুখ লাল হয়ে উঠলো, তাতে মিশে আছে ভীষণ খুশি.. সাথে যেন ঈষৎ কেঁপে উঠলো ও,বলা ভালো শিহরিত হলো..... আমি দেখে শান্ত মৃদু হাসলাম,কিন্তু মনের তটিনীতে খুশির জোয়ারে ভেতরটা উথাল পাথাল করছে তখন.....
সেদিন বিকেল হতে না হতেই দ্রুত ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি.... সেদিন ভীড়ও কম ছিলো.. ভাবলাম, ভালোই হয়েছে যতো কম লোক আজ আমাদের একসাথে দেখে ততোই ভালো...ভাবনা শেষে মনে মনে ইশ্বরকে ছোট করে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম আমি.... এমনিতেই পাহাড়ি এলাকায় এদিকটায় লোকজন বিশেষ নেই... তার ওপর সন্ধ্যে নেমে এসেছে... তাই রাস্তাগুলো এখন যেন একটু বেশি নির্জন....
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে এসেছিলাম আমরা, একে অপরের হাত ধরে কথা বলতে বলতে... একপাশে খাদ আর তার পাশের সরু রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি আমরা, আচমকা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে রাভিয়া দেখি ওর শাড়ীর মধ্যে থেকে এক গোছা ছাতিম ফুল বের করে এগিয়ে দিলো আমার দিকে.. আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "ইয়ে ফুল...?"...
রাভিয়া আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, "ছাতিম ফুল বাবু.. ইসকি খুস্বু বহৎ প্যায়ারা হ্যায় মুঝে... বান্ধ দোগে ইয়হা পর বাবু... "..বলে ওর মাথার পাশটা দেখিয়ে আমার দিকে এক মন আকুলতা নিয়ে তাকিয়েছিলো রাভিয়া...
প্রায় tribal সংস্কৃতি ঘেঁষা একটা মেয়ের মুখে ছাতিম কথাটা শুনে ভ্রু অল্প কুঁচকে গেলো আমার, এখানেও 'ছাতিম' নামটার অপভ্রংশ হয়নি এতটুকুও, কোনো সমঝদার ওকে এভাবেই বলতে শিখিয়েছে হয়তো,সেই সবই তো শেখানো... আমি মৃদু হেসে ওর হাত থেকে ফুল নিয়ে বেঁধে দিয়েছিলাম ওর মাথায়....
বেঁধে দিতেই ও উজ্জ্বল মুখে লাজুক হেসে বলেছিলো,"পাতা হ্যায় আজতক কিসিকে সাথ ম্যায় ইঁউ কহি বাহার নেহি গ্যয়ি...আপ হি হ্যায় জিসকে সাথ ম্যায় আজ নিকল পঢ়ি বিনা কুছভি সোচে..."...
না চাইতেই আমার মুখ থেকে শব্দকটা যেন নিজের থেকেই বেরিয়ে এলো.."কিঁউ... মেরে সাথ হি কিঁউ...?"...
রাভিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলো, "আপনে মুঝসে কভি কুছ গলত নেহি বোলা হ্যায় বাবু .. নাহি গলত তারিকেসে ছুনে কি কৌশিশ কি হ্যায়.... ম্যায় প্যহেচানতি হু লোগো কো.. "... বুঝতে পারছিলাম ওর কি অগাধ ভরসা আমার ওপর... মনে মনে বললাম, কেনো এতো সরল তুমি রাভিয়া... আমি কি তোমার ভরসার যোগ্য? আমি তোমাকে যেভাবে চাই, ভালোবাসি সবটা জানার পরেও কি তুমি এই কথাটা বলতে পারবে রাভিয়া...
সবাই একইভাবে ভালোবাসতে পারেনা রাভিয়া, ভালোবাসাও তো একরকমের আবেগমাখা শিকার করা আর শিকার হওয়ারই খেলা.... কেউ কেউ ভালোবাসাকে শিকার করে নিজের কাছে খাঁচায় বেঁধে রাখতে চায় সারা জীবনের জন্য, কেউ কেউ আবার শিকার করতে এসে শিকার হয়ে বুকে ক্ষত নিয়ে ফিরে যায় নিরুদ্দেশে... আবার কেউ কেউ এই আমার মতো দিনের পর দিন চুপ করে বসে অপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটা সঠিক সময়ের জন্য................
আমার ভাবনার স্রোতে বাধা দিয়ে হঠাৎ রাভিয়া বলে উঠলো, "আপসে এক বাত ক্যহেনি থি বাবু... খুদকে বারেমে... পাতা নেহি সুননে কে বাদ আপ...",বলার সময় খেয়াল করলাম ওর মুখে কালো ছায়া নেমে এসেছে, গলার স্বরও কেমন ভরাট, কাঁপা কাঁপা.. কান্না চেপে রাখলে যেমন হয়, ঠিক সেরকমটা... খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম আমি রাভিয়া কি বলতে চায়...
কিন্তু নিজের মহত্ব অক্ষুন্ন রাখতে আমি সাথে সাথে বাঁধা দিয়ে বললাম, "ছোড়া উনসব বাতোকো রাভিয়া... যো বাত তুমহে তকলিফো মে ধকেল দে, তুমহে দর্দ দে Wo বাতে মুঝে নেহি সুন নি... ম্যায় তুমসে প্যায়ার করতা হু রাভিয়া...মুঝে ইসি এহেসাস কে সাথ জিনে দো ইয়ে সারে পল...".... রাভিয়া আমার হাতটা চেপে ধরে বুঝিয়েছিলো ওর মনের ভাব যা ও ভাষায় প্রকাশ করে উঠতে পারেনি সেই মুহুর্তে.... দেখেছিলাম ওর কৃতার্থ চোখে টলটল করছে জল.... দু হাতে তা মুছে দিয়ে এক মনে তাকিয়ে দেখছিলাম ওর কালো কালো দীঘল চোখ দুটোকে..... কি ছলনাময় এই দুটো চোখ, অথচ একইসাথে কি নিষ্পাপ.....
আরো কিছুটা গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে চোখে পড়লো সেই সস্তার motel টা..... আমি একাই গিয়ে কিছু একটা বলে ব্যবস্থা করবো বলে স্থির করলাম, ওকে কিছুই জানানো যাবে না....
তাই ওকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে বললাম, "রাভিয়া, হাম পহচ গ্যয়ে বাস্ তুম ইয়েহি রুকো ম্যায় আভি আয়া, ম্যায় দেখকে আতা হু কহি ব্যয়ঠনে কা জাগহা হ্যায় ভি ইয়া নেহি.... তুম ইয়েহি খড়ি রহো, কহি যানা মত..."... রাভিয়া নির্মল হেসে সায় দিলো.... আমিও সানন্দে দ্রুত চলে গেলাম ভেতরে...
সব বন্দোবস্ত করে যখন ফিরে এলাম প্রায় দশ মিনিট পর, দেখলাম রাভিয়া নেই... জায়গাটা একেবারে ফাঁকা দেখে সাথে সাথে আমার মনে হলো, কেউ যেন আমার হৃদয়ের গভীরে সজোরে ধারালো দাঁত বসিয়ে টেনে খুবলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সেটাকে...
আমি হোচট খেয়ে এলোমেলো পায়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিলাম.. নাহ্, এখানেও নেই.. কোত্থাও নেই.. কেউ আশেপাশে নেইও যে জিজ্ঞেস করবো ওর কথা.... কোথায় গেলো রাভিয়া... স্বাভাবিকভাবেই ফোনে হাত চলে গেলো, কিন্তু তখনই মনে পড়ে গেলো রাভিয়ার তো ফোন নেই...! সব থেকে বড় কথা, রাভিয়ার কাছে আর সবার মতো দৃষ্টি শক্তিটা পর্যন্ত নেই....!
একরাশ যন্ত্রণা আর অসহায়তা চেপে ধরলো আমায়, আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করতে করতে ওর নাম ধরে ডাকতে লাগলাম....বিষাদ মাখা একটা ঘোলাটে ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে চিৎকার করে ওকে ডেকে যাচ্ছিলাম আমি, ওর নাম ধরে সমানে.. একটানা.. চোখ থেকে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ছিলো জল...
দিনের আলো নিঃশেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ , পাহাড়ে তখন বড় বড় গাছ গাছালির ভিড়ে নিশ্চুপ হয়ে কুকড়ে পড়ে থাকা এক ফালি জায়গাটায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এসেছে.. ওভাবে অন্ধকারে ওখানে কতক্ষণ দৌড়োদৌড়ি করেছিলাম আমি জানিনা..... কিন্তু কোথাও ওর সাড়াশব্দ তো দূরের কথা, এতটুকু চিহ্ন পর্যন্ত পাইনি কোথাও....
হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত ফোনটা বের করে নিলাম আমি... ভীষণ প্রত্যাশা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই আমার ভেতরের সমস্ত আগুন নিভে গেলো এক মূহুর্তে.... মা ফোন করেছে... আমি দ্রুত নিজের শ্বাসের গতি যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বার কয়েক ঢোক গিলে, হাত দিয়ে মুখটা মুছে ফোনটা রিসিভ করে কানে দিলাম....
পরিচিত উত্তেজিত ক্যরক্যরে আওয়াজটা কানে এসে ধাক্কা দিলো, বুঝলাম মা রেগে গেছে ভীষণ কিন্তু কেনো... জানার কোনো ইচ্ছেই আমার মধ্যে তৈরী হলো না...
শুধু ফোনটা কানে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি, নিঃশব্দে চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছিলো,"তুই কোথায়? রাত কটা বাজে সেই খেয়াল আছে?? এসে থেকে শুধু এখানে ওখানে টো টো করে ঘোরা! এক্ষুনি ফিরবে তুমি...! আশ্রমের গেট বন্ধ করে দিচ্ছিলো আমরা অনেক request করে আটকেছি... তোমার বাবার বন্ধু তারক uncle এতোবার করে request করেছেন বলে এখানে থাকা, তোমার জন্য তার মুখটাই বা কোথায় থাকছে?? তাড়াতাড়ি ফেরো!"... আমি অনেক প্রচেষ্টার পর ঠোঁট অল্প নাড়িয়ে কিছু বলে ওঠার আগেই ফোনটা কেটে দিলো মা, আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না.... ঠিক যেরকম সুযোগ দিলো না রাভিয়া.....তাইতো, এখন কটা বাজে.. কি জানি..
আর ফোনটায় চোখ রেখে সময়টা পর্যন্ত দেখতে ইচ্ছে করছিলো না আমার...... আমি উল্টো দিকে পা বাড়ালাম, নিজেকেই সেদিন নিজের কাছে ভীষণ ভারী মনে হচ্ছিলো, যেন টেনে নিয়ে যেতে পারছি না, তবু নিস্পৃহ ভাবে হেঁটে চলেছিলাম টানা পথ......
আমি পৌঁছলে ভীষণ এক প্রস্থ ঝামেলা করেছিলো বাড়ির সবাই... আমি কোনো উত্তর না দিয়ে কলের পুতুলের মতো ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়েছিলাম শুধু ওদের সামনে, ওদের একটা কথাও সেদিন আমার কানে যায়নি... চোখে শুধুই ভাসছিলো রাভিয়ার নিষ্পাপ মুখটা, ব্যথা করছিলো বুকের ভেতরটা থেকে থেকে তার তীব্রতায় মুখে ভাজ পড়ছিলো আমার, ছলছল করে উঠেছিলো চোখ...সব একে একে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলে ওখানেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি অনেকক্ষণ অশক্ত কীটের মতো... তারপর সোজা বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিয়েছিলাম আমি...
শুয়ে টের পেলাম, একটানা যন্ত্রণাটা অপরাধ বোধে পরিণত হতে বেশি সময় নিলো না....বারবার ভাবছিলাম, কেনো ওকে একা দাঁড় করিয়ে রেখে, ভেতরে যেতে গেলাম আমি....? ও কিছু চেনে না, অসহায় অন্ধ একটা মেয়ে, আমার ওপর ভরসা করে একা চলে এসেছিলো কতটা.. আমি কেনো....?! আমার জন্যই তো ও গিয়েছিলো ওখানে, নাহলে তো ওর ওখানে যাওয়ার কথাই নয়... শুধু আমার জন্য মেয়েটা....! জানিনা কোথায় ও... কি করে হঠাৎ ওভাবে হারিয়ে গেলো রাভিয়া....? অবশ্য এইভাবে হারিয়ে না গেলেও কি ওর ওই সরলতার দাম, নিষ্পাপ স্বার্থহীন ভালোবাসার দাম, সন্দেহবিহীন নির্ভরতার দাম আমি দিতাম....? কেনো নিয়ে গিয়েছিলাম আজ ওকে ওখানে আমি... ওকে অন্ধকারে রেখে, ওর অজান্তেই ওকে সম্পূর্ণটা নিজের করে পেতে তো?! ....
সাথে সাথে একটা সম্ভবনা ভেসে উঠলো মনের সিড়ি বেয়ে.. আচ্ছা, সেটাই বুঝতে পেরে লুকিয়ে পড়েছিলো কি মেয়েটা...?শুনেছি অন্ধরা বেশি করে বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে.. ও কি বুঝতে পেরেছিলো আমার উদ্দেশ্য?আমার অন্যরকম চাওয়াগুলো.... তাই কি.........? কিন্তু লুকোনোর জায়গা তো সেখানে সেরকম ছিলো না... তবে কোথায় তুমি রাভিয়া.....?
আর আমারই বা এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো... ওরকম পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কেনো ওকে, একেই কি ভালোবাসা বলে? তাহলে আমিও কি আসলে তোমাকে আর সবার মতো করেই ভালোবেসে ফেলেছি যেরকম ভালোবাসলে বাধা পড়তে বা বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করে? নাকি বুভুক্ষুর সামনে থেকে খাবার কেড়ে নিলে যা হয় ঠিক তাই হয়েছে, মোক্ষম সময়ে শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় মাথার ঠিক ছিলো না আমার.... কোনটা....
উফ্ জানিনা, শুধু জানি একটা মেয়ে আজ আমার জন্য বাড়ি ফিরতে পারে নি, তার বৃদ্ধ বাবার কাছে ফিরতে পারে নি... আমি নিজেও জানি না সে কোথায় কিভাবে আছে.... ভাবতে ভাবতে প্রচণ্ড যন্ত্রনায় বুকের পেশীর সাথে মাথার শিরাও যেন ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আমার...অথচ দেহে সাড় নেই... আমি কোনোমতে বালিশ দিয়ে মাথা চেপে নিথর, স্থির, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে শুয়েছিলাম, মৃত মানুষের মতো সারা রাত.....
পরের দিনই আমাদের ফেরার কথা আমি জানতাম... কিন্তু সকালে উঠেই কোন মায়াবিনীর মায়াবলে আমি জানিনা আমার পা নিজের থেকেই টেনে নিয়ে চলেছিলো আমাকে মন্দিরের দিকে... আমি শুধু অবশ মনে অনুসরণ করছিলাম আমার পথ চলাকে...
মন্দিরে পৌঁছেই সবার প্রথমে দ্রুত সিড়ির কাছটায় তাকালাম, যদি তাকে.... নাহ্, নেই সেখানে রাভিয়া, জায়গাটা নির্মমভাবে খালি... বিষণ্ণ চোখ ফিরিয়ে দেখলাম আশেপাশে ইতস্তত জটলা... আমার ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠলো..
কয়েকজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কি... ক্যায়া কুছ হুয়া হ্যায় ইয়হা..."...
"হা সাহাব..wo খালি জাগহা দেখ রহে হ্যায় সাহাব.. Woহা আপ জিস লড়কি কে পাস আতে থে না wo..."...
আমি অস্থির হয়ে ওনার দিকে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ওনার কথার মধ্যেই বলে উঠলাম, "হা হা wo লড়কি... কাহা হ্যায়... জাগহা খালি.. খালি কিউ হ্যায়...."...আমার চোখে মুখে আমার মনের হাহাকারটা ফুটে উঠেছিলো বোধ হয়...
ওই প্রৌঢ়ের করুণ দৃষ্টি চিৎকার করে তাই বলছিলো আমায়.. খানিকক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে মুখ খুললেন উনি, "আজ সুবহ লাশ মিলি হ্যায় উসকি সাহাব... দূর এক খাই মে গিরি পঢ়ি থি বিচারী... দেখ নেহি সকতি থি না সাহাব, পাতা নেহি কিউ গ্যয়ি থি woহা... ইয়হি লিখ্যা থা শায়েদ উসকি কিসমত মে.. উসকি বাপকা ক্যায়া হোগা অব ক্যায়া পাতা...অব তো রাম জানে ক্যয়া হোগা উনকা..."..
আরো কি কি সব বলে যাচ্ছিলো প্রৌঢ় তখনও... প্রৌঢ়ের প্রথম কথাকটা কানে যেতেই ছিটকে দু পা পেছনে সরে এসেছিলাম আমি... আমার সর্বাঙ্গ ভঙ্গুর হয়ে ধ্বসে পড়তে চাইছিলো সেইখানেই... আমি আমার শরীরটাকে টেনে নিয়ে এসে কোনোরকমে মোটা গাছটার গায়ে ফেলে, সব ভার গাছটার ওপর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম কোনোমতে.... মনে, মাথায় একটাই কথা ঘুরে ঘুরে ঝড় তুলেছে আমার ভেতরে ততক্ষণে... রাভিয়া আর নেই... মৃত... রাভিয়া মৃত... এবং আমি মেরে ফেলেছি ওকে, খুনী আমি... ভালোবাসার নামে একটা ফুলের মতো মেয়েকে খুন করে ফেললাম আমি...! হঠাৎই আমার মনে পড়ে গেলো সেই রাতে রাভিয়ার বলা কথাগুলো.... আবার যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম ও মোলায়েম স্নিগ্ধ স্বরে বলছে, "বাবু, জিসসে প্যায়ার হো wo আপনা... অর আপনোসে সে ডর ক্যায়সা... বাকিকা ভগwaন হ্যায়... সালো সে ফুল চঢ়াতে আ রহে হ্যায়... কুছ গলত নেহি হোনে দেঙ্গে..."...অনর্গল দু চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো আমার অপরাধ বোধ... সত্যি ভগবান সেদিন ওকে আমার থেকে বাঁচিয়েই ছিলেন, কিন্তু এইভাবে...? ওর জায়গায় আমাকে কেনো শেষ করে দিলেন না... যাতে বাকি জীবনটা দগ্ধে দগ্ধে কাটাই সেই জন্য...? নাকি যাতে অপরাধ বোধে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে যেতে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাই সেই কারণে...? এটাই কি আমার শাস্তি..... হয়তো তাই এক আকাশ ভারী এই নারকীয় অনুভূতি গত চার বছর ধরে একা বুকে চেপে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি, আলেখ্য গাঙ্গুলি.....
হ্যা, আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিনই.... একটা মেয়ে যে শুধু আমার কারণে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো বিনা দোষে, তা কাক পক্ষীতেও টের পেলো না.... আরেকজন অসুস্থ বৃদ্ধ যাকে অসহায় করে দিয়ে শেষ সহায় সম্বলটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছি আমি, এখন সে কিভাবে বেঁচে আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা তারও কোনোরকম খোঁজ আমি রাখিনি... সব ছেড়ে একরকম পালিয়ে চলে এসেছিলাম আমি কলকাতায়, গত চার বছরে আর কোথাও ঘুরতে যাইনি আমি.... কোথাও না.. বাড়ির লোক জোরাজুরি করলে আমি বিভিন্ন অজুহাতে কাটিয়ে দিয়েছি তা বারবার, কারণ জানতে চাইলে, বারবার জোরালো মিথ্যে বলেছি আমি....... কিন্তু যাইনি, যেতে পারিনি...
বাড়িতে কেউ কিছুই জানে না, কাউকেই কিছু বলিনি আমি... শুধু আস্তে আস্তে বাড়তে থাকা আমার নিরুৎসাহী আর গম্ভীর ভাবটা লক্ষ্য করে বাড়ির লোক কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রশ্ন করেছিলো, আমি এতো চুপচাপ কেনো থাকি আজকাল.. বলেছিলাম, "work pressure...".... Mnc তে যে heavy work pressure থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কি... তাই কেউ সন্দেহ করেনি... কিন্তু আমি ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারছিলাম, ফিরে আসার পর থেকে যেন রাভিয়া আরো বেশি করে চেপে বসেছে আমার মনে,মাথায়... প্রায় সবটুকু জুড়েই.........
অপরাধ বোধ, কষ্ট, গ্লানি দিনে দিনে বৃদ্ধি পেতে পেতে সহানুভূতিবশতই কি ওকে মনের মধ্যে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছি আমি, আরো বেশী জায়গা জুড়ে বসিয়ে রেখেছি ওকে.... অনেকবার প্রশ্ন করেও এর উত্তর আমি পাইনি.... এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি ওকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছি.... জানিনা, তবে অস্বীকার করি কি করে একটা মেয়ের মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষভাবে শুধু আমি দায়ী! পরোক্ষভাবে ওর বাবার দুর্দশার জন্যও তো আমিই দায়ী.... শুধুই আমি..............
আয়নায় ফের তাকালাম আমি.... নিজের মুখটা দেখে ভেতরটা কেমন গুলিয়ে উঠলো আমার, অথচ ভালো চাকরির সাথে সাথে এই মুখ দেখেই নাকি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে পাত্রীপক্ষের লোকেরা.....আমার চাকরিটা পাওয়ার সাথে সাথে বিয়ের জন্য মেয়ে মোটামুটি finalise করে ফেলেছে বাড়ির সবাই... হয়তো আমার মনমরা ভাবটা কিংবা আমার সবকিছুর প্রতি এরকম উদাসীনতা দেখেই....আজ সেই মেয়েটাকেই দেখতে যাওয়ার কথা... বাড়িতে সবাই ready, আমিও...
আয়নায় চোখ রেখে মনে মনে নিজেকে প্রশ্নটা করলাম, আমি কি সত্যিই ready?... To marry..? এতবড় একটা ঘটনাও কি এতটুকু পাল্টে দিতে পারেনি আমাকে..? সেই ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছি আমি.. এখনও এতটুকু সাহস জন্মায়নি মনে? স্বীকার করে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে জন্মায়নি..? যদি জন্মে থাকে তাহলে কেনো বলতে পারিনি আজ পর্যন্ত রাভিয়ার ব্যাপারে একটাও কথা মাকে.. বাবাকে..? কেনো পারোনি তুমি বলতে তার কথা... আলেখ্য গাঙ্গুলি..! খুন করেছো তুমি একটা নিষ্পাপ মেয়েকে.... তারপর তার অসহায় বৃদ্ধ বাবাকে চির অন্ধকারে ঠেলে পালিয়ে এসেছো নিজের জমকালো জীবনে... আর এখন, মা বাবার কথায় বিয়ে করতে চলেছো আরেকটা মেয়েকে...? মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, "Ain't you cheating on that girl, on yourself...?"....
দ্রুত অস্থির পায়ে বাথরুমে গিয়ে দরজাটা সজোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করে চকচকে মসৃণ ঘিয়ে রঙা basin এর গায়ে দু হাত রেখে আয়নায় নিজের চোখ রেখে তাকালাম আমি.... নিজেকেই বলে উঠলাম,"কিসের ভয় তোমার... Status quo ভেঙে যাবে? একা হয়ে যাবে...? পরিবার পাশে থাকবে না? এমনিতেও নেই... দেখো, তোমার কাছে কেউ জানতে চায়নি যে তুমি বিয়েটা করতে চাও কিনা... It's their decision... তাহলে বিয়েটা কেনো করছো তুমি আলেখ্য গাঙ্গুলি? Why... নাহলে emotional blackmail করবে, অশান্তির ভয় তোমার....?! যারা তোমায় বোঝে না তাদের তুমি পরিবার বলো? থেকো না তাদের সাথে, leave them... কেনো? আবার আটকে যাচ্ছে পা?? মনে বারবার জাকিয়ে বসছে সেই একা থাকার ভয়..?? তাকিয়ে দেখো কে দোকা বাঁচছে... Nobody...! "... উত্তেজনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাত দিয়ে basin এর গায়ে সজোরে আঘাত করলাম একবার....." নাহ্... মেয়েটাকে সব বলে দেবো... সব....! পৃথিবীর এক কোণে বসে এই মেয়েটা বা তার পরিবার আমার ব্যাপারে কি ভাবলো তাতে কিছু যায় আসে না, rather it doesn't make any sense to me! Reject করে দেবে আমাকে,দিক! আমিও তাই চাই...ফিরে এসে মা বাবাকে সত্যিটা বললে at least কিছুটা হলেও নিজে শান্তি পাবে তুমি আলেখ্য গাঙ্গুলি... মনে যে দাবানল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো তুমি, তাতে নিজে দিনরাত পুড়ে চলেছো... আবার নতুন করে জীবনে অন্য কাউকে নিয়ে এসে তাকেও একইভাবে পুড়তে বাধ্য করতে পারো না তুমি.. না.....! ".....
সাথে সাথে মন থেকে চিরাচরিত সংস্কার যেন হঠাৎ নিঃশব্দে চিৎকার করে উঠলো, না এটা হয়না, এটা মুর্খামি আলেখ্য....
সাথে সাথে আয়নার দিকে চোখ রেখে বলে উঠলাম,"কে বলেছে সবাইকে একইরকম করে হওয়াতে হবে...? বাকিদের মতো জীবনের একটা অভিশপ্ত অধ্যায়কে লুকিয়ে তার ওপর আরেকটা অভিশপ্ত অধ্যায়ের সূচনা করতে হবে...? না হয় নাই পেলাম সমাজে প্রচলিত চালাকির সস্তা তকমা... বোকা হয়ে যদি আমি শান্তি পাই তার থেকে সার্থক বাঁচা আর হতে পারে না.... একই ঢালে বয়ে চলতে হবে সবাইকে?... সবাই যা বিশ্বাস করে, যে philosophy নিয়ে বেঁচে থাকে আমাকেও সেটাই follow করে যেতে হবে অন্ধের মতো?.. Dogmatism এর against এ কি কেউ গলা তুলে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা পর্যন্ত করবে না...! একটা ফুটফুটে মেয়েকে খুন করেছো তুমি,আর আজ এই মেয়েটাকে নিজের এই কালো জীবনে টেনে এনে দ্বিতীয় খুনটা করো না... না...... ".....
বাথরুম থেকে বেরিয়ে, জুতোটা পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি.... আমাদের গাড়িটায় রওনা দিলাম সবাই মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে... আমার মাথায় চলছে এতদিন পর সত্যিটাকে, সততাকে আঁকড়ে ধরার প্রবল চেষ্টা... রক্ত যেন গরম হয়ে উঠেছে, আজ গ্লানি থেকে মুক্তির উপায় এসেছে..... স্বীকার করে নিতে হবে সব,সব... এরপর ফলাফল যা হবে সব মেনে নেবো আমি..
একটাও শব্দও উচ্চারণ করিনি আমি গাড়িতে বসে, হঠাৎ গাড়িটা স্বল্প ঝাঁকুনি দিয়ে যখন থামলো বুঝলাম আমরা পৌঁছে গেছি ওদের বাড়ি, সবাই ভীষণ আনন্দে নামলো গাড়ি থেকে, আমিও নামলাম.... কিন্তু আমার কোনোদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না আর....
সবার পেছন পেছন যন্ত্রের মতো হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করলাম ওদের বাড়ির ভেতরে.... ভেতরের বিশাল drawing room টাতে গিয়ে বসলাম আমরা.. কিন্তু আমার কিছুই ভালো লাগছে না... কি অসহ্য এই পরিবেশ, ঘরে সোফাসেটে বসে আমাদের ঘিরে থাকা মুগ্ধ হাসিমুখগুলো কেনো জানিনা বিভৎস লাগছে আমার.... আমি শুধু অপেক্ষায় আছি কখন সে আসবে... তাকে সব খুলে বলবো... মাথা নিচু করে ভাবছি ঠিক তখনই কানে এলো...
"এই তো এসে গেছে... এসো মা, এসো..."....
আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালাম চোখ তুলে অনেকটা নির্লজ্জের মতো....
"এই যে রুচিরা.."...
টের পেলাম চোখ হয়ে কি যেন একটা ক্রমে আমার ভেতরে প্রবেশ করে উত্তেজিত স্নায়ুগুলোকে ক্রমে দুর্বল, শিথিল করে দিচ্ছে.... টের পেলাম যতো মেয়েটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে ততোই আমার ভেতরের আগুনটা নিভে আসছে ধীরে ধীরে.... মাথাটা ক্রমে ফাঁকা হতে হতে ভীষণ হালকা লাগতে শুরু করেছে এখন আমার... মেয়েটার চোখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারছিলাম চার বছরের পুরোনো শক্ত জটগুলো স্নিগ্ধ শীতল আরাম মাখা কিসের স্পর্শে যেন আস্তে আস্তে আলগা হয়ে খুলে যাচ্ছে নিজে থেকেই... আরো অনুভব করলাম, আমার মুখের অস্থির, গম্ভীর, বিরক্ত ভাবটা পুরোপুরি মুছে গিয়ে এখন তাতে শুধুই তন্ময়তা আর মুগ্ধতা...
মন যেন নিজে থেকেই বলে উঠলো সে বাধা পড়তে চায় চির কালের মতো এই মানুষটার কাছেই, একসাথে কাটাতে চায় জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত... একে অপরের সামনে বসে বৃদ্ধাভাবের রেখাগুলো গুনতে চায়, নিরলস ভাবে একটা একটা করে....
এরকম কি আগেও আমি আর কখনো অনুভব করেছি, কেনো জানিনা বর্তমানের কাছে এমনভাবে বাঁধা পড়ে গেছি বলে মনে হলো, যে অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে তার সাথে মিল অমিল খোঁজাটাই এই মুহুর্তে সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে বোধ হলো আমার.......
নিমেষের মধ্যে বাকি সব ভাবনাগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়ে মনের উপরিতলে একটাই শব্দ ভেসে উঠলো, রুচিরা... মানেটা আমি জানি, 'সুন্দর'...সত্যি,এতো সুন্দরও কেউ হয়...? তার ওপর মেয়েটার মধ্যে একটা আলগা শহুরে মার্জিতভাব আর চটকদারী প্রলেপও আছে... দারুণ আটোসাটো, সুঠাম মেদহীন গঠনে মেয়েটা হালকা সাজেও যেন এক কথায় অপরূপা... খেয়াল করলাম, ওর মাথার একপাশে হালকা হলদেটে অচেনা একগুচ্ছ ফুল....
"আপনাদের আপত্তি না থাকলে রুচিরা আর আলেখ্য আলাদা করে কথা বলতে পারে...?"....মায়ের প্রস্তাবটা শুনেই এক বয়স্কা মহিলা অল্প হেসে বলে উঠলেন, "oh sure.. Why not..."....
"যা.. তাহলে... Where she feels comfortable.."... বাবার কথাটা শুনে রুচিরা আমার দিকে তাকিয়েই বললো, "how about the garden..."... আমি সম্মতিসূচক মৃদু হেসে উঠে দাঁড়াতেই বাকিরা হেসে উঠলো আনন্দে....
রুচিরা একটু লজ্জা পেয়েই এগিয়ে গেলো... আমিও গেলাম পেছন পেছন ওদের সাজানো বাগানটায়.... আমিই প্রথম জিজ্ঞেস করলাম, "hey.. Nice flowers..but what's the name?"...
রুচিরা মিষ্টি সপ্রতিভ মৃদু হাসলো... "thanks..Carnation, my favourite.... Oops...".. বলে হঠাৎ অল্প ব্যস্ত হয়ে মাথার পাশটায় হাত ছোঁয়ালো ও....
সাথে সাথে বলে উঠলাম, "what happened..?".. রুচিরা হাতে একটা ফুল নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো.... মুখে কেমন আদুরে অসহায়তা ফুটিয়ে, মিষ্টি করে বললো, "খুলে গেলো... can you fix this...."....
আমি ওর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলাম, "sure...."... ও একটু কাছে এসে ওপাশ ফিরে দাঁড়াতেই আমি ওর মাথায় নির্দিষ্ট জায়গায় ফুলটা লাগাতে উদ্যত হলাম.. ঠোঁটের কোণে ফিরে এলো এককালের হারিয়ে যাওয়া সেই পুরোনো খুশি তবে এবার যেনো মনে হলো ভীষণ পরিণত, অকৃত্রিম আর একেবারে নিখুঁতভাবে......
সাথে মনে উঠে এলো কয়েকটা কথা, "নাহ্, আর না...in between truth and life, I chose life... A life, full of life, hope and light... ছাতিম গাছটা কালই কাটিয়ে ফেলতে হবে... আর Carnations এখানকার nursery তে available নিশ্চয়ই....".......
সমাপ্ত

