অনুকম্পন
অনুকম্পন
আমাদের মল্লিকপুর গ্রামটি কলকাতা থেকে আড়াই ঘন্টার দূরত্বে । ট্রেনে বাসে যে ভাবেই যান আড়াই ঘন্টা জার্ণি করতেই হবে । তবে এ' আমার জন্মভূমি নয় ; শ্বশুরালয় । এই গ্রামে হিন্দু মুসলমান সবাই বাস করে । ধর্ম এবং জাতিভেদে প্রথম থেকেই নানান পাড়ায় বিভক্ত । অথচ গ্রামে একতা অক্ষুণ্ণ । এমনকি কোন কারণে কোথাও কোন রূপ দাঙ্গা হাঙ্গামা হলে এই গ্রামের লোকজন একত্রিত হয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে পালা করে গ্রাম পাহারা দেয় ।
এখানে মোল্লা, হাজি, কাজী গাজী যেমন আছেন তেমনই নাটা মল্লিক, স্যাটা বোস, ঝাঁটা কুণ্ডুরাও আছেন । আর আছেন দু'তিন ঘর সদাচারী ব্রাহ্মণ পরিবার ।
নাটা মল্লিক মানে আমি ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের কথা বলছি না । এই পরিবারের লোকজন আকৃতিতে নাটা - তাই নাটা মল্লিক বলে পরিচিত ।
তেমনই স্যাটা বোস বলে কোন চরিত্র আপনি মরে গেলেও খুঁজে পাবেন না । অপেক্ষাকৃত ধনী বলে ওঁদের নাম হয়ে গেছে স্যাটা বোস এণ্ড কোম্পানী।
আবার দেখুন ঝাঁটা কুণ্ডু বলেও কয়েকটি পরিবার আছেন । ঝাঁটা তো কারুর নাম হয় না । অথচ কি করে যে ওঁরা তকমা পেয়ে গেলেন ঝাঁটা কুণ্ডু - শুনলে অবাক হবেন । গ্রামের বড়দা শ্রীযুক্ত উৎসব রায়চৌধুরীকে তো ইতিমধ্যে আপনারা জেনে গেছেন । ' আকাশের রঙ ফ্যাকাশে ' নামক যে বিশেষ গোয়েন্দা কাহিনী পড়েছেন তা'তে তিনিই তো ছিলেন মহানায়ক ।
ঝাঁটা কুণ্ডুদের ইতিহাস তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলেন আমার শ্বশুর মশাই ।
- আচ্ছা উৎসবদা ! এই গাঁয়ের সবারই এক একটা নাম আছে । যেমন আমি মদন গোপাল সেন - যদিও তোমরা আমাকে মদনা বলতে অভ্যস্ত -
বাধা দিলেন শ্রীযুক্ত রায়চৌধুরী মশাই ।
- শোন মদন ! কে কি বলে তোকে - তুই জানিস । আমার মুখ দিয়ে কখনও শুনেছিস আমি কারও নাম বিকৃত করে বলি ?
- না না তোমার কথা বলছি না উৎসবদা । অন্যেরা তো বলে ! সে যাক । আমি একটা কথা জানতে চাই কুণ্ডুদের সবাইকে লোকে ঝাঁটা কুণ্ডু বলে কেন ?
- ওটা ওদের ব্যবসায়িক নাম ।
- ঠিক বুঝলাম না দাদা । একটু খোলসা করে বল দেখি !
- দেখ মদন, এই গাঁয়ে যে ক'জন কুণ্ডু আছে ; তারা সবাই ঝাঁটার ব্যবসা করে । চোরকাঁটার ঝাঁটা, নারকেল পাতার ঝাঁটা, এমনকি বিভিন্ন তৃণজাতীয় ঝাঁটা বানিয়ে ওরা যে ব্যবসা করে সংসার চালায় - তার জন্যই ওদের নাম হয়ে গেছে ঝাঁটা কুণ্ডু ।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শ্বশুর মশাই আমাকে জানিয়েছিলেন । যদিও আমি বিয়ে হওয়া থেকে কোনদিন এই মল্লিকপুর গ্রামে আসিনি ; এখনও সেখানে ত্রিদিবের সাতপুরুষের ভিটে এবং কিছু জমিজমা আছে । অবশ্য জমিগুলো অন্যের হাতে দেওয়া হয়েছে ভাগচাষের জন্য । বছরের চাল, গম , ওখান থেকেই আসে । আর শাকসবজি যা হয়, গরীব চাষীরাই ভাগাভাগি করে নেয় ।
একদিন শ্বশুর মশাইয়ের কাছে বায়না ধরলাম শ্বশুরের পৈতৃক ভিটেটা দেখতে যাব । তিনি তো আবদার মেনে নিলেন; প্রচণ্ড বাধা দিলেন শাশুড়ি মা ।
- না বউমা ! যাওয়া হবে না । একে তো গাঁ , তায় পরিত্যক্ত ভিটেতে একটা ছোট কুঁড়েঘর । কেমন দশায় আছে কি জানি ! হয়তো সাপ-খোপের আড্ডা হয়ে আছে এতদিনে ।
তা-ছাড়া তুমি হলে শহরের মেয়ে , ওখানে গেলে অস্বস্তিতে পড়বে আর তীরের তো ছুটি নিতে বড় ঝামেলা পাকায় , তাও তো একটা কারণ !
আমি বললাম - রাত কাটাতে তো যাচ্ছি না । গাড়িতে যাব - দিনের আলোয় দেখব আর সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আসব ।
শাশুড়ি মাকে বললাম - আপনি তো বহুকাল ওখানে ছিলেন । কত পরিচিত লোকজন পাবেন - আপনার মনও ফ্রেশ হয়ে যাবে ।
- কি হয়ে যাবে ?
- ফ্রেশ - মানে - তাজা ।
- মন্দ বলনি বউমা । দেখা যাক তীরে আসুক কথা বলব ।
- অলক, সায়নীকেও নিয়ে যাব মা !
- সে তো নিয়ে যেতেই হবে । নইলে মেয়ে আমার মাথা চিবিয়ে খাবে ।
খুব আনন্দ হল । শাশুড়ি মাকে রাজী করিয়েছি , এবার না গেলেই নয় ।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে শোবার ঘরে যেতে শুনলাম শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে ত্রিদিবের কথা কাটাকাটি চলছে ।
ত্রিদিব বলছে - সানডে প্রোগ্রাম কর । রাজী আছি । ছুটি নিতে বল না । এখন ছুটি নেওয়া সম্ভব নয় ।
- কিন্তু আমি যে বউমাকে কথা দিয়ে ফেলেছি ! এই শোন না ! দুটো দিন ছুটি চেয়ে নে । প্লীজ, আমার কথা ভেবে ।
ত্রিদিব বলল - ঠিক আছে দেখছি । মনে হয় হবে না । তবু দেখছি কি করা যায় ।
এ তো সোনায় সোহাগা । দেশের বাড়ি দেখতে যাব - তাও একদিন নয়- তিন তিনটে দিন ।আমার খুশী আর ধরে না ।
রাতে বাড়ি ফিরে এসে ত্রিদিব জানাল তিনদিনের ছুটি পেয়েছি । কিন্তু সানডের ওভারটাইমটা মাঠে মারা গেল । সে যাক । খুশী তো ?
সবাই যেন হাতে স্বর্গ পেলেন । শাশুড়ি মা বললেন - ছেলে আমার বাহাদুর ছেলে । বাব্বা: আমি কি বুঝি না ? আমি বললে দোহাই দেয় ছুটি নেই বলে । এবার ? বউয়ের আদেশ ! ফেলতে পারে ?
উঠতে বসতে এমন খোঁচা দেওয়া যেন ওঁর চরিত্রগত । আমরা কেউ কিছু বললাম না বা এতে ইগো খাড়া করতে চাইলাম না । শ্বশুর মশাই বললেন - নাও এবার রেডি হও ।
শাশুড়ি মা বললেন - দুটো নতুন শাড়ি নিয়ে আয় খোকা । মিনির মাকে উপহার দেব । আর হ্যাঁ, মিনির জন্য দু'টো ফ্রকও নিবি । কি জানি এখন আবার কত বড় হয়ে গেছে ! থাক, মিনির জন্য মঙ্গলার হাট থেকে কিনে নেব । কিন্তু এখানকার শাড়ি পেলে মিনির মা খুব খুশী হবে ।
আজ তো মঙ্গলবার । সামনের রবিবার যাবার কথা । হাতে ঢের সময় । ত্রিদিব বলল - সব হবে । এখন খেতে দাও তো! খুব খিদে পেয়েছে ।
অবশেষে এসে গেল সেই আকাঙ্খিত সানডে । গতরাতে সায়নী ও অলকেশ এসে পড়েছে । আমরাও রেডি হয়ে আছি ।
পথে সরাসরি দক্ষিণেশ্বর পড়বে না ; একটু ডানদিকে মোড় নিয়ে অলকেশের উদ্যোগে মা ভবতারিণীর পূজো দিলাম । ঘন্টা দুই দেরী হল ঠিকই ; শাশুড়ি মা কিন্তু ভীষণ খুশী হলেন ।
অলকেশকে বললেন - দীর্ঘজীবী হও বাবা । তোমার জন্যই মায়ের সাক্ষাৎ পেলাম ।
আমার মন পড়ে আছে অদেখা অচেনা সেই মল্লিকপুর গ্রামে । শ্বশুর মশাইয়ের মুখ থেকে অনেক দুর্ধর্ষ গল্প শুনেছি । আর সেই গল্পের মহানায়ক হয়তো আর বেঁচে নেই, তাঁর ভাইও বা ভাই-বউ হয়তো বেঁচে ।থাকলেও খবর পাঈনি ।আবার তাঁর বংশধর অরিত্র ওরফে বুকুন তো এখন বিদেশের কনসাল জেনারেল । ইচ্ছে হল ওঁদের পূণ্যভূমিও দেখে যাব ।
আমার শাশুড়ি মা শ্রীমতি বিভা সেন বলেছিলেন গাঁয়ে ঢোকার আগে মেইন রোডের উপর একটা পথ আছে ; সেখানে মোড়ে নাকি জমজমাটি বাজার বসে । গ্রামের হাট বাজার চাক্ষুষ করা আমার নিকট উপরিপাওনা ।
বেশ আগ্রহ নিয়ে চলেছি আমার নিজস্ব শ্বশুর বাড়িতে ।
( চলবে )

