#অনপেক্ষিত
#অনপেক্ষিত
পর্ব-৫
আজ সারাদিন উজান গম্ভীর থাকলেও ওকে রাগতে দেখলোনা কেউ. অদ্ভুত ভাবে হিয়ার প্রতিও বিরক্ত হলোনা আজ উজান. হিয়া আর অন্তরীক্ষর সাথে হাতে হাতে কাজও করলো অনেক. ধৃতির সাথে দেখা হয়েছে অনেকবার তবে দূর থেকে. ধৃতি যখন অষ্টমীর অঞ্জলি দিচ্ছিলো তখন উজান ওকে দেখেই যাচ্ছিলো. আজ প্রথম ধৃতিকে শাড়িতে আর এলো খোঁপায় দেখলো উজান. অন্তরীক্ষ উজানের প্রাণের বন্ধু, ও জানে উজান অন্তর্মুখী. উজানের না বলা কথাগুলো অন্তরীক্ষ বুঝতে সময় নেয়না. উজানের চোখের মুগ্ধতা যে উজানের মনের বহিঃপ্রকাশ সেটা অন্তরীক্ষ খুব ভালো করেই বুঝে ফেলেছে. হেসেছে মনে মনে, যাক ওর এই পাগল বন্ধুটার একটা হিল্লে হলো মনে হচ্ছে. হঠাৎ করে হলেও, শুরুটা তো হলো. কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেই হয়۔۔
আজ উজান যতবারই কিছু খেতে গেছে বারবার ধৃতির মুখটাই মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে. খেতে পারেনি উজান ঠিক করে. বিরক্ত হয়েছে ধৃতির উপর. মনে মনে অনেক তর্ক বিতর্ক করেছে ধৃতির সাথে এই উপোস থাকাকে কেন্দ্র করে, তারপর আবার আঁকায় মনোনিবেশ করেছে. আঁকা শেষ হয়ে যাবার পর উজান দেখে আজকের ভোরের ছবিটা নিজের মনের মতো করে এঁকেছে. ছবিতে গাড়িতে হেলান দেওয়া দুটো মানুষকেও আবছা দেখা যাচ্ছে, এই সোনা গোলানো প্রকৃতির মধ্যে যারা প্রায় মিশে গেছে۔۔
সন্ধি পুজো শেষ হবার পর ধৃতি প্রথম যখন প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙলো তখন উজানের মনে হলো যেন ওর বিরক্ত মনের উপর এক ঝলক হিমেল বাতাস বয়ে গেলো. অন্তরীক্ষ আর ধৃতি সেখানে আসে যেখানে উজান আর জিনি দাঁড়িয়ে ছিল. তারপর অন্তরীক্ষ সবার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করতে চলে যায়. একটু পরে ফিরে আসে সবার জন্য চা নিয়ে, তবে ধৃতির জন্য চায়ের বদলে আসে গ্লুকোজ ওয়াটার. ধৃতি সেটা দেখে নাক কোঁচকালে উজান ধমকে ওঠে. জিনি আর অন্তরীক্ষ একে ওপরের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসে۔۔
উজান: অনেক করেছো۔۔۔۔۔চুপচাপ খেয়ে নাও. আমিই বলেছিলাম গ্লুকোজ ওয়াটার আনতে۔۔
ধৃতি একটু অপ্রস্তুত: কিন্তু উজান দা সারাদিন খালি পেটে থেকে এতটা জল খেলে গা গোলাবে۔۔
উজান: একটু একটু করে খাও, কিছু হবেনা. (একটু থেমে) বাড়িতে কি খাবে?
ধৃতি: দেখি মা কি করে রেখেছে. আপনি বলুন কেমন কাটলো আজকের দিনটা আপনার? আপনি এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছেন কেন? শরীর খারাপ করবে তো. গতকাল রাত্রেও তো ঘুমোন নি۔۔
উজান: সে তো তুমিও ঘুমোওনি. তাছাড়া আমার অসুবিধা হয়না, অভ্যেস আছে. তুমি বরং তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে খেয়ে নাও۔۔
ধৃতি: হ্যাঁ۔۔۔ আপনি খেয়েছেন তো?
উজান: কেন তুমি না খেলে কি আমি খাবোনা?
ধৃতি: আমি সেটা বললাম নাকি?
অন্তরীক্ষ একবার আড় চোখে উজানকে দেখে নিয়ে বলে : কারোর খাওয়ার সাথে উজানের খাওয়ার সম্পর্ক নেই ঠিকই, তবে আজ উজানও খেতে পারেনি۔۔
ধৃতি উদ্বিগ্ন হয় : কেন? শরীর খারাপ করে নি তো?
ধৃতিকে ওর জন্য উদ্বিগ্ন হতে দেখে উজানের ভালো লাগে. কিন্তু সেটা গাম্ভীর্যের মুখোশে ঢেকে বলে۔۔
উজান: এই তোমাকে এতো ভাবতে হবেনা. যাও তো নিজে গিয়ে আগে খাও, নাহলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এবার۔۔
ধৃতি অবাক চোখে উজানের দিকে তাকিয়ে এই ধমকের অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা করে. উজানকে এই কয়েকদিনে একটু একটু করে চিনতে পারছে ধৃতি. আর যতই চিনছে, মানুষটাকে তাতই ভালো লেগে যাচ্ছে. কিন্তু লাভ কি?
উজান: হোয়াট?
ধৃতি হেসে: কিছুনা উজান দা۔۔۔আমি আসছি۔۔۔۔ (অন্তরীক্ষকে) বন্ধুকে এবার কিছু খাইয়ে দাও۔۔
ধৃতি যেতে উদ্যত হলে উজানের ডাকে ফিরে তাকায়۔۔
উজান: শোনো۔۔۔۔۔۔۔আমার তোমার সাথে কোনো ভাই বোনের সম্পর্ক নয়, কাজেই এই "উজান দা" বলা বন্ধ করো۔۔
ধৃতি হতবম্ব. আমতা আমতা করে বলে: তাহলে কি বলবো? ডা: চ্যাটার্জী?
উজান: সে আমি কি জানি? যা ইচ্ছে বলো۔۔۔۔۔۔"উজানদা" বাদে۔۔۔
বলেই উজান পেছন ফিরে হাঁটা লাগায়۔۔۔ অন্তরীক্ষও এতোটাই অবাক হয় যে সে কি প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে পারেনা, শেষে উজানের পেছনে ধাওয়া করে. ধৃতি আর জিনি দুজনে দাঁড়িয়ে থাকে হতবম্ব হয়ে۔۔۔
উজান সোজা চলে আসে বিল্ডিং এর ছাদে, পেছন পেছন অন্তরীক্ষ۔۔۔
অন্তরীক্ষ: ওটা কি ছিলো?
উজান: কোনটা?
অন্তরীক্ষ: তা۔۔۔۔۔۔ ধৃতির সাথে তোর কি ধরণের সম্পর্ক?
উজান: মানে?
অন্তরীক্ষ: ভাই বোনের সম্পর্ক তো না বললি۔۔۔۔তাহলে কিসের সম্পর্ক?
উজান: কেন? কোনো না কোনো সম্পর্ক কি থাকতেই হবে?
অন্তরীক্ষ: একেবারেই না. তবে কি জানিস তোকে এই কয়েকদিনে যেরকম দেখছি সেরকম এতো বছরে একদিনও দেখিনি۔۔
উজান: বুঝলাম না۔۔۔
অন্তরীক্ষ: বোঝার দরকারও নেই. অবশ্য ধৃতির তো কোনো এনগেজমেন্ট থাকতেই পারে۔۔
উজান: হোয়াট? ওর বয়ফ্রেন্ড আছে?
অন্তরীক্ষ কৌতুকের স্বরে: আমি এনগেজমেন্ট বলেছি. আর এনগেজমেন্ট মানে কি সব সময় বয়ফ্রেন্ডই হয়?
উজান: ওসব ছাড়. আগে বল ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা۔۔
অন্তরীক্ষ: থাকলেই বা কি, আর না থাকলেই বা কি?
উজান: থাকলে আমি আর ওর ধারে পাশে ঘেঁষবো না. আর যদি না থাকে۔۔۔۔
উজানকে কথা শেষ করতে দেয়না অন্তরীক্ষ۔۔
অন্তরীক্ষ: তাহলে তুই ওর ধরে পাশে আর কাউকে ঘেঁষতে দিবিনা۔۔۔۔তাই তো?
উজান গম্ভীর স্বরে: হুম. তবে ওর মতামত টাও জানা দরকার. জরুরি না যেটা আমি ফিল করছি সেটা ধৃতিও ফিল করছে. যতক্ষণ না জানতে পারছি ততক্ষন শান্তি নেই۔۔
অন্তরীক্ষ: এই উত্তরটা পেয়ে গেলেই কি শান্তি আসবে বন্ধু?
উজান: মানে?
অন্তরীক্ষ হাসে :অর্জ কিয়া হ্যায়۔۔۔
"সুঁকুন অউর ইশক উয়ো ভি দোনো এক সাথ,
রেহেনে দো গালিব কোই আকল কি বাত করো۔۔۔"
নবমীর দিন সকাল থেকে ধৃতি যেন একটু বেশিই ব্যস্ত. উজানের ধারে কাছে আসেনি, উজানও ধৃতিকে বিরক্ত করেনি. আজ ওদের সাংকৃতিক অনুষ্ঠান. উজানের সাথে সাথে আরো অনেকের আঁকা ছবি দিয়ে সুন্দর করে সাজনো হয়েছে চারপাশটা. উজান নিজের সৃষ্টি দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়. এতো বছর পর কি করে সম্ভব হলো? উজান লক্ষ্য করেছে ধৃতি ওর ছবি গুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলো۔۔
প্রোগ্রাম শুরু হয় নিজের সময়ে. কমপ্লেক্সের বাসিন্দারাই প্রোগ্রাম করে. জিনির আবৃতি শোনা হয়ে গেলে উজান ধৃতিকে খুঁজতে থাকে۔۔ কোথাও না পেয়ে জিনির কাছে ধৃতির ফোন নম্বর চায়. জিনি জানায় ধৃতির দুটো নম্বর আছে. একটা নম্বর জিনি উজানকে তখনি বলে দেয়. উজান সেটা ডায়াল করে আর জিনিকে বলে আরেকটা নম্বর ওকে হোয়াটস অ্যাপে যেন পাঠিয়ে দেয়. জিনি উজানের কথানুসার কাজ করে. উজান অবশ্য প্রথম বারেই ধৃতিকে পেয়ে যায়. ধৃতি জানায় ওদের প্রথম যেখানে আলাপ হয়েছিল ও সেখানেই আছে. উজান আর দেরি করে না, পৌঁছে যায় ধৃতির কাছে۔۔
উজান: কি করছো এখানে? সবাই খুঁজছে তোমাকে?
ধৃতি: এখন কেউ খুঁজবেনা, আর খুঁজলে ফোন করতো. (একটু চুপ থেকে বলে) আপনি আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলেন?
উজান: জিনি দিলো. বাই দা ওয়ে, হঠাৎ এখানে একা বসে আছো কেন? আবার কারো উপর রাগ হলো নাকি?
ধৃতি হেসে বলে: রাগ কেন হবে? এমনি বসে আছি۔۔
উজান এবার ধৃতির পাশে বসে۔۔
উজান: কি ঠিক করলে? কি বলে ডাকবে আমাকে?
ধৃতি: ডা: চ্যাটার্জী۔۔
উজান: শেষ পর্যন্ত এটাই পছন্দ হলো?
ধৃতি: আমার পছন্দ যে আপনারও পছন্দ হবে এরকম তো কোনো কথা নেই۔۔۔۔۔তাই না?
উজান: না۔۔۔۔۔তবে۔۔۔۔
ধৃতি: তবে?
উজান: দেখো۔۔۔۔۔আমি স্পষ্ট কথা বলতে আর শুনতে ভালোবাসি. স্পষ্ট কথা কখনো কখনো কষ্ট দেয় ঠিকই, তবে সেটা for the time being.
ধৃতি: বলুন কি বলতে চান۔۔
উজান: জানতে চাই۔۔۔۔۔ (একটু থেমে) তুমি কি কারো সাথে রিলেশনে আছো?
ধৃতি এতোটা স্পষ্ট কথাও আশা করেনি উজানের থেকে. একটু সময় নেয় ও, মনে মনে গুছিয়ে নেয় নিজেকে, তারপর বলে۔۔
ধৃতি: না
উজান: তুমি মনে হয় বুঝতে পারছ আমি তোমাকে ঠিক কি বলতে চাইছি۔۔
ধৃতি উঠে দাঁড়ায়: আমার আপনাকে কিছু বলার আছে۔۔
উজানও উঠে দাঁড়ায়. ও ধৃতির যেকোনো উত্তরের জন্য মনে মনে প্রস্তুত۔۔۔
দেখা যাক ধৃতি উজানকে কি বলে!!!!

