অনপেক্ষিত
অনপেক্ষিত
পর্ব-১
বিরক্তিতে উজান নিজের গাড়ির বনেটের উপর একটা ঘুঁষি মেরে বসে. যখন থেকে কলকাতায় পা রেখেছে তখন থেকে ওই একটা নাম শুনে শুনে ও বিরক্ত হয়ে গেছে. সিনেমার মতো ওই নামটা ওর কানে ইকো হতে থাকে, রাগে দুহাতে কান চাপা দেয় উজান.
ঘটনার শুরু সেইদিন যেদিন উজান USA থেকে কলকাতায় নামে. উজান আর অন্তরীক্ষ, ছোটবেলার দুই বন্ধু, বলা যেতে পারে "চাড্ডি-বাড্ডি ইয়ার". সেই প্লে স্কুলে ওদের আলাপ, তারপর থেকে তাদের বন্ধুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে বই কমেনি. ১০ 2 লেভেল কমপ্লিট করার পর দুজনের রাস্তা আলাদা হয়. আলাদা মানে অবশ্য ক্যারিয়ার, বন্ধুত্বে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি. উজান USA তে ডাক্তারি পড়তে যায় আর অন্তরীক্ষ যায় IIT কানপুর.
উজান ছয় বছর USA তে আছে. প্রতি বছর একবার আসে X-MASS এর সময়, তাও গতবছর আসতে পারেনি. পুজোর সময় এই প্রথমবার ও কলকাতায় এলো USA যাবার পর. অন্তরীক্ষও উজানের সাথে প্ল্যান করেই কলকাতায় আসে প্রতিবার. একে অপরের সাথে দেখা করার এটাই তো সুযোগ.
এয়ারপোর্টে উজান কে আনতে হাজির হয় ঠাম্মি আর জিনিয়া. ফেরার পথে গাড়িতে বিভিন্ন আলোচনার মধ্যেই ওদের আবাসনের এই বছরের পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়.
ঠাম্মি: এবার পুজোটা তোর সাথে কাটবে ভাবতেই কি যে ভালো লাগছে. বাঙালির ছেলে পুজোয় বাংলার বাইরে কাটাবে ভাবতেই অবাক লাগে. এই জিনি হিয়া কে বলিস উজানকেও পুজোয় একটা দায়িত্ব দিতে. দায়িত্ব না নিলে কি পুজো সেভাবে উপভোগ করা যায়? কি বলিস উজান?
উজানের এই "হিয়াকে বলিস" কথাটা ভালো লাগেনা.
উজান: (মনে মনে: হিয়া কে? আর সে আমাকে দায়িত্ব দেবারই বা কে?) হিয়া কে ঠাম্মি? এর আগে তো এই নামটা শুনিনি.
উজান প্রথমবার বিরক্ত হয়۔۔۔
জিনিয়া: হিয়াদি রা আমাদের কমপ্লেক্সে দুবছর হলো এসেছে. ওরা আসার আগে তুমি USA ফিরে গিয়েছিলে তাই জাননা.
ঠাম্মি: হ্যাঁ রে জিনি তুই আবার হিয়া কে জানিয়েছিলি তো যে উজানকে নিতে আসছিস? কি সব রিহার্সাল চলছিলোনা তোদের?
জিনিয়া: জানিয়ে এসেছি ঠাম্মি, তবে হিয়াদি এতো সুইট যে কিছু বলেনা.
উজান: তাই নাকি? আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসার জন্য তোকে ওনার পারমিশন নিতে হয়েছে বুঝি?
উজান দ্বিতীয়বার বিরক্ত হয়۔۔۔
জিনিয়া: আরে না দাদাভাই. আসলে অর্গানাইজার হিসেবে ওর জানা উচিৎ যে টিম মেম্বাররা কে কোথায় আছে, বলা তো যায়না হঠাৎ কোনো কাজ পড়ে যেতেই পারে. তার উপর আজ চতুর্থী۔۔
উজান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে.
জিনিয়া: জানো দাদাভাই, হিয়াদি ও তোমার মতো ডাক্তারি পড়ছে Delhi AIIMS এ۔
উজান মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দেয়: ডাক্তারি পড়তে পারে, তবে আমার মতো নয় (উজানের উত্তরে বিরক্তি ঝলকে ওঠে)
উজান একটু রাগী, কম কথার, কড়া কথার মানুষ ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ও কাউকে কোনোদিন ছোট করে কথা বলেনা. তাই উজানের হিয়ার প্রতি এই মনোভাব সবার কানে লাগে, এমনকি উজানের নিজেরও۔۔
হিয়ার প্রতি বিরক্তির সূত্রপাত এখান থেকেই. তারপর যত সময় গড়িয়েছে বিরক্তির পরিমান বেড়েই গেছে. বাড়ির ভিতরে, বাড়ির বাইরে "হিয়া হিয়া" শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই কখন যেন উজান একটা অজ্ঞাত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে হিয়ার বিরুদ্ধে. ও ঠিক করেই রেখেছে যেদিন ওর হিয়ার সাথে দেখা হবে সেদিন ও হিয়াকে এক চোট নেবে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত হিয়ার সাথে উজানের দেখাটাই হয়ে ওঠেনি.
ষষ্টির দিন উজান, অন্তরীক্ষ যখন ওদের কয়েকজন বন্ধুর সাথে কথা বলছিলো তখনিই নীল ওখানে আসে. নীল ওদের থেকে বয়সে কিছুটা ছোট.
অন্তরীক্ষ: এতক্ষন কোথায় ছিলি?
নীল: আর বোলো না, হিয়া ছাড়ছিলোই না۔۔
অন্তরীক্ষ: যে কাজটা করতে পারিসনা তার দায়িত্ব নিতে যাস কেন?
নীল একটু বোকার মতো মাথা চুলকে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলে: আসলে কাজটা তো বাহানা দাদা, উদ্দেশ্য তো ছিল হিয়ার সাথে বন্ধুত্ব পাতানো. কিন্তু ও তো পাত্তাই দিচ্ছেনা উপরন্তু খাটিয়ে মারছে۔۔
উজান: কন্টিনিউ না করতে পারলে বেরিয়ে আয়. থাকার জন্য কেউ মাথার দিব্বি তো দেয়নি۔۔
নীল: ওখানেই তো সমস্যা, চেয়েও পারছিনা. আসলে মেয়েটা না বড্ডো ভালো জানোতো. আমি কাজগুলো পারিনা জেনেও আমাকে বের করে দেয়নি কমিটি থেকে. উল্টে আমার কাজগুলো ও করে দেয় যাতে আমাকে কথা শুনতে না হয়.
উজান: তাহলে তো তোর মামলা সেটেলটেড.
অন্তরীক্ষ: নারে۔۔۔হিয়া সবার প্রতি এইরকম.
নীল: এক্সাক্টলি۔۔۔এখানে আমার মামলা সেট হবার নো চান্স. ও পাত্তাই দেয়না.
এরপর একে একে অঞ্জন, মৃগেশ, পরমদীপ ও আরো অনেকে এসে উপস্থিত হয় এই আড্ডায়, তাদের মুখেও কোনো না কোনো প্রসঙ্গে সেই হিয়ার প্রশস্তি. একসময় উজানের মনে হয় পুরো কমপ্লেক্সটা যেন হিয়াময় হয়ে উঠে ওকে কটাক্ষ করছে. উজানের সাথে কোনো সম্মুখ সমরে না গিয়েও হিয়া উজানের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছে. বিরক্ত উজান ওখান থেকে একাই বেরিয়ে আসে কাজের অজুহাতে. সবার সামনে যে বিরক্তি টা প্রকাশ করতে পারেনি, একাকিত্বে তার প্রকাশ ঘটায় গাড়ির বনেটে....
দেখা যাক হিয়ার প্রতি উজানের বিরক্তি কিভাবে কাটে!!

