অলৌকিক ললন্তিকা
অলৌকিক ললন্তিকা
নাভি পর্যন্ত বিলম্বিত মালাকে বলা হয় ললন্তিকা । বর্তমানে সোনার গয়না মহার্ঘ , মধ্যবিত্তর হাতের নাগালের বাইরে । তাই ললন্তিকা হারের প্রচলনও খুব একটা দেখা যায় না । এই ললন্তিকা হার নিয়েই একটা অলৌকিক কাহিনী আজ ভাগ করে নিলাম ।
রায় বাড়ি সেজে উঠেছে আলোয় আলোয় । সারা বাড়ি গমগম করছে অথিতিদের আগমনে । দিনটা ভূতচতুর্দশীর , বাড়ির বড় গিন্নি চোদ্দ শাগ রেঁধে সকলকে খাইয়ে সন্ধ্যার চোদ্দ বাতি দানের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন । বাড়িতে কালি পুজো হয় কয়েক দশক ধরে । অমাবস্যা পড়ার আগেই চতুর্দশীর সকালে ওই বংশের সকল সদস্যরা চলে আসে যে যার আবাস থেকে রায় ভিলাতে । এটাই এই বংশের নিয়ম , যা পালনে বাধ্য থাকে সকলেই । অনেকেই অন্য শহরে বা অন্য রাজ্যেতে থাকে চাকরি সূত্রে । আবার এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে লালি তো থাকে মস্কোতে । সেও ঠিক পৌঁছে যায় নির্ধারিত দিনের মধ্যে । এই নিয়ে লালির স্বামী জো খুব হাসাহাসি করে , যে একবার না গেলে কি এমন হবে ? সবই লালির বাপের বাড়ি যাবার ছল । লালি জোকে কিছু বলে না কারণ মা কালীর মাহিত্য জো বুঝবে না । জো মস্কোর ছেলে , ও ইন্ডিয়ান কালচারের কিছুই জানে না আবার লালির সাথে ওর বাড়ি যেতেও চায় না । লালির সাথে ওর আলাপ জার্মানিতে পড়াশোনা করার সময় । তারপর বিয়ে করে ওরা লালির পরিবারের অমতে । তবে মেয়েকে কি ফেলে দেওয়া যায় ? রায় বাড়ির লোকজন ও পারেনি লালিকে ত্যাগ করতে । তাই প্রতি বছর মা কালি ও আসেন কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে আর লালিও আসে তখনই । রায় বাড়ির মেয়েদের বউদের সন্মান দেখলে কেউ বলতেই পারবে না যে এদেশে মেয়েদের প্রতি অনাচার করা হয় । বাড়ির পুরুষেরা ভীষণ সন্মান ও যত্ন করে এবাড়ির নারীদের । রায় বাড়ির মেয়ে বউরা আর মা কালির মধ্যে ফারাক রাখেনা রায় কর্তারা । মা কালি এবাড়িতে বউঠাকুরুন নামে পরিচিতা । কেন এই নাম ?
তখন দেশ স্বাধীন কেন ? পরাধীনও হয়নি ঠিকঠাক । দেশ তখনো মোঘলদের হাতে আছে । নদিয়ার জমিদার চিত্রাঙ্গদ রায় তার দ্বিতীয় পুত্র শ্রীমান পরিজাতের বিবাহ দিলেন কৃষ্ণনগরের এক জমিদারের মুহুড়ির মেয়ের সঙ্গে । জমিদারী সূত্রে কৃষ্ণনগরে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে মুহুড়ির মেয়ে ললন্তিকাকে দেখে চোখ সরাতে পারেননি চিত্রাঙ্গদ । তিনি পদমর্যাদা বা জমিদারী এসবের দিকে দৃষ্টিপাত না করে সঙ্গে সঙ্গে নিজের পুত্রের জন্য ললন্তিকাকে পছন্দ করে ফেলেন । এক প্রকার পাকা কথা দিয়ে ফিরে আসেন নদীয়া । জমিদার গিন্নি সে কথা শুনে মাথায় হাত দিলেন । তিনি স্বামীর যুক্তি বুঝছেন আর স্বামীর বিরুদ্ধে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না । তারপরেও একটা কুণ্ঠা তো থেকেই যায় কুলমর্যাদার কি হবে ? বড় বৌঠাকুরানী বল্লাল রাজের মেয়ে , সে তো পদে পদে ছোট করবে এই ছোট বৌঠাকুরানীকে ? তখন কি হবে ? তারপরেও বিয়েটা হলো কারণ জমিদার চিত্রাঙ্গদ তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন । অসময়ে লগ্ন ছাড়াই কার্তিক মাসেই বিয়ে হলো পারিজাতের । পালকি করে বউকে জমিদার বাড়ির উঠানে নামানো হলো । নেমে এলেন পালকি থেকে ছোট বৌঠাকুরানী ললন্তিকা । দীর্ঘ ললনা , গৌর বর্ণা , দীঘল দুটি কাজল কালো চোখ , পা স্পর্শ করছে কেশরাসি , তীক্ষ্ণ নাসিকা , গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট .... বারো বছরের ললন্তিকাকে দেখে সকলে হা হয়ে গেল । এত রূপ ! এইটুকু মেয়ের ? যেন স্বয়ং ঈশ্বরী সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সকলের অবাক চোখের মাঝেই এক জোড়া ঈর্ষান্বিত চোখ ও ছিলো । যার মধ্যে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছিল হিংসার । সে বড় বৌঠাকুরানী আবিরা । মুহুরীর মেয়ের কাছে হেরে যাবে তবে জমিদার বল্লাল রাজের মেয়ে ?
জমিদার গিন্নি নতুন বউকে ঘরে তুললেন আর তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝলো এ মেয়ে সুলক্ষনা । মেয়েকে মুহুরী সোনায় মুড়ে পাঠাতে পারেননি তাই বেশ লজ্জিত । ললন্তিকা ফুলের গয়নায় সেজে এসেছে শশুর বাড়ী । শশুর মশাইও যেচে বৌমাকে গয়নায় মুড়ে বেয়াই বাড়ি থেকে আনেননি কারণ এতে বেয়াইকে হয়ত ছোট করা হতো । বউ এসে থেকে তাকে বড় বৌঠাকুরানী আবিরা খোটা দিতে শুরু করে ভিকারীর বিটি বলে । তারপর সেদিন চতুর্দশী আর পারিজাত ও ললন্তিকার বৌভাতের দিন । জমিদার গিন্নি ছোট বৌঠাকুরানীকে গলায় পরিয়ে দিলেন বংশের এক অনন্য সম্পদ হীরক চর্চিত সোনার ললন্তিকা হার । বললেন এত গয়না দিয়ে বৌমাকে সাজিয়েও তার মন ভরেনি , যে মেয়ের এত রূপ ... যার নাম ললন্তিকা ... তার জন্যই মা ভবানী হয়ত পূর্বপুরুষদের হাতে এই হারখানি বানিয়েছিলেন ! হারটার উপরে লোভ ছিলো আবিরার , শাশুড়ি মরলে সেই পাবে বড় বৌঠাকুরানী হিসেবে এটাই ছিলো তার ধারণা । সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় সে জ্বলে ওঠে । বৌভাতের আচার পালনের সময় ঘি দিতে দিতে ছোট বৌঠাকুরানী ললন্তিকার মাথা থেকে অসাবধানতাবশত ঘোমটা খসে পড়ে শশুর , ভাসুরের সামনে । এই সুযোগে বড় বৌঠাকুরানী রে রে করে ওঠে , সে বলে এ কি অনাচার ? ছোটলোকের বিটির নাম ললন্তিকা হলেই কি তাকে ললন্তিকা হার পরে জমিদার বাড়ির বউ হওয়া সাজে ? কথাটা শুনে এক হাত জিভ কেটে ছোট বৌঠাকুরানী দিকবিদিক শূন্য হয়ে ছুটলো । একটা ঝপ করে শব্দ হলো আর বাড়ির চাকর বাকরের দল হৈ হৈ করে উঠলো । বাড়ির সংলগ্ন ভবানী মন্দিরের কাছে যে দীঘি আছে তাতে ললন্তিকা ঝাঁপ দিয়েছে । জমিদার চিত্রাঙ্গদ ছুটলেন সেদিকে । লোক নামানো হলো , জাল ফেলা হলো .. সারা দীঘির জল ছেচে ফেলা হলো তবুও ছোট বৌঠাকুরানী বা তার পার্থিব শরীর কিছুই পাওয়া গেল না । আনন্দের দিনে শোক নেমে এলো , সকলে বললো দিনক্ষণ না দেখে বিয়ে দেবার ফল । বড় বৌঠাকুরানীকে দোষ দেবার সাহস করো হলো না । আবিরার আফসোস পথের কাঁটা তো সরে গেল কিন্তু হারটা ?
রাতে জমিদার চিত্রাঙ্গদ স্বপ্ন দেখলেন , মা ভবানী রুষ্ট হয়েছেন । তাকে এ সংসারে ঠাঁই দেওয়া হয়নি , তিনি এসেছিলেন ললন্তিকার রূপে । ঘেমে নেয়ে জমিদার চিত্রাঙ্গদ ছুটলেন মন্দিরের দিকে । গর্ভগৃহের ভিতরে ঢুকে দেখলেন কোথায় মা ভবানীর মূর্তি ? তার বদলে যে দাঁড়িয়ে আছে সে যেন অবিকল ছোট বৌঠাকুরানী ললন্তিকা ! শুধুমাত্র রূপে মা দীপান্বিতা কালি । বিচক্ষণ চিত্রাঙ্গদ মায়ের সংকেত বুঝলেন , ভোর হতেই তিনি মায়ের পুজোর প্রস্তুতি শুরু করলেন । অমাবস্যা পড়লে পুজো শুরু হলো , পুজো শুরু হতেই মায়ের পাথরের মূর্তি নড়তে শুরু হলো । যেন থাকতে চাইছেন না দেবী এই রায় ভিলাতে । চিত্রাঙ্গদ শিকল দিয়ে মাকে জড়িয়ে দিলেন আর শিশুর মত কাঁদতে কাঁদতে বললেন , " ছেলেকে ছেড়ে কোথায় জাবি মা ? একবার পালিয়েছিসরে মা কাল বৌমা রূপে , আজ আর ছাড়বো না । "
শেকল দিতেই মা শান্ত হলেন , পুজো শেষ হলো আর অহংকারী বড়বৌঠাকুরানী আবিরা ও বুঝলো তার ভুল । সে রাতারাতি ভোগীনি থেকে যোগিনী হলো , সাধনার পথে সে নিজেকে বাড়িয়ে দিলো । কালের বিবর্তনে চিত্রাঙ্গদ তার স্ত্রী সকলেই ইহলোক থেকে বিদায় নিলো । বড়বৌঠাকুরানী মৃত্যুর সময় জানিয়ে গেলেন তার দেহত্যাগ করার পর নুন দিয়ে তাকে সমাধি দেওয়া হয় যেন । আর আগামী কার্তিক মাসে ওই সমাধি খুঁড়ে তার হাড় গুলো বার করে এনে ওই হাড় দিয়ে ললন্তিকা হার বানিয়ে যেন মা বৌঠাকুরানী কালিকে পড়ানো হয় । তবেই যে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা পাবেন । সেই থেকে যুগ যুগ ধরে রায় ভিলাতে চলে আসা পুজো মা বৌঠাকুরানীর গলায় শোভা পায় স্বর্ণের বদলে অস্থি নির্মিত ললন্তিকা হার ।
